poet
stringclasses
137 values
category
stringclasses
21 values
poem
stringlengths
9
18.7k
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
চেয়ার অস্বস্তিকর, উঠে দাঁড়ালেও স্নায়ুতন্ত্রী হয়না ঝংকৃত নিরাপদ মৃদু তালে, ফুলগুলি ব্যর্থ আজ। উদ্বেগের খচখচে কাঁটা ক্রমাগত বিঁধছে আমার মনে; ক্ষণে ক্ষণে হাওয়ায় হাওয়ায় কেমন পাশব গন্ধ ভাসে, আমার দু’কাঁধে কিছু বিসদৃশ ঘটে যাবে যেন! পাখনা গজাবে নাকিঅকস্মাৎ? আমি, শামসুর রাহমান, অবশেষে কাফকার গ্রেগর শামসা হয়ে যাবো? আমি বড়ো বেশি ছোটো হয়ে যাচ্ছি, মনে হয়; কীট পতঙ্গের মতোই আমি কি তবে দেয়ালে বসবো? মৃত্তিকায় খাবো লুটোপুটি কিংবা নোংরা শুঁড়ে নিয়ে নিরুদ্বেগ নর্দমার ধারে উড়ে যাবো আবর্জনা ভালোবেসে?ভাগ্যিস এসেছো তুমি এ মুহূর্তে, তোমার দৃষ্টির স্পর্শে আজ আমার মনুষ্যরূপ রয়ে গেলো শেষে।   (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
মনের খেয়ালে গেঁথে অগণন তারা অস্তিত্বের তন্ময় দেয়ালে স্মৃতিকে করেছি আমি সীমাহীন সুনীল আকাশ। সেখানে কয়টি হাঁস শৈবালের আর বন্ধ্যা তুষারের গণ্ডি ছেড়ে পেতে চায় রৌদ্রের জোয়ার আজও, আজও নিরুদ্বেগ সাহসী ডানায়।মনে পড়ে আমিও একদা পড়েছি ঝাঁপিয়ে অন্তহীন নীলিমায়, কতদিন মেঘের প্রাসাদে কাটিয়েছি মায়াবী প্রহর আমি আশ্চর্যের যুবরাজ।সেদিন আননে ছিল আঁকা ত্রিলোকের রূপাভাস, আর স্বপ্নের কাননে তুলে বাসনার ফুল যথারীতি পেয়েছি মদির সঙ্গ কত এবং বেসেছি ভালো-আস্থা রেখে সেই দ্রাক্ষাবনে, অনন্তের প্রীত গুঞ্জরণে- স্বপ্নের সুন্দরীদের। কাটিয়েছি কত যুগ সেই নীলিমা-খচিত মায়ালোকে।তাড়াতাড়ি হঠাৎ রাত্রির শেষ বাসে উঠে প’ড়ে ভাবি এই নেশার খোঁয়ারি কেটে গেলে নামব কোথায় তবে, এখানে কোথায়? থাক থাক, ক্ষতি নেই কিছু, ভাবব পরে। এখন দু’চোখ ভরে শুধু দেখা যাক-কী দেখব? নিশ্চল, নিরেট অন্ধকারে হাতড়িয়ে পথ কাকে ছোঁব শেষে? কাকে? ডিঙিয়ে মর্ত্যের বেড়া পাব কি স্বর্গের অবতরণিকা? সাফল্যের গাছ যত পাখি পুচ্ছ তুলে নাচে, আজ তাদের স্বপ্নের ঘোরে বুঝি আমার চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে এ-রাত্রির শেষ বাসে! ও কিছুই নয় আসলে হৃদয় মাঝে-মাঝে হয়ে পড়ে নেহাত অবুঝ নাবালক নেশার খোঁয়ারি কেটে গেলে পৃথিবীকে নির্বোধের হাসির মতোই মনে হয়। শূন্য প্রহরের দীর্ঘশ্বাস বৃথা প্যানিক ছড়ায় এবং নড়ায় স্তব্ধ আদর্শের ভিত।জানি এই ভিড় ঠেলে, ঢিলে-ঢালা সস্তা স্যুট প’রে রাস্তার দাম্ভিক শত বিজ্ঞাপন প’ড়ে, পুঁইশাক ডাঁটার চচ্চড়ি, নিরীহ মাছের ঝোলে ডুবিয়ে জীবন থাকব, বাঁচব আমি দিনের চিৎকারে রাত্রির করুণ স্তব্ধতায়।মাঝে-মাঝে কারো অস্তিত্বের সুরভির জন্য হয়তোবা ধমনী চঞ্চল হবে স্পন্দিত নদীর মতো ফের, সত্তার মিনারে চাঁদ জ্বলবে তখন। আজ শুধু স্মৃতিকে করেছি আমি বিশাল আকাশ।   (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
ভক্তিমূলক
(হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে)তিমির-বিলাসী যারা তারা অন্ধকারে মাথা গুঁজে থাকে সর্বক্ষণ। তুমি বন্ধু, আলোপ্রিয়,- বুঝি তাই জীবনের প্রায় সকল প্রহর কাটিয়েছো জ্ঞান আহরণে আর বিভিন্ন খাতার পাতা সাজিয়েছো সৃজন-মুখর পঙ্‌ক্তিমালা দিয়ে। এভাবেই কেটে গেছে কত না বিনিদ্র রাত।অথচ করোনি অবহেলা কোনওদিন ছাত্রদের, দিয়েছো উজাড় ক’রে জ্ঞানের ভাণ্ডার। ওরা সব তোমার উৎসুক, প্রিয় শিক্ষার্থী সবাই নিবেদন করেছে সশ্রদ্ধ ভালোবাসা। ধন্য তুমি; জানলে না যদিও এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাজপথে, চায়ের দোকানে, এবং পণ্ডিতদের প্রতিটি আসরে, কবি-সংঘে, গ্রামে-গঞ্জে, উদ্দীপ্ত মিছিলে আজ হচ্ছে উচ্চারিত তোমার হীরার মতো জ্বলজ্বলে নাম। এই নাম স্বদেশের সীমানা পেরিয়ে এখন তো প্রস্ফুটিত দেশ-দেশান্তরে।তুমি যে অম্লান অবদান রেখেছো গচ্ছিত জাতির ভাণ্ডারে তার বিনিময়ে কতিপয় সন্ত্রাসীর দাগাবাজ অস্ত্রাঘাতে হয়েছো ভীষণ জর্জরিত অথচ করোনি মাথা নত, রেখেছো উন্নত সর্বক্ষণ।তোমার সুপ্রিয়া কোহিনূর, জীবন সঙ্গিনী, কন্যাদ্বয় মৌলি, স্মিতা, পুত্র অনন্য এখন তোমাকে হারিয়ে দিশেহারা; শূন্যতার নিপীড়নে দূর দিগন্তের দিকে দৃষ্টি মেলে দিচ্ছে বারবার। হায়, আজ তাদের প্রশস্ত সেই তোমার বুকেই টেনে নাও। অতীতের ধরনে স্নেহের জ্যোৎস্না ওদের অস্তিত্বে মেখে দাও, দাও আজও। দেবে নাকি মেঘ থেকে কিংবা আলগোছে গোধূলির অপসৃয়মাণ আভা থেকে চুম্বনের ছাপটুকু?   (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
বহুক্ষণ হেঁটে, হেঁটে, হেঁটে কোথায় এসেছি গায়ে-কাঁটা-দেয়া এই জন্মন্ধ সন্ধ্যায়? মনে হচ্ছে পশ্চিম আকাশ কালো বিস্কুটের মতো আর চাঁদ কোনও বুড়োর ধরনে কতিপয় ফোকলা দাঁতের আহামরি সৌন্দর্যের বিদঘুটে বাজারু প্রচারে কী অশ্লীল!বিদঘুটে, হিংসুটে এক বৃক্ষতলে ক’জন জুয়াড়ি মেতেছে খেলায় আর কখনও কখনও তাদের হুল্লোড়ে কেঁপে ওঠে জমি, যেন গিলে খাবে সেই ফতুর জুয়াড়িদের। আচানক নারীর কান্নার ধ্বনি ভেসে আসে ক্ষণে ক্ষণে ঘোর কৃষ্ণ দিগন্তের বুক চিরে। কে এই নিঃসঙ্গ অনামিকা?কখন যে নিজেকে দেখতে পাই এক হ্রদের কিনারে, বড় বেশি অন্ধকার চারদিক থেকে দাঁত নখ খিঁচিয়ে আসছে। মুখ ঢেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। আমি তো ভেবেছিলাম হ্রদ থেকে উঠে জাগবে সুন্দরী কেউ হাসি মুখ আর বসবে আমার পাশে, শোনাবে জলজ কাহিনী এবং ওষ্ঠ এগিয়ে চুম্বন দেবে এঁকে আমার এ পিপাসার্ত ঠোঁটে।এরকম কিছুই ঘটেনি, শুধু দেখি ধু ধু বিরানায় বসে আছি এক বুক হাহাকার নিয়ে আর ক্ষেপে-যাওয়া চাঁদ দূর থেকে থুতু, শ্লেষ্মা ছিটিয়ে আমাকে তুচ্ছতার ভাগাড়ের বাসিন্দা বানাতে বড় বেশি ব্যগ্র হয়ে ওঠে। আচমকা আমার ভেতর প্রায় ক্রোধের ধরনে কী এক আবেগ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মাটি থেকে কিছু ঢেলা কুড়িয়ে ওপরে ছুড়ে দিই বিস্মিত দৃষ্টিতে দেখি পুষ্পবৃষ্টি ঝরে অবিরত!  (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
কী চাও আমার কাছে বন্ধুরা এখন? ইতোমধ্যে পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছি, চুলে পাক ধরেছে বেবাক অনেক আগেই, কোনো কোনো দাঁত খুব নড়বড়ে, চোখে কম দেখি ইদানীং, প্রায় অদৃশ্য পৃথিবী চশমা ব্যতীত আর শিরায় শিরায় মাঝে মাঝে রক্ত ফুঁসে ওঠে, তখন দাঁড়ানো কিংবা বসে থাকা নয়, বিছানায় শুয়ে থাকাটাই সমীচীন মনে হয়। আইঢাই করে প্রাণ হর- হামেশাই; মোট কথা, স্বাস্থ্যের আকাল আমার অস্তিত্ব ঘিরে। তাই বলি, যখন আমার বাস্তবিক এই হাল, তখন আমার কাছে কার কী পাওয়ার থাকে আর?তোমাদের জ্বলজ্বলে সারিতে দাঁড়ানো সাজে না আমাকে। যতদূর মনে পড়ে কখনো শৈশবে দস্যুতায় ভাঙিনি পাখির বাসা, এবং খেলায় মেতে ছিঁড়িনি প্রজাপতির পাখা আর রঙ- বেরঙের বেড়াল ছানাকে ডুবাইনি নর্দমার নোংরা জলে অথবা যৌবনে বন্দুকের নল আমি কখনো করিনি তাক কাজল বিলের ঝাঁক ঝাঁক বালি হাঁস, সুন্দরবনের কোনো হরিণের দিকে। এত অপদার্থ আমি যে সুযোগ পেয়েও একালে কোনো অস্ত্র, এমনকি তীর ও ধনুক, হায়, চালাতে শিখিনি।এই যে দেখছো যাকে সে নেহাত স্তিমিত পুরুষ, গানে-পাওয়া, নানা ছদ্মবেশী নেকড়ের তাড়া-খাওয়া, উদাসীন, শব্দের ধীবর, একে দিয়ে কী এমন কাজ হবে তোমাদের? আজ কেবল ক্ষমাই প্রাপ্য তার। যদি সে দাঁড়ায় পাশে, মুগ্ধাবেশে দ্যাখে তোমাদের, তবে তাকে করবে কি অবহেলা? যতই আসুক ব্যেপে নৈরাশ্যের কালো পঙ্গপাল, অন্তত সে বাঁচার অভ্যাসে নয় বীতরাগ।    (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
লোকটা ক্ষয়েছে খুব, বেশিদিন বাঁচবে না আর, বড় জোর টিকে যাবে দু’তিন বছর। ঘুণ ধরা ফুসফুস নিয়ে পথ হাঁটে, পুরনো কালের ঘড়া, মেঘের, হাওয়ার সঙ্গে কথা বলে এবং পাহাড় সহজে ডিঙিয়ে যায়, নদী পার হয়, দীর্ঘ রাত জেগে পদ্য লেখে ভাবে কাগজের বুকে হীরে জ্বলজ্বল করে; লোকে তাকে উপেক্ষার রুক্ষ তীরে ঠেলে দেয়, কাটে তাকে বার বার কষ্টের করাত।ভীষণ কেউটে তার নিকটেই থাকে, তোলে ফণা, খেলা করে বৃক্ষতলে, নদীতীরে। ব্যাপক মড়ক চেটে নেয় খর জিভে মেধা ও মনন, ওড়ে ছাই সভ্যতার; খৃষ্টের মাথার জ্যোর্তিমণ্ডলের কণা মর্চে-পড়া, লোকটা নিভৃতে বলে, ‘হে দীপ্র হীরক, ও বৃক্ষ ও নারী আমি দীর্ঘকাল বেঁচে থাকতে চাই’।   (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
তুমিই আমাকে জপিয়েছে সাধারণ মাপকাঠি দিয়ে পরিমাপ করা চলে না আমাকে কিছুতেই; সমাজে আমার আচরণ হবে খুব পরিপাটি এবং নিখুঁত-এই তুচ্ছতার প্রয়োজন নেই। ‘কবি তুমি, শব্দশিল্পে নিবেদিত থাকবে সর্বদা অন্য সব কিছু গৌণ হোক, তাহলেই হবো সুখী,’ বলেছিলে তুমি একদিন কথাচ্ছলে প্রিয়ংবদা নিভৃত ড্রইংরুমে। ভাবনার অন্য আঁকি-বুঁকিছিল না তোমার মনে, অনুমান করি। কিন্তু কাল কী-যে হলো অকস্মাৎ সামাজিক তুচ্ছতার টানে ছিঁড়ে গেল হৃদয়ের সূক্ষ্ম তার, বেসামাল হয়ে তুমি আগুন ঝরালে খুব তালছুট গানে; সামাজিকতায় ছিল আমার অবুঝ-ভুলক্রটি, বুঝি তাই দিয়েছে আমাকে কালো ভর্ৎসনা, ভ্রূকুটি।   (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
এখন বচসা থাক, ঢের কথা কাটাকাটি হলো- নিরীহ চায়ের কাপে শান্ত হোক সব ক্ষ্যাপা ঝড়। এই যে ড্রইংরুমে সোফার গহ্বরে বসে খর তর্কে মেতে ওঠে উৎসবের মতো খুব ঝলোমলো দ্বিপ্রহরে ইতিহাস, সমাজ শিবির সংঘ আর ত্র্যাবসার্ড নাটকের রীতিনীতি নিয়ে অর্থহীন, ভীষণ নিষ্ফল মনে হয়। এমন সুন্দর দিন এভাবে কারো না ব্যর্থ; প্রাণের পুষ্পিত ঝোপঝাড়এখন উঠুক দুলে, আমাকে দেখতে দাও চোখ ভরে স্মৃতিজাগানিয়া চোখ, চোখের কাজললতা; অসিত শিখার মতো চুল আর স্তনাভা তোমার, দাও, দাও, আমাকে দেখতে দাও। সব দ্বিধা হোক দূর, হও উন্মীলিত, আমাকে বলতে দাও কথা- যে-কথা বলেনি কেউ কোনোদিন রমণীকে তার।   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
তোমার যোগ্য কি আমি? এখন আমার দিকে চোখ রেখে ভালো করে দ্যাখো, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দ্যাখো এই আমাকে নবীনা তুমি। আমার সত্তায় আর নেই প্রখর বৈভব প্রৌঢ়ত্বের তাম্রছায়া প্রায় শোক হ’য়ে ঝুলে থাকে ত্বকে। আমি সেই জুয়াড়ী যে তার সর্বস্ব খুইয়ে বসে আছে একা। অথচ এখন সহস্র নক্ষত্র-জ্বলা অনাবিল তোমার যৌবন। আমার সত্তায় স্পষ্টাঙ্কিত রহস্যের অন্তঃসার।আমার কিছুই নেই, না প্রতাপ, না বৈভব। শুধু এই আধপেটা জীবনের ছকে বেয়াড়া সন্ত্রাসে অপটু অভিনেতার মতো আওড়াই কী যে ভুল শব্দ এলোমেলো, বস্তুত কিছুই নয় অনুকূল- তবুও তোমার স্পর্শে জেগে ওঠে আমার এ ধু ধু, জীবনে দ্বীপের মতো দ্বিতীয় যৌবন জয়োল্লাসে।   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
যখন পেছনে ফিরে তাকাই সহসা, বিস্ময়ের রূপালি চমক লাগে চোখে। সুদূর বালক এক, নিঃসঙ্গ কিশোর, গানে-পাওয়া যুবা একজন, যখন আমার প্রতি রুমালের ভালোবাসা নাড়ে এই সান্দ্র গোধূলিতে, চেনা লাগে; আমিও ব্যাকুল করি প্রিয় সম্ভাষণ। তাহলে কি সত্যি আমি সেই দূর পাড়াতলীর শ্যামল পথ, আরো পথ ঘাট, বেগার্ত নদীর বাঁক, বৃক্ষহীন মাঠ, দীর্ঘ সেতু এবং শহুরে ঝিল পেরিয়ে এসেছি? ছিল যারা আশেপাশে, একে একে ছিটকে পড়েছে কে কোথায় আজ শিকারির গুলিবিদ্ধ পাখির ঝাঁকের মতো। একজন বন্দ ঘরে রাত্রির টেবিল ঘেঁষে একা পদ্য লেখে এবং হৃদয় তার আর্তনাদ করে নিঃস্ব নির্বাসিত বাহাদুর শাহ জাফরের মতো। এখন পেছনে ফিরে ব্যাকুল তাকাতে সাধ হয় মাঝে মধ্যে, বিগত যা তাকে দামি আংটির মতন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিই বারংবার আর ছাড়ি দীর্ঘশ্বাস আমার নিজেরই অগোচরে। ফের কোন্‌ অজুহাতে পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া ভালোবাসা জেগে উঠবে শ্যাওলা নিয়ে সত্তাময়। অতিক্রান্ত কাল নিঝুম প্রত্যক্ষ করি যেমন বিদেশ থেকে ফিরে একান্ত আপন প্রিয় শহরকে দেখি পুনরায়, দেখি ঘর গেরস্থালি, মানুষের আনাগোনা, স্মিত বাসর ঘরের আলো, শোকাপ্লুত কালো শবযাত্রা। আজ থানা পুলিশের মলিন প্যারেড থেকে দূরে দেবদূতী চুক্তি ক’রে দ্যুতিময় কবিত্বের ঘোরে সবখানে শব্দ-নখ প্রবল বসিয়ে দিতে চাই।   (অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
একজন খর্বকায় মানুষ নিস্তব্ধ সন্ধ্যেবেলা পড়ছে নামাজ কী তন্ময়। মনে হয়, সে এখন অনেক অনেক দূরে শাল তাল অর্জুনের বন পেরিয়ে সমুদ্রে এক ভাসিয়েছে নিরঞ্জন ভেলা। এখন সত্তায় তার শান্ত উঠোনে শিশুর খেলা, দিগন্তের বংশীধ্বনি, বিশাল তরঙ্গ, পাটাতন, কিশোরীর পাখি পোষা, শিকারীর হরিণ হনন, ভগ্নস্তুপময় জ্যোৎস্না একাকার, নিজে সে একেলা।যদিও জমিনে নতজানু তবু তার নক্ষত্রের মতো মাথা পৌঁছে যায় পাঁচবার দূর নীলিমায়। তার মতো আমিও একটি ধ্যানে সমর্পিত, তবু আমার অভীষ্ট কেন ক্রমাগত অনেক দূরের আবছা সরাই হয়ে থাকে? কেন আমি ব্যর্থতায় কালো হই? কেন বিষ্করুণ বাক্‌ প্রতিমার প্রভু?   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
সময় ক্ষধার্ত বাঘ। পশু, পাখি, উদ্ভিদ, মানুষ গ্রাম আর জনপদ যা প্রায় গোগ্রাসে গিলে ফেলে এবং প্রত্যহ খোঁজে নতুন শিকার। চোখে মেলে চেয়ে থাকে রাত্রিদিন, হিংস্রতায় প্রখর, বহুঁশ। অশেষ ধ্বংসের কালি মুখে তার মেখেছে কলুষ যুগে যুগে। জঠরে কি দাঁতে অবাস্তব ক্ষুধা জ্বেলে ছুটে যায় লোকালয়ে, সভ্যতায়, গেলে অবহেলে সব কিছু; মহানন্দে ওড়ায় সে জয়ের কানুস।আমাকে ও প্রতিক্ষণ খাচ্ছে আঘাটায়, আমি তার জ্বলন্ত চোয়ালে বিদ্ধ, যেমন উদ্ধার অসম্ভব জেনে ও পথিক কোনো পাহাড়ের খোঁচে প্রাণপণে পাথর আঁকড়ে ঝুলে থাকে। আর যে মানবতার দায়ভাগ বয়ে চলি তারই টানে করে যাই স্তব অমৃতের, যদিও বিরাম নেই কালের হননে।   (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
আমি তাকে অকস্মাৎ তারস্বরে গেট আউট গেট আউট ব’লে তাড়িয়ে দিলাম।সদর দরজা দিয়ে পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি অন্যমনস্কতা বিড়ি ফুঁকে চ’লে গেলো। দালানের অভ্যন্তরে যেতে চেয়ে পথ দীর্ঘ পথ বেয়ে যথারীতি চ’লে যাবে খোলার ছা-পোষা ঘরে সূর্যাস্তের পরে।আমি কি নির্দয় কোনো জীব? ঠিক তা’না, তাকে জাহান্নামে যেতে ব’লে অনুতাপের বিবরে ব’সে আছি। অথচ তক্ষুণি তাকে, মানে সেই অপদার্থ লোকটাকে না তাড়ালে লোকচক্ষুর আড়ালে আমাকে অরণ্যেআস্তনা গাড়তে হতো। লোকটা অর্থাৎ সেই কম্পোজিটার আমাকে বিরক্তির খানাখন্দে কেবলি দিচ্ছিলো ঠেলে যখন তখন।একটি নিটোল স্বপ্ন তাকে কম্পোজ করতে দিয়ে দেখি, স্বপ্নের জায়গায় দিব্যি দুঃস্বপ্ন দিয়েছে বসিয়ে সে, সুস্থতার জায়গায় অসুখ আর উন্মত্ততা। তার হাতের অস্থির স্পর্শে সুবিশাল উন্মুক্ত প্রান্তর কারাগার হয়ে যায়, শিশুর চিৎকারধন্য মৃদু আলোময় একটি আঁতুড়ঘর গোরস্থান। পরিপাটি গ্রাম, মুখর শহর তাকে কম্পোজ করতে দিলেই সে টাইপে সাজাতো দগ্ধ, বিধ্বস্ত ভিয়েতনাম আর আলো চাইলে তড়িঘড়ি ছত্রিশ পয়েন্ট বোল্ড টাইপে নিখুঁত অন্ধকার শব্দটি বসিয়ে দিতো বারবার। একি দারুণ অবজ্ঞা তার? না কি বৈপরীত্যবিলাসী সে ভ্রান্তির কোটরে খোঁজে স্বস্তি অহর্নিশ? এখন তাড়িয়ে তাকে নিজেই টাইপ কেস নিয়ে বসে গেছি চমৎকার; দেখবো এবার কী ক’রে তুমুল ভুল শব্দ যথার্থ শব্দের জায়গা জুড়ে বসে। কিন্তু আমি স্বপ্ন কম্পোজ করতে গিয়ে, ভারী অপ্রস্তুত, দেখছি দুঃস্বপ্ন হ’য়ে যাচ্ছে অবিকল এবং সুস্থতা ভীষণ অসুখ; আশা নৈরাশ্যের জুতোয় গলিয়ে দিচ্ছে ঠিক পদযুগ পরিপাটি গ্রাম, মুখর শহর হয়ে যাচ্ছে বিধ্বস্ত ভিয়েতনাম এবং টাইপ কেস তন্ন তন্ন ক’রে আলো শব্দটি পাচ্ছিনা খুঁজে আর, পাচ্ছি না কোথাও-ছত্রিশ পয়েন্ট বোল্ড টাইপে অত্যন্ত দ্রুত শুধু ভীষণ হাভাতে এক অন্ধকার বানিয়ে ফেলছি!   (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
মানি অর্ডার ফর্মে একটি প্রেমের কবিতার খসড়া। দু’তিনটি পঙ্‌ক্তির পর কিছু কাটাকুটি, তারপর কয়েকটি পঙূক্তি। শেষের দিকের বাক্যটি অসমাপ্ত। নিজের হস্তাক্ষর সে নিজেই বুঝতে ব্যর্থ। হঠাৎ এক সময় ওর মনে হয়, সে তো একজন নয়, নানা জন। এই মুহূর্তে প্রত্যেকে আলাদা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে নিজেকে ওদের ভেতর থেকে বের করে এনে বসে চেয়ারে। কিসের আকর্ষণে বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে। সে জাঁহাবাজ দুপুরে নিজের উপস্থিতি টের পায় হলদে শস্য ক্ষেতের ধারে। শস্য ক্ষেতের ওপর এক ঝাঁক উড়ন্ত কালো কাক। তার ভেতর কবেকার এক চিত্রকর ভর করে যেন, তার হাত ক্ষুধার্ত হয়ে ওঠে রঙ আর তুলির জন্যে, ঝাঁ ঝাঁ করছে মাথা, এক ধরনের উন্মাদনা তাকে কী সহজে গ্রেপ্তার করে ফেলেছে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে।বাজখাঁই সূর্যের তাপ স্তিমিত হলে সে ফিরে আসে নিজের ঘরে। ঘরে ঢুকতেই ওর চোখে পড়ে মানি অর্ডার ফর্মে লেখা প্রেমের কবিতার খসড়াটি টেবিল থেকে উঠে দেয়ালে সেঁটে গেছে সমুদ্র থেকে উঠে আসা ভেনাস হয়ে। ঘরময় নেচে বেড়াচ্ছে একটা কাটা কান আর মেঝেতে পড়ে থাকা একটা ব্যান্ডেজ গাঙচিল-রূপে উড়ে যায় দূরে। আয়নার দিকে তাকিয়ে সে প্রশ্ন করে, “আমি কি উন্মাদ হয়ে যাচ্ছি?” প্রত্যুত্তরে ঘরের কিন্নরকণ্ঠ চারদেয়াল উচ্চারণ করে, তুমি দিব্যোন্মাদ।   (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
