poet
stringclasses
137 values
category
stringclasses
21 values
poem
stringlengths
9
18.7k
শামসুর রাহমান
স্বদেশমূলক
গুলিবিদ্ধ শহর করছে অশ্রুপাত অবিরত, কেননা মিলন নেই। দিন দুপুরেই নরকের শিকারী কুকুর তার বুকে বসিয়েছে দাঁত, বড় নিঝুম স্থাপত্য আজ মিলনের প্রতিবাদী মুখ।মিছিলে আসার আগে মায়ের স্নেহের ছায়া থেকে তাড়াতাড়ি সরে এসে, স্ত্রীর প্রতি হাত নেড়ে, চুমো খেয়ে শিশুকন্যাটিকে নেমেছিল পথে শুভ্রতায় শহরের বন্দীদশা ঘোচাবার দুর্নিবার টানে।এ শহর ছিল শৃঙ্খলিত, ভয়ংকর শৃঙ্খলিত প্রতিটি মানুষ, ঘরদোর, গাছপালা পশুপাখি; শেকল ভাঙার গানে কণ্ঠ মেলাতে মিলন নিজে আগুন-ঝরানো গান হয়েছিল তপ্তজনপথে।অকস্মাৎ আকাশে কে যেন দিল ঢেলে কালো কালি, দুপুর সন্ধ্যার সাজ প’রে বিধবার মতো চোখ মেলে চেয়ে থাকে আর আঁচলে সংগ্রামী স্মৃতি জ্বলে, মিলনের মুখে বৃষ্টি নয়, বাংলার অশ্রু ঝরে।   (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
আসলে ব্যাপার হলো, এখন আমরা একটা খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছি। ঘুরঘুট্রি অন্ধকারে কেউ কারো মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না; অন্ধের মতো এ ওকোঁ হাতড়ে বেড়াচ্ছি, খুঁজছি ভালো ক’রে দাঁড়াবার মতো একটা জায়গা। একটু পরেই হয়তো আলোর আবীর ছড়িয়ে পড়বে, কিন্তু যতক্ষণ না পড়ে ততক্ষণ আমাদের সর্তক থাকার পালা, যাতে পা হড়কে অতল খাদে না পড়ে যাই। আমার পিছনে ফেলে এসেছি অনেক খানাখন্দ, চোরাবালি; বহু বালিয়াড়ি পাড়ি দিয়েছি-আমাদের চামড়া ঝলসে গেছে রোদের অত্যাচারী চুমোয়, আমাদের পাগুলো এখন সীসার মতো ভারী; দীর্ঘ অনাহারে শীর্ণ, কায়ক্লেশে নিজেদের টেনে হিঁচড়ে কোনোমতে নিয়ে এসেছি এই খাদের কিনারে। এক পা একা পা ক’রে আরেকটু এগোলে কী নজরে পড়বে, জানিনা। হয়তো খুব কাছেই একটা পাইথন ভীষণ কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে আছে, যে-কোনো মুহূর্তে নড়ে উঠতে পারে আমাদের গিলে খাওয়ার জন্যে, ভাবতেই ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ, বুকের রক্ত হিম। এই পাইথনের কথা অজানা নয় কারো; কাড়া-নাকাড়া বাজিয়ে চারদিকে রটানো হয়েছে ওর কীর্তিগাঁথা। ইতোমধ্যে ঢের ছাগল, ভেড়া, হরিণ, শুয়োর এবং মানুষ শিকার হয়েছে ওর। আমাদের আগে যারা এসেছিল এই পথে, তারা কেউ গন্তব্যে পৌঁছতে পারেনি, একে একে সবাই ফৌত হয়ে গেছে পাইথনের স্বেচ্ছাচারে।