কী যে হয়েছে তাঁর, ইদানীং কোনো কিছুই তেমন স্পষ্ট দেখতে পান না, না হাতের কাছের চায়ের পেয়ালা, না দূরের গাছপালা। অনেকটা আন্দাজে ঠাওর করে নেন। হাসপাতালে যাই যাই করেও যাওয়া হলো না আজ অব্দি। রোয়াকে বসে থাকেন, যতক্ষণ না উড়ে যাওয়া ঝাঁক ঝাঁক পাখির পাখায় লাগে সাঁঝবেলার আগেকার আবীর সেই রঙ দেখে তাঁর মনে পড়ে বাসর ঘর, একটা লাজরাঙা টুকটুকে মুখ, উপ্টান আর মেহেদীর ঘ্রাণ।তিন কূলে কেউ নেই তাঁর। অথচ একদা ছিল অনেকেই। তিনি তিল কুড়িয়ে তাল করতে গাধার খাটুনি খেটেও সংসারের চেহারা তেমন পাল্টাতে পারেন নি। বরং হারিয়েছেন গৃহিনীকে; বড় ছেলেটা বায়ান্নোয় বাংলা হরফের ইজ্জত বাঁচাতে গিয়ে নিজে বাঁচে নি। মেজো ছেলে উণসত্তরে রাজপথে জনতরঙ্গের সঙ্গে হলো একাকার। ছেলের লাশ ফেরত পান নি পিতা। বাকী তিন ছেলের দিকে তাকিয়ে টেনে ধরেন শোকের লাগাম।একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে ঘরের মায়া ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো তাঁর দুই ছেলে। বিজয় ছিনিয়ে অনেকেই আপন ঘরে এল ফিরে, কিন্তু তার দুই ছেলে কখনো ফিরে আসে নি। তাঁর শুকনো চোখে পাথরের আদল, তিনি এখন প্রায় টেরাকোটার মূর্তি!মেজাজে তিনি হরতালী নন, তবে মনেপ্রাণে চান যারা হরতাল করে তাদের ঘরে যেন জ্বলে আনন্দের বাতি। সাতাশিতে তাঁর বয়স দাঁড়ালো দুই কম চার কুড়ি। কনিষ্ঠ ছেলেটাকে আগলে রাখেন সারাক্ষণ, রাখেন চোখে চোখে। জানেন, গণআন্দোলনের আওয়াজ কী দুর্বার আকর্ষণ করে তাঁর পুত্রদের, যেমন সাতসমুদ্র তের নদীর ঢেউ নাবিককে। থাকুক, অন্তত কনিষ্ঠ পুত্র তাঁর থাকুক, মনে মনে জপেন তিনি। কিন্তু ঘর আর পিতার বুক অন্ধকার করে চৌদিক ঝলসে-দেয়া প্রায়-অপার্থিব আলোর সংকেতে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র ছুটে যায় মিছিলে। ফিরে এসে জনকের বুক শবেবরাতে দীপাবলী দিয়ে সাজায় না। এবার তিনি আদিম মানুষের মতো ডুকরে ওঠেন। তাঁর সত্তা-চেরা আর্তনাদে বাংলাদেশের নিসর্গ নিঃঝুম কান্নায় কম্পমান।অস্তিত্বের সমস্ত কান্না সেচে ফেলে তিনি বসে থাকেন রোয়াকে, এখন তিনি ডাঙায় তুলে-রাখা নৌকো। তাঁর চোখ থেকে রোশনি ক্রমাগত বিদায় নিচ্ছে, তবু কপালে হাত ঠেকিয়ে দেখতে চাইছেন তাঁর তেজী ছেলেরা যে সমাজবদলের কথা বলতো দীপ্র কণ্ঠস্বরে তার চিহ্ন আজ খুব আব্‌ছা হলেও কোথাও দেখা যায় কিনা।   (হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
স্বপ্নের ভিতরে বাল্যশিক্ষা ওড়ে নিশ্চিত সহজে জ্যোৎস্নাধোয়া পাখির মতোন, মাল্য বিভূষিত তোরণের কাছে উড়ে যায়। বাল্যশিক্ষা, যতদূর জানি, কখনো বিলাসী নয়, পরে না সে আংটি, মণিহার, সিল্কের দস্তানা কোনো, বটের পাতার মতো রূপে থাকে এককোণে, মাঝে-মাঝে পাঠশালা পাঠশালা বলে সুদূরের গান গেয়ে ওঠে ভোরে কিংবা মধ্যরাতে অকস্মাৎ।দেখেছি তদন্ত করে প্রতিদিন মনুমেন্টে মায়াবী অক্ষর ঝরে যায়, ভিখিরীর পাত্রে, উদাসীন পথিকের চাদরের খুঁটে লেগে থাকে কিছু, স্বপ্নস্মৃতি। ছেলেবেলা পেয়ারা গাছের পাতা, হলদে কোঠাবাড়ি সমেত এখানে শীর্ণ নদীর এপারে এসে করে কানাকানি।নিঃশব্দ আড়ালে দ্যাখে বাল্যশিক্ষা তামাটে বিকেলে একজন মুঠোয় নৈরাশ নিয়ে বসে আছে, কেউ মত্ততায় হেসে ওঠে গভীর অরণ্যচারী কাপালি-প্রায়। শহরে হাতির পাল ক্ষিপ্র ছোটে দিগ্ধিদিক, কেউবা কুড়ায় মুদ্রা কিছু ডিগবাজী খেয়ে চোরাস্তায়। গ্রাম্যবধূ ফুটপাতে থতমত, স্বপ্নের ভিতরে বাল্যশিক্ষা ওড়ে, মেঘে নীল সামিয়ানা।   (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
রূপক
যদি মুখ খুলি কী বলব? বলার কিছুই নেই? বলব কি দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া রমনার শান্ত গাল দিয়েছে রাঙিয়ে, বলব কি আর দশজন মরে মরুকগে, আমার সকালে চাই রোজ দুটি আধাসেদ্ধ ডিম, রুটি-মাখনের সঙ্গে-জ্যাম না-ই হোক, ক্ষতি নেই অথবা মলির ছোট মেয়েটার (কী-যে তার নাম ক’দিন হয়েছে হাম), যে-লেখক এবার পেলেন আদমজী পুরস্কার তিনি প্রত্যহ মাজেন দাঁত কলিনস্‌ দিয়ে, কী করে বিকোয় সবজি বাজারে ইত্যাদি টুকিটাকি বলব কি ছাদহীন ঘরে দিন কে চায় কাটাতে আজীবন, সোনার খাঁচায় রইল না দিনগুলি। আদিতে কিছুই নেই, অন্তে নেই কিছু; মধ্যে শুধু এই থাকা না-থাকার জ্যোৎস্না চমকিত ঊর্ণাজাল।গ্রীষ্মের দুপুরে রাস্তার বিবর্ণ কোণে ঘোড়ার খুরের শব্দ সত্য, সত্য এই জানালার কাচে কালো বৃষ্টির আঁচড়, পাতার কঙ্কাল আর ব্রিজের ওপর ঝকঝক রাত্রির চলন্ত ট্রেন, দাড়ি না-কামানোমুখের মতন দিন সত্য-সত্য সবি।কিন্তু তবু কী সম্পর্ক পূর্ণিমা চাঁদের সঙ্গে এই খেঁকি কুকুরের? অথবা রজনীগন্ধা আর দূর চিমনির ধোঁয়া অবিশ্বাস্য কী গ্রন্থিতে আছে বাঁধা? সম্বন্ধের কোন প্রসারিত পরিধিতে মগ্ন পরস্পর হাতের চকিত মুদ্রা জনাকীর্ণ এভেন্যুর ফোয়ারার বিচূর্ণিত জল!একটি প্রখর পাখি ঠুক্‌রে ফেলে দেয় অবরিত পোকা-খাওয়া মূল্যবোধ। আমরা যে-যার মতো পথ চলি, দেখি বুড়ো লোকটা পার্কের বেঞ্চে ব’সে হাঁপিয়ে, ফুঁপিয়ে অভিশাপ ছুড়ে দেয়, গাল পাড়ে ভিখিরিকে আর উল্কি-পরা সরু গলি চমকায় নগ্ন ইশারায়, বেকার যুবক দৃষ্টি দ্যায় সিনেমার প্ল্যাকার্ডের রঙচঙে ঠোঁটে, মুখে বুকে আর মদির ঊরুতে।পৃথিবীটা চলছে, চলবে যতদিন সূর্য তার ছিটোবে সোনালি থুতু, কিন্তু যদি ততই নিশ্চিত এই পৃথিবীর ভবিষ্যৎ তবে কেন সে নব্বুই বছরের বুড়ো কনকনে হাওয়ায় ভাসিয়ে ধবধবে সাদা চুল এক হাঁটু তুষারের মধ্যে দাঁড়িয়ে শোনায় কতো শান্তি ললিত বাণী একই কেন্দ্রে ঘুরপাক-খাওয়া অগণিত মানুষের হাটে!যদি মুখ আদপেই খুলি বলব কি এপ্রিলের উত্তপ্ত হাওয়ায় ঘেমে মেঘে রোজ হচ্ছি নাজেহাল, ব্লাউজ পিস্‌টা চমৎকার…তোমাকে মানাবে ভালো পরো যদি খয়েরি শাড়ির সঙ্গে অথবা হানিফ করেছে সেঞ্চুরি ফের, দালাই লামার আত্মজীবনীতে কত ঘটনার সমাহার; বলব কি চলো যাই কফি খাই হাল ফ্যাশনের কিছু বই পড়া চাই নইলে লাফাবে তুমি এঁদো ডোবা, কুয়োর ভেতরে।বলব কি টাইয়ের নিখুঁত নট শিখলোনা বাঁধতে বেচারা আজ অব্দি, বলব কি তিনটি সরলরেখা মিলেই ত্রিভুজ… ঘরে বসে ছুঁচোর কেত্তনে আজ মেটাব কি সাধ, বলব কি…   (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
(অগ্রজ জনাব আজিজুর রাহমান চৌধুরীকে)আমার প্রথম ভাই কান্তিমান, স্কুল-ছুট, সতত বালক (এমনকি মধ্যবয়সেও) নবাববাড়ীর নওশা, আলাভোলা, প্রখর, যৌবনে ছিলেন উড়নচণ্ডী। পরিণীতা, পুত্র রইল পড়ে এবং হলেন তিনি দেশান্তরী, ঘুরে বেড়ালেন সার্কাস পার্টির সঙ্গে। সাত ঘাটে আঁজলা ভরিয়ে, ভিজিয়ে পায়ের পাতা একদিন শেষে ঘরের উধাও ছেলে ফিরে এলো ঘরে। তারপর কাটে তাঁর অনুজ্জ্বল বৈচিত্র্যরহিত দিনগুলি সংসারের ভাঙ্গা খাঁচায় এবং অকস্মাৎ কোনো মধ্যরাতে খাঁচার ভিতর থেকে অস্থির অচিন পাখি উড়ে গেল অনন্তের দিকে। আমার দ্বিতীয় ভাই, আবাল্যে তুখোড় ডানপিটে, দীর্ঘকায়, সুদর্শন, পৌরুষে ভাস্বর। ভ্রমণবিলাসী তিনি কলেজ পালিয়ে মেহগনি বাক্স ভেঙে ঘুরেছেন দাক্ষিণাত্যে মন্দিরে মন্দিরে, অজন্তার বিখ্যাত গুহায় আর দিলেন কাটিয়ে দিল্লিতে ভক্তিতে মজে হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়ার মাজারে দু’তিন বছর। গত বিশ্বযুদ্ধে পাঠাতেন তারবার্তা ব্রিটিশ জাহাজ থেকে, মনে পড়ে। হঠাৎ খেয়ালে জাহাজের খোল ছেড়ে সেই যে এলেন নিজের ডাঙায় ফিরে, তাকে আর ভোলাতে পারেনি সমদ্রের গান; এমনকি যে ইহুদি রমণী বিদেশে ছিলেন দয়িতা, তার ঘাগড়ার রেশমি টান, চোখের কুহক ফেরাতে পারেনি তাঁকে ভবঘুরে জীবনের বাঁকে বাঁকে, অনন্তর সমুদ্রের ঢেউ নয়, কোনো রমণীয় শরীরের চড়াই-উতরাই নয়, তরুণ ঘোড়ার পেশি-তরঙ্গের প্রতি কী দুর্মর আকর্ষণ তাঁর। রেসের মরীচিকায়, তাসের আড্ডায় রেখেছেন জীবন বন্ধক। এখন যখন তিনি আরমানীটোলার পথ দিয়ে হেঁটে যান ক্লান্ত, রুগ্ন, ভীষণ একাকী, যুদ্ধাহত সৈনিকের মতো, তখন মুখাবয়বে তাঁর ছয় দশকের আর্তি, বহ্নুদ্যৎসব, হাহাকার, প্রমাদ, চিৎকার জেগে থাকে অবেলায়।আমার তৃতীয় ভাই ছিলেন মাঝারি গড়নের, ইস্পাতি শরীর তার ঝলসাত মাঠের রোদ্দুরে গোল্লাছুট কাবাডি খেলায়, ক্রোধের ভিমরুল তাঁকে কামড়ালে, কালো কপালের কাটা দাগ আরও চিকচিকে আর গাঢ় হয়ে যেত। কখনো কখনো তিনি নাকীসুরে খুব দুলে দুলে গাইতেন ফিল্মি গান এবং বন-বাদাড়ে একা-একা কাটত সময় আর বলতেন তাঁর চোখ ভেসে ওঠে কত সুন্দর আজীব গাছপালা, জীব-জানোয়ার কিমাকার আর অতল পাতাল। যখন এ. আর. পি.-তে লেখালেন নাম, উর্দি-পরা তাঁকে দিব্যি বীর-বীর লেগেছিল। ছিলেন অকৃতদার আর অকস্মাৎ এ কি বজ্রপাত আমাদের ঘরে- আমার তৃতীয় ভাই ক্রূর পিত্তশূলে হলেন অকালমৃত প্রেমিকার চুম্বনবিহীন, সন্তানের আলিঙ্গনহীন।আমার চতুর্থ ভাই পিতার মিনিয়েচর, তেজী একরোখা, স্পষ্টভাষা! ন্যায়-অন্যায়ের তুলাদণ্ডে সর্বদা নিবদ্ধ দৃষ্টি তার, উপার্জনে নিয়ত সংগ্রামশীল, সামাজিক নিমন্ত্রণে অকুণ্ঠ, উদার; ভোজনবিলাসী, নীড়প্রিয় বাবুই পাখির মতো গোছায় সংসার প্রতিদিন। পুরানো প্রথাম প্রতি নতজানু; এই শতকের রোদে পিঠ দিয়ে ভালোবাসে মধ্যযুগী মায়াবী আঁধার। নিত্য সুরে-সাদেকের আলো-আঁধারিতে করে পাঠ কলমা দরুদ।আমার পঞ্চম ভাই সুকান্ত, সৌজন্যময় আর রুচিবান এবং সবার প্রীতিসাধনে তৎপর সর্বক্ষণ, পরমতসহিষ্ণু অথচ সুতাকিক। গোঁড়ামির প্রতি সায় নেই তার, গ্রন্থপ্রিয় মন করে বিচরণ মুক্তবুদ্ধির মিনারে, উপরন্তু, সংগীত-নির্ঝরে স্নাত নিয়মিত, আদালতে সাজিয়ে কথার পিঠে চোস্ত কথা কুড়ায় বাহবা, দীপ্ত অধ্যাপকও বটে। বস্তুত সে স্নিগ্ধ বুদ্ধিজীবী।আমার কনিষ্ঠ ভাই চটপটে, বেপরোয়া, বড় ঝলমলে; নিখুঁত টাইয়ের নট, গায়ে হাল-ফ্যাশনের নানা পোশাক-আশাক। আকৈশোর অভিযানে মাতাল। তাই সে প্রায়শ জমায় পাড়ি দূর দেশে, যেন কোনো নামহীন দ্বীপ থেকে আনবে নির্যাস ছেঁকে রহস্যের কিংবা অতল পাতাল থেকে মণিরত্ন, যেন নিমেষেই নেমে যাবে তুড়ি মেরে দুর্গম খনিতে একা। নৈরাশ্যের থুতনি নাড়িয়ে দিয়ে জোরে ‘যে যাই বলুক আমি বাণিজ্যেতে যাবোই’ বলে সে আমার কনিষ্ঠ ভাই ভাসিয়েছে সমদ্রে জাহাজ।কখনো-কখনো ভাবি আমার ভ্রাতৃ-সংঘের কতটুকু আছে নিহিত আমার মধ্যে? কার চোখ, কার মুখভঙ্গি হুবহু প্রতিফলিত আমার সত্তায়? কার কোন আচরণ করি ব্যবহার মুদ্রাদোষের মতন আমিও অজান্তে মাঝে মাঝে? আর মাঝে-মধ্যে আমাদের বংশের প্রাচীন নামহীন কত পুরুষের অজ্ঞাত জীবনী মন্ত্রের মতন গুঞ্জরিত হতে চায় আমার নিজস্ব অবচেতনের রহস্য-শোষক তন্দ্রাচ্ছন্ন স্তরে স্তরে।   (উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
এখন বাইরে রাত্রি তপোক্লিষ্ট বিমর্ষ নানের পোশাকের মতো আর সুদূর কোথাও সন্ন্যাসীর অস্থায়ী ধুমল আস্তানায় আস্তে ঝরছে শিশির, প’ড়ে থাকে কতিপয় চিহ্ন উদাস অন্তর্ধানের। নিশীথ রপ্তানি করে প্রসিদ্ধ সুরভি বাগানের দূর-দূরান্তরে, ক্লান্ত মগজের ভেতরে রাত্তির ডোরাকাটা বাঘ, জেব্রা, ঝিলঘেঁষা হরিণের ভিড় নিয়ে গাঢ়, শিহরিত ঘাস পুরানো গোরস্তানের।ঘুমন্ত পৃথিবী মধ্যরাতে, আমি ধুধু অনিদ্রায় কাটাই প্রহর একা ঘরে আর তুমি দেশান্তরে সুখান্বেষী তোমার শরীরে মিলনের চন্দ্রোদয়; না, আমি মানিনা এই দূরত্বের ক্রুর অন্তরায়। যদিও দুস্তর ব্যবধান, তবু প্রতিটি প্রহরে তোমারই শিয়রে জ্বলে আমার ক্ষুধার্ত চক্ষুদ্বয়।   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
রুটির দোকান ঘেঁষে তিনটি বালক সন্তর্পণে দাঁড়ালো শীতের ভোরে, জড়োসড়ো। তিন জোড়া চোখ বাদামি রুটির দীপ্তি নিল মেখে গোপন ঈর্ষায়। রুটিকে মায়ের স্তন ভেবে তারা, তিনটি বালক তৃষিত, আত্মাকে সঁপে সংযত লোভের দোলনায়, অধিক ঘনিষ্ঠ হ’ল তন্দুরের তাপের আশায়।কিন্তু তারা কর্মঠ থাবার তাড়া খেয়ে, তাড়াতাড়ি ফিরে গেল হিমেল বাতাসে খুঁজে নিতে অন্য কোনো বুভুক্ষার পরিমেল। যে বুড়ো লোকটা আধপোড়া সিগারেট তন্ময় নিষ্ঠায় রাস্তা থেকে তুলে নেয়, তার কাছে তিনটি বালক যেন নরক পালক, সহযাত্রী দুঃখের ভ্রমর-ডিসেম্বরে ফুটপাতে কুঁকড়ে থেকে এক কোণে হাড়ে হাড়ে টের পায় যারা হিমেল হাওয়ার ধার শরীরের মাংস যেন খ’সে প’ড়ে যাবে ইতস্তত পচা কমলালেবুর মতো নামমাত্র স্পর্শে, আরফুটোভরা কাঁথার তলায় শুয়ে তারাময় খোলা আকাশের নিচে কোনো দিন হয়তো অলক্ষ্যে হয় স্বর্গের শিকার।মাঝে-মাঝে স্বপ্ন দেখে ম্লান কুয়াশায় এক ঝাঁক ঘুঘু নামে পূর্বপুরুষের সম্পন্ন ভিটায়।   (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
সময় তো বয়ে গেলো চোখের নিমেষে, অথচ জমার খাতা খাঁ খাঁ রয়ে গেছে আমার, আকাঙ্ক্ষা উড়ে যায় মেঘলা আকাশে। বসে থাকি একা ঘরে হতাশায়।তবে কি বৃথাই আমি বহু রাত নির্ঘুম কাটিয়ে ঝাঁঝালো দুপুরে পাহাড়ের চূড়ায় হেঁটেছি আর সমুদ্রের ঢেউয়ে বসে কাটিয়ে দিয়েছি বহুদিন? বেলা শেষে কী তবে পেলাম?এতকাল যা ছিল আরাধ্য, যদি তার কিছুই না জুটলো সঞ্চয়ে, তাহলে জীবন ফাঁপা অতিশয়; হায়! কেঁদেও পাবো না তাকে, প্রাপ্তি যার ছিল আকাঙ্ক্ষিত।আমাকে দেখে কি আজ সর্বহারা মনে হয়? না কি বুড়ো ঈগলের মতো অথর্ব, ঝিমোনো? তাই কি উদ্ধত দাঁড় কাক, এমনকি ক্ষুদ্র পাখি ঠুকরে আমুদে ঢঙে উড়ে চলে যায়। চুপচাপ বসে থাকি।  (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
এখন প্রত্যূষ, ফিকে অন্ধকার, হৃদয়ে শ্রাবণ অবিরাম; বসে আছি, নির্ঘুম কেটেছে সারারাত, দু’চোখে মরিচ-গুঁড়ো, এই প্রভাতী হাওয়ার হাত বুলোয় প্রলেপ কিছু, তবু শুধু হু হু করে মন। যে আমার স্থৈর্য, নিদ্রা অগোচরে করেছে হরণ, তাকেই সঁপেছি মনপ্রাণ, তারই উদ্দেশে কবিতা লিখি নিত্য ভূতগ্রস্ততায়; সে-যে প্রজ্ঞাপারমিতা কষ্ট দেয়, তবু তারই কাছে চাই সর্বদা শরণ।ক্ষ্যাপার মতোই ঘুরি ফুটপাতে, পার্কে নদীতীরে তার টানে, যে আমাকে হাতছানি দেয় বারবার। আমিতো মুখশ্রী তার খুঁজে ফিরি এই ঘেমো ভিড়ে, কখনো মাতাল ক্লাবে, কখনো সিঁড়িতে সিনেমার ক্লান্তিতে ভীষণ ডুবে। দেখা দিয়ে চকিতে মিলায়, আমি অসহায় একা; শুয়ে আছে সে তার ভিলায়।
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
আমার ব্যর্থতা, কালো, সাংকেতিক ব্যর্থতা কখনো লতাপাতা কিংবা পাখপাখালির আড়ালে লুকিয়ে থাকে, কখনো-বা ওষ্ঠের কিনারে তিক্ত স্বাদ রেখে যায়।আমার নৈবেন্য নেয় বারবার ব্যর্থতার হা হা এভেনিউ। শব্দ কতিপয়, অসফল, দিশেহারা, বুঝি পিতৃমাতৃহীন পথের সন্তান, এলেবেলে খেলে মৃত অন্ধকারে, ঘুমায় কবরে। লতাগুল্মময় কবরের পাশে নতজানু কম্পমান, ডাকি বারবার ঝোড়ো হৃদয়ের তীব্র আর্তি নিয়ে, ওরা নিঃস্পন্দ নিঃসাড় যেন মেঘের আড়ালে বিকলাঙ্গ চন্দ্রকণা অথবা এমন লখিন্দর যার গলিত শরীরে পারবে না চল্‌কে দিতে প্রাণধারা বেহুলা কখনো।ওদেরতা চমৎকার সেজেগুজে, শার্টের কলার উল্টিয়ে শোভন আর টুপিতে পালক গুঁজে পথে বেরুনোর কথা ছিলো, কথা ছিলো, ওরা যাবে ড্রইংরুমের সুশীতল পরিবেশে, বসবে সোফায়, লাল গালিচায়, দেবে জুড়ে নিভৃত আলাপ, কথা ছিলো, ওরা যাবে ভেজা-ভেজা অন্ধকারময় গ্রন্থাগারে, মেলাবে আপন হাত তত্ত্বপরায়ণ, তথ্যঠাসা অধ্যাপকদের সঙ্গে, তরুণ তরুণীদের ভিড়ে করবে রগড় পার্কে করিডরে আলো আঁধারিতে কাফেটারিয়ায়, কথা ছিলো, ওড়াবে অজস্র টিয়ে বাণিজ্যিক এলাকার লাল পেট্রোল পাম্পের কিছু সম্ভ্রান্ত ওপরে, মধ্যবিত্ত ছাদে, চিলেকোঠায় গলির মোড়ে আর খবরের কাগজের হুজুগে পাড়ায়, অথচ এখন ওরা লতাপাতা কিংবা পাখির ডানার অথবা ঠোঁটের ছায়াচ্ছন্নাতায় গভীর লুকোনো এবং তাদের সঙ্গে আমার শ্যামল শৈশবের কিছু বেলা যৌবনের অলৌকিক রথ, দীপ্র, ভগ্ন, স্মৃতি আচ্ছাদিত, শ্যাওলায় কারুময়, আমার আশার কীর্তনিয়া করেছে প্রস্থান গৌণ শিল্পের আড়ালে।   (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
যে-হাত যুগল স্তনে খোঁজে চাঁদ-শাদা স্বপ্নের মদির পথ, খোঁজে ক্ষেত্র প্রীতি কর্ষণের,- ভাবতে অবাক লাগে, সেই একই হাত সহজেই কাগযে নির্দেশ লেখে বোমা বর্ষণের!   (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
বয়স যতই হোক, আজো অমিলের ভিড়ে মিল খুঁজে ফিরি বন্ধ ঘরে, প্রত্যেকের থেকে অন্তরালে একটু আলাদা ভাবে থাকি কিছুকাল। কী হারালে বিনিময়ে কী লভ্য সে-কথা ভেবে কিছু ঢিল ছোঁড়া যায় নক্ষত্রের আস্তানায়। আলৌকিক ঝিল আমার ভেতরে উচ্ছ্বসিত, অস্তিত্বের তন্তুজালে গভীর সরোদ বেজে ওঠে। সে কোন্‌ সুদূর কালে ছিলেন আমারই মতো তপোক্লিষ্ট হোমার, ভার্জিল-এ-কথা স্বরণে রেখে নিজেকেই উস্‌কে দেয়া যায় মাঝে মধ্যে; তবে এ-ও জানি শূন্য ফাটা কলসের মতো বেজে ওঠা শুধু আত্মপ্রবঞ্চককে মানায়। তাই একা, বড়ো একা কাটাই প্রহর কলমের স্পর্শে মূলহীন লাল-নীল কমলের জাগরণ দেখে, দেখে মরুবেক্ষ হরিণ-কোমল ঘন বন।   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
দিনভর রাতভর তোমার উদ্দেশেই আমার এই ডাক, গলা-চেরা, বুক-ছেঁড়া। আসা না আসা তোমার খেয়ালের বৃত্তে ঘূর্ণ্যমান, কোনো পাখি যদি স্বপ্নঝিলিক, আশার খড়কুটো আমার ঘরে না ঝরায়, তবু ডেকে যাবো, যতদিন না তুমি আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়াও।সে কবে তোমাকে দেখলাম; তুমি এসে বসলে আমার পাশে, সবুজ ঘাসে লুটিয়ে পড়েছে তোমার ঘাসফুল-রঙ শাড়ির আঁচল, তোমার হাসির ঢেউ, আমার ভেতরে নৌকার দোলা, তোমার খোলা চুল নিয়ে খেলছে হাওয়া, স্বপ্নছাওয়া চোখ তুলে কী যেন বললে তুমি, কিছু শুনতে না পেয়ে আমি তোমার সৌন্দর্যের গহনে ডুবুরী। তোমার নরম হাত আমার মুঠোয়। আমি কোনো গোলাপ কিংবা স্বর্ণচাঁপাকে স্পর্শ করিনি। মনে হলো, তোমার সকল কিছুই স্পর্শাতীত।মুখের ওপর রোদের ঝলক, বাসী ধু ধু বিছানায় আমার ধড়ফড়িয়ে ওঠা, চোখ রগ্‌ড়ে বারবার স্বপ্নের ছেঁড়া মসলিন সেলাই করবার পরিণামহীন চেষ্টা। ভীষণ তেষ্টায় আমার চোখ জুড়ে, গলা জুড়ে, বুক জুড়ে বালি, কেবল বালি।চকিতে মনে পড়ে, তোমার হেকারতের হ্যাঁচকা টানে টালমাটাল আমি দেখেছি আমার স্বপ্নের সওদাকে গড়াতে সদর রাস্তায়। টুকরো টুকরো ছবি ভাসে, ডোবে। খণ্ডগুলোকে জোড়া দিতে অপারণ আমি অমিলের বেড়াজালে আটকা। যাকে দেখেছিলাম শেষরাতের স্বপ্নের অভ্রের আভাময় মাঠের মাঝখানে, সেকি তুমি? তার কালো চুল কি নিতম্ব অব্দি নেমে-আসা ঝর্ণা নাকি বিউটি পার্লারে রচিত খাটো স্তবক?আর তার আয়ত সুন্দর চোখ? ঈষৎ বাদামি নাকি নীল ঢেউয়ের ঝলকানি-লাগা? অথবা মৃত্যুর মতোই ঘন কালো? তোমাকে আর তাকে মেলাবার আমার সকল আয়োজন শুধু, পণ্ড হতে থাকে। তোমাকে বাস্তবিকই কখনো দেখেছি কি দেখি নি, এই ধন্দ আমাকে নিয়ে লোফালুফি করে লাগাতার। বুকের ধুক ধুক আর হৃৎপিণ্ডের রক্তের দাপাদাপি আর সীমাছাড়ানো অস্থিরতা নিয়ে আমি কিছু শব্দকে ‘আয় আয়’ বলে ডেকে বেড়াই দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। অনন্তর যে প্রতিমা গড়ে ওঠে আমার হাতে, তাকে দেখে অনেকে বলে ওঠে সোল্লাসে, ‘সাবাস কবি, কেমন করে, এই অসম্ভব সুন্দরকে আনলে মর্ত্যলোকে?’ মাঝে-মধ্যে আমারও অবাক হবার পালা। অথচ এই আমি বহুদিনের নাছোড় অস্থিরতা এবং অনেক নির্ঘুম রাত্রির বিনিময়েও তোমাকে আমার সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে অক্ষম। এর ব্যর্থতার ঝুলকালি মুখে নিয়ে চৌদিকে মানুষের মেলায় হাঁটবো কী করে?মনকে প্রবোধ দিই, আমাকে না বলেই তুমি চলে যাবে, বিশ্বাস করি না। তুমি সাড়া দাও আর নাই দাও, আমি দিনরাত্তির ডেকেই যাবো অকাল বসন্তের ব্যাকুল কোকিলের মতো। গলায় রক্ত চল্‌কে দেয়া এই ডাক তোমাকে কি কখনো নামিয়ে আনতে পারবে না তোমার উদাসীনতার মিনার থেকে? তুমি কি শীগগীরই একদিন এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলবে না, এই যে আমি? আজ শুধু অন্ধকারে হারড়ে বেড়ানো, নিজের সঙ্গে কথা বলা। শোনা যায়, কখনো কখনো মর্মর মূর্তিও বেদীর স্থানুত্ব বিসর্জন দিয়ে তার রূপের সাধককে বাঁধে নিবিড় আলিঙ্গনে। কোন্‌ দিকে পড়বে তোমার পদচ্ছাপ, তা দেখার জন্যে প্রতীক্ষায় কখনো আমি পাথরের নুড়ি, কখনো প্রজাপতি, কখনো বা দোয়েল।   (হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
তরুণী ডালিমগাছ রৌদ্রশুক্র করছে ধারণ অসংকোচে, প্রসূনকে নদীজলে ভাসিয়ে দেবে না। আকণ্ঠ রয়েছি ডুবে নিরাশায়, গাছটির দিকে তবু চেয়ে থাকি, যেন আমার না-লেখা কবিতার ফুল ফুটে আছে তার ডালে। বিপদে রয়েছি খুব, নিজগৃহে ভাত রেঁধে প্রফুল্ল হাওয়ায় খেয়েদেয়ে শান্তির বালিশে মাথা রাখা দায়। মানুষের মুখ ক্রমাগত গরিলার মুখ হয়ে যাচ্ছে, চতুর্দিকে ঘাতকের মজলিশ, তাদের নিশ্বাস বিষ ঢালে বায়ুস্তরে আর সুন্দরের গলা চেপে ধরে ওরা বাঘনখ প্রসারিত ক’রে। দেবদূত নর্দমায় খাবি খায়, চাঁদের কলঙ্ক বেড়ে যায় প্রতিদিন।পারি না কোথাও যেতে, ভূতলবাসীর মতো দিন কাটে আতঙ্কিত, রাত্রি দুঃস্বপ্নের ভয়াবহতায়। উদ্ধারের পথ রুদ্ধ? শবাহারী পশুর উল্লাস কানে আসে ক্ষণে ক্ষণে। অকস্মাৎ বরাভয় জাগে বৃক্ষদের শ্যামল মুদ্রায়, বিজয়ীরা সমাগত- ডালিমগাছের ডালে ফলগুলি হতেছে ডাগর।   (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
স্বদেশমূলক
আমার হারিয়ে যাওয়া ডায়েরিটি মধ্যরাতে এসে প্রেতের ধরনে হাসে, যেন সেই হাসিতে ক্রন্দনই বেশি ছিল; বল্‌ল ধূসরিম কণ্ঠে, “আমাকে অনেক অবহেলা করেছো হে কবি, কোন্‌ সে আঁধারে তুমি আমাকে রেখেছ ফেলে, আমার শরীরে ঢের ধুলো পুরু হয়ে জমেছিল। একবারও ভুলে পাতাগুলো খানিক দেখনি খুলে; হায়, তাকাওনি ভালোবেসে পুরোনো পাতার দিকে কিংবা স্নেহভরে ক’বছর।অথচ সুদূর একাত্তরে ভরেছ আমার পাতা বেদনার্ত কিছু কবিতায়, কখনো হয়েছি স্নাত তোমার অশ্রুতে আর তুমি বারবার বুকে টেনে নিয়েছ আমাকে আর রেখেছ আগলে অগোচরে, ছিলাম লুকানো যত্নে। আজ আমি অভিমানে, ক্ষোভে হারিয়ে গিয়েছি শূন্যে, ইতিহাসে হলো নাকো ঠাঁই।“   (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
প্রতীতি আসেনি আজো, শুধু গৃহপালিত স্বপ্নের তদারকে বেলা যায়। অস্তিত্বকে ভাটপাড়া থেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এসে, চিকণ কথার বিদ্যুল্লতা থেকে দূরে উল্টো পাল্টা চিত্রকল্পে দিয়েছি পা মেলে। বশংবদ নক্ষত্রেরা আত্মায় জানায় দাবি, দেখি।সবসুদ্ধ কয়েক শ’, তারও বেশি সুকণ্ঠ কোকিল হত্যা করে, বহু লক্ষ প্রজাপতি ছিঁড়ে, পাপিয়াকে সোৎসাহে নির্বংশ করে, লোকটা সদর্পে হেঁটে গেলো রোমশ ছত্রিশ ইঞ্চি ঠুকে ঠুকে। সময়ের ছাদ ধসে যেতে চায়, দেখলাম ভূতগ্রস্ত নগ্নতায়।শতাব্দীর ফসিল জমানো কতো কবির পাঁজরে। মধ্যে মধ্যে হাতড়াই স্বর্গের চৌকাঠ, বসে বসে দিনের উদ্বেল স্তন খুঁটি; ভাবি, নিস্তাপ সন্ধ্যার মেঘমালা, ফুলের নিশ্বাস, বৃক্ষ ছায়া, দাঁড়বন্দী পাখিটার টলটলে চোখগুলো আমাকে কবিতা দেবে কিছু? দশটি আঙুলে খুঁটি নিজেরই পাঁজর।প্রতীতি আসেনি আজো, প্রেম আসে মরালের মতো, ডানা ঝাপটিয়ে বসে চিত্তহারী প্রচ্ছন্ন মাস্তুলে। ভাটপাড়া থেকে দূরে ভালবাসা তুমি থাকবে কি? মেলবে কি পাখা এই ভূতগ্রস্ত কলঙ্কী পাঁজরে?   (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
রূপক
একদা তোমার নাম হাটে মাঠে ঘাটে, সবখানে গুজ্ঞরিত হতো জানি। বড়ো মিঠে তোমার সংলাপ মুখস্থ করতো যারা রাত্রিদিন, তাদের উত্তাপ জোগাতে মোহিনী রূপে-এ দশকে আজ তা কে জানে! বিজয়িনী তুমি, তাই সেলুনে কি পানের দোকানে রবীন্দনাথের পাশে ঝুলতো তোমার ফটোগ্রাফ, দেখতাম; সে আশ্চর্য বাবুবিলাসের যুগে-সাফ মনে পড়ে-ছিলে বহু যুবকের বিনিদ্র শিথানে। কাল তার ত্র্যালবামে কিছুতে রাখে না সব ফটো, দেয় ঠেলে আস্তকুঁড়ে; সময় বেজায় জাঁহাবাজ। বুঝি তুমি তাই লোকলোচনের আড়ালে, মলম পারে না রুখতে আর জরার আঁচড়। বড়ো-ছোটো পানের দোকানে ঝোলে অন্যান্য বালার ছবি আজ, নেপথ্যে জীবনী লেখে পুরোদমে ভৌতিক কলম।   (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
স্বদেশমূলক
১ লিখি আর না-ই লিখি, প্রতিদিন কবিতার খাতা খুলে বসি পুনারায়, তাকে টেবিলে সযত্নে রাখি মঠবাসী সন্ন্যাসীর মতো ব্যবহারে। কবিতার খাতা, মনে হয়, দূর অতীতের তাম্রলিপি, কখনো প্রবাল-দ্বীপ। কবিতার খাতাটির স্মৃতি নিয়ে একা একা পথ হাটি সারাদিনমান, বেলাশেষে পৌছে যাই সে-দেশে, যেখানে আজ হরিণ হরিণ নয় আর, যেখানে পাখিরা নয় পাখি। তবু আমি হরিণের বর্ণিল ভঙ্গিমা, পাখির গানের ছায়া সঙ্গে নিয়ে আসি, নিয়ে আসি কবন্ধের হাত থেকে ময়ূর-ময়ূরী। যাবতীয় অনিন্দ্য গোলাপ, বিদ্যুল্লতাময় মেঘ, বৃষ্টিভেজা মুখ আর মায়াবৃক্ষসহ সেসব অর্পণ করি পুণ্যার্থীর মতো আমৃত্যু আমার সঙ্গী কবিতার খাতাটির বুকে।২ সুদূর বৃটিশ যুগে পঞ্চাশের মন্বন্তর থেকে কিছু শিখে নিই আমি আর কবিতার খাতা। রবরবা মুসলিম লীগের আমলে কত কিছু শিখে নিই আমি আর কবিতার খাতা। বায়ান্নোর রক্তাপ্লুত ভাষা-আন্দোলন থেকে কিছু শিখে নিই আমি আর কবিতার খাতা। ভাসানীর সন্তোষের কুটিরের আর তাঁর পদযাত্রা থেকে কিছু শিখে নিই আমি আর কবিতার খাতা। রাজবন্দিদের নির্যাতিত জ্বলজ্বলে চোখ থেকে কিছু শিখে নিই আমি আর কবিতার খাতা। শেখ মুজিবের স্বাধীনতা-ঝলসিত উদ্যত তর্জনী থেকে, বজ্রমুষ্টি থেকে কিছু শিখে নিইআমি আর কবিতার খাতা। সতত ভূতলবাসী তরুণ সিরাজ সিকদার আর তাঁর সহযাত্রীদের কাছ থেকে কিছু শিখে নিই আমি আর কবিতার খাতা। মুক্তিযোদ্ধা, হুইল চেয়ার আর ক্রাচ থেকে কিছু শিখে নিই আমি আর কবিতার খাতা। জীবনানন্দীয় পাতা থেকে আস্তে সুস্থে কিছু শিখে নিই আমি আর কবিতার খাতা। কমল মজুমদার পাঠ করে চণ্ডালের হাঁড়ি, শ্মশানের তন্বী সতী, তার বানভেজা স্তন আর গোলাপ সুন্দরী আর শ্যাম নৌকার নিকট থেকে কিছু শিখে নিই আমি আর কবিতার খাতা। পথিকের মধ্যহ্নভোজন আর ভগ্ন পান্থ নিবাসে কাছ থেকে কিছু পিছুটান শিখে নিই আমি আর কবিতার খাতা। এবং বৈচিত্র্যময় উপজাতীয় সংস্কৃতি থেকে কিছু শিখে নিই আমি আর কবিতার খাতা। বাথরুমে-রাখা বালতির পানি আর কৈশোরের নদীটির কাছ থেকে কিছু শিখে নিই আমি আর কবিতার খাতা। মেয়েদের হস্টেল এবং মাতৃসদনের কাছ থেকে কিছু শিখে নিই আমি আর কবিতার খাতা। স্বপ্নপ্রসূ কম্যুনিস্টো থেকে, পরাবাস্তবের সূর্যমুখী থেকে কিছু শিখে নেয় আমৃত্যু আমার সঙ্গী কবিতার খাতা। রৌদ্রদগ্ধ শস্যক্ষেতে কৃষকের অবস্থান থেকে, বিবাহ বাসন আর কবরের বাতি থেকে কিছু শিখে নেয় আমৃত্যু আমার সঙ্গী কবিতার খাতা।   (আমার কোন তাড়া নেই কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
লোকগুলোর কী হয়েছে বলোতো মুখে কুচকুচে অথবা ধবধবে দাড়ি দেখলেই অথর্ব মোল্লা ঠাউরে নেয় আর উশকো খুশকো চুল ময়লা ট্রাউজার হলুদ উদাসীনতা-ছাওয়া চোখ দেখলেই ছন্নছাড়া পদ্যলিখিয়েকী যে বোঝাতে চায় এই নিদ্রাচারীরা ওরা নিজেরাই তার মর্মেদ্ধার করতে পারবে কি না তা’ নিয়ে বিস্তর জল্পনা কল্পনা করা যেতে পারে ঘুমের জঠরে ক্ষণিক বসবাসকালীন সময়ে কী কী বলা হয় জেগে ওঠার পর অবোধ্য তন্ত্র মন্ত্রওরা বলছে সমাজতন্ত্র কফিনে শায়িত শেষ পেরেক ঠোকা খতম হয়ে এলো ব’লে গির্জার পথেই মুক্তি হতে পারে সাবলীল আমি বলি ব্যান্ডেজবাঁধা মাথা নিয়ে মার্কস এবং লেনিন আকিদা আর মমতায় আগলে রাখছেন সমাজতন্ত্রকে কবরের উপর সূর্যমুখী আশ্বাসের আভা যা বলে বলুক লোকগুলো ওদের কথামালাকে পাথর চাপা দেওয়া নিরর্থক এক ঝটকায় সুন্দরের ঘাড় মটকে দেওয়া সত্য-শিবের পশ্চাদ্দেশে কালি মেখে উদ্বাহু নৃত্য কুবাক্যসমূহকে সুসমাচারের আদলে পেশ ক’রে হাওয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া ওদের পেশাওদের প্রত্যেকের হাতে বিষঝরানো তীরধনুক আমি কি ক্ষমা করতে পারবো ওদের যাদের বাক্যশলাকায় আমার কবিতা জর্জরিত ছটফটানো দুলদুল যেভাবে হোক আগলে রাখা চাই কবিতা আর পবিত্র সব লক্ষ্যবস্তুকেলোকগুলোর যে কী হয়েছে সূর্যের মুখে ওরা আলকাতরা লেপে দিতে উদ্যত নক্ষত্রগুলো উপড়ে ফেললে ওরা হৈ হৈ মরদ লোকগুলোর মুদ্রা আমি ওদেরই ফিরিয়ে দেবো অসম্ভব নিশ্চুপ থাকা এই কালবেলায় আমার কণ্ঠস্বর আজ ঈগলের উড়াল সবখানে   (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
বারান্দায় আহত লোকটা। তার অর্ধেক শরীর রোদ্দুরে, অর্ধেক ন্যস্ত ছায়ায়; ঘুরে কোমলতা প্রশ্রয় দিয়েছে তাকে। খোয়াবের অর্ধস্ফুট ভিড় ঘিরে ধরে, সুপ্রাচীন কংকালেরা হিজিবিজি কথা কেবলি বলতে থাকে স্বপ্নের ভেতর। অকস্মাৎ জেগে ওঠে, এদিক ওদিক দেখে নেয় ভালো করে; বেখাপ্পা দুপুর ছোরাহত মানুষের মতো কাত হ’য়ে বিকেলের কাঁধে ঢলে পড়ে গৃহস্থের দোরে।এ কেমন রাত আসে? ধূসর পথের ক্লান্ত ঠোঁটে শিশির রক্তের রঙ ধরে; ঘরবাড়ি শীতে নয় আতঙ্কে কম্পিত যেন। নিদ্রাছুট মানুষেরা ভয় পেতে পেতে নিথর নিঃস্পন্দ হ’য়ে গেছে। অবিশ্বাসে আচ্ছন্ন পাথুরে চোখ। কখন যে ফের জেগে ওঠে মানবিক বোধ, এই প্রশ্ন কাঁপে প্রতিটি নিঃশ্বাসে।    (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
কচ্ছপের উদোম পেটের মতো বিন্যস্ত টেবিলে একটি গোলাপ নম্র শুয়ে আছে খাতাটির বুকে সেই কবে থেকে, মনে হয় দান্তের নির্বাসনের কাল থেকে। আজ কোন্‌ আর্সেনিক আর কীট মিলে কুরে কুরে খাচ্ছে তাকে? একজন কবি ধুঁকে ধুঁকে দেখছেন পারমাণবিক দহন বির্বাপণের আয়োজন নেই কোনো; ক্রুদ্ধ এরোস্পেস খাবে গিলে সভ্যতার হাড়গোড়, অনন্তর হিশেব নিকেশ যাবে চুকে।চূর্ণ এরোড্রোম আর হাইরাইজ বিল্ডিং-এর স্তূপ থেকে না-মানুষ, না-জন্তু বেরিয়ে ইতস্তত চরে বুঝি হারানো স্মৃতির মোহে শারদ জ্যোৎস্নায়। সেসব প্রাণীর রূঢ় পদতলে গীতবিতানের পোড়া পাতা পিষ্ট হয় আর স্তনের ক্ষতের মতো দগদগে নক্ষত্রেরা উপহাসে মেতে মদ খায়!   (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
আখেরে অসিত বিচ্ছেদের দিন হলো অবসান আজ এই প্রসন্ন বেলায়। আনন্দের অনাগত মুহূর্তের তীব্র প্রতীক্ষায় হৃদয়ের অন্তর্গত গানে-পাওয়া পাখি গেয়ে ওঠে পুনর্মিলনের গান। একেকটি দিন ছিল বহুশত বর্ষের অবসান, যখন ছিল না তুমি কাছে, প্রতিদিন অবিরত দেখেছি তোমার মুখ মেঘে, স্বপ্ন-সরোবরে নত পদ্মের আভায়, শুধু তোমাকেই করেছি সন্ধান।বিষাদের মুখে হাসি ফোটে, হাওয়া এসে দিলখোলা কথা বলে, বুলায় রেশমি হাত চুলে, গৃহকোণ বাসর শয্যার ঘ্রাণে পুলকিত; এ কিসের দোলা আমার অস্তিত্বে? এই বুঝি বেজে ওঠে টেলিফোন, যার অপেক্ষায় আছি স্বরচিত মনোজ নিবাসে ঘাতক কালের মোড়ে, শাসকের ব্যাপক সন্ত্রাসে।  (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
ঘুমভাঙা চোখে দেখি, হাতঘড়িতে ভোর ছ’টী। আকাশ-ঝারি শহরময় অবিরল জল ছিটোচ্ছে রাতের শেষ প্রহর থেকেই। শ্রাবণ- ধারায় আমি হয়ে উঠি গুণীর সেতারের আলাপ। আমার মনের গহনে চকিতে কদম ফুল ফোটে। এই ফুল ফোটালে তুমি, অথচ নিজেই জানলে না। জানি, এখন তুমি ঘুমের গহীন গাঙে স্বপ্নময় ডুবসাঁতারে নিমগ্ন, ছুঁয়েছ জলজ গুল্ম আর কয়েকটি রঙিন শঙ্খ গাঙের তলদেশ। তোমার ঘুমন্ত ঠোঁটে হাসির কুঁড়ি চোখ মেলছে তোমার অজ্ঞাতে। তোমার নিত্যদিনের সুপ্রভাত আর শুভ রাত্রিগুলো আনন্দমেলা হয়ে আমাকে ঘিরে দুলছে এক স্বপ্নিল ঘোর-লাগা নাগরদোলায়। কৃতজ্ঞতায় ছলছলে আমার চোখ। মনে পড়ে, কাল রাতে হঠাৎ তোমার ক্ষণিকের আবির্ভাবে অনন্তের কয়েকটি বুদ্বুদ দেখেছিলাম। অনৈতিহাসিক অথচ ব্যক্তিগত তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্তের মুকুল আমার অসুস্থতার কালোয় আলো ছড়িয়েছিল অকপট অকার্পণ্যে। সেই ঝলক তোমারই দান জেনে জ্যোৎস্নারাতের সোনালি মাছ হয়ে তুমি ঝলসে উঠছিলে ক্ষণে ক্ষণে। আজকের ভোরবেলা গত রাতের কয়েকটি মিনিট লাল চেলী গায়ে আমার বুকে মাথা রাখে। উন্মাতাল আমি দু’বাহুর নীড়ে টেনে নিই বিগত ক্ষণকালকে।   (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
নিজের হাতের দিকে হঠাৎ তাকাই, নখগুলো অতিশয় তাড়াতাড়ি বর্ধমান রিরংসার মতো অহর্নিশ; আমি কি দূরের কোনো অসভ্য মানব, ক্ষৌরর্কম জানা নেই যার? এইসব নখ নিয়ে বড়ই বিব্রত থাকি। শহরের প্রধান সুন্দরী কাছে এলে তার স্তনে, তলপেটে দাগ ক’রে দিই, এরকম ইচ্ছে বাঁদরের মতো চুলকোচ্ছে মাথা কিছুকাল ধ’রে; আপাতত কবিতাকে খুঁটে-খুঁটেমর্ষকামী সুখ পাই। দেখি তার চতুর্দিকে ঘাস গজিয়ে উঠেছে দীর্ঘ ছাঁদে, ফড়িং গভীর ক্ষতে দ্যায় সুড়সুড়ি; তার চেয়ে ভালো নিজেকেই আজ খাম্‌চে-খুম্‌চে ছিঁড়ে খুঁড়ে খুব খুঁতময় মুখ নিয়ে ব’সে থাকা পেকামাকড়ের মাঝে, লোভী ভ্যাম্পায়ার মহানন্দে শুষে নেয় প্রতারিত কবির প্রতিভা।  (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
নদীর উর্মিল বেগ পেশীতে পেশীতে; প্রতিদিন, ছুটিছাটা বাদে, নিয়মমাফিক যায় কারখানায় এবং কলের পাকে স্বেদসিক্ত ঘুরপাক খায়- যেমন দেখেছি ফিল্ম-এ মজাদার চার্লি চ্যাপলিন ঘুর্ণ্যমান, চক্রাকারে হয়ে যান নিজেই মেশিন। বাজলে ছুটির বাঁশি ফ্যাক্টরি-গহ্বর ছেড়ে ছুড়ে ক্লান্ত, ভারি পায়ে চলে আসে পথে, সে খিস্তি খেউড়ে মাতে চা-খানায় দোস্তে-ইয়ারের সাথে শান্তিহীন।মনের ভেতরে মন ডুব দেয় তারও স্মিত নীলে মেশে সত্তা; কী উদার তৃণভূমি, ঘন বনস্থলী, কী করে যে, বোঝে না সে, জেগে ওঠে শূন্য আশেপাশে। দ্যাখে, অকস্মাৎ শাদা হাতি দলে দলে ধেয়ে আসে তারই দিকে; কবন্ধের কালো হাটে চলে নরবলি। রূপোলি পানের বাটা, শিরস্ত্রাণ হলুদ টেবিলে।   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
লোকে জানে, আমি নিজে জানি সবচে’ বেশি, অতীতে বহুবার প্রেম-প্রেম খেলা খেলেছি বেপরোয়া জুয়াড়ির ধরনে এবং সেসব খেলা ভেঙে যেতে অধিক সময় লাগেনি।তোমাকে ভালোবাসার আগে, তোমার প্রেমের পূর্ণিমায় স্নাত হওয়ার আগে ধনীর দুলাল কায়েস ঐশ্বর্যখচিত খিমা ছেড়ে কেন ছিন্ন বেশে উদ্‌ভ্রান্ত ঘুরে বেড়িয়েছে শরীর শীর্ণ এবং পা রক্তাক্ত ক’রে লায়লা লায়লা ব’লে, ভাস্কর ফরহাদ কেন শিঁরির জন্যে নহর আনার উদ্দেশ্যে, নিজেকে দিনরাত উপোসী রেখে পাহাড় কাটার কাজে বিলীন করেছে, সওদাগর কেন মাহিওয়াল হয়ে নিজের উরুর মাংস কেটে পাঠিয়েছে সোহনীর উদ্দেশে, মালকা বানুর আশেক মনু মিয়া তার মাশুকের জন্যে কেন বারবার পেরিয়েছে মহেশখালী প্রণালী- এসব অসম্ভবের তাৎপর্য কখনো উপলব্ধি করিনি।কত দুর্গম পথ পেরিয়ে বিষধর সাপের ফণা থেকে মণি ছিনিয়ে এনে একটি মণিহার তোমাকে পরিয়ে আর তোমার ভালোবাসার চন্দন-তিলক ললাটে নিয়ে জেনেছি ভালোবাসা কারে কয়।   (তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
এখনও এখানে অশেষ পুঞ্জীভূত গ্রাম ও শহরে কুটির অট্রালিকায়, রাজপথে আর অলিতে গলিতে আর শহরতলিতে টিনশেড কলোনিতে মধ্যযুগের বেঘোর অন্ধকার।জংধরা এক টিনের তোরঙে ওরা পুরুষানুক্রমে রেখেছে ঊর্ধ্ব তুলে পোকা দংশিত আদ্যিকালের পুঁথি। কখনো সখনো অতি ভক্তিতে মজে জীর্ণ কেতাব মাথায় ঠেকায় শুধু।ছেঁড়া কাঁথা আর মলিন বালিশ পেতে ঘুমায় নোংরা ভাড়াটে বাড়িতে ওরা। সেই কবেকার তুরানী স্বপ্ন আজও কেরানি মনের তল্লাটে দ্যায় উঁকি। সাতপুরুষের ভিটায় ময়াল সাপ।আয়েশী স্বভাবে এখনও অটুট কিছু; অথচ অভাব পোষা বেড়ালের মতো পায়ে পায়ে ঘোরে। সোনাদানা, ঘটি-বাটি বন্ধক রেখে জুড়ায় জঠরজ্বালা, বসন্ত দিনে দেনায় ডুবেছে মাথা।শিরায় শিরায় জুয়োর বনেদী নেশা, বোঝে না নিজেই দাবার নিরঙ ঘুঁটি। আত্মায় জমে ইট-সুরকির কণা, হঠাৎ কখনো গহন সন্ধেবেলা মনে পড়ে যায় বনতুলসীর ঘ্রাণ।যুক্তিকে ওরা পাঠিয়েছে বনবাসে, এখানে চিরায়ু ভাববিলাসের যুগ।জ্ঞানীর বাণীতে কখনো পাতে না কান, শুধু চুমো খায় আলখাল্লায় তাঁর। নানা মরীচিকা দেখে দেখে কাটে বেলা।অতীতের পানা পুকুরে প্রেতের মতো সকাল-সন্ধ্যা বুড়বুড়ি কাটে মন। শ্যাওলা-বিছানো বদ্ধ পানিতে ভাসে রঙ-বেরঙের কিংবদন্তি কত, কিংবদন্তি লেহনে ধন্য ওরা।পঞ্জিকা আর গঞ্জিকা সম্বল করে ওরা ধরে গায়েবী ঘোড়ায় বাজি। চারপাশে জ্বেলে লোবান, আগরবাতি পুরানো ক্ষতের গন্ধ মুছতে চায়, হৃদয় ওদের উদ্ভট হানাবাড়ি।সম্মুখে খোল রাস্তার সংকেত, ওরা পড়ে যায় বিচ্ছিরিভাবে পথে, হাঁটুভাঙা ভীরু হরিণের মতো ধু-ধু ডানে বাঁয়ে দ্যাখে নেকড়ের শত চোখ। কে তুলবে টেনে কাদামাখা অবেলায়?   (উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