এই গিরিখাদ পেরুতে পারলেই একটি নদীর রূপালি কল্লোল শুনতে পাবো দৃষ্টি সবুজ করে দিয়ে উচ্ছ্বসিত হবে শস্যের মাঠ, শত শত শিশুর কণ্ঠস্বর পাখির গানের ঝংকৃত ছায়া বুনে দেবে স্মৃতিতে।ভয়ের গলায় পা রেখে, পাইথনের বিখ্যাত ক্ষুধায় ধুলো দিয়ে যত কষ্টই হোক, সামনের দিকে নজর রেখে এখন একটু পা চালানো দরকার। পাইথনের আড়মোড়া ভাঙার ধরনের আমাদের পায়ের তলায় মাটি নড়ে উঠছে ঘন ঘন। তবে কি এখন শুরু হবে ভয়ংকর সেই ভূমিকম্প, যার ধমকে টাল সামলাতে না পেরে পাইথনটা নিজেই পড়ে যাবে অতল গিরিখাদে?   (অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
কবিতা আমার ধমনীকে তোর জোগাই নিত্য রক্তকণা। হায় রে তবুও তোর জন্যেই পদে পদে জোটে প্রবঞ্চনা।হেঁটেছিস পথ গুরুজনদের শত গজ্ঞনা মাথায় করে। কাটা ঘুড়ি তুই, বাতাসের লেজ শাসাচ্ছে তোকে অবুঝ ওরে।হায় রে দুস্থ কবিতা আমার তুলে নিলি কোন্‌ জোয়াল কাঁধে! কিসের তাড়ায় এখানে যে তোর চক্ষুলজ্জা খোয়াতে বাধে!ছেঁড়া কাঁথাটাকে সম্বল করে কতকাল আর ঘুরবি বল? নির্বোধ নারী, বাতুল পুরুষ তোর কাছে চায় সুখের ছল।অনাবশ্যক মুক্তো ছড়ালি ফোটালি অলীক কথার খই। যোগ্য মূল্য দেবে যে তেমন উলুবনে বল ক্রেতারা কই?পয়ারে কিংবা মাত্রাবৃত্তে আঁধারকে দিলি আলোর ধার। বিশ্বজোড়া সে সন্তাপ ছেঁকে এনেছিস বটে সত্যসার।প্রতি পক্ষের বাছা বাছা চাঁই নিন্দা রটায় কাব্যলোকেঃ রোগজর্জর এক দশকেই দারুণ শনিতে পেয়েছে তোকেখ্যাতির দ্রাক্ষা নাগালে পাসনি বলেই দিবি কি গলায় দড়ি? তোর দর্পণে চিরন্তনের প্রতিবিম্বকে ঈষৎ ধরি।   (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
এখন আমার সত্তাময় কত ভীষণ আঁচড়। কত পৌরাণিক পশু আমার সমগ্রে দাঁত-নখ বসিয়েছে বারংবার ধুমায়িত ক্রোধে। কী প্রখর চঞ্চু দিয়ে ঝাঁক ঝাঁক কালো পাখি আমার ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেলেছে বেবাক, কোনোদিন দেখবে না তুমি, খেদহীন আমি তোমার ধারণা, বিবেচনা ইত্যাদির পরপারে আস্তে সুস্থে হেঁটে যাবো, চেনা- শোনা ছিল কোনোদিন আমাদের, এই তো সান্ত্বনা।বিদায়ের ঘণ্টা বাজে হৃদয়ের দিগন্তে এখন। চড়ায় ঠেকেছে শূন্য রূপসী ময়ূরপঙ্খী নাও, বৈরী হাওয়া সহসা কাঁপিয়ে দেয় আমার পাঁজর। দুঃখ নাম্নী যে নিঝুম পল্লী আছে, সেখানে আপন ডেরা আজো, সংসার পাতো গে তুমি, যাও মেয়ে যাও, বস্তুত তোমার পথ চেয়ে আছে মুর্গী ও গাজর!   (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