বেলী আর কনকচাঁপার গুঢ় সহবতে থাকি, বেশ আছি সর্ষে ক্ষেত, প্রজাপতি, শালুক, শামুক, দোয়েল ঘুঘুর সঙ্গে। কোকিলের সঙ্গে কুহু ডাকি নির্জন নেপথ্যেঃ কত বলাবলি-লোকটা কী সুখ পায় এতে? চুল খায় রূপালি আদর, রাতে ভালো ঘুম নেই, থাকি না কখনো হুজরায়। খোলা মাঠ, জোনাকির দাওয়াত কবুল করি, চাঁদের আলোয় ওজু সারি বারংবার। মধ্যরাতে পুকুরের ঘাটডেকে নেয় চুপিসাড়ে, দেখবো পরীর নাচ আর ঝিঁঝি পোকাদের সঙ্গে মাতবো জিকিরে সারা রাত। হরফের তসবি হাতে ঘুরি, প্রায় অলৌকিক বাজনার তালে নেচে উঠে দেখি অকস্মাৎ কী সুন্দর হাত আমার কপালে দেয় আলগোছে চন্দনের ফোঁটা; ফলত দিগন্তপানে একা ছোটা, নিরন্তর ছোটা।   (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
রূপক
এই তো হরিণ ছোটে, রত্নরাজি ওড়ায় সুতীক্ষ্ম খুরে, ফুলের মেঘের নরম সংকেত জেগে ওঠে; মুঞ্জরিত গুপ্ত ক্ষেত। আবেগের গলায় পা রেখে দেখেছিতো, তবু জলজ্যান্ত স্বর সোনালি ঘন্টার মতো বাজে চতুর্দিকে আর ঘর বাড়ি উল্টোপাল্টা ছুটে যেতে চায় আকাশের সুনীল মহলে। আপিশ ফটক ছেড়ে পথে নামি, ঠিক সন্ধে হ’লে, কখনো বা আরো পরে বাড়ি ফিরি, বাসের টিকিটে আলতামিরার চিত্র, শিং উঁচানো রৈখিক বাইসন, খিটখিটে বুড়োটা ভীষণ উক্তিময়, হঠাৎ চোয়ালে তার গাছের বাকল পরা রমণী ঝিকিয়ে ওঠে, নিসঙ্গ আমার কাঁধে। কড়া নাড়লেই দরজাটা যাবে খুলে যথারীতি, জামা- জুতো ছেড়ে লম্বা হবো কিছুক্ষণ। ঘনিষ্ঠ পা’জামা চোখের পলকে শূন্যে তাঁবু হয়, ওড়ে; কী প্রাচীন হ্ণদে ঝুঁকে মজি ছায়াবিলাসে, সহসা কারা যেন লাঠি ঠোকে কঠিন মাটিতে, আসে তেড়ে দুর্বার চাদ্দিক থেকে। আমি তো নিবিয়ে আলো শুয়ে পড়ি চাদরে গা ঢেকে।চোখ বুজলেই দেখি পিতৃপুরুষের কবরস্থানের খুব ডাগর ডোগর ঘাস, সবুজ ছাগল; ডাবা হুঁকো ক্ষিপ্র ডুব দিয়ে সরোবরে মানস হংসের মতো প্লুত শোভা রচনার পরে নাচতে নাচতে দোতারার কুয়াশায় আমার বাড়িটা একি প্রকাশ্যেই মহিলার মুখ হ’য়ে যায়।   (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
আকাশে চঞ্চল মেঘের কারুকাজ, বর্ষা সেতারের বাজালো ঝালা আজ। একটি সুর শুধু শুনছি ঘুরে ফিরে- সে সুর বাজে যেন আঁধার চিরে চিরে। বাইরে কিছু আর যায় না জানি দেখা, কোথাও কেউ নেই, ত্রিলোকে আমি একা।বজ্রে কেঁপে উঠি, বিরহ মেলে দল; হৃদয়ে ঝরে জল কেবলি অবিরল। কৌতূহলে হাত বাড়াই ডানে বামে, আঁধারে শূব্যতা, হতাশা বুকে নামে। বাইরে কিছু আর যায় না জানি দেখা, কোথাও কেউ নেই, ত্রিলোকে আমি একা।আমার পৌরুষ অবুঝ পাখি হয়ে আঁধারে মুখ রেখে কাঁদে না লোকালয়ে। তবুও মেঘেদের অকূল হুতাশনে স্মৃতির লোকালয়ে পড়ছে কাকে মনে? বাইরে কিছু আর যায় না জানি দেখা, কোথাও কেউ নেই, ত্রিলোকে আমি একা।আকাশ ঢেকে গেছে নীলাম্বরে আজ, ভাবছো কোন ছলে করবে তুমি সাজ? আপন অঙ্গ তো চেনাই হলো দায়। কী মেঘে বিদ্যুৎ লুকিয়ে ভীরু পায়? কেমন করে বলো নামবে তুমি পথে! পারতে যদি সেই নীলাম্বরী হতে!আমার অঙ্গনে সিক্ত এলোচুলে আঁচলে মুছে মুখ দাঁড়ালে নাকি ভুলে? আমার অঙ্গন আঁধারে হলো বন, নিয়েছি বুক পেতে জলের দংশন! বাইরে কিছু যায় না জানি দেখা, কোথাও কেউ নেই, ত্রিলোকে আমি একা।  (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
তোমরা যে কাজ করো দশজনে মিলে তাতে জিত হলে ভালো, হার হলেও কারোর লাজ নেই, এ কথাটা সুনিশ্চিত জানি, তাই তোমাদের সব চমৎকার ধুন্ধুমার বাজে নাক গলাতে আসি না। পথেঘাটে যাত্রীভরা বাসের ভেতর যদি বোমা ফাটে হঠাৎ, বলি না ঘরে বসে এ এ খবর মনঃপূত নয় মোটে। প্রতিদিন শহরে মিছিল বের হলে, যানজট যেখানে সেখানে বাধলে হামেশা চিড়বিড়ে বিরক্তির রাগী চিল প্রশান্তির গাঢ় নীলিমাকে, মন জ্ঞানে, আঁচড়িয়ে চঞ্চু দিয়ে ছিঁড়েখুঁড়ে এক সা করে না কস্মিনকালেও; যদি জ্বালাও-পোড়াও দাবি আদায়ের জন্যে, করো ঘেরাও কর্তাকে কোনো, বলবে না এ বান্দা কাজটা মন্দ হলো, সে-পথে চলেছ ঠিক সেই পথে চলো।তোমাদের কোনো কাজে বাগড়া দেবার অভিলাষে যদি কেউ দলে আমাকে ভেড়াতে চায়, চোখ মেলে দূরের আকাশে উদাসীন তাকে কথা দেবার বদলে স্রেফ সাত হাত দূরে সরে যাব আমি কিছুই না বলে। বলে রাখি, তোমাদের সঙ্গে আছি, যতই দোরে খিল ত্রঁটে বসে থাকি গহন একাকী।কারো সাতে পাঁচে নেই আমার নিজের কাজ যাতে করে যেতে পারি নিজ মনে চিরদিন বাধাবন্ধহীন, সেদিকে নজর রেখো, তাহলেই আনন্দের ভেলা। আমাকে ভাসিয়ে নেবে দ্বীপ-দ্বীপান্তরে।সারাবেলা কী কাজ আমার, যদি চাও জেনে নিতে, তবে ঘরে এসে দেখে যাও- পায়রা উড়িয়ে দিই যখন তখন, টবে ফুল ফোটাই সযত্নে ফ্ল্যাটে নিমেষে ময়ুরপঙ্খী নাও আর জলকন্যাদের ডেকে আনি, তুলি বিনা ছবি আঁকি সারাক্ষণ, স্বপ্নের বসতবাটি ফঁড়ে ধ্বনির ফোয়ারা জেগে ওঠে। সোনালি কপাট খুলি রহস্যের আর ঘুরে ঘুরে কেবলি পাল্টাতে থাকি সবকিছু। বিরহিণী রাধা বসে থাকে আমার চেয়ারে ফরহাদ নহর বানায় ঘরে, তানসেন চকিতে আনেন পূর্ণ চাঁদ, মেঘমালা। দোহাই, আমার এই কাজে কখনো দিও না বাধা।   (না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
সবুরে ফসবে মেওয়া, না ফসলেও নেই ক্ষতি। তুমি শুধু মাথা নীচু করে রোজ তোমার টেবিলে উপবাসী সিদ্ধার্থের মতো স্থির হও; দূর নীলে তোমার দখন থাক চিরকাল, কলমের গতি, মনে রেখো, যেন রুদ্ধ না হয় কখনো। যদি নতি সহজে স্বীকার করো ক্ষমাহীন শব্দের নিখিলে, যদি না বন্ধন ছিঁড়ে আনো নব্য মায়া ছন্দে মিলে, তাহলে বলবে লোকে এ-কবির কাব্যে নেই মতি!কিছুই হলো না বলে করো না আক্ষেপ কোনোদিন হে বন্ধু তুমিতো জানো জীবনানন্দের পায়ে পায়ে ঘোরেনি ফ্যাশনদীপ্র লাস্যময়ী ললনার ঝাঁক ভুলেও কখনো কিংবা নিজের ভবন দ্বিধাহীন দেননি নির্জন্সে কবিকে ছেড়ে আলৌকিক দায়ে ঐশ্বর্যশালিনী কেউ। তাই বলি, ক্ষোভ মুছে যাক।   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
স্বদেশমূলক
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ? আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো, সিঁথির সিঁদুর গেল হরিদাসীর। তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা, শহরের বুকে জলপাইয়ের রঙের ট্যাঙ্ক এলো দানবের মত চিত্কার করতে করতে তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা, ছাত্রাবাস বস্তি উজাড় হলো। রিকয়েললেস রাইফেল আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র। তুমি আসবে ব’লে, ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম। তুমি আসবে ব’লে, বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভূর বাস্তুভিটার ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে একটানা আর্তনাদ করলো একটা কুকুর। তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা, অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিলো পিতামাতার লাশের উপর।তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ? আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ? স্বাধীনতা, তোমার জন্যে এক থুত্থুরে বুড়ো উদাস দাওয়ায় ব’সে আছেন – তাঁর চোখের নিচে অপরাহ্ণের দুর্বল আলোর ঝিলিক, বাতাসে নড়ছে চুল। স্বাধীনতা, তোমার জন্যে মোল্লাবাড়ির এক বিধবা দাঁড়িয়ে আছে নড়বড়ে খুঁটি ধ’রে দগ্ধ ঘরের।স্বাধীনতা, তোমার জন্যে হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী শূন্য থালা হাতে বসে আছে পথের ধারে। তোমার জন্যে, সগীর আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক, কেষ্ট দাস, জেলেপাড়ার সবচেয়ে সাহসী লোকটা, মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি, গাজী গাজী ব’লে নৌকা চালায় উদ্দান ঝড়ে রুস্তম শেখ, ঢাকার রিকশাওয়ালা, যার ফুসফুস এখন পোকার দখলে আর রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুড়ে বেড়ানো সেই তেজী তরুণ যার পদভারে একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হ’তে চলেছে — সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জলন্ত ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে, মতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক এই বাংলায় তোমাকেই আসতে হবে, হে স্বাধীনতা।
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
অনেক শতাব্দী জুড়ে প্রতিক্ষণ আমার হৃদয় বস্তুত স্পন্দিত হচ্ছে তোমার জন্যেই। বিষণ্নতা প্রত্যহ আমাকে ঘাট থেকে ঘাটান্তরে নানা কথা জপিয়েছে, চেয়েছে ফেলতে মুছে ধ্যানের সময়, যাতে ভুলে থাকি তোমাকেই, তবু আমি সুনিশ্চয় ভ্রমের গোলকধাঁধা আর বহুরূপী বিরূপতা উজিয়ে বিস্ময়ে দেখি গোধূলিতে তুমি অবনতা বঙ্গোপসাগর তীরে আমার জন্যেই, মনে হয়।কখনো মহেঞ্জোদারো অথবা কখনো মথুরায় ছিলে, পায়ে মল বেজে উঠতো মধুর নিশাকালে, কখনো সমরখন্দে, কখনো বা বোখারায় জানি সুরতের রোশ্‌নি তোমার শায়েরের তারানায় ঝলসাতো বারবার। কখনো বাংলার মত্ত খালে বাইতে মহুয়ারূপে আমারই উদ্দেশে তরীখানি।   (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
আড়ালেই থাকি, ত্রস্ত সর্বদাই; ব্যস্ত ভিড় ঠেলে কবুই ভরসা ক’রে সম্মুখে এগিয়ে যাওয়া আজো হলো না আমার। পাদপ্রদীপের আলো কোনোদিন পড়বে না মুখে জানি। তা ব’লে ভাগ্যের কথা তুলে বারোমাস কাউকে দিই না দোষ। হাটে মাঠে নয়, মৃদু আলো-আঁধারিতে গৃহকোণে একা একা কাটেপ্রায়শ আমার বেলা। খেয়ালের বশে বাস্তবের সঙ্গে খেলি কানামাছি-লেখার টেবিলে অকস্মাৎ দেখে ফেলি ডোরাকাটা উদ্দাম জেব্রার দল কিংবা গন্ডারের একরোখা দৌড়, কখনো লেগুন নম্র ওঠে জেগে আদিম জলের মায়া নিয়ে। স্নানার্থিনী কটি থেকে দেয় ছেড়ে প্রাচীন বাকল, প্রেমবিদ্ধ বংশীবাদকের সুরে পাথর, মরাল আসে ছুটে, সিংহ আর মেষ থাকে শুয়ে পাশাপাশি, কখনো বা জিরাফ বাড়ায় গলা বইয়ের পাহাড় ফুঁড়ে, দেখি বারংবার টেবিলের ইন্দ্রজালঃ ট্রয়ের প্রাচীর শালের ঘর্মাক্ত আলোয় বড়ো বেশি নিঃস্ব, যেন প্রেতপুরী; এক কোণে বাংলার মাটিলে ঘর প্রস্ফুটিত, অন্যদিকে পদ্যাক্রান্ত নিশি-পাওয়া কাফে।বইয়ের পাতায় খুঁজি মুক্তির সড়ক বদ্ধ ঘরে প্রত্যহ, তত্ত্বের ঢক্কা নিনাদে কখনো কানে মনে লাগে তালা; অহর্নিশ মননের রৌদ্রজলে বাঁচা সার্থক মেনেছি, তবু জানি সারাক্ষণ দর্শনের গোলক ধাঁধায় ঘুরে তথ্যের খড়-বিচালি ঘেঁটে ক্লান্ত লাগে, বুদ্ধির সম্রাট ভয়ানক মুখোশের আড়ালে প্রচ্ছন্ন থেকে হানেন সন্ত্রাস। বাস্তবিক মননে থাকলে মেতে সর্বদা অথবা শিল্পে ম’জে রইলে অগোচরে মনে জটিল অরণ্য জেগে ওঠে, জীবন-বিরোধী শ্বাপদের খুরে মগজের কোষ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। তাই বদ্ধ ঘর ছেড়ে দূরে মাঝে-মধ্যে যাওয়া ভালো, ভালো সূর্যাস্তের স্তবময় টিলায়, নদীর শান্ত বাঁকে যাওয়া। তবে মননেও খেলবে উদার হাওয়া, শিল্প হবে দীপ্র, মানবিক।   (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
রূপক
এ শহর ছেড়ে দূরে কোথাও এখন চলে যাওয়া ঠিক হবে কিনা ভাবি। আট দশ দিন ধরে জ্বরোভাব, বিপন্ন মাড়িতে জীবাণুর সংক্রমণ, কুষ্টিয়ায় কবি সম্মেলন, লালনের উৎসবে এবার যাওয়া হবে না আমার। বিছানায় শুয়ে শুয়ে দেখি বিকেলের গায়ে-হলুদ এবগ্ন ‘গেরস্তের খোকা হোক’ বলে একটি অদৃশ্য পাখি বিকেলের থুতনি নাড়িয়ে সন্ধ্যার সন্ধ্যানে চলে যায়। চকিতে তোমার কথা মনে পড়ে, প্রাণোচ্ছল হাসি খেলা করে আমার এ শূন্য ঘরে।সেদিনের বিকেল ছিল কি যে-কোনো বিকেল? হাওয়া ছিল, পাতাগুলো কম্পমান, শারদ রোদ্দুর জানালায় নীরব কথক। টেলিফোন বেজে ওঠে; মদন ভস্মের বহু আগেকার স্বর ফোটে জ্যোৎস্নাছায়াময় ঝরনার ঝলক নিয়ে, বলে- ‘যদি চাই একটি কবিতা, দেবে তুমি? হবে কি সময়? নিরুত্তর বসে থাকি কিছুক্ষণ। অকস্মাৎ আমার ভেতর থেকে কেউ, খাপছাড়া, নিঃশব্দে বেরিয়ে গিয়ে বসে সোফাটায় তোমার একান্ত মুখোমুখি, দু’চোখে স্বপ্নের বীজ রুয়ে তুলে নেয় দ্বিধাহীন তোমার নরম হাত। স্পর্শের আবেশে লোকটা রূপান্তরিত, গোঙানির মতো শব্দ কিছু করে উচ্চারণ, ‘তোমাকে ফেরাতে পারি, শিখিনি সে মন্ত্র কোনো দিন’ সত্যি বলতে কী লোকটার আচরণে ক্রমশ কুঁকড়ে যেতে থাকি। ক্ষমা করো, উন্মাদের বুলি উপেক্ষার চেয়ে বেশি কিছু আদায়ের যোগ্য নয়, তুমি তার দোষে আমাকে দিও না শাস্তি। তোমার আয়ত্ত চোখের মায়ায় ছেয়ে যাক স্বপ্নজাত আমার আকাশ। এ কেমন দোটানায় পড়ে গেছি; নিজেই কবিতা তুমি, তবু কেন চাইলে কবিতা, যখন অসহ্য দাহে পুড়ে যাচ্ছি আপাদমস্তক। এই নাও, আমার যেমন ইচ্ছে রুপালি পালক কিছু তুলে নাও, আমি শুধু আগুনের মধ্যে বসে নিরিবিলি দেখব কুড়ানো।   (না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
এই তো আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি, গাছের পাতা বলেছে, গৌরী। আমার ঘরের জানলার পর্দা দুলিয়ে হাওয়া বলে যায়, গৌরী। ভাশমান মেঘমালা মেদুর স্বরে বলে, গৌরী। আসমান-পেরুনো পাখির ঝাঁক নীলিমার কানে কানে আওড়ায়, গৌরী। পাশের বাড়ির বাগানে ফুল ফুটেই জপে, গৌরী।আমার বারান্দার ঝুলন্ত ফুলের টবে এসে বসা প্রজাপতি বলে, গৌরী। আমার বুক শেলফের বইগুলো সমস্বরে আলো-ঝরানো স্বরে বলে, গৌরী। আমার লেখার টেবিল কণ্ঠে আনন্দ-লহরী জাগিয়ে বলে, গৌরী। আমার কবিতার খাতা বাউলের মতো দোতারা বাজিয়ে নেচে নেচে গেয়ে ওঠে, ‘এমন মানব-জনম আর কি হবে, কতদিন এই হালে যাবে, আমার মনের মানুষ গৌরী। আমার প্রতিটি নিঃশ্বাস, প্রতিটি হৃৎস্পন্দন আর রক্তকণিকা মনসুর হাল্লাজের মতো জপে গৌরী, গৌরী, গৌরী…   (তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রকৃতিমূলক
তখন ও চাঞ্চল্যে ক্ষিপ্র হয়নি শহর, ট্রাফিকের কলতান বাজেনি প্রবল সুরে। টলটলে স্নিগ্ধশ্যাম ঐ পার্কের শরীর ঘেঁষে যাচ্ছিলাম হেঁটে দ্রুত পায়ে বর্ষাতিটা গায়ে চেপে। সহসা সরিয়ে বৃষ্টির ঝালর একজন হাত রেখে নিঃশব্দে আমার কাঁধে বললেন গাঢ় উচ্চারণেঃ“কোথায় ছুটেছো তুমি হন্তদন্ত হয়ে পরিশ্রমী নাগরিক এমন বর্ষায় ? বরং পার্কের বঞ্চে সময় কাটাই চলো কথোপকরনে, চলো পার্কে বৃষ্টির আদর মাখি চোখে-মুখে, সেখানে তুমিও সুম্নাত গাছের সখ্য পাবে, হাওয়ার অশ্রান্ত ম্যাণ্ডোলীন শুনে বেঞ্চটাকে মনে হবে সাধের গণ্ডোলা।“এবং তোমাকে বলি শোনো, বার বার যূথীর সান্নিধ্যে যাওয়া ভালো; মাইল মাইল পথ বেলা-অবেলায় হেঁটে দেখেছিতো শেষে সে-পথ কোথায় নিয়ে যায়, কী কল্যাণ হাতে আসে! ট্রাম-লাইনের ধারে সুকৌশলে হয়তোবা, অপঘাত যেখানে গা ঢাকা দিয়ে থাকে সিঁধেল চোরের মতো। ট্রাম-লাইনের ক্ষীণ ঘাসের সম্মোহ ফুরোয়নি বলে আমি শুনলাম ডাক সেই রৌদ্রের নিশির, এবং নিমেষে ভাসলাম কী রক্তিম সারোবরে!“মাইল মাইল পথ হেঁটে দেখেছি তো অবশেষে সে-পথ কোথায় নিয়ে যায়, কী কল্যাণ হাতে আসে! পরিশ্রমী নাগরিক দাঁড়াও এখানে ক্ষণকাল স্তব্ধতায়, বর্ষায় নিমগ্ন হও, নিসর্গকে করো তীর্থভূমি” এই বলে প্রবীণ জীবনানন্দ পার্কের শরীর ঘেঁষে একা কোথায় গেলেন দূরে।জনশূন্য ফুতপাতে চির নিঃসঙ্গতা মুর্হূতে চোয়াল দিলো মেলে আমন্ত্রণে; চতুর্দিকে অনাসক্ত বৃষ্টি পড়ে, বর্ষাতির আড়ালে শরীর সকল বিফল হলো ভেবে ফিনকি হয়ে যেতে চায় মেঘদলে। দেহ ছাড়ি যেন মোর প্রাণ চলি যায়- অকস্মাৎ বাতাসে এ কার হাহাকার?ঝড়ের নদীতে একা টলমল নৌকোর মতোই ভেসে চলি তিমির দুরন্ত ফুটপাতে। চলতেই শঙ্কিল পঙ্কিল বাট, ঘন-ঘন ঝন-ঝন বজ্র নিপাত। আকাশের কাজল ট্যাঙ্কের থেকে জল ঝরে অবিরল, বৃষ্টি পড়ে সমস্ত শহরে, বৃষ্টি পড়ে অপরূপ স্বপ্নের চত্বরে। মনে হয় যুগ-যুগ ভিজে ভিজে সত্তায় জমেছে দামী, অনুপম শ্যাওলার কারুকাজ, মৎস্য-ঘ্রাণ, আর সহসা নিজেই যেন হয়ে যাই বৃষ্টিভেজা রাত্রির শহর!অগ্রজ কবির মন্ত্রণায় নিসর্গকে তীর্থভূমি জ্ঞানে দ্রুত যতোটা এগোই তারও বেশি নিশ্চিত পিছিয়ে পড়ি বিতৃষ্ণায়, আর চিরকেলে বর্ষার জানুতে মাথা রেখে রেখে বড়ো ক্লান্ত লাগে। চোখে-মুখে একরাশ বৃষ্টির আঁচড় নিয়ে ঐ স্নিগ্ধশ্যাম পার্ক ছেড়ে চলে যাই, বিরক্তিতে ভরপুর, অস্তিত্বের শীর্ষে ক্ষান্তিহীন বৃষ্টি ঝরঝর ব’য়ে ইহুদির মতো সর্বদাই ধাবমান, নৈঃসঙ্গ্যের কাঁটায় জর্জর।   (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
আচমকা কুয়াশা-কাফন চকচকে দুপুরেই গিলে ফেলে আমাকে চলিষ্ণু ভিড়ে। কয়েকটি হাত লুফে নেয় আমার শরীর এক লহমায় পথের কিনার থেকে এবং ঠেলতে শুরু করে কে জানে কোথায়। এ রকম আচানক ঘটনায় ভীষণ বিব্রত, বলা যেতে পারে, বিপন্ন বোধের দখলে আটকে পড়ি। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন দু’টি চোখ জ্বালা করে।কতিপয় মুণ্ডহীন অস্পষ্ট শরীর বয়ে নিয়ে চলেছে আমাকে কোথায় যে, বোঝা দায়। জীবিত কি আমি, নাকি লাশ হয়ে আজব কবন্ধদের কাঁধে শুয়ে যাচ্ছি লাশকাটা ঘরে? এখানে উত্তর দাতা কেউ নেই।আমি কি দেখছি পথে আমারই রক্তের ফুলঝুরি সত্য ভাষণের অপরাধে? হায়, বেলা অবেলায় ক্রুশবিদ্ধ প্রাণহীন শরীর আমার দেখছে কি কৌতূহলী নরনারী? কে এক সুকণ্ঠী শিল্পী গান গেয়ে আসর মাতাতে গিয়ে খুব বেসুরো আওয়াজ তুলে মূক হয়ে যায়। একজন খ্যাতিমান চিত্রকর সুসময় ফুটিয়ে তোলার রঙে দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকে ফেলে।পদে পদে ইচ্ছাকৃত ভ্রম ঘটে সমাজের বিভিন্ন সারিতে, ফলত কান্নায় ভাসে অসহায় নরনারী। গোল টেবিলের অট্রহাসি কনসার্ট হয়ে বাজে যখন তখন! আহা মরি! অমূল্য কাগজে ঘন ঘন দস্তখত চলে নানা ছাঁদে আর কুয়াশা-কাফন নামে, নামতেই থাকে জগতের নানান অঞ্চলে। আমি কোথায় এখন? মার্গে? নাকি ধু ধু চরে?    (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
মধ্যরাতে আচমকা ঘুম থেকে জেগে দেখি- আমার ডান হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এগোচ্ছে দেয়ালের দিকে। ভীত, সন্ত্রস্ত আমি চোখ বুজে থাকি কিছুক্ষণ। আবার চোখ মেলতেই বিচ্ছিন্ন হাতকে দেখি দেয়াল আর ছাদ ভ্রমণের তোফা জায়গা ঠাউরে নিয়েছে।বেহাত আমি কাকে ডাকবো গহন রাতে? চেঁচাতে গিয়ে বেজায় নির্বাক হয়ে শুধু পড়ে থাকি বিছানায়। হঠাৎ মনে হয়, এ কি! আমার নিজের ভাষা, অন্য যে-ভাষা জানা আছে-সবই বিস্মৃতির তিমিরে নিমজ্জিত। কিছু বলতে গেলে জাগছে অবোধ্য শব্দের বেখাপ্পা কিছু ধ্বনি। আমাকে নিয়ে এ কেমন খেলা চলছে? চৌদিকে আজব সব ছবি ভাসছে, ডুবছে বারবার। দেয়াল ভেঙে পড়ছে এদিক সেদিক। আমি আর আমি নই।আমাকে ঠুকরে খাচ্ছে কয়েকটি আজব মিশকালো কাক। কখন থেকে পড়ে আছি এঁদো কাদায়, বলা দায়। আমাকে এখানে এনেছে কারা-কেউ কি বলে দেবে? অস্থিরতা চেপে ধরেছে! বীভৎস শব্দ সব ধেয়ে আসছে চতুর্দিক থেকে। কারা যেন আমার শরীর থেকে খসিয়ে নিচ্ছে মাংস, কতিপয় ক্ষধার্ত শকুন সোৎসাহে ধেয়ে আসছে নেমে আমার দিকে।এ কি! আমার শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে কিয়দ্দূরে বিষণ্ন এক বটগাছের প্রায় শরীর ছুঁয়ে নাচতে শুরু করে। অথচ আমার শ্বাসপ্রশ্বাস বইছে রীতিমতো। উপরন্তু আমার মনে অসমাপ্ত কবিতার কয়েকটি পঙ্‌ক্তি গজিয়ে উঠলো গাছের সতেজ পাতার মতো স্বচ্ছন্দ, অনাবিল। পাশেই ধ্বনিত পাখির গান।   (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
চায়ের দোকানে বসে মেঘলা সন্ধ্যায় অকস্মাৎ সাধ হয় রবীন্দ্রনাথের মতো চুলদাড়ি রেখে প্রেমিক সন্ন্যাসী হয়ে রূপোর মতোন কিছু ভস্ম আলতো বুলিয়ে দিই রুক্ষ জীবনের গালে। আমারও মুখমণ্ডলে উপনিষদের আভা বেশ মিশ্চিন্ত করুক খেলা সারাবেলা, সাধ হয়। কয়েকটি টক বিস্কুটের গুঁড়ো পড়ে থাকে বিবর্ণ পিরিচে।উড়ছে গেরুয়া আলখাল্লা কালপুরুষের তলোয়ারে গাঁথা, ধর্মকর্ম কতকাল করি না হে, বাতাসের কিছু কি প্রবল নড়বে ভাবো কোনোদিন? বলা কওয়া নেই, যেতে হয়, সবাইকে যেতে হয় শৌচাগারে আর শবাগারে। চায়ের দোকানে বসে চেনা অচেনা মুখের ভিড়ে এ রকম ভাবনার পাড়া ঘুরে বেড়াতে লাগে না মন্দ কখনো সখনো।চায়ের দোকানে বসে মেঘলা সন্ধ্যায় খিস্তি খেউড়ের মাঝে রবীন্দ্রনাথকে কেন টেনে আনা মিছেমিছি? বিশেষত তার চুলদাড়ি বিষয়ে নীরব থাকা ভালো। অন্য কিছু ভাবা যাক, আমাদের দীর্ঘশ্বাসে যাক বয়ে কিছু সিক্ত যুথী গন্ধ, মগজের অন্তর্গত আকাশে উড়ুক আমাদের পোড়খাওয়া জীবনের বেদনার সাথী। যে বিদায় অকস্মাৎ এসেছিল নেমে ভরসন্ধ্যার মতোন, তার কথা ভেবে নিজেকে পোড়াই পুনরায়। কেন তার কথা মনে পড়ে সারাক্ষণ, কেন? খোলা আকাশের নিচে তার ওষ্ঠে, মনে পড়ে, খেলা করছিল সোমত্থ বিকেল, তৃষ্ণার্থ যাত্রীর মতো আমি সেই ওষ্ঠস্থিত অপরাহ্ন চুমুকে চুমুকে পান করতে গিয়ে প্রতিহত, হঠাৎ সে সরে গিয়ে বলেছিল ‘চুম্বনে আশ্লেষে শোনো, আমাকে খুঁজো না তুমি খুঁজোনা কখনো, আমার আপন মনোলোকে আছো তুমি, থাকবে সর্বদা’। ভিজিয়ে চোখের জলে সত্তা সে আমার হাত নম্র ছুঁয়েছিল, তখন আকাশে ছিল বিদায়কালীন রুমালের মতো পাখি থর থর। আমি সে ভুবনে আজ, মানে তার মনোলোকে, পড়ে আছি একা (হৃদয়কে চোখ ঠারি) ছিন্নবেশ রুক্ষকেশ সন্তের মতোন উপবাসে। আমাকে করছে রান্না সর্বক্ষণ ভীষণ আনাড়ি পাচকের মতো কেউ। কে সে? কে সে? বলে আমি বিচ্ছেদের বালি মুখে পুরি চায়ের দোকানে বসে রবীন্দ্রনাথের মতো চুলদাড়ি রেখে প্রেমিক সন্ন্যাসী হয়ে যেতে চাই দেশ দেশান্তরে বাদ্য বাজাতে বাজাতে পথপ্রান্তে নদীতীরে, ফুটপাতে, টার্মিনালে এবং ছড়াতে চাই ভস্ম জীবনের মুখের উপর, মরণের চোখে, (মরণরে, হে মোর মরণ) দুনিয়াদারির কোনো তোয়াক্কা না রেখে অলৌকিক জমিদারি ঔদাস্যে বেড়াই খুঁজে, এক জোড়া রণপা কোত্থেকে এসে যায়।স্বপ্নের মতোন ভেসে ওঠে পথরেখা, ছিন্ন স্মৃতির মতোন দৃশ্যাবলী, আমি ফুটপাত, ত্র্যাভিনিউ, মজা খালবিল লঞ্চ টার্মিনাল, বাস ডিপো আর বনবাদাড়, আঁধার জমিজমা, চকচকে ফ্ল্যাটে আর কোঠাবাড়ি, গোচারণ ভূমি পায়ের অনেক নিচে রেখে হেঁটে যাই, হেঁটে যাই, হেঁটে যাই কেমন চিত্রিত মুখে, মাথার উষ্ণীষ মেঘলগ্ন; কেবল জ্বলতে থাকে মাথার উপরে ধ্রুবতারার মতোন তার চোখ, বিপরীত জীবনের লোভ। বেলাশেষে লঘু প্রজাপতিদের মোহন বিক্ষোভ দেখে লাস্যময় সময়ের কথা ভাবি, ভাবি কোন পথ কোন দিকে যায়, কতদূর যায়? বিপুল জ্যোৎস্নায় কাক কেন মাথা কোটে বৃক্ষমূলে পত্রালি অস্থির কেন হয়? আমার বিরুদ্ধে কেন কথা বলে বারংবার আমারই হৃদয়?   (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
একটি বালক তার রঙিন মার্বেল খুঁজে খুঁজে প্রায় দিনশেষে কৈশোরের ঘাটে এসে বসে। জলস্নেহ কাছে ডাকে, তিনবার দিল ডুব সূর্য ডোবার আগেই। কিশোরের স্নাত চিকন শরীরে পলক না পড়তেই যুবকের সুঠাম শরীর, জল ছেড়ে ওঠে জ্বলজ্বলে তরবারি। যুবক নিয়ত হাঁটে একা একা অচিন উদ্যানে, কে এক অধরা তাকে গহন ভাষায় দূরে ডেকে নেয়, হৃদয়ের রত্নরাজি যত্নভরে দেখায় এবং নিভৃত উদ্যানেশ্বারী সপ্তপদী চালে বিভ্রম জাগায়। পর্যটনপ্রিয় যুবা একজন প্রৌঢ়ের ভেতরে যাত্রা করে, বিপরীতগামী এক উদাস পথিক তাকে হেসে মরমী পুস্তক দেয় উপহার।একটি গাছের নিচে বিকেলের সুমন্ত আলোয় মুগ্ধ প্রৌঢ় করে পাঠ মরমী পুস্তক, ভাবে সে সন্ন্যাস নেবে, চাখবে অশেষ নির্জনতা, ফলমূল খেয়ে করবে জীবন ধারণ। নিজেকে বিভক্ত করে কয়েকটি ভাগে অগোচরে- এ ওকে টানতে থাকে নিজের নিকট; কেউ লোকালয়ে যায়, কেউ ধায় বিজন ভূমিতে, দ্রুমতলে দ্রুত তালে নেচে ওঠে মরমী পুস্তক।   (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
অন্ধকার ঘোর অন্ধকার উবু হয়ে বসে আছে হতাশার কোলে, ধসে-যাওয়া ঘরবাড়ি ভাঙাচোরা থামগুলি দুঃস্বপ্নের স্মৃতি নিয়ে অবনত, মধ্যরাতে এমিয়ার কপোতেরা এক সঙ্গে আর্তনাদ করে। য়ূরোপের আত্মাহিম শীত নেমে আসে হা-হা স্বরে এমিয়ার ঘরে ঘরে, খানিক উত্তাপ সকলের প্রার্থনার প্রধান প্রস্তাব, মৃত্যু অন্তরালে হাসে বাঁকা হাসি; জানে তরুপের তাস তার হাতেই গচ্ছিত। গ্রন্থপাঠ, সমাজের যাবতীয় রীতিনীতি বেবাক অসার। সর্বনাশ গ্রাস করে দশদিক, সর্পাহত অক্ষর সাজায়।ভ্রান্তি পথপ্রদর্শক জেসে খুব দ্রুত হেঁটে যায়, অনুসারীগণ অন্ধকারে, কেবলি হোঁচট খায় খানাখন্দে, কেউ কেউ ভীষণ আটকে পড়ে কাঁটাবনে, যে গ্রন্থের পাতা ওরা ছিঁড়ে ছিঁড়ে হাওয়ার উড়িয়ে দিয়েছিল, তার প্রয়োজন তীব্র বোধ করে অনুশোচনায়, উত্তুরে হাওয়ার দিকে দগ্ধ মুখ রাখে। শক্রতায় উন্মুক্ত আক্রোশে যে মূর্তিকে করেছে আঘাত, তাকে সম্ভ্রমের পতাকা জড়িয়ে আবার করাবে দাঁড় অনেক উঁচুতে, মনে হয়। তখন নক্ষত্রপুঞ্জ মহিমার সুর হয়ে বাজবে ব্যাপক, ধূর্ত শেয়ালেরা, নেকড়ের পাল বেদিশা পালাবে বহুদূরে, এশিয়ার ঘরে ঘরে উঠবে জ্বলে প্রকৃত জ্ঞানের শিখা আর কবির হরফ হবে নব্য মানবের স্তব, নিত্য সহচর।   (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
কে যেন অনবরত ডাকছে আমাকে বেজায় উচ্চস্বরে, যেন এভাবে না ডাকলে মাথার বাজ পড়বে, চতুর্দিকে আগুন জ্বলবে, পুড়িয়ে ছারখার ক’রে দেবে নিমেষে সবকিছু। বেজায় মুশকিলে প’ড়ে গেলাম যেন। কখনও ডানে, কখনও বামে ছুটে যাই, চিৎকার করতে গিয়ে গলা যায় বন্ধ হয়ে, কখনও ছুটতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে প’ড়ে যাই।খানিক পরে মনে হয়, কারা যেন আমার দিকে এগিয়ে আসছে আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য আর আমি মাটিতে প’ড়ে গোঙাচ্ছি, ফেটে-যাওয়া আমার মাথা থেকে ঝরছে রক্তধারা।গোঙাতে গোঙাতে কখন যে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, কিছুতেই স্মৃতিপটে ভাসাতে পারছিলাম না। কে আমি? কোথায় জন্মস্থান আমার- কোনওকিছুতেই ভেসে উঠছে না স্মৃতির পরদায়। কে আমি? কী ক’রে এলাম এখানে?ঘোর অন্ধকার ঘিরে ধরেছে আমাকে। মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছি। আমি কি পাগল হয়ে গেলাম? কীভাবে আমার উদ্ধার হবে? আমি কি মনুষ্যত্বের আড়ালে থেকে যাব কোনও?  (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
রূপক
এখন নখরাবাজি ছাড়। লচ্‌ খাওয়া হয়ে গেছে অনেক আগেই; সেই কবে থেকে জোমে আছি আর তোমার জন্যেই আজ আমি এমন উঠাইগিরা। তোমার অশোক ফুল ফোটা পড়েছে আমার চোখে বহুবার, বহুবার দেখেছি ঝুল্‌পি, ছাতি। জিভ ভ্যাঙচানো; বুলিয়েছি হাত ঝাপে। জোড়-খাওয়া তা-ও হয়েছে অনেকবার হে চামর খেপ্‌লু আমার। আমিতো কপাল ফেরে ভিড়েছি তোমার মারকাটারিঅন্দরখানায়। আচমকা থেমে পড়ি, ফের গোড়া থেকে করি শুরু আর এক পা এক পা চলি; তুমি কাছে না থাকলে বলো কী করে হাওয়ায় গেরো বাঁধি? কেন তুমি মাঝে-মধ্যে খামোকা বাতেলা দিতে চাও? আন্‌সান্‌ কথা রাখ চনমনে মেয়ে যদি তুমি আমার এ খোমা-বিলা দেখে সবকিছু গুবলিট করে দিতে যাও, তবে কেন নিয়েছো আমার ছল্‌লা ঘন-ঘন কান্‌কি মেরে? চুস্‌কি তুমি, সাতঘাটে ঘুরেফিরে বেড়ানোই কাজ; স্থিতু হয়ে বসতে পারো না কোথাও সামান্যক্ষণ। এখন হঠাৎ ঠাণ্ডা পানি হবে তুমি, তা হবে না। কেননা হেকোরবাজ নই আমি আজো, যদিও ঢ্যাম্‌না বলা যায় ইদানীং।   (আমার কোন তাড়া নেই কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
ফাঁদ তো পাতাই থাকে নানাদিকে, পা হড়কে আটকে পড়াটা অসম্ভব কিছু নয়। চৌদিকে ইঁদুর-দৌড় খুব জমেছে দেখতে পাচ্ছি, কে কাকে কনুই দিয়ে গুঁতো মেরে আচানক নিজের জবর গলা সম্মুখে এগিয়ে দিয়ে বাজি জিতে নেয়া, হৈ-হুল্লোড়ে মেতে ওঠা কেল্লা ফতে বটে।কথাগুলো কোথায় কখন ঠিক কে যে শুনিয়েছিলেন, মনে পড়ছে না। উচ্চারিত কথামালা কোন্‌ সন্ধ্যাবেলা দুলেছিল, খুঁটিনাটি সবই বিস্মৃতির ডোবায় পচছে। আজকাল মগজ বেবাক ফাঁকা, উপরন্তু অসংখ্য কাকের হাঁকডাকে একান্ত নিভৃতচারী কোকিলের গান ডুবে যায়। কে যে কোন্‌দিন মুখে চৌকশ মুখোশ এঁটে নিয়ে দাঁড়াবে সম্মুখে এসে নিশ্চয়তা নেই, সেই মূর্তি দৃষ্টি পথে পড়লেই নির্ঘাৎ ভড়কে উঠে মূর্চ্ছা যাব আর প্রেতদের হাসি আঁধারকে অধিক আঁধার করে তুলবে চৌদিক, দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে ওরা আর মনুষ্যত্ব সম্ভবত দু’হাতে ঢাকবে মুখ অসহায় বালকের মতো।রাত সাড়ে তিনটায় বুড়িগঙ্গা নদীটির নিদ্রিত যৌবন অকস্মাৎ জেগে উঠে তীর ছাপিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে পথে, বেপরোয়া আবেগে রাস্তার পর রাস্তা বেয়ে ঠিক প্রবল চুম্বন করে লালবাগের কেল্লাকে আর ছুটে গিয়ে একুশের শহীদ মিনারে মাথা ঘষে, আসমান নেমে এসে খুব নিচে মিনারকে করে আলিঙ্গন।অপরূপ এই দৃশ্য কেউ দেখল কি দেখল না, এই সত্য জানলো কি জানালো না-বুড়িগঙ্গা, কেল্লা অথবা শহীদ মিনারের কাছে শাদা কাগজের মতো অবিকল। আলোকিত এই দিন নয়তো নির্বাক; কল্যাণ, প্রগতি আর চিরসুন্দরের জয়ঢাক সবদিকে বাজাতে আগ্রহী আজও পঁচিশে বৈশাখ।   (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
মিয়ে ছিলাম ঘরে একা; আচমকা ঘুম ছিঁড়ে গেলে পর মনে হলো কে যেন ঝাঁকুনি দিয়ে জোরে ভাঙালো আমার শান্ত, গাঢ় নিদ্রা; বিচলিত হয়ে খুঁজি কাকে? কোন্‌ সে মানব অথবা মানবী, যার মুখ দেখার আশায় দ্রুত শয্যা ছেড়ে উঠে দোর খুলে দৃষ্টি বুলোই চৌদিকে।না, কোথাও নেই চিহ্ন কারও; বহুদূর থেকে কান্না ভেসে আসে অথচ নিকটে ঘরবাড়ি নেই কোনও। তা’হলে কি আকাশের মেঘমালা থেকে মানবীর ক্রন্দনের মতো ধ্বনি ঝরছে আমার শ্রুতিতে অথবা দূরে কোনও রুগ্ন, বিরহী যুবক বাঁশিতে তুলছে কান্নারূপী সুর উন্মাতাল হয়ে।কিছুতে আসে না ঘুম। মনে হলো, যুগ যুগ ধরে এভাবেই নিদ্রাহীন থাকবো এখানে বিরানায়। ভুলেও এখানে কেউ আসবে না, কারও কোনও কথা শোনার সুযোগ হয়তো-বা কোনওকালে মিলবে না কিছুতেই। পশু, পাখি আর কীট, পতঙ্গ ব্যতীত আর কারও মুখ দেখতে পাবো না কোনও কালে!কখনও রবিনসন ক্রুশোর ধরনে অবিকল নিঃসঙ্গ জীবন কাটাবার মতো দশা হলে, তবে জানি না কী ক’রে কাটাতাম একা দ্বীপবাসী হয়ে। তা’হলে কি উন্মাদের পরিণতি হতো না আমার? তখন হয়তো পাতাময় গাছের আগ্রহী ডালে নিজেকে ঝুলিয়ে চিরতরে অসীমের ধোঁয়াশায়  (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
লি্‌ফট বড় দেরি করে, কতক্ষণ এখানে এভাবে এক ঠায় একাকী দাঁড়িয়ে থাকা যায়? বার বার ঘড়ি পড়ি, ছটফট করি, পাঁচতলা সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাবো? সহজ তো নয় আর, এদিকে সময় বড় কম। দীর্ঘ করিডোর স্তব্ধতায় কেমন ঝিমিয়ে-পড়া, প্রায় দৌড়ে যাই কেবিনের দিকে, দরজায় মৃদু টোকা।এ কাকে দেখতে গিয়ে দেখে ফেলি কাকে? ঠান্ডা রোদে ছিলেন চেয়ারে ব’সে বারান্দায়, খাড়া শিরদাঁড়া গায়ে ডোরাকাটা শোবার পোশাক; মনে হলো, নাৎসী বন্দী শিবিরের অতিশয় বিশীর্ণ বাসিন্দা, অত্যাচারী পাহারাদারের পশুকেও লজ্জা-দেওয়া নির্যাতনে ক্লিষ্ট, জব্দ, অথচ নালিশ নেই কোনো, স’য়ে যাওয়া, শুধু স’য়ে যাওয়া মুখ বুঁজে প্রতিক্ষণ, এমনকি কাতরানি নেই এতটুক; বুক তার ধুক-পুক করছে কি? কোথায় উধাও ছন্দোজ্ঞান।ইনিই কি একদা ফাইল থেকে চোখ তুলে দেখতেন কিছু নৃত্যপরায়ণ পাখি, ঝুঁকে-পড়া কোনো রক্তজবা, মাঝে-মধ্যে জিপসি মেঘের শোভা, কৌতুকমিশ্রিত ভঙ্গিময় জনস্রোত, যান প্রবাহ কখনো? হেঁটে যেতে যেতে ছায়াচ্ছন্ন পথে ভাবতেন কতকিছু। কোনো কোনো মুখ, টুকরো কথা কিংবা কারো হাসির ফোয়ারা, টেলিফোনে বলা গীতবিতানের কোনো পংক্তি; ওষুধের গন্ধে ইদানীং কোথায় মিলিয়ে গেছে মৃগনাভি শব্দের সৌরভ। অসহায়, অন্তর্গত নৈঃসঙ্গ্য কুপিয়ে কুপিয়ে মারছে তাকে ক্রামগত। ঝুঁকে, ধুঁকে ধুঁকে জীবনের করুণা কুড়ানো একমাত্র কাজ তার আজ। বরাবর সৌন্দর্য আরাধ্য তার, অথচ এখন নির্বাসিত সুন্দরের মায়াকাননের কুঞ্জ থেকে। অনেক অষ্ফুট কথা শুনে যাই-বাল্যকাল, যৌবন, বার্ধক্য ভাসমান। যার সঙ্গে এতকাল অন্তরঙ্গ পরিচয়, তাঁকে একটি অদ্ভুত ছায়া ভেবে ব’সে থাকি ব্যথিত, স্তম্ভিত। দুপুরেই সন্ধ্যা নামছে কি? বাড়ি ফেরার সময় হয়ে এলো বুঝি, যাই? যেতে যেতে শুধু মনে পড়ে, ছায়াময় ঘরে শুষ্ক মাঠে ঈষৎ গজিয়ে-ওঠা শাদা শিশু ধান চারার মতন চুল মাথা জোড়া, মাথার তিনটি ফুটো দ্রুত ভরাট হবার পথে, কম্পমান ঠোঁট।   (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
বাড়িতে ঢুকলেই তুমি দেখবে সব আছে ঠিকঠাক, সিঁড়ি, কুত্রিম ঝরনাধারায় কেলিপরায়ণ মাছ, সোফাসেট, শয়নকক্ষ, স্নানঘর এবং গাড়িবারান্দা, সর্বোপরি রবীন্দ্র রচনাবলী। তোমার দু’টি চোখ যাকে খুঁজে বেড়াবে অনুপস্থিতির আলো-আঁধারিতে, যার হৃদয়-নিঙড়ানো কবিতার কোনো কোনো চরণ অকস্মাৎ ভ্রমর হয়ে গুঞ্জরণ তুলবে মনে, তাকে দেখবে না কোথাও।টেলিফোন উঠলে বেজে লোকটা পড়ি মরি তুলবে রিসিভার, ভুল নম্বরের ধাক্কা খেয়ে সে কিছুক্ষণ থাকবে বসে, চেয়ারে একলা ঘরে, উল্টোপাল্টে দেখবে কিছু কবিতার বই। টেলিফোনে লোকটার কণ্ঠস্বর শুনেও তুমি বুঝতে পারবে না সে কেমন ছিল, এলে বস্তুত হবে মাটির নিচে থেকে তোলা ভাঙাচোরা মূর্তির মুখোমুখি।  (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
কে তুমি আমাকে লাটিমের মতো ঘুরোতে ঘুরোতে আখেরে কোথাও দূরে ছুড়ে ফেলো? কখনও তোমার পাই না তো খোঁজ। কত পথে হাঁটি, কত মাঠে ছুটি, নদীর কিনারে বসে থাকি এক ধ্যানীর ধরনে।প্রায়শ কতো রাত কেটে যায় নির্ঘুম আর সারাদিন কাটে ঘরের ভেতর পায়চারি করে। কখনও আহার মুখে তুলে নিতে ভুলে যাই আর গাছে পাখিদের সংসার দেখে কত যে সময় কেটে যায় আর জরুরি চিঠির পাতা ছিঁড়ে ফেলি বড় ভুলো মনে।যদি ভাবে কেউ রমণীর প্রেমে মজে এই আমি এমন হয়েছি তা’হলে বেজায় ভুল হয়ে যাবে। ভালোবাসবার বয়সের কোনও সীমানা যদিও বাঁধাধরা নেই, সে কারণে আজ হইনি এমন।ভুলো-মন তবে? বুঝি না, জানি না। কেউ কি আমাকে দয়াপরবশ হয়ে বলে দেবে কেন আজকাল এমন উতলা এ-মন আমার? কোন্‌ সে ব্যাধির হয়েছি শিকার? এই ব্যাধি থেকে আমাকে মুক্তি দেয়ার সাধ্য হাকিমের নেই।  (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
কবিতা লিখতে গিয়ে হঠাৎ পড়ল মনে এই কিছুদিন আগে তুমি আমার একটি কবিতায় ওষ্ঠ রঞ্জনীর গাঢ় ছাপ রেখেছিলে মমতায় তোমার নিজস্ব ঘরে। এ ঘটনা গাঁথা স্মৃতিতেই। এতকাল কেটেছে একুশে ফেব্রুয়ারি কী রকম নিস্তেজ, নিষ্প্রভ যেন। মন ভালো ছিল না, ফলত নীরবে ছিলাম আমি শহীদের স্মৃতিতে প্রণত এবং হৃদয় জুড়ে ছিলে তুমি কিউপিডের কসম।আমার কবিতা ডানা মুড়ে ঘুমোচ্ছিল, আমি তাকে শিস দিয়ে ব্যাকুল জাগিয়ে তুলি, স্মরণ করিয়ে দিই তুমি নেই বলে ওকে বেশি চাই, ওর সঙ্গ না পেলে আমার চতুর্দিকে প্রেত নেচে নেচে ভঙ্গ করবে মনের শান্তি। আজ বাংলা বর্ণমালা দিয়ে নক্ষত্রের আভা মেখে পরিপূর্ণ সাজাবো তোমাকে।   (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