রূপক
যখন রবীন্দ্রনাথ কালো ঘোড়াটাকে সিন্ধুপারে দেখলেন, সম্মুখ শান্তির পারাবার অবগাহনের তৃষ্ণা নিয়ে চোখে দৃশ্য-মোছা-ঝড়ে দিলেন প্রশান্ত দৃষ্টি মেলে চরাচরে, মৃত্যুর অতীত সৃষ্টিলীলা, শান্তিলেপা কত ছবি শব্দের ছন্দের জাদু, মায়াবনবিহারিণী হরিণী এবং ছায়া সুনিবিড় গ্রাম, মাছের কানকা ভরা গলি, ঋতুরং- যেদিন গেলেন তিনি, ভুললেন সবি।হামেদ জালাল, সেই পৌঢ়, জ্যোৎস্না রাতে যিনি গ্রান্ড ক্যানালের গন্ডোলায় ভেসে আপেলের মতো ছাড়িয়ে সত্যের খোসা, স্মিত হেসে বুদ্ধের মূর্তির নিচে, যিনি বাদামি চুলের বান্ধবীর সাথে কাঁকড়ার ঝোল কিংবা অয়েস্টার চোখে, মাতাডোর আর ষাঁড়ের লড়াই দেখে মিটিয়ে চোখের তৃষ্ণা ঘাসের ঘাগরার নাচে, শেষে একদিন সাফল্যের তরী বেয়ে সুদূরে আবেশে স্বদেশের ঘাটে ভিড়লেন, যিনি শালিকের দিকে চেয়ে ‘আগে এখানে নামিনি? তিনিও ধুলোয় মিশে ভুললেন কাঞ্চন-কামিনী, ত্বকের নিবিড় লেনদেন।সুফিয়া খাতুন যার ঘন কেশদামে ছিল দীপ্ত যৌবনের স্বর্ণভস্ম, যাকে নীল খামে স্বামী ছাড়া আরো ক’জন উদ্‌ভ্রান্ত যুবা নানা ছলে পাঠিয়েছে পত্র-লোকে বলে, তিনিও কবরে শুয়ে ভোলেন নিপুণ কামকলা। কর্মঘর্ম গাঁথা ব্যস্ত রাস্তায় গলিতে যারা গলাবাজি করে, দাঁতে দাঁত ঘষে, সহানুভূতির মতো সবুজ সবজির প্রয়োজনে দর কষে, রুটির মতোই জীবনকে ধ্রুব জানে জমায় বিভ্রান্ত ভিড় শুঁড়ির দোকানে, সোনার ষাঁড়ের লেজ ধরার আশায় দিনরাত ঘোরে দিগ্ধিদিক, বিকেলের মিহি রোদে নেতার বক্তৃতা শুনে দেয় করতালি, অকস্মাৎ মুখ ঢেকে কেঁদে ওঠে বেনামি দুর্জ্ঞেয় কোনো বোধে তারা যাবে, ভুলবে বাজার দর আর সোমবার কিবা রবিবার।   (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
তুমি আমাকে ভুলে যাবে, আমি ভাবতেই পারি না। আমাকে মন থেকে মুছে ফেলে তুমি আছো এই সংসারে, হাঁটছো বারান্দায়, মুখ দেখছো আয়নায়, আঙুলে জড়াচ্ছো চুল, দেখছো তোমার সিঁথি দিয়ে বেরিয়ে গেছে অন্তুহীন উদ্যানের পথ, দেখছো তোমার হাতের তালুতে ঝলমল করছে রূপালি শহর, আমাকে মন থেকে মুছে ফেলে তুমি অস্তিত্বের ভূভাগে ফোটাচ্ছো ফুল আমি ভাবতেই পারি না। যখনই ভাবি, হঠাৎ কোনো একদিন তুমি আমাকে ভুলে যেতে পারো, যেমন ভুলে গেছো অনেকদিন আগে পড়া কোনো উপন্যাস, তখন ভয় কালো কামিজ প’রে হাজির হয় আমার সামনে, পায়চারি করে ঘন ঘন মগজের মেঝেতে, তখন একটা বুনো ঘোড়া খুরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে আমাকে, আর আমার আর্তনাদ ঘুরপাক খেতে খেতে অবসন্ন হয়ে নিশ্চুপ এক সময়, যেমন ভ্রষ্ট পথিকের চিৎকার হারিয়ে যায় বিশাল মরুভূমিতে। বিদায় বেলায় সাঝটাঝ আমি মানি না আমি চাই ফিরে এসো তুমি স্মৃতি বিস্মৃতির প্রান্তর পেরিয়ে শাড়ীর ঢেউ তুলে,সব অশ্লীল চিৎকার সব বর্বর বচসা স্তব্দ করে ফিরে এসো তুমি, ফিরে এসো স্বপ্নের মতো চিলেকোঠায় মিশে যাও স্পন্দনে আমার।
শামসুর রাহমান
রূপক
আজকাল কী-যে হয়, বড় ভুল করে ফেলি বারবার। চিঠি লিখে খামে ভরবার পর ঠিকানা লিখতে গিয়ে কিছু বাদ পড়ে যায় অনিচ্ছাবশত আর সেই ভ্রম ভ্রমরের মতো হুল ফোটাতেই থাকে। চিঠিখানি ডাকঘরে বেঘোরে ঘুমায়।বয়সকে দোষী ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিই বটে, তবু এই বেয়াড়া মনের হঠকারি আচরণে ক্রদ্ধ হয়ে আমারই মাথার চুল ছিঁড়ি আর কষে চড় দিই টেবিলের গালে। অকস্মাৎ নিকটে ঝিমিয়ে-থাকা অসমাপ্ত কবিতা আমার হায়, ভীতত্রস্ত হয়ে দৃষ্টিপাত করে ডানে, বামে।তা হ’লে আমি কি খাতা বন্ধ করে রাখবো সর্বদা ? কলমের মুখে এঁকে দেবো খিল যতদিন বেঁচে থাকি ? ‘কেন তুমি এই মতো ভাবনাকে আজকাল চলেছো প্রশ্রয় দিয়ে ?’- নিজেকে সওয়াল করি; ‘মন থেকে ঝেড়ে ফেলে শুধু স্বাভাবিক জীবনের পথে হেঁটে ফের তুখোড় আড্ডায় ঝেড়ে ফেলো ক্লান্তির কুয়াশা।‘অথচ আমাকে নানা উদ্ভট দৃশ্যের ছায়াছবি কেবলই দেখায় ভয়। ঘুমোতে গেলেই কঙ্কালেরা আমার শয্যার পাশে এসে দাঁড়ায় অথবা বসে। নিঃশব্দ হাসির তোড়ে ভাসায় আমাকে!কাদের ভগ্নাংশ এরা? কোন্‌ দশক অথবা শতকের ধুলো ঝেড়েঝুড়ে এসেছে এখানে? দাঁতহারা, শব্দহারা হাসি যাচ্ছে দেখা মুখমণ্ডলে ওদের। কঙ্কালের হাসি কি আমাকে কোনও পরমার্থ বোঝাবার চেষ্টা করছে নির্জন ঘরে? পরমুহূর্তেই ওরা ঘরের রেলিং-এ ঝুলে পড়ে, যেন কোনও ঘৃণ্য অপরাধের আসামি। আচমকা নিজেকেই সেই কঙ্কালের মতো মনে হয় আর আমি শুয়ে আছি যেন কোনও পুরনো কবরে; নানা কীট শরীরের মাংসহীন, ক্ষয়া হাড়ে হেঁটে হেঁটে ভীষণ বিরক্ত, ক্রুদ্ধ খুব! সেই দৃশ্য থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে করে ভারী ক্লান্ত হয়ে পড়ি, নখ দিয়ে স্যাঁতসেঁতে মাটি আঁচড়াতে থাকি।  (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