অকস্মাৎ এ কেমন নিস্তব্ধতা এল ব্যেপে দেশে? এ কেমন সূর্যাস্তের ছটা বিলাপের মতো আকাশে ছড়িয়ে পড়ে? বেদনার্ত পাখি নীড়ে ফেরা ভুলে যায়, ফুল উন্মীলনে পায় না উৎসাহ, নদীতে জোয়ারভাটা থেমে যায়; মনে হয়, পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রতি ইঞ্চি কী ভীষণ বাষ্পাকুল। না তোমাকে মানায় না এ রকম কাফনের সাদা মোড়কে সাজানো শুয়ে থাকা মাটির গভীরে, না তোমাকে মানায় না; এ গহন স্তব্ধতায় মিশে-থাকা সাজে না তোমাকে। রেডিও সংবাদপত্র বলে, তুমি নেই। গাছপালা, নদীনালা, মাঝিমাল্লা, ক্ষেতমজুরেরা বলে, তুমি নেই; গ্রাম্য পথ, শহুরে সড়ক দ্বীপ বলে, তুমি নেই প্রতিটি নদীর বাঁক, পদ্মার রুপালি ইলিশের ঝাঁক বলে, তুমি নেই, গোলাপ বাগান, পাহাড়ের পাকদণ্ডি, উদার গৈরিক মাঠ বলে, তুমি নেই বাউলের একতারা বলে, তুমি নেই, তোমার নিজস্ব ঘর গেরস্থালি বলে নেই, তুমি নেই, পাখিদের ক্লান্ত ডানা বলে, তুমি নেই, তুমি নেই। তুমি থাকবে না শহর-কাঁপানো মিছিলের পুরোভাগে, তুমি থাকবে না শ্রমিকের কৃষকের, ছাত্রদের বিপুল উজ্জ্বল সমাবেশে, তুমি থাকবে না পার্টির ব্যাপক সম্মেলনে, ক্ষুধার্তের সারিতে তোমাকে দেখব না, রৌদ্র-ধোয়া এ পবিত্র শহীদ মিনারে ফুলের স্তবক তুমি করবে না অর্পণ কখনো স্বৈরাচারীদের হিসহিসে চাবুকের আঘাতে আঘাতে গণতন্ত্র গোঙাবে যখন, তখন তোমার কণ্ঠস্বর গর্জে উঠবে না কোনো দিন আরসমাজতন্ত্রের ডাক দিয়ে মেঘে মাথা ঠেকিয়ে কখনো তুমি আর হাতে নিয়ে ভবিষ্যর সোনালি পতাকা উদ্দাম যাবে না ছুটে, নেবে না বুকের কাছে তুলে গুলিবিদ্ধ যুবার শরীর, কী করে আমরা মেনে নেব অবেলায় রৌদ্রদগ্ধ পথে যেতে যেতে হঠাৎ তোমার হাঁটা চৌরাহায় বন্ধ হয়ে যাবে? এখন তোমার করোটিতে পুষ্পসার, এখন তোমার চক্ষুদ্বয় স্বপ্নহীন এখন তোমার কণ্ঠ প্রগতির উচ্চারণহীন এখন তোমার হাত যুদ্ধোত্তর মাটিলেপা নিষ্ক্রিয় বন্দুক।যখন আটক ছিলে জেলে, দুপুরে ভাতের পাতে সর্বদা উঠত ভেসে স্বদেশের মুখ, যখন নীরন্ধ্র সেলে আসত না ঘুম দেশবাসীর দুর্গতির কথা ভেবে, বাঘের চোখের মতো কিছু তারা কী যেন তোমার কানে কানে বলে যেত, যখন নিঃশব্দে পালিয়ে বেড়াতে তুমি ডালকুত্তাদের ঘ্রাণশক্তি থেকে, তখনো তোমার বুকে হীরের ধরনে জ্বলত নিবিড় ভালোবাসা দূর আগামীর জন্যে, তোমার সত্তায় ছিল লেখা মুক্তির অক্ষর। তোমার প্রদীপ্ত কণ্ঠস্বর চকিতে হারিয়ে গ্যাছে কী বিষণ্ন কুয়াশায়, যদিও এখন তুমি মেঘে ভাসমান, এক গুচ্ছ ফুল, বিরান প্রান্তরে জীবনের বীজ, অথচ এও তো জানি মৃত্যুর জঠর ফুঁড়ে লোকগাথার মতন কিংবদন্তি হয়ে তুমি থাকবে বাংলায় আমাদের পাশে অগণিত হৃদয়ে হৃদয়ে।   (না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
আজ উৎসবের দিন; চতুর্দিক খুব ঝলমলে পোশাকে সেজেছে যেন। মিহি বৃষ্টি, দূর আকাশের ঘন আবলুসী মেঘ আনন্দ-চঞ্চল মানুষের মুখ ম্লান করে দিতে ব্যর্থ হলো। কোন্‌ যাদুবলে এ শহর গলায় আলোর নেকলেস নিয়ে জ্বলে এমন আন্ধারে? শুধু আমি এ আনন্দ বাসরের ছটা থেকে বঞ্চিত, ফলত আজ নিজের ঘরের কোণে একা মগ্ন ধ্যানে; অন্যেরা মেতেছে কোলাহলে।উৎসবের ঝর্নাধারা কী করে করাবে ফুল স্নান আমাকে যখন আমি বিচ্ছেদের স্রোতের কামড়ে ক্ষয়ে যাচ্ছি প্রতিক্ষণ? যার নাম করি উচ্চারণ বারবার জাগরণে, এমনকি স্বপ্নের ভেতরে, যে আমার অন্তরে বাহিরে নিত্য গুঞ্জরিত গান, সে নিজেই অন্যত্র উৎসব হয়ে জ্বলে সর্বক্ষণ।   (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
আমার ভেতর থেকে একজন একাকী মানুষ হেঁটে যায় তোমার নিদ্রার দিকে, তুমি তার যাত্রা, ব্যাকুলতা, কাতর দৃষ্টির প্রতি উদাসীন, ঘুমের ভেতরে মজ্জমান, লতাপাতা জড়ায় তোমাকে, খরগোশ বুকের নগ্ন মদির উষ্ণতা শোঁকে কিছুক্ষণ। তার যাত্রায় রোদ্দুর নাচে, বৃষ্টি পড়ে, কখনো জ্যোৎস্নাও ঝরে। কেমন অচেনা পাখি ডাকে তার দু’চোখের নিরালায়।আমার ভেতর থেকে একজন একাকী মানুষ হেঁটে যায় তোমার জাগরণের প্রতি, তার চুমু ঝরে অবিরল যে পুষ্পিত জাগরণে। এখন সে তোমার নিদ্রার দিকে হাত দিয়েছে বাড়িয়ে, নিশীথের ঘ্রাণময় বিছানায় নিটোল ঘুমাও তুমি, তোমার নিদ্রার রাঙা জল অত্যন্ত নিথর থেকে যাবে। ভয় নেই, তোমাকে সে জাগাবে না; বুকে নিয়ে শীতরাত তোমার রূপের হ্রদে ওজু করে চলে যাবে উড়িয়ে ফানুস আকাঙ্ক্ষার। চিরকাল হৃদয়ের অভ্যন্তরে তার গভীর বনানী আবৃত্তি করবে কিছু স্মৃতিময় বাণী।যখন সবুজ লনে শিশুর মতোন সুখে গড়াবে সকাল, কার্ডিগান গায়ে তুমি বারান্দায় নিশ্চুপ দাঁড়াবে, তখন তোমার মনে হতে পারে একজন একাকী মানুষ শীতল সিঁড়ির ধাপে নত মুখে নিঃস্ব বসে আছে কতকাল।   (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
কোথায় লুকালে তুমি? বলো কোন্‌ সুদূর পাতালে দিনান্তে পালঙ্কে শুয়ে কাটাও প্রহর প্রিয়তমা? এখানে নেমেছে দশদিকে মৃত্যুর মতন অমা, সেখানে কি কেলিপরায়ণ তুমি স্মিত জ্যোৎস্নাজালে সোনালি মাছের মতো? নাকি তোমার নৌকোর পালে লেগেছে উদ্দাম হাওয়া অজানা সমুদ্রে। কী উপমা দেবো সে যাত্রার আজ? হয়তো মরুর বালি জমা হয়েছে তোমার কালো চোখে রোজ সন্ধ্যা ও সকালে।যেখানে তোমার পদচ্ছাপ প্রস্ফুটিত, বেজে ওঠে কণ্ঠস্বর কিংবা তুমি দর্পণে প্রতিফলিত, গান গাও গুনগুন সুরে, পারি না সেখানে যেতে, তবু সেদিকেই মুখ রেখে পথ হাঁটি। হতাশাই প্রভু সে-পথের জেনেও সর্বদা করি যাত্রা, কাঁটা ফোটে পায়ে; তোমাকেই পাবো, আমি কি এমনই পুণ্যবান?   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
আমার নিকটে এসে পুনরায় দূরে চলে গেলে। যাবার সময় তুমি আমার কথার প্রতি কান দাওনি, অথচ আমি আলো-আঁধারির কণ্ঠস্বরে হৃদয়ের কিছু কথা তোমাকেই বলতে চেয়েছি।আমার দু’হাতে কারা হাতকড়া দিয়েছে পরিয়ে, আমি হাঁটলেই ঝন্‌ঝনিয়ে ওঠে লোহার শেকল বার বার-এই অজুহাতে তুমি পরিহার করো আমাকে এখন, জানি কারাগারে জমে না প্রণয়। তবুও তোমাকে নিত্য গোলাপ পাঠাই, ভিলানেল লিখে যাই তোমার উদ্দেশ্যে তাজা হৃদরক্ত দিয়ে। প্রতিষ্ঠালোলুপ সব সমাজসেবক স্তব করে শাসকের; আমি আজও তোমাকেই বন্দনীয় মানি।   (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
হেঁটে হেঁটে বেশ কিছুদূর এসে আজ মনে হয়- এই যে এতটা পথ পেরিয়ে এলাম কত আলো, কত অন্ধকার খেলা করেছে আমার সঙ্গে। ভালো, মন্দ এসে ঘিরেছে আমাকে আর ক্রুর দ্বন্দ্বময় অন্তরের ইতিহাস রয়ে যাবে অজানা নিশ্চয়। যদি নগ্নতায় উদ্ভসিত হতো অন্তর্লোক, তবে অনেকে আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকাতো নীরবে, কেউ কেউ দিতো টিটকিরি দিব্যি রাজপথময়।আমরা এমন যুগে বাস করছি, যখন কেউ পাশে এসে বসলে ভীষণ উসখুস বোধ করি। মনে হয়, পার্শ্ববর্তী ব্যক্তির শার্টের খুব ফিকে আড়ালে রিভলবার কিংবা ছোরা ঘাপ্টিমারা ফেউ হয়ে আছে। এক্ষুণি লোকটা হাসিমুখে তড়িঘটি হিম লাশ করে দেবে জলজ্যান্ত ভদ্রলোকটিকে!   (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
রেডক্রসের গাড়ি ভয়ার্ত রাজহাঁসের মতো চিৎকার করতে করতে ছুটে গেল মধ্যাহ্নের প্রাখর্যকে কম্পমান পর্দা বানিয়ে। সেই গাড়িটার ভেতরে আশ্রয় পেলে আপাতত বেঁচে যেতাম। ভীষণ অসুস্থ আমি, শ্বাসরোধকারী আমার ব্যাধির কথা জানে নীলিমা, পাখির ঝাঁক, নতজানু… রেডক্রসের গাড়ি আমাকে নিয়ে যাক মেঘে মেঘে, দূর নীলিমায়।রেডক্রসের গাড়ি এ মুহূর্তে আমার মন্ত্রোচ্চারণ, অকস্মাৎ এই মরু-মধ্যাহ্নে মনে হল, তুমি তোমার হাত বাড়িয়ে দিলে আমার দিকে একটা চিকচিকে মরীচিকাকে মুছে ফেলে হৃদয়ের মতো অন্তরঙ্গ হাতের তালুতে।এই শহরের সবচেয়ে সুন্দর পাখি, ইদানীং পাখি বড় একটা চোখে পড়ে না- গান গেয়ে আমাকে বলেছিল ফিরে এসো। একটি বেহালা করুণ সুরে আর্তনাদ করে উঠেছিল- তোমার প্রতীক্ষায় আমি বাজব অষ্টপ্রহর; পার্ক ডেকে বলেছিল, তোমার জন্যেই উন্মাচিত আমি, ফিরে এসো। আমি ওদের ডাকে সাড়া দিইনি। তোমার ওষ্ঠ যদি বলি, তবে আমি কোনো সেবাসদন কিংবা রেডক্রসের গাড়ির স্বপ্ন দেখব না, ছুটে আসব আবার।আমি লিখছি অন্ধকার রাত্রির হৃৎপিণ্ডের ভেতরে ব’সে।কবেকার রাস্তায় দেখা ঘোড়ার জৈবিক গন্ধ, একলা ঘরে একজন বামনের কড়িকাঠ-ছোঁয়া উল্লাস, আর সেসব পাখি যারা বিল ছেড়ে উড়ে যায় আমার স্বপ্নের ভেতরে, ক’জন তাসুড়ের বর্মী টেবিল ঘিরে ঘণ্টা ঘণ্টাব্যাপী বসে-থাকা, হাওয়ায় ফুলে-ওঠা জকির রঙিন জামা আর রাজপথে বয়ে-যাওয়া তরুণ বীরের রক্তস্রোত মেশে আমার পঙ্‌ক্তিমালায়, কখনো কখনো কাগজ-কলম নিয়ে সে থাকি সারারাত, সাদা পাতার দিএক চেয়ে থাকি প্রহরের পর প্রহর যেমন কৃষক তার শূন্য ক্ষেতের দিকে-কী করুণ আর ক্লান্ত। একটা রেডক্রসের গাড়ি ভয়ার্ত রাজহাঁসের মতো চিৎকার করতে করতে ছুটে গেল রাত্রিকে টুকরো টুকরো করে। হঠাৎ আমার চোখে মুখে রাগে তোমার সুগন্ধি নিঃশ্বাস, আমার কবিতার খাতায় ঠিকরে পড়ে তোমার চোখের জ্যোতি , তোমার চোখের জ্যোতি, তোমার চোখের জ্যোতি।   (উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
সদ্য সন্ধ্যা সাঁঝের সজ্জা ছেড়ে শরীরে জড়ালো রাতের রেশমি শাড়ি। এক লহমায় আমাকে অবাক করে অপরূপ শোভা পেয়ে যায় ফ্ল্যাটবাড়ি।কলিংবেলের ডাকে সাড়া দিয়ে দেখি, দাঁড়িয়ে রয়েছো দরজার পাশে একা। ভুলেও ভাবিনি হবে আচানক রাতে আজকেই ফের তোমার সঙ্গে দেখা।খোদার রহম, প্রসন্ন ভাগ্যতারা, কোথায় বসাবো কিছুতে পাই না ভেবে। এদিক ওদিক চেয়ে থাকি অসহায়, জানি ক্রটি হলে তুমি ক্ষমা করে দেবে।বাসন্তী রঙ তোমার শরীর জুড়ে মেতেছে দৃষ্টি-জুড়ানো খেলায় আজ। হৃদয়ে আমার সাত সাগরের দোলা, কী ফুল ফোটায় সত্তায় ঋতুরাজ। ইলেকট্রিকের আলোয় কর্ণমূলে লাজুক হাসিতে কাঁপলো স্বর্ণদুল। আমি নিশ্চুপ; তুমিও অথৈবচ; কানে ফুটে আছে স্বর্গীয় দু’টি ফুল।চলেছি দু’জন রিকশায় শিশুরাতে, সামনে ছড়ানো তোমার ফেরার পথ। হঠাৎ কোথায় উধাও একটু দুল? বল্‌লে, ‘চুমোর অপূর্ব খেসারত। আমাকে খোঁচায় অস্বস্তির কাঁটা, নিজেকে কেবলি মনে হয় অপরাধী। খুঁজে পেলে দুল নিজেরই শাড়ির ভাঁজে, আমি মনে মনে স্বস্তির সুর সাধি।‘কী সুখ পাচ্ছো আমাকে মথিত করে? কী হবে এমন যাত্রার পরিণতি? আখেরে কীভাবে চিহ্নিত হবো আমি? তোমার প্রশ্নে থামে প্রমোদের গতি!কম্পাসহীন নাবিকের মতো ভাসি; ঝড়ে ভেঙে গেলে সুদৃশ্য মাস্তুল, স্রোতে হাবুডুবু খেয়ে বলবো না, ‘হায়, আমাদের প্রেমে ছিল ভয়ানক ভুল।বাসুকির মতো ফণা তুলে ঢেউগুলি করুক আঘাত, পাবো না কখনো ভয়। তোমার এ-হাত লগ্ন থাকলে হাতে কোনো সংঘাতে মানবো না পরাজয়।দুঃসময়ের কৃষ্ণপক্ষে আছি; বিশ্বব্যাপ্ত ধ্বংসের ঝাঁপতালে- যখন অনেকে আত্মবিনাশে মাতে, আমরা দোহার সাজবো না কোনোকালে।পৃথিবীর সব বৃক্ষ আজকে যদি বজ্রদগ্ধ হয় হোক প্রিয়তমা, আমরা ছড়িয়ে প্রেমের পুষ্পরেণু দ্রুত মুছে দেবো অকল্যাণের অমা।  (হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
এই তো কদিন হলো কবিতার একটি পঙ্‌ক্তিও লিখতে পারিনি শত চেষ্টা করে। বাজে কাগজের ঝুড়ি ভরে ওঠে কাটাকুটিময় বাতিল কাগজে। লেখার টেবিলে ঝুঁকে কাটে কত বেলা, স্নানাহার কখনো স্থগিত থাকে, ক’দিনের না কামানো দাড়ি, যেন গালে কালো ঘাস; অস্থিরতা কয়েদি পাখির মতো পাখায় ঝাপ্টায়, কী এক অভিমানে নিজেকেই নিমেষে পুড়িয়ে শেষে দু’হাতে ওড়াই শুধু ছাই।বর্থ্যতা হরণ করে দিনের বিশ্রাম, নিশীথের নিদ্রা, বেদনায় ছেয়ে যায় চিদাকাশ, দূরে বসে প্যাঁচা হয়ে ওঠে উপহাসপ্রিয়, ঝুলন্ত বাদুড় তাচ্ছিল্যে তাকায় মিটিমিটি। অকস্মাৎ তুমি এলে এই ঘরে কবিতার পঙ্‌ক্তিমালা জন্ম নেয় মনে।   (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
এখন কোথায় আছো তুমি? জানার উপায় নেই কিছুতেই; যদি কোনোক্রমে হয়ে যেতাম নাবিক সিন্দাবাদ, তবে সাত সাগরের তরঙ্গে তরঙ্গে দিতাম ভাসিয়ে এক সন্ধানী জাহাজ অবিলম্বে তোমার উদ্দেশে আজ, অথবা সী-মোরগের পিঠে উদ্দাম সওয়ার হয়ে, যদি ধনকুবের হতাম তাহলে চার্টার্ড প্লেনে চড়ে চলে যেতাম তোমার ঠিকানার সুলুক সন্ধান করে বিদ্যুৎগতিতে।আগেও বিদেশে গেছ, কাটিয়েছে বেশ কিছুদিন, সানন্দে ট্যুরিস্ট হয়ে। তখন হইনি এরকম ব্যাকুল, অস্থির কোনোদিন। মন যেন বোমাধ্বস্ত নিষ্প্রদীপ নির্জন নগর, বড়ো একা বসে থাকি গৃহকোণে, কবিতার খাতা একমাত্র সঙ্গী, ভাবি- সময় ফুরায় যত ব্যাকুলতা বেড়ে যায় তত।  (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
আজ কার কাছে উন্মোচন করি আমার হৃদয়? এই যে বাড়ির কাছে গাছপালা দাঁড়ানো সেগুলো এখন সবুজ মনে হচ্ছে না তেমন, আকাশের নীলিমা, নক্ষত্র আকর্ষণহারা, যে গায়ক পাখি রেলিঙে বসলো এসে তার শিস কেমন বেসুরো লাগে আর মহান দান্তের কাব্যগ্রন্থ ‘নরক’-এর মাত্র দু’তিনটি পঙ্‌ক্তি পড়ার পরেই রেখে দিই, রবীন্দ্রনাথের গানও আন্দোলিত করে না আমাকে।এ শহর থেকে তুমি বিদায় নেওয়ার পর এই অত্যন্ত করুণ হাল হয়েছে আমার, প্রিয়তমা। হৈ-হৈ বইমেলা, মানুষের ভিড়, আড্ডা, মদ্যপান- কিছুই লাগে না ভালো। একা একা থাকি, নিজেকেই ছন্নছাড়া প্রেতপ্রায় মনে হয়। নিভৃতে হৃদয় খুঁড়ি, ঘুরি, খুঁজি আমাদের অন্তরঙ্গ ক্ষণগুলি।   (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
গোড়াতেই নিষেধের তর্জনী উদ্যত ছিলো, ছিলে সুপ্রাচীন শকুনের কর্কশ আওয়াজে নিশ্চিত মুদ্রিত আমার নিজস্ব পরিণাম। যেন ধু ধু মরুভূমি কিংবা কোনো পানা পুকুরে কি জন্মান্ধ ডোবায় অস্তিত্ব বিলীন হবে কিংবা হবো সেই জলমগ্ন ভুল প্রত্ন পরিশ্রমী, ধৈর্যশীল, উদ্যমপ্রবণ ধীবরের জাল যাকে ব্যাকুল আনবে টেনে নৌকোর গলুইয়ে- এইমতো ভয়ংকর সংকেত চকিতে উঠেছিলো কেঁপে রুদ্ধ গোলকধাঁধায়।আমিতো বারণ মেনে বিশ্রুত স্থপতি ধীমান পিতার পারতাম জলপাই আর বৃষমাংস খেয়ে, পান ক’রে চামড়ার থলে থেকে উজ্জ্বল মদিরা এবং নিভৃত কুঞ্জে তরুণীকে আলিঙ্গনে মোহাবিষ্ট ক’রে, ধারালো ক্ষুরের স্পর্শসুখ নিয়ে প্রত্যহ সকালে সাধারণ মানুষের মতো গোচারণ, শষ্যক্ষেত আর সন্তান লালন ক’রে কাটাতে সময়। পারতাম সুহৃদের সঙ্গে প্রীতি বিনিময়ে খুশি হতে, তৃপ্তি পেতে পাতার মর্মরে, বনদোয়েলের গানে, তামাটে দুপুরে পদরেখা লাঞ্ছিত জঙ্গলে নিজেকে বিযুক্ত ক’রে মধু আহরণে। কী-যে হলো, অকস্মাৎ পেরিয়ে গোলকধাঁধা পিতৃদত্ত ডান। ভর ক’রে কিছুক্ষণ ওড়ার পরেই রৌদ্রের সোনালি মদ আমার শিরার ধরালো স্পর্ধার নেশা। শৈশবে কৈশোরে কতদিন দেখেছি পাখির ওড়া উদার আকাশে। ঈগলের দুর্নিবার ঊর্ধচারী ডানার চাঞ্চল্যে ছিলো সায় সর্বদা আমার, তাই কামোদ্দীপ্তা যুবতীর মতো প্রবল অপ্রতিরোধ্য আমার উচ্চাভিলাষ আমাকে অনেক উঁচুতে মেঘের স্তরে স্তরে রৌদ্রের সমুদ্রে নিয়ে গেলো। দ্বিধাহীন আমি উড়ে গেলাম সূর্যের ঠোঁটে কোনো রক্ষাকবচবিহীন প্রার্থনার মতো।কখনো মৃত্যুর আগে মানুষ জানে না নিজের সঠিক পরিণতি। পালকের ভাঁজে সর্বনাশ নিতেছে নিশ্বাস জেনেও নিয়েছি বেছে অসম্ভব উত্তপ্ত বলয় পাখা মেলবার, যদি আমি এড়িয়ে ঝুঁকির আঁচ নিরাপদ নিচে উড়ে উড়ে গন্তব্যে যেতাম তবে কি পেতাম এই অমরত্বময় শিহরণ? তবে কি আমার নাম স্মৃতির মতন কখনো উঠতো বেজে রৌদ্রময় পথে জ্যোৎস্নালোকে চারণের নৈসর্গিক, স্বপ্নজীবী সান্দ্র উচ্চারণে? সমগ্র জাতির কোন কাজে লাগবে না এই বলিদান, শুধু অভীপ্সার ক্ষণিকের গান গেলাম নিভৃতে রেখে ঝাঁ ঝাঁ শূন্যতায়। অর্জন করেছি আমি অকাল লুপ্তির বিনিময়ে সবার কীর্তনযোগ্য গাথা, যেহেতু স্বেচ্ছায় করেছি অমোঘ নির্বাচন ব্যাপ্ত, জ্বলজ্বলে, ক্ষমাহীন রুদ্র নিজস্ব আকাশ।   (ইকারুসের আকাশ কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
রূপক
তোমার নির্মিত নক্ষত্রেরা তোমাকে ভেংচি কাটে চিরম্ভনতার প্রসঙ্গ টেনে রাতদুপুরে ওদের নিরস্ত করার কারিকুরি আজ অব্দি রপ্ত করোনি ওরা হয়ে ওঠে নাছোড় বিরক্তিকর বিদুষকলতাপাতাঢাকা কোঠ বাড়ি প্যাঁচানো ধোঁয়া বমি করে কী সব আবছা শব্দ প্রায়শ চুপিসাড়ে হেঁটে আসে কাজ সারে ডোবার ধারে সেখানে যারা থাকে তাদের নামগোত্র কেউ জানে না উপস্থিত থেকেও অনুপস্থিতগুজব আকাশের কাছ থেকে তারার কাছ থেকে গাছগাছালি পাখপাখালির কাছ থেকে চুপি চুপি অনেক কথা এনে ওরা উনুনে চাপায় খুব গনগনে হ’লে ছড়িয়ে দেয় এখানে সেখানেসবসময় ওরা আত্মবিলোপী ক’জন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে গুজব ভীষণ বিপজ্জনক ওরা শিশুদের ভাজে কড়াইতে নরনারীর গায়ের চামড়া তুলে ডুগডুগি বানায় উপড়ে নেয় বৃদ্ধ বৃদ্ধার চোখআতঙ্কবাদীদের ডেরা একদিন ঘেরাও করে সেপাই সান্ত্রীরা হাত উপরে তুলে সুবোধ ভঙ্গিতে বেরিয়ে আসার হুকুম লাউডস্পীকারে ধ্বনিত ঘন ঘন কোঠাবাড়ি থেকে একটি পিপঁড়েও নড়ে না ওরা নিজেরাই উড়িয়ে দেয় ডেরা এই সঙ্গে তোমার নির্মিত নক্ষত্রেরা পাঁচিল ঘেরা বাড়িটাও মাটিতে মুথ থুবড়ে পড়ে উর্ধ্বগামী বারুদগন্ধী ব্যাঙের ছাতা   (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
শিল্পী, কবি, দেশী কি বিদেশী সাংবাদিক, খদ্দের, শ্রমিক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, সমাজসেবিকা, নিপুণ ক্যামেরাম্যান, অধ্যাপক, গোয়েন্দা, কেরানি, সবাই এলেন ছুটে পল্টনের মাঠে, শুনবেন দুর্গত এলাকা প্রত্যাগত বৃদ্ধ মৌলানা ভাসানী কী বলেন। রৌদ্রালোকে দাঁড়ালেন তিনি, দৃঢ়, ঋজু, যেন মহাপ্লাবনের পর নুহের গভীর মুখ সহযাত্রীদের মাঝে ভেসে ওঠে, কাশফুল-দাড়ি উত্তুরে হাওয়ায় ওড়ে। বুক তাঁর দক্ষিণ বাংলার শবাকীর্ণ হু-হু উপকূল, চক্ষুদ্বয় সংহারের দৃশ্যাবলিময়; শোনালেন কিছু কথা, যেন নেতা নন, অলৌকিক স্টাফ রিপোর্টার। জনসমাবেশে সখেদে দিলেন ছুঁড়ে সারা খাঁ-খাঁ দক্ষিণ বাংলাকে। সবাই দেখল চেনা পল্টন নিমেষে অতিশয় কর্দমাক্ত হয়ে যায়, ঝলছে সবার কাঁধে লাশ আমরা সবাই লাশ, বুঝিবা অত্যন্ত রাগী কোনো ভৌতিক কৃষক নিজে সাধের আপনকার ক্ষেত চকিতে করেছে ধ্বংস, পড়ে আছে নষ্ট শস্যকণা।ঝাঁকা-মুটে, ভিখিরি, শ্রমিক, ছাত্র, সমাজসেবিকা, শিল্পী, কবি, বুদ্ধিজীবী, দেশী কি বিদেশী সাংবাদিক, নিপুণ ক্যামেরাম্যান, ফিরিঅলা, গোয়েন্দা, কেরানি; সমস্ত দোকান-পাট, প্রেক্ষাগৃহ, ট্রাফিক পুলিশ, ধাবমান রিকশা ট্যাক্‌সি, অতিকায় ডবল ডেকার, কোমল ভ্যানিটি ব্যাগ আর ঐতিহাসিক কামান, প্যান্ডেল টেলিভিশন, ল্যাম্পপোস্ট, রেস্তোরাঁ, ফুটপাত যাচ্ছে ভেসে, যাচ্ছে ভেসে ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ বঙ্গোপসাগরে। হায়, আজ একী মন্ত্র জপলেন মৌলানা ভাসানী!বল্লমের মতো ঝল্‌সে ওঠে তাঁর হাত বারবার অতি দ্রুত স্ফীত হয়, স্ফীত হয়, মৌলানার সফেদ পাঞ্জাবি, যেন তিনি ধবধবে একটি পাঞ্জাবি দিয়ে সব বিক্ষিপ্ত বেআব্রু লাশ কী ব্যাকুল ঢেকে দিতে চান।