কী-যে হলো ক’দিনেই এমন বেহাল। অ্যাম্বলেন্স আসেনি এখনো। প্লিজ, টেলিফোন করো আবার; অস্তিত্ব আগাগোড়া করুণ রঙিন মেঘে মোড়া, চৈতন্যের ছেঁড়া সুতো দিয়ে জোড়া। ফুসফুসে প্রদাহ, দু’চোখ বুজে আসে, ঘন ঘন শ্বাসকষ্ট, সন্ধ্যা না সকাল বোঝা দায়; মাঝে মধ্যে কানে আসে ফিস্‌ফিসে কণ্ঠস্বর। কে যে কোন্‌ কাজে যায়, কী সে কিছু কমবে যন্ত্রণা এ ভাবনা সকলের। কেবল শিশুরা ভাবলেশহীন, বেশ ক্রীড়াপরায়ণ। হয়তো বোঝে, খারাপ একটা কিছু ঘটে গ্যাছে পাটখড়ির মতন লোকটার।যা কিছু আমার প্রিয়, ব্যক্তিগত, বইপত্র, পাণ্ডুলিপি আর না দেখা প্রুফের তাড়া, উদ্বিগ্ন স্বজন- সবকিছু থেকে দূরে বিচ্ছিন্ন চলেছি। অ্যাম্বলেন্স এসে গ্যাছে। স্ট্রেচারে শুইয়ে দাও, দেখো যেন কষ্ট না হয় রোগীর। প্রায় অচেতন; এমন কি বিকারের ঘোরেও চকিতে মনে পড়ে, এসেছো আমার ঘরে। যে মুখ ভোলার প্রশ্ন অবান্তর, খুঁজি তাকে বারম্বার। সিঁড়ি বেয়ে নামছে স্ট্রেচার, অ্যাম্বুলেন্স থেকে দেখি স্বপ্নময়তায় রয়েছো দাঁড়িয়ে ঝুল বারান্দায়। সেখানে ছিলে কি তুমি বাস্তবিক? না কি অন্য কেউ অন্য গ্রহবাসিনী, সুদূর, একাকিনী? যাচ্ছি দ্রুত; বিদায়, বিদায়।২ ‘এক্ষুণি এক্স-রে করা দরকার, ফুস্‌ফুসে কতটা ফ্লুইড জমেছে দেখতে হবে বলে ডাক্তার উদ্বেগে তাকান আমার দিকে। পরে প্লেট দেখে গুম্‌ হয়ে বলেন, ‘প্রচুর অবহেলা করেছেন, বীজাণুর খেলা চলেছে গোপনে বহুকাল। মনে মনে বলি, মানি চক্ষুষ্মান আপনি ডাক্তার অথচ দৃষ্টির অগোচরে রয়ে গেল আপনার চাঁদের পিঠের মতো গর্তময় দুঃখচিহ্নগুলি, সে এক মধুরতমা, সাম্প্রতিক, নিষ্ঠুর আঁচড়ে করেছে জখম বারবার আমাকে, কোনোই দাগ তার পড়লো না এক্সরের প্লেটে কিংবা আপনার চোখে!৩ হাসপাতালের বেডে একা। শ্বাপদের আঁচড়ে, কামড়ে ছেঁড়াখোঁড়া বাবুই পাখির বাসা আমি। খুব ফিকে জামরঙা শাড়ি, রোদ-চশ্‌মা-পরা তুমি আস্তে সুস্থে হেঁটে আমার তন্দ্রার তীরে এলে। মৃদু কণ্ঠস্বর শুনে জেগে উঠি। তোমার চুলের গন্ধে সুরভিত স্বপ্নেরা আমার।