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
আরো কিছু সময় আমাকে দিলে, প্রিয়তমা, খুব বেশি ক্ষতি হবে কি তোমার? মালা-থেকে-খসা মুক্তো যেন তোমার সময়, প্রত্যহ ছিটকে পড়ে এদিক ওদিক। দু’চারটে বেশি মুক্তো নির্দ্বিধায় তুলে দাও যদি আমার ঝুলিতে, পৃথিবীর বিখ্যাত আহ্নিকগতি থেমে যাবে, এমন তো নয়। থাক থাক কোনো নড়বড়ে অজুহাতে অথবা যুক্তিকে ক্রাচে দাঁড় করানোর প্রয়োজন নেই আর মুক্তি চাই অনুপস্থিতির স্বৈরাচার থেকে; এসো আমার নিকট সব তুচ্ছতার জঞ্জাল পুড়িয়ে। কেন তুমি বুঝতে পারো না হায় প্রতীক্ষায় দিনরাত হাওয়ায় হাওয়ায় উড়িয়ে দেয়ার মতো প্রচুর সময় নেই আমার মুঠোয়?এই যে এখনো হাওয়া টেনে নিতে পারে ফুসফুস, এখনো দু’চোখ বাগান, পুকুর, পাখি, গ্রীষ্মের দুপুরে, নিরিবিলি গৃহকোণে সুস্নিগ্ধ সুরাই কিয়দ্দূরে বিষাদের প্রতিমূর্তি একা ঘোড়া দেখে নেয়; নিঝুম বৃষ্টির শব্দ, দোয়েলের গান কানে আসে আজো, এ এক পরম আশার্বাদ; কিন্তু কত অনিশ্চিত আর ক্ষণস্থায়ী। চলে যেতে পারতাম এই তো সেদিন দূরে, বহুদূরে, জীবনের অদৃশ্য ওপারে পরিযায়ী পাখির ধরনে ছায়া রেখে কারো কারো মনের দেয়ালে। যদি এক বছর আগেও নিতাম বিদায়, তবে হতো না তোমার সঙ্গে দেখা কোনো কালে। এ আমার হাত, ওষ্ঠ, বুক ঈর্ষাযোগ্য হতো না কখনো দেবদূতের; তবু স্বস্তিহীন, শান্তিহীন দিন যায়, রাত কাটে মনগড়া রত্নখচিত দেয়ালে কোন্‌ সে দেশের বোধিদীপ্ত পাখিদের গান শুনে।কী লাভ এভাবে বেঁচে থাকা ধুঁকে ধুঁকে, হতাশার দিকে ঝুঁকে বুকে নিয়ে অপ্রাপ্তির অমানিশা? বরং এখনই এসো, প্রিয়তমা, শুষে নাও জিভে অথবা নিঃশ্বাসে হৃৎপিণ্ড আমার, যাতে সেখানে স্পন্দিত না হয় কখনো আর তোমাকে পাওয়ার দারুণ দহনময় মধ্যাহ্ন-আকাঙ্ক্ষা নিত্যদিন।অথচ বাঁচাই কাম্য ততদিন, যতদিন তুমি রোদ্দুরে জ্যোৎস্নায় হেঁটে যাও, তুলে নাও আলগোছে নুয়ে উঠোনের গাছ থেকে ফুল, এবং তোমার চুল ওড়ে খোলা পথে কিংবা ঘরে ফ্যানের হাওয়ায়।এখন তো যে কোনো ছুতোয় একরোখা কোনো চৌকিদারের ভঙিতে মৃত্যু এসে লাঠি ঠোকে আমার চৌকাঠে, আমার নিঃশ্বাস দ্রুত ক্রোক, করে নেবে বলে ভীষণ শাসায় অন্তরাল থেকে, বিশেষতঃ যখন থাকো না তুমি পাশে। বস্তুতঃ তোমার উপস্থিতি লেখে জীবনের নাম আমার নিঃশ্বাসে, তাই তোমাকেই চাই চুম্বনে, নিবিড় আলিঙ্গনে আর তুমি তো জানোই, প্রিয়তমা, আমার আয়ুর সীমা সরহদ কত সংকুচিত।   (হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
খুব একা হাঁটি বোবা কালা অন্ধ বামনের ভিড়ে। নোনা ঘামগন্ধ, মুখ-গহ্বরের কটু গন্ধ ঝাঁকে, ভীষণ দুঃস্বপ্ন যাপি রুদ্ধশ্বাস এ বন্দীশিবিরে। যেখানেই যাই কালো সন্ত্রাস আমাকে ধরে ঘিরে, অনিদ্রার রক্তজবা জ্বলে চোখে, যদি কোনো ফাঁকে দৃষ্টি থেকে মরুভূমি সরে যায়, চেতনাকে ঢাকে বিষলতা, নিশ্বাসও বিকিয়ে যায় এমন তিমিরে।তাহলে কী লাভ বলো, প্রিয়তমা, বিচ্ছিন্নতা পুষে আমাদের দুজনের মধ্যে আর? এসো ভালোবাসি দূরন্ত আবেগে, সব বাধার প্রাকার দ্বিধাহীন ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে এসো আমরা পরস্পর শুষে নিই আমাদের অস্তিত্বের সারাৎসার, সুখে ভাসি কিছুকাল, নিশ্বাসকে করে তুলি প্রবল রঙিন।   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
ডাকতে হয় না, নিজেই সে আসে, টোকা দেয় মনে, স্মৃতি যার নাম। কখনো কখনো মুখোমুখি বসে, পা দোলায় শিস দেয় দোয়েলের মতো কখনোবা চোখের পানির মতো কী অপ্রতিরোধ্য এসে পড়ে সবকিছু এলোমেলো করে, এমনকি পীড়নের ভয়কে তফাৎ যাও বলে। মনে পড়ে, সেলিম তোমার কথা মাঝে মাঝে খুব মনে পড়ে। সে কবে প্রথম দেখা হয়েছিল আমাদের? সেই উনিশশো আটান্নোয় পুরানো ঢাকায়, অতি পুরাতন বেতার ভবনে।মনে পড়ে বহুদিন গল্পচ্ছলে সিগারেট পুড়ে ছাই হ’তে দেখেছি আঙুলে তোমার এবং কত কিছুই তো ছাইয়ের গাদায় ঠাঁই নেয় ক্রমান্বয়ে, এমনকি অমৃতের সন্তানও সহজে।যে হাসি তোমার ঠোঁটে প্রায়শই বেলা-অবেলায় দেখেছি ঝিকিয়ে উঠতে, তাতে বিষাদে করেছি লক্ষ্য দ্রুত পুড়ে-যাওয়া মানুষের কাহিনীর ঈষৎ ঝলক। অনেকেই, বিশেষত শিল্পীরা পোড়ায় নিজেদের; কিন্তু এরকম সাততাড়াতাড়ি কেউ আমার ধরনে করে না আগুনে সমর্পণ। বন্ধু, তুমি অকম্পিত হাতে মোমবাতিটার দু’দিকেই খেলাচ্ছলে তৈরি করেছিলে শিখা।  (না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
সে-রাতে তোমার বাড়িতে আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে আমিও ছিলাম একজন, ঈষৎ দূরত্ব আর নৈকট্যের নানা কোণ থেকে তোমাকে দেখে আমি আতশবাজি, সরোদের ঝংকার। তখন মুক্ত কণ্ঠে বলতেই তো পারতাম, তোমার সৌন্দর্যধারায় স্নাত আমি, বলতেই তো পারতাম, তোমার কথার লাবণ্যে আমার হৃদয়ে ফুটছে নানা রঙের ফুল, অথচ আমার মুখ ছিল যেন কুলুপ-আটা।মগজে জ্যোৎস্না পুরো সোফায় নিশ্চুপ বসেছিলাম এক কোণে; কখনো স্যান্ডেলিয়ারের দিকে, কখনো দেয়ালের বিমূর্ত পেন্টিং-এর দিকে তাকিয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলার প্রবল ইচ্ছের মুখ সেলাই করে রেখেছিলাম আর সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, কোনো নিষাদ কোকিলের কণ্ঠে তীর বিদ্ধ করলে গায়ক পাখিও হয়ে যায় রক্তাক্ত, মুক।   (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
আমার স্বপ্নের ঘাটে বৃষ্টি পড়ে, টগবগে সাদা ঘোড়া পা ঠোকে পিছল মাটিতে, যদি সে পড়ে যায় মুখ থুবড়ে, পাতাগুলি সসম্ভ্রমে ঢেকে দেবে তাকে। বজরায় কে বধূ রয়েছে ব’সে সালংকারা? তার মনোভার পারে না সরিয়ে দিতে স্তব্ধ নিশীথের জলধারা।আমার স্বপ্নের ঘাটে ঈশ্বর পুত্রের আংরাখা বুকে চেপে নারী করে অশ্রুপাত, তার ওপর নক্ষত্র ঝরে, দেবদূত ওড়ে আর চারণ কবির কণ্ঠস্বরে সৃষ্টি হয় জ্যোৎস্নাস্নাত মানবিক গাথা। জগৎ সংসারে প্রতি যুগে মানব সন্তান কত ক্রুশবিদ্ধ হয়, রক্ত মুছে যায় তাণ্ডবে, আমেন।২ ‘কবিকে পোছে না কেউ,’ ব’লে এক গলির মাস্তান গুলী ছোঁড়ে মেঘের মুলুকে। কুকুরেরা চিৎকারে বমন করে ভীতি। কবি কিশোরের পাণ্ডুলিপি গুণ্ডার পায়ের নিচে কবুতরছানা। এই দৃশ্য দেখে কিছু দু’চোখে অঞ্জনমাখা ভণ্ড ধর্মাশ্রয়ী হো হো হাসে, উহাদের হিংস্র দাঁতে জ্যোৎস্নাও পারে না দিতে সৌন্দর্য প্রলেপ। ছিন্নবেশ উন্মাদের অট্রহাসি বরং অধিক রমণীয় মনে হয়। বসিয়া বিজনে কেন একা মনে কবি বৃষ্টিতে ভেজাও দুঃখ? কেন বুকের ভেতরে জ্বালা প্রগাঢ় আগুন ছন্নছাড়া প্রার্থনায়?৩ বয়স ঢলেছে বটে পশ্চিম আকাশে, তবু শব্দবোধ সঠিক হ’ল না মঞ্জরিত। দুরাশায় করেছি মেঘের চাষ দারুণ খরায়। চোখমুখ হায়, জ্বলে পুড়ে যায় রোদের ছ্যাঁকায়। বৃষ্টিহীন দীর্ঘ দিবসের ভস্মকণা দু’চোখে ফোটায় পিন। দুঃস্থ কৃষকের, মজুরের চালডাল চকিতে নেপোয় দেয় মেরে।এ শ্রাবণে হায়রে এমন ঘন ঘোর বরিষায় ফুটোময় টিনের ছাদের তলায় এভাবে প্রাণাধিক বিবি বাচ্চা নিয়ে বাস করা দায়।আত্মত্যাগী, রুক্ষ বুদ্ধিজীবী ঢাউস বইয়ের পাতা চেখে নিজেকে বলেন আজো বলেন জনসভায় ধারালো ভাষায়, ‘এ সংকটে মার্কসীয় দর্শন ছাড়া মুক্তি নেই কোনো। কম্যুনিস্ট মেনিফেস্টো সবার মুখস্থ থাকা চাই। সমাজতন্ত্রের কথা অমৃত সমান, শ্রেণীচ্যুত কবি ভনে, শোনো পুণ্যবান।৪ কীভাবে যে বেঁচে আছি পিশাচ নগরে! দিনদুপুরেই দেখি গুম হ’য়ে যায় লোক, নগররক্ষীরা নিদ্রাতুর, পাহারা ভরসাছুট, সকলেই নিষ্ক্রিয় দর্শক। পচা মাংসের দুর্গন্ধ বেড়ে যায়; যে কোনো মুহূর্তে অন্ধকার ঘাড়ে নিয়ে ভিক্ষুর মুদ্রায় আমি চলে যেতে পারি, বহু পথ ঘুরে টলটলে দিঘির কিনারে এসে শান্তিজল আঁজলায় তুলে নেব, হাওয়ায় উড়বে বৈকালী চীবর।৫ এখানে রেখেছি লিখে নিজেকে নানান ছাঁদে, ছোঁও, ছুঁয়ে দেখো, আমার হৃৎপিণ্ড কীরকম বেজে ওঠে নিরিবিলি। শব্দগুলি মিলনপ্রয়াসী রমণীর মতো বুক উন্মোচন ক’রে দেবে। কেউ গৈরিক বাউল হ’য়ে একতারা হাতে এক পাক ঘুরে এ গহন দুপুরে উঠবে গেয়ে গান, কেউ ত্র্যাকর্ডিয়নের রীডে তার আঙুল নাচাবে। এই লেখা অকস্মাৎ আর্তস্বরে ব’লে দেবে হৃদয়ের উষ্ণ-অশ্রুজলে- আমার শৈশব আর আমার কৈশোর সেই কবে বিক্রি হ’য়ে গেছে কোলাহলে আঁশটে হাটে; যৌবন যে বাজেয়াপ্ত হ’ল কবে, নিজেই জানি না। খুঁজে দেখো, আমার স্পন্দিত বুকে স্তরময় বিষাদের খনি।এখানে রেখেছি লিখে অন্যমনস্কভাবে, নাকি গৃঢ় ঘোরে সে গাছের কথা, নিষ্পত্র যে, যার ডালে ভুলেও বসে না কোনো পাখি, যে দাঁড়িয়ে থাকে দিনভরা রাতভর বজ্রাহত অভিমানে।   (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রকৃতিমূলক
‘দ্যাখো, দ্যাখো, কেমন ফুটেছে ফুল আমার বাগানে; বল্‌লে তুমি আমাকে সে-রাতে। দেখি গাঁদা আর কিছু ডালিয়ার স্মিত মুখ। ‘এখানে গোলাপও ছিল ঢের কখনো, কুকুর কষ্ট পাবে বলে, কাঁটার আঘাতে গোলাপ মরেছে যত্নাভাবে-তোমার কথায় ছিল বেদনার রেশ আর আসমানে পঞ্চমীর চাঁদ যেন বা তোমার কণ্ঠে হর্ষবর্ধনের আমলের হাঁসুলি, তোমার দেহে আমার দু’চোখ পর্যটক।পঞ্চমীর চাঁদের অজানা নয় সে-রাতে তখন আমার হৃদয়ে ফুটেছিল অজস্র রঙিন ফুল তোমার সান্নিধ্যে সেই বাগানের কাছে, তুমি টের পাওনি, এমন মশগুল ছিলে বিবরণে। শেষে প্রস্থানের কালে দেখি কলোনি কংকাল অতিকায় এবং পথের ধারে দুধের বাতিল কৌটো, এঁটো।   (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
নিজের বিষয়ে আমি কস্মিনকালেও খুব বেশি ভাবি না, বিশ্বাস করো। মাঝে-মধ্যে ভাবি এ জীবন চাকরিত্বে অন্তরীণ, ভীষণ নাছোড় অনটন সর্বক্ষণ, যদিও ধনিক সংঘে কিছু ঘেঁষাঘেঁষি করি, আর নিজেরই সংসারে অনবোলা পরদেশী হয়ে থাকি, শ্যামলিম মফস্বলে কবি-সম্মেলন হলে যাই কালেভদ্রে, মনে পড়ে আমার এ মন কেড়েছিলো সে কখন নবীনা সুস্মিতা এলোকেশী।অকুন্ঠ কবুল করি, আমার জীবনে নেই কোনো রঙিন চমক কিংবা বীরোচিত কর্মযোগ, শোভা নেই অসামান্য, তবে আমার দর্পণে ভেসে ওঠে অসুখী করুণ বিদূষক আর কখনো সখনো আমার নিমগ্ন সত্তা অন্ধকারে খুনীর বাহবা পেয়ে যায়, মাঝে মাঝে সন্তের ভঙ্গিও কিছু ফোটে।   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
কৈশোরে পৌঁছে মাত্র দু’চার দিনের ফারাকে একে একে বাপ-মা দু’জনকেই হারিয়ে ফেলে মুতালিব আলি। প্রথমে এক ব্যাপক অমাবস্যা কাফনের মতো এঁটে গেল ওর সত্তায়। কিন্তু একদিন শরতের রোদ্দুর ওর কৈশোরকে হাত ধরে পৌঁছে দিলো যৌবনে। মধ্য যৌবনে মুতালিব আলির ঘরে এল এক-গা চমকিলা যৌবন নিয়ে এক কনে। ওকে দেখলে অবশ্য কু’চবরণ কন্যার মেঘবরণ চুলের কথা মনে পড়েনা। কিন্তু একেবারে ফ্যালনাও নয় সে মেয়ের রূপ। এক ধরনের মাধুর্য ওর সারা মুখ জুড়ে খেলা করে বিকেলবেলার আলোর মতো। একদিন মুতালিব আলির খালি ঘরে তার ঘরণীর কোলে মাণিকের আভা ছড়িয়ে খোকা এল। দিন যায়, খোকা মায়ের কোল ছেড়ে উঠোন পেরিয়ে রাস্তায় যায়। মিছিলে আওয়াজ তোলে, সে আওয়াজে দোলে সারি সারি কুর্শি, চলে জোর কদম। গুলি খায়, লুটিয়ে পড়ে ভবিষ্যতের দিকে মুখ রেখে।বুকের একমাত্র মাণিককে হারিয়ে মা বিলাপ করে। মুতালিব আলি কাঁচা-পাকা চুলভর্তি মাথা নিয়ে বসে থাকেন রঁদ্যার মূর্তির মতো। কাল, বিখ্যাত শুশ্রুষাকারী, তাকে মাঝে মধ্যে রক্তকরবীর গুচ্ছ এবং কোত্থেকে উড়ে-আসা পাখির পুচ্ছ থেকে চোখ সরাতে দেয় না। মুতালিব আলি অফিসে যান, সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় গুনগুনিয়ে সুর ভাঁজেন পুরানো গানের।এক হেমন্তসন্ধ্যায় মুতালিব আলির গৃহিনী, জয়তুন খাতুন, বুকের বাঁদিকটা চেপে ধরে টলে পড়লেন, সারা দুনিয়া দুলে উঠলো খোকার শৈশবের দোলনার মতো! তারপর আর তিনি উঠে দাঁড়াননি গা ঝাড়া দিয়ে। মুতালিব আলি এখন একা, ভীষণ একা, একেবারে একা। এখন তার জীবন যেন খুব সান্নাটা এক গোরস্তান। দিন যায়, চুলে আরো বেশি পাক ধরে, মুখের ভাঁজগুলি হয় গাঢ়তর। দিন যায়, পূর্ণিমারাতে বলক-দেওয়া দুধের ফেনার মতো জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়ে উঠোনে, জানলা গলে লুটিয়ে পড়ে খাঁখাঁ বিছানায়। দক্ষিণ দিক থেকে এক ঝাঁক স্বপ্নের মতো হাওয়া আসে, ভালো লাগে, মুতালিব আলির ভালো লাগে।   (অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
আকাশটা যেন ভাঙা বাসনের মতো এক্ষুণি পড়বে ঝরে আমাদের ভয়ার্ত মাথায়-এ রকম আশঙ্কায় কাটছে সময় অনেকের। মস্তিকের ভেতরে বৃশ্চিক কখন যে ফের করবে দংশন আচানক, বলতে পারি না। স্বস্তি নেই, শান্তি নেই একরত্তি; আমি সদা সহবাসী যাদের, তাদের জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চোখ রাখতে পারি না কিছুতেই, যেন এই প্রিয়জনদের সঙ্গে কানামাছি খেলে যাচ্ছি যখন তখন।পায়ের তলার মাটি কাঁপছে ভীষণ, দিকে দিকে ঘরবাড়ি রূপান্তরে ভগ্নস্তুপ, অসহায় মাতম ধ্বনিত পাড়ায় পাড়ায়, কত সংসার উজাড় হলো চোখের পলকে এই কালবেলায় কাদের, কে আমাকে ব’লে দেবে? ‘মানবের, মানবীর’, বলে গেল আতঙ্কিত পাখিদের উড্ডীন মিছিল, দিগন্তের ছায়ায় জন্মন্ধ শিল্পী হয়ে যায় বেদনার্ত সুর। দূর দিগন্তের সুরে আমার লেখনী নিমেষেই টেবিলে স্পন্দিত হয়, গভীর সঙ্কেতে ডাকে কাছে মিলনের আকাঙ্ক্ষায় চেনা ক’টি আঙুলের সঙ্গে। জানি না কী কথা তার মনে মেঘ হয়ে জমে আছে, আমার চৌদিকে শুধু বহু বিঘা পোড়ো জমি আর ওদের হৃদয়-চেরা বিলাপের বিষণ্ন ফসল জেগে ওঠে!মাটিতে একটি মৃত কাকের চৌদিকে উড়ে উড়ে কাছে এসে কয়েকটি কাক প্রতিবাদী শোক করছে পালন, লক্ষ করি আমার জানালা থেকে। অথচ নগরে ও পল্লীতে আজকাল কী সহজে রোজ সোল্লাসে মানুষ চুরি করে নেয় প্রাণ মানুষের প্রতিদিন দেশপ্রেমিকেরা নিগৃহীত, নিপীড়নে জর্জরিত। এখন তো আসমানে চাঁদ বড় বিষণ্ন এবং চুর্ণ হতে চায় প্রতিবাদে।দেখছি স্বচক্ষে আজ মহত্ত্ব বিচূর্ণি, পদদলিত নিয়ত এই ভ্রষ্ট, নষ্ট কালে ন্যাঙটো রোশনিতে। এই মতো ভরদুপুরেই ঢের ঢের আগে, জানি, অকস্মাৎ নেমেছিল ঘোর অমাবস্যা, তবু নানা যুগ করে স্তব, গায় জয়গাথা কালজয়ী মহাপুরুষের।   (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
আমার মৃত্যুর খবর পেয়ে তুমি অবশ্য অঙ্গে কোনো শোকবস্ত্র ধারণ করবে না, তোমার দীঘল চুলও হবে না আলুলায়িত কোনো উন্মাদিনীর মতো, তবে তোমার মানসাকাশ ছেয়ে যাবে শোকার্ত মেঘে।জানি না তুমি তক্ষুণি ছুটে আসবে কি না আমার বাড়িতে, আমার লাশের উপর লুটিয়ে প’ড়ে উদ্বেলিত নদী হয়ে উঠবে কি না। না কি শুধু আড়ালে দাঁড়িয়ে উদাস দৃষ্টি ছড়িয়ে দেবে দূরের আকাশে! হয়তো তখন আমার কিছু কবিতা উড়ে আসবে তোমার দিকে আদর কুড়াতে, যেমন আমি ব্যাকুল হয়ে উঠতাম তোমার স্পর্শের জন্যে, চুম্বনের প্রত্যাশায়। এক সময় হয়তো সবার অগোচরে তুমি নেবে বিদায়। আমার মৃত্যুর পরে কিছুকাল তোমার ভেতরে চলতে থাকবে ভাঙচুর, মাঝে মধ্যে চোখ দুটো হয়ে উঠবে শ্রাবণের ভরা নদী; টেলিফোনে বেজে উঠলে সারসের মতো, হঠাৎ তোমার হৃৎস্পন্দন যাবে বেড়ে। না, তুমি আমার কণ্ঠস্বর শুনতে পাবে না আর। কোনো কোনোদিন যখন স্নানঘরে নিজের উন্মোচিত যুগল স্তনে চোখ যাবে, তখন হয়তো তোমার মনে পড়বে, আমি ওদের নাম রেখেছিলাম জেদী, স্বর্গীয় ফল।কিছুকাল মনে মনে শোক পালনের পর আস্তে-সুস্থে সবকিছুই হয়ে আসবে স্বাভাবিক। স্বামীর সঙ্গে মাঝে মাঝে রাত্রির তৃতীয় যামে রতিবিহারে জীবনের তাপমুগ্ধ হবে তুমি, (মৃত্যু বড় হিম, মৃত্যু বড় দুঃসহ শীতল, প্রিয়তমা) পুত্রকন্যার প্রতি তোমার স্নেহ বাড়বে বৈ কমবে না এক রত্তি, আনন্দে মেতে উঠবে বান্ধবী-সম্মেলনে আগেকার মতোই। মাঝে-মাঝ কাউকে কাউকে পাঠাবে নিজের তৈরি শুভেচ্ছা কেক কিংবা অন্য কোনা উপহার।তখন আমার কবরের ঘাসে, কাঁটাগুল্মে, আগাছায় কখনো নিঝুম রোদ, কখনো হৈ-হৈ বৃষ্টি, কখনো জ্যোৎস্নার ঝলক, কখনো অমাবস্যা, কখনো বা হাওয়ার ফোঁপানি।ক্রমান্বয়ে বয়স বাড়বে তোমার, কেশে ধরবে পাক; কখনো-কখনো নাতি-নাতনীর গুলজার আড্ডায় উল্লসিত হয়ে, ক্লান্ত হয়ে দাঁড়াবে আয়নার সামনে, মন খারাপ হবে, হয়তো মনে পড়বে একজন বয়েসী কবির কথা যে তোমার রূপের তারিফে ছিল মশগুল, যে তোমার হৃদয়ের গাঙে ভাসিয়েছিল তার ভাঙা নাও অসীম সাহসে। হয়তো তোমাকে উপহার-দেওয়া সেই কবির কোনো কবিতার বইয়ের পাতা ওল্টাতে-ওল্টাতে তার ধূসর স্বাক্ষর দেখে হঠাৎ তুমি চমকে উঠবে নিজেরই অজান্তে।   (তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
লোকটা বিকেলবেলা দু’ভুরুর মাঝখানে সোনালি-হলুদ আয়োজন নিয়ে হেঁটে যায়, বসে হ্রদের কিনারে নিরিবিলি; আঁজলায় তুলে নেয় জল পিপাসার ধূসরতা মুছে ফেলার তাগিদে। ডালে-বসে-থাকা পাখি ডেকে ওঠে, যেন বিস্মৃতির আবরণ কোমল সরিয়ে শোনাবে কাহিনী কোনো। পথিকের ক্লান্তি ঝ’রে গেলে অকস্মাৎ কতিপয় ডাকাবুকো লোক ঘিরে ধরে তাকে। জোরে শোরে শব্দ করে সব পাখি আর শান্ত গাছদের পাতা। বুঝি ওরা ভয়ানক ক্ষুব্ধ আর ভীষণ আহত।‘কী তোমার নাম’ প্রশ্ন ক’রে ওরা খুব কটমট তাকায় নিশ্রামরত পথিকের দিকে। ‘নগণ্য মানুষ আমি’, ব’লে সে নীরব হ’য়ে থাকে, প্রসন্নতা-ছাওয়া দৃষ্টি মেলে দেয় হ্রদের গভীরে।‘তোমার নাম ঠিক ঠিক ব’লে দে এক্ষুণি, নইলে আজ বেঘোরে হারাবি প্রাণ’ ব’লে একজন জাঁহাবাজ বুকে তার চকিতে ঠেকায় বন্দুকের নল।‘সামান্য মানুষ আমি, এর চেয়ে বড় পরিচয় নেই কোনো এই অধমের। সদুত্তর নয় ভেবে গর্জে ওঠে ভয়ঙ্কর রাগী মারণাস্ত্র, গোধূলির রঙের মতোই রক্তধারা অবিরাম করে উচ্চারণ, ‘মানুষ, মানুষ।   (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
রূপক
ছিঃ। লোকটা কি আহাম্মকরে বাবা, ‘সোজা আঙুলে ঘি ওঠে না’ বাক্যটি সেই ছেলেবেলা থেকে শুনে শুনেও পড়ন্ত বেলায় তার কোনো আক্কেল হলো না। হিঃ হিঃ হিঃ।ভেবেছিলো, সবকিছুই চলে সরল রেখায়; আসলে যে তা’ নয়, এটা বুঝতে বুঝতে ওর জীবন এলিয়ে পড়েছে গোধূলি আকাশে। কিন্তু, বুঝলে কি হবে? এই এখনো পথে বেরুলে সে চমকে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে, ভড়কে যায়। কী মুশকিল, ডান দিকের রাস্তা সবাইকে ভানুমতির খেল দেখিয়ে বাঁ, দিকে মোড় নেয়, বাঁ দিকের পথ সাপের মতো এঁকে বেঁকে ডানে মিশে যায়। ব্যাপারটা এরকম, এদিক-ওদিক এবং ওদিক-সেদিকে জড়িয়ে যেতে থাকে, যেন মাতালের প্রলাপ।ঢাকঢোল পিটিয়ে জানানো হলো- কাল বিকালে এক বিরাট জমায়েত রাজধানীতে। বাচাল মাইক্রোফোন দশদিক কাঁপিয়ে রটিয়ে গেলো, ‘দলে দলে যোগ দিন’। তা ধিন তা’ ধিন।সেই থেকে মধ্যবয়সী লোকটা ভাবতে শুরু করলো, দ্রোপদীর শাড়ি। এক ফোঁটে ঘুম হলো না রাতে। চোখ থেকে অবিরল পানি গড়িয়ে পুড়ে দু’ গালে।সারাটা দিন কাটে কাজ-থামানো অস্থিরতা আর দপদপে উদ্দীপনায়। বিকেল হ’তেই রত্ত্বয়ানা হয় জমায়েতের উদ্দেশে। অবাক কান্ড, যেখানে হাজার হাজার লোক জড়ো হবার কথা, সেখানে শূন্যতা গেঁয়ো মোড়লের মতো পায়ের ওপর তুলে হুকো টানছে আর বেশ দূরে দাঁড়িয়ে কিছু লোক হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে, যেন মস্ত তামাশা চলছে একটা। সেই ভিড়ে ওর মিত্রদের দেখতে পেয়ে লোকটায় পিলে যায় চমকে; বজের মতো হাঁক দিতে গিয়ে তার মনে হলো, খুবই মিহি গলার আহত এক পাখি ভর করেছে কণ্ঠে, সে নিজের চুল নিজে ছিঁড়তে থাকে এবং চতুর্দিকে হিঃ। হিঃ। হিঃ।ছিঃ লোকটা কী আহাম্মকরে বাবা। ভেবেছিলো, দেশটার চোখ গেছে খুলে, চুয়ান্ন হাজার বর্গ মাইল এখন গনগনে লোহা। এবার সত্যি সত্যি হবে লড়াই। এখন সে ডন কিহোতের মতো একাই লড়ুক উইন্ডমিলের সঙ্গে। ছিঃ। কী বুরবকরে বাবা, হিঃ। হিঃ। হিঃ!   (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
বিষাদের সঙ্গে কাটিয়েছি সারাদিন সারারাত, ভোরবেলা চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে দেখি, এ কী কেমন নাছোড় বিষণ্নতা ভাসমান, কখন যে চুমুকে চুমুকে সেই বিষণ্ন পানীয় আমার নাচার জিভে ছেয়ে গেল আর আমি নিজের কাছেই যেন কেমন বেগানা হয়ে যাই।বুঝতে পারে কি কেউ কীভাবে ভেতরে তার কোন্‌ রিপু তাকে হিঁচড়াতে হিঁচড়াতে নিয়ে যায় সর্বনাশের কন্দরে? এই আমি অসহায় চেয়ে চেয়ে দেখছি যাপিত জীবনের পাতাগুলি কী দ্রুত গাছকে ন্যাড়া ক’রে ঝরে গেছে, এই আমি অচিরেই হয়ে যাব কীট পতঙ্গের উৎসবের উপাদান।হাহাকার তাড়া করে নিয়ত আমাকে আজকাল; কারা যেন, বস্তুত কঙ্কালসার কতিপয় বুড়ো, ভয়ঙ্কর ভঙ্গিমায় এগোয় আমার দিকে, তিমির-ছড়ানো ছমছমে শ্মশানের কালো ছায়া আমার মানসে ভীষণ দুলতে থাকে, পা দু’টো কে যেন মাটিতে দিয়েছে পুঁতে, হায়, হয়ে গেছি স্বরহারা।কিছুক্ষণ কেটে গেলে নিজেকে দেখতে পাই রক্তখেকো কিছু অর্ধপশু অর্ধ-মানবের জটলায়। ওদের বীভৎস চোখ ক্ষণে ক্ষণে করছে বমন নরকের অগ্নি-ঢ্যালা;- পুড়ে যাচ্ছি, ছুটে যেতে চাই অন্য দিকে, অন্য কোনও সুস্নিগ্ধ অভয়াশ্রমে, যেখানে দুঃস্বপ্ন নেই, নেই অর্ধপশু অর্ধ-মানবের পৈশাচিক স্বৈরাচার, বন্য আইনের হাঁক। শ্মশানের ছাই উড়ে এসে জুড়ে বসেছে শহরে আমাদের, বেয়াড়া অস্ত্রের ঝলসানি বারবার নিরীহ চোখের জ্যোতি নেভানোর শপথ নিয়েছে যেন, মাস্তানের জোট শ্রেয়বোধ তাড়ানোর, কল্যাণের দীপ নেভানোর প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে বেদম আর শুভবাদী চেতনা হিংসার পদতলে পিষ্ট, ক্লিষ্ট।সময় কি ফুরিয়ে এসেছে সত্যি? আমি কি এমন ভ্রষ্ট, নষ্ট সমাজের বাসিন্দা হয়েই বাকি সময়ের ধ্বনি শুনে যাবো? ধুধু গোরস্তানের স্তব্ধতা সারাক্ষণ বয়ে যাবো? প্রায়শই মধ্যরাতে ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম থেকে কেঁপে জেগে উঠে বোবা হয়ে থাকবো কেবল? তখন কি ত্বরিত পড়বে মনে একদা দুপুরে-শোনা কোকিলের গান?   (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
রূপক
‘এখানে এসে কি ভুল করলাম?’ এই প্রশ্ন তাকে চঞ্চুতে স্থাপন করে। উস্‌কো খুস্‌কো চুল, গালে দাড়ি কামানোর কাটা দাগ, শার্টের কলারে এক টুকরো ঘাস, যেন স্তম্ভিত টিকটিকির জিভ। এখানে আসার আগে ছিলেন নির্জন মাঠে শুয়ে। মেঠো ঘ্রাণ ঘিরে আছে তাকে, বুঝি উদ্ভিদের প্রাণ তার মাঝে সঞ্চারিত; কেউ তাকে আড় চোখে দ্যাখে, কেউ কেউ উপেক্ষার ডগায় নাচিয়ে কিছুক্ষণ ভিন্ন দিকে নজর ফেলায়, তিনি তাচ্ছিল্য উজিয়ে বললেন, ‘এসো কোণে, একা গুঞ্জনের অন্তরালে’।চোখে তার দূর দূরান্তের ছায়া। একে-একে ক’জন অতিথি কণ্ঠে ভাষণের মনোহর নক্‌শা ফুটিয়ে প্রচুর সুখ্যাতি পেলেন, সারা ঘর করতালিময়। এবার বলার পালা তার। অপ্রস্তুত,থতোমতো, গলায় কিসের দলা বাক্য-রোধক, হঠাৎ তার দু’ ভুরুর মাঝখানে রঙধনু জেগে ওঠে, ভোরের শেভের কাটা দাগে দোলে পুষ্পরেণু, কণ্ঠে ফোটে অচিন পাখির ধ্বনি। সারা ঘর নিস্তব্ধ প্রান্তর।   (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
যদি হতে পারতাম কোনো হিন্দী ফিল্মের নায়ক পুণ্যবলে, তবে আমি ডুগডুগি বাজিয়ে ঠিক কৃতী পুরুষ হতাম জানি। প্রেমের দেবতা যথারীতি মেঘের আড়াল থেকে দিত ছুঁড়ে পুষ্পিত শায়কঃ হস্তিমুর্খ ধনী দুলালী সে-ও নির্ঘাত শৌখিন প্রেমে খেতো হাবুডুবু। মধ্যপথে বাড়াভাতে ছাই পড়লেও, শেষ দৃশ্যে বিসমিল্লা খানের সানাই বাজবে মধুর সুরে, হেসে খেলে কেটে যাবে দিন।অতএব চাকরি বিনে কস্মিনকালে ও ফুটপাত হতো না চষতে আর পরিশ্রমী কুকুরের মতো একটি হাড়ের খোঁজে ক্রমাগত গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে হতাম না ক্লান্ত শুধু। আপাতত এই শীর্ণ হাত করি সমর্পণ দুস্থ জ্যোতিষীর কাছে, ভাগ্যহত- রুপালি পর্দার লীলা অবিরত থাকে চোখ জুড়ে!   (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
এগিয়ে যেতেই চাই। স্থবির আমার চতুর্দিকে গজিয়ে উঠুক নিত্য দীর্ঘকায় ঘাস আর আমি পোকামাকড়ের স্পর্শেও অনড় থাকি, আমাকে করে না দখল এমন সাধ কস্মিনকালেও। আমি দূর তারাময় আকাশে সাঁতার কেটে চাঞ্চল্যের স্বাদ পেতে চাই।অথচ আমাকে আজকাল বারবার ভীষণ ঝিমুনি ঘিরে ধরে; হাঁটতে দাঁড়ালে যেন কেউ চেপে চেয়ারে বসিয়ে দেয় অথবা শয্যায় হাত-পা ছড়িয়ে দিব্যি নিদ্রা নেশায় ডুবিয়ে কোন্‌ সে অবাস্তব মজলিশে নিয়ে যায়, বলা দায়। কাটলে আজব নেশা, ক্লান্তির ছায়ায় মিশে যাই।মধ্যরাতে বাঁশের বাঁশির সুর না জানি কোত্থেকে ভেসে আসে, মনকেমনের আলোড়ন আমাকে চঞ্চল ক’রে তোলে; শয্যা ছেড়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াই। হঠাৎ যুবতী চাঁদের বাহু প্রণয়ের আভা ছড়িয়ে আমার সত্তায় কী গান গেয়ে চলে গেল যোজন শূন্যতায়!এগিয়ে চলার সাধ মিটে গেছে কি আমার? কখনও তা’ নয়। আজও জীবনের এই ধূসর গোধূলি বেলাতেও কাঁটাময় পথে হেঁটে ক্লান্তির কুয়াশা মেখে সত্তায় এগোতেই চাই! পথে আমাকে ফেলুক গিলে, দাঁতাল কাঁটারা সব ছিঁড়ে খুঁড়ে নিক আমার শরীর, যাত্রা তবু থামাবো না।   (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
বসেছিলাম লেখার টেবিল-ঘেষা অনেকদিনের পুরনো চেয়ারে। হঠাৎ চোখ পড়লো কিয়দ্দূরে রোদ পোহানো নিঃসঙ্গ ঢের ক্ষয়ে-যাওয়া একটি জুতোর দিকে। কেমন যেন মায়া লাগলো। কার জন্য?আবার দৃষ্টি ছুঁলো হাতে-রাখা আধ-পড়া বইটির পাতায়, মন বসলো না। দৃষ্টি গেলো পুরনো, বেখাপ্পা জুতোর দিকে। এক লহমায় কী মনে হলো নিজের চেহারা দেখলাম আয়নায়। চমকে উঠি রোদ-পোহানো, ক্ষয়ে-যাওয়া জুতোর সঙ্গে আমার মুখের মিল দেখে।  (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
ঘরের জন্যেই ঘুরি, সারাদিনমান ঘুরি, অথচ কোথাও চার দেয়ালের কিংবা জ্যোৎস্না-ছাওয়া, রৌদ্রের গুঞ্জনময় কোনো ছাদের নিশ্চিন্তি নেই। থিয়েটার গিয়ে দেখি, হায়, এ কেমন বেয়াড়া উদ্ভট স্থান? মঞ্চ নেই, অভিনেতা নেই, নেই দর্শকের ভিড়। একজন বিড়বিড় বিষম অস্পষ্ট কী একটা পড়ছেন, খুব দ্রুত ওল্টাচ্ছেন পাতা, হয়তো বা নাট্যকার, কিন্তু পান্ডুলিপি তাঁর বর্ণমালাহীন। কী-যে হয়, আমি বাগানের কাছে যেতে চেয়ে নিষ্পাদপ মরুন গভীরে চলে যাই। নক্ষত্রপ্রতিম পত্রপূর্ণ গাছ দেখবো না কোনখানে, এ কেমন বেখাপ্পা বসতি?ওখানে কে পড়ে আছে, অধো মুখ, দোমড়ানো টিনের মতন? কাটা সেপাইয়ের ভাগ্যের ভূগোল কাঁটাতার-দীর্ণ, নির্দয় কর্দমময়। তার কাছে ফুল হাতে যাই, ফুল ধুলো হ’য়ে যায়। তবে কি আমিও ধস্‌-আতংকিতখনি-শ্রমিকের মতো ভূ-গর্ভস্থ কয়লার দেয়ালে ভীষণ আটকা পড়ে গেছি উদ্ধারের অতীত? তবে কি আঙুল রক্তাক্ত ক’রে লুপ্ত হবো খনিজ আড়ালে? যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সে-জমিনও আজ যথেষ্ট অনড় নয়, খুঁটিগুলো কেবলি এলিয়ে পড়ে। দৃঢ় ভূমি কোথাও কি নেই? যেদিকে তাকাই, সাগর শুকিয়ে যায়, ঝরনা রূপান্তরিত পাষাণে, মায়ের সিন্দুক প্রতিধ্বনিময় গুহা, অশরীরী তান্ডবে দুঃস্বপ্নাকীর্ণ। তাকালে গাছের দিকে, পাতা পোড়া মাটি হয়ে ঝরে, শেকড় সাপের মতো ফণা তুলে আসে। এমন কি তোমাকেও দেখি না মিটিয়ে তৃষ্ণা, পাছে তোমার গহন ঐ নয়ন পল্লব ভস্মীভূত হয়, তুমি নিমেষে জীবাশ্ম হয়ে যাও।   (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
এ-কথা শিখেছি ঠেকে নিজের ‘মনকে চোখ ঠেরে মেলে না ফায়দা কোনো। যখন দুঃস্বপ্ন আসে তেড়ে জন্মান্ধ ষাঁড়ের মতো ক্রমাগত, মুছে যায় অপমৃত স্বপ্নের কুহক। মেঘে-ঢাকা স্তব্ধ আকাশের বুকে বিদ্যুৎ-ঝলক দেখা দিলে, অন্ধকার আরো বেশি লোভী হয়, নানা অমঙ্গলময় প্রতিচ্ছবি বারবার দেয় হানা ভ্রষ্ট মনে। অলৌকিকে সমর্পিত অগ্রজেরা নিশ্চিন্ত ঠিকানা সহজে ঠাউরে নিয়ে জীবন যাপন করেছেন এবং আপন মহিমার সীমা বাড়াবার ঘোরে ঘুরেছেন দেশ- দেশান্তরে; আমার বিমূঢ় চেতনায় যৌথ স্মরণের রেশ বাজে দিনরাত, সর্বনাশে মাঝে-মাঝে মনে হয় শ্রেয় আত্মঘাত।একদা যে-সব গাছ দিতো ছায়া, তারা সেই কবে হয়েছে নির্মুল বাদ্যরবে যেসব বসতবাড়ি সুরের জৌলুশ পেতো, তাদের মাটিতে মেশানো হয়েছে, উপরন্ত জ্ঞনপীঠে শেয়াল, বাদুড় আর গন্ধমুষিকেরা পেয়েছে মৌরসীপাট্রা, এ শহর দুর্জনের ডেরা ইদানীং। শূন্য ঘড়া বাজে দশ দিকে প্রখর আওয়াজ তুলে; সেতারে এস্রাজে মেকী বিগ্রহের জুড়ি ছাড়া অন্য কোনো ধ্বনি নেই। পথে-ঘাটে শুধু কেন্দ্রচ্যুত, দিশেহারা পথচারী কখনো পা বাড়ায়, কখনো পিছু হটে, চেনা দৃশ্যপটে ক্ষণে ক্ষণে বিভীষিকা কী ব্যাপক লেপ্টে যায়, জেগে ওঠে উষর মধ্যহ্ন মরীচিকা। অনেক আগেই ফুরিয়েছে পুঁজিপাটা, নির্দ্ধধায় বিনা দামে বিকিয়ে দিয়েছি সবকিছু, নিজ নামে রাখিনি কিছুই, শুধু পূর্ব পুরুষের একখানি জরাগ্রস্ত নৌকা ছিল, তা-ও ধু-ধু মাঝ দরিয়ায় ঝড়ে খান খান হয়ে গেছে আর আমি অসহায় সঙ্গীহীন পড়ে আছি ভগ্নকণ্ঠ, এমনকি এখন কারুকে ডাকার শক্তিও লুপ্ত, বুকে অতীতের নুপুরের ধ্বনি বাজে, কবেকার ঝাড় লণ্ঠনের দৃষ্টিকাড়া বর্ণময়তায় চোখ খোঁজে আশ্রয়, পাই না সাড়া কোনোখানে; আজ কাদায় ডুবেছে গলা, একমাত্র কাজ এখন আমার শুধু ব্যাঙাচির নকড়া ছকড়া সয়ে-যাওয়া আর শূন্যে নৌকা বাওয়া।বস্তুত তোমার সামনে ঘটা করে অর্ঘ সাজাবার মতো কিছু নেই বাকি এখন আমার অস্তিত্বের বিপন্ন চীৎকার ছাড়া। পৃথিবীতে জেনেছি কিছুই পারে না বইতে স্থায়িত্বের বার; চামেলী কি জুঁই, অট্রালিকা, বাজ্যপাট-সবই তো মিলায় তঙ্কর হাওয়ায় একদিন; ভালোবাসা, তা-ও ধুলায় উধাও কংকালের কণ্ঠে হাত জড়িয়ে ঘুমায় অকাতরে। কোনো রক্ষাকবজের শক্তি কিংবা দেবতার বলে আস্থা নেই; তবু আমি ব্যাকুল জানাই- যতোদিন বেঁচে আছি, ততোদিন চাই, ভালোবাসা পেতে চাই।   (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
আমরা যখন ভেসে যাচ্ছিলাম নানা কথার স্রোতে, তখনও তুমি বলোনি, আজ সন্ধেবেলা তুমি আসবে। আমরা দু’জন মুগ্ধাবেশে বলছিলাম ভাসমান মেঘের কথা, সদ্য উড়তে-শেখা পক্ষী শাবকের কথা, এমন একটি বাড়ির কথা বলছিলাম, যার অবস্থান গাছপালা, লতাগুল্মময় টিলার উপর। সেই বিনীত, বাংলো প্যাটার্নের বাড়িতে থাকবো শুধু আমরা দু’জন। কেউ আমাদের নির্জনতার দ্বারে হানবে না আঘাত। তুমি বললে কণ্ঠস্বরে মাধুর্যের ঢেউ খেলিয়ে, ‘এই শোনো, তুমি কখনো কবিতা পড়বে, আমি শুনব তন্ময় হ’য়ে, আর আমি পড়বো তোমার নতুন লেখা কোন কবিতা তুমি শুনবে আনন্দিত চিত্তে, আমি পড়তে গিয়ে হোঁচট খেলে, তুমি মৃদু হাসবে। কখনো তোমার মাথা টেনে নেব কোলে, আমার চুল ছড়িয়ে পড়বে তোমার সারা মুখে। আমার আদরে তোমার চোখে নামবে ঘুম। আমাদের স্বপ্নের বাড়িতে বয়ে যাবে আমাদের দিনগুলো, রাতগুলো, যেন গুণীর তান।তুমি চৈত্র-দুপুরে তোমার একাকিত্বের কথা বললে, আমি বললাম আমার ভেতরকার হু হু হাওয়া আর হাহাকারের কথা। কিন্তু আমরা কেউ কারো কথার নিঃসীম শূন্যতাকে ধারণ করতে পারিনি। এক ধরনের অভিমান তোমার মনে ঝুলে রইল সব কালো মেঘ হয়ে। আবার আজ তুমি আসবে আমার ঘরে। আমি সেই সম্ভাবনার কথা ভেবে বসন্ত ঋতুকে নিবেদন করলাম, আজ আসতে হবে আমার ঘরের ভেতর, নার্সারির গোলাপগুলোকে আমার অতিথি হওয়ার আবেদন জানালাম; কোকিল এবং দোয়েলের কাছে খবর পাঠালাম আমার ঘরকে সুরেলা করার জন্যে। এভাবেই সাজাবো আমার ছোট ঘরটিকে। তুমি আসবে তো তোমার সৌন্দর্যের তরঙ্গ তুলে, সুরভি ছড়িয়ে হাওয়ায়? আমি সেই কখন থেকে তোমার প্রতীক্ষায় প্রতিক্ষণ কখনো ধনুকের ছিলা, কখনো চাতকের তৃষিত ডাক।   (তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
বিচিত্র হিংসুক ভিড় শিল্পকে প্রচণ্ড লাথি মেরে, তীব্র কোলাহল করে বোধগুলি আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো, যেন ছেঁড়া হলুদ কাগজ। ক্রমাগত সময় তাড়িত তারা, ঘোরে ঘূর্ণিপথে, বাঁশিগুলি তাদের রোমশ হাতে গুঁড়ো হয়, চতুর্দিকে শুধু বেজে ওঠে ক্যানাস্তারা। জীবন দু’হাতে ঢাকে কান!কমা সেমিকোলনের ভিড়ে এ জীবন কখনো বা ঢ্যাঙা এক শূন্যতায় ভীষণ হাঁপিয়ে ওঠে, পালাই পালাই বলে রোজ প্রহর হত্যার দায়মুক্ত হতে চায়, মুখ থুবড়ে পড়ে দেখি কেমন খুঁড়িয়ে হেঁটে স্মরণীয়ভাবে গলি আর এভেনিউ নিঃসঙ্গ পেরিয়ে যায়, বেলাশেষে হয়তোবা ঝুলে থাকে বাসে। ডানে কিংবা বামে লতাগুল্ম, তৃণদল কিছুই পড়ে না চোখে, নিরুপায় রক্তচক্ষু মেলে দূর নীলনবঘনে।“এ-ও ভালো শুকনো ডালে ঝুলে ঝুলে তুমি প্রতিদিন রাজহাঁস হওয়ার রুটিন-বাঁধা স্বপ্নে মশগুল, এ-ও ভালো রঙরেজিনীর কিছু রঙ ধার নিয়ে কদাচিৎ নিজের আত্মার চিত্র মনোহারী করার নিখুঁত প্রয়াসে নিমগ্ন থাকা, ছুঁড়ে ফেলে দেয়া দূরে নিরঙ বুরুশ- এ-ও ভালো; ভালো এই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা মরজগতের শিল্প সব, চেয়ে দেখা যা-কিছু লুকানো রহস্যের রুপালি আধারে, ভালো কমা সেমিকোলনের ভিড়ে “নিমজ্জন। অতঃপর নানান ফুলের ডাঁটা নিয়ে শূন্য বুকে বেপরোয়া নিদ্রা যাওয়া ভালো, হঠাৎ দাঁড়িয়ে পালা এলেই নিশ্চিত জেনো চুকে যাবে সব পাট। দ্যাখো সারাক্ষণ কারা যেন সুন্দর পাখির ঝাঁক প্রত্যহ দু’বেলা পোড়াচ্ছে ফার্ণেসে” বলে এ জীবন ভাঙ্গা হাঁটু গেড়ে বসে গৃহকোণে আর মাথা রাখে স্বপ্নহীন ক্ষুধিত দেয়ালে।   (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
মাকে দেখি প্রতিদিন ধ্যানী প্রদক্ষিণে ছায়াবৃতা আপন সংসারে। তাকে চিনে নিতে পারি সহজেই যখন নিভৃত অনুভবে বারবার একটি ভাস্বর নদী, ফলের বাগান, মাঠ আর শস্যক্ষেত, দূরের পাহাড় গলে গিয়ে একই স্রোতে বয়ে যায়, সীমা মুছে যায় চরাচরে স্বদেশের স্বতন্ত্র মহিমা অনন্য উপমা তাঁর। কে যেন চকিতে চেনা স্বরে বলে শুনি, পাল্কি চড়ে, বেনারসি পরে যদিন এলেন তিনি আমার ঘরে চেরাগের মতো কল্যাণের হাত ধরে- তারই স্মৃতি আছে লেগে অদৃশ্য চাঁপার উন্মীলনে, সোনার কলসে আর সাঁঝ-নামা দিঘির গহনে। মার চোখে শৈশবের ক্রৌঞ্চ দ্বীপ ভাসে? চোখে বেনেবউ পাখি, চোখে চন্দ্রমল্লিকার দাবি শঙ্কিত আভাসে আঁকা-ভাবি রান্না আর কান্না গাঁথা রুক্ষ এই মরুর আকাশে এখনও কি স্বপ্ন বোনে ঊর্ণনাভ চাঁদ নাকি স্বপ্নের জরির পাড়ে সবি জাদুকরি ফাঁদ। চেয়েছে বুকের সূক্ষ্ণ সোনালি সুতোয় চিরদিন সমস্ত জীবন হোক নকশিকাঁথা সে ইচ্ছার ঋণ শুধে দিতে বুঝি হতে হয় গাছের মতোই এই রৌদ্রজলে মৃন্ময়, তন্ময়।মাকে দেখি। আজও দেখি কী এক মায়ায় পাখি তার হাত থেকে স্নেহের খাবার খেয়ে যায় দু’বেলা আবেগ ভরে। দেখি তসবি গুনে সত্তার মিনারে সত্তার কিনারে ঐ দূরায়নী আজানের ধ্বনি শুনে আর সুবে-সাদেকের তীব্র শুভ্রতায় নির্মেঘ আনন্দে শোকে আজীবন সমর্পিতা কোরানের শ্লোকে।আমার দুর্ভাগ্য সেই বিশ্বাসের অনড় জমিনে দেখি না প্রোথিত কোনো অলীক পর্বত-যাকে চিনে দ্বন্দ্বহীন জীবনের কাছে আত্মবিসর্জনে পাব স্বর্গসুখ। মাঝে-মাঝে সংশয়ের গলিতে বিমুখ প্রশ্ন তুলে ধরে ফণা আমি কি সঠিক জানি ভদ্রমহিলাকে -আমি যার একান্ত বিস্তার অনন্তের শুভ্রলোকে- চিনি তাকে? ব্যথা হয়ে বাজে মাঝে-মাঝে তারও চোখ আমার অস্তিত্ব-পটে ‘কে এই অচেনা ভদ্রলোক?’   (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)