কেউ কেউ ছিল কেবিনে এবং হাইহিল জুতোর ব্যস্ততা বাজে। আমার মাথার বালিশটা ঠিকঠাক গুছিয়ে দেবার জন্যে এলে কাছে। রোগীর নির্দোষ অজুহাত নিয়ে প্রথমবারের মতো প্রাণ ভরে নিলাম তোমার নরম বুকের ঘ্রাণ। এখন আমার যাত্রা তোমার অতল অন্তরের অধিক অন্তরে; ভাগ্যিস, আমার ভীষণ অসুখ করেছিল।৪ গাছপালা যেখানে দাঁড়ানো ছিল, সেখানেই আছে। লম্বা বারান্দাটা প্রসারিত, যেন দীর্ঘ স্মৃতিপথরেখা। একটি কি দু’টি শালিক চড়ুই ওড়াউড়ি করে এখানে সেখানে, দুপুরে ডাকতে থাকে বুকে রক্ত তুলে অবোধ কোকিল, সবুজের ছোঁয়া লাগা মাঠ, দূরে ইস্পাতের মতো চকচকে ঝিমধরা ঝিল, আকাশে চক্কর-কাটা শঙ্খচিল ওরা আমাকে তোমার মতো ফেলে অকস্মাৎ চলে যায় নি কোথাও।৫ ‘কাল চলে যাবো’ বলে তুমি দাঁড়ালে বেডের ধারে। অবরুদ্ধ আমার গলায় অগোচরে কী একটা দলা কেমন পাকিয়ে ওঠে। নিরুত্তর চেয়ে থাকি তোমার সুন্দর হস্তধৃত সাহিত্যপত্রের দিকে। তুমি নির্দয়ত’ হবে ভেবে দয়া করে আমার বিরুদ্ধে হুলময় ঝকঝকে ম্যাগাজিন দাও নি, যা তোমার নিজেরই সম্পাদিত; তোমার পড়ে নি মনে কীটস্‌-বিরোধী ব্ল্যাকউড ম্যাগাজিনটির কালো কীর্তি ঘুণাক্ষরে? অথবা ভাবো নি একবারও সবচে’ নির্দয় খেলা সাত তাড়াতাড়ি আমাকে একলা ফেলে রেখে তোমার অমন চলে যাওয়া। তোমার নিকট দয়া নয়, দয়াবতী, ভালোবাসা চাই; যদি পারো আমার মুমূর্ষ ওষ্ঠ সঞ্জীবিত করো স্বর্গের শিশিরে।৬ সারাক্ষণ ছটফট করি, উল্টে-ধাওয়া আরশোলা। মাঝে মধ্যে নানাবিধ শব্দ কানে আসে, রাত্রির নিজস্ব শব্দ আছে কতিপয়, যা শুনলে এমন কি খুব অসুখেও গা’ অত্যন্ত ছম ছম করে। সারারাত নিদ্রাহীনতায় কাটে, ভোরে চোখ জ্বালা করে, কেউ মরিচের গুড়ো ছাড়য়ে দিয়েছে চোখে। অস্থিরতা বাসা বেধেছে সত্তায়, কছিতেই স্বস্তি নেই। খাদ্যাতঙ্ক করেছে দখল আর টলটলে লিকুইড ফুড্‌ও ক্রমাগত প্রত্যাখ্যান করছে জঠর। প্রত্যুষ আমার প্রিয় চিরকাল, কালো রাত কাটে উজ্জ্বল ভোরের প্রতীক্ষায়। অথচ প্রত্যুষ কেন এরকম বিবমিষা আনে? তুমি নেই পাশে, বুক পুড়ে খাক, বুক পুড়ে খাক। হৃদয়ের চোখ সয়লাব পানিতে পানিতে, তবুও নেভে না কেন বুকের দহন?৭ কতকাল ছুঁই না তোমাকে। কতকাল তোমার অধর থেকে আমার তৃষ্ণার্ত ওষ্ঠ বিচ্ছিন্ন এবং কাঁপে না তোমার স্তন বনকপোতীর মতো থর থর আমার মুঠোয়। আমার নিঃশ্বাসে নেই বিষ, স্পর্শে যার গোলাপের বুকে ছড়িয়ে পড়বে কীট। এখন মধুরতমা নির্দ্বিধায় এসে তোমার মসৃণ চুলে আমার ফ্যাকাশে মুখ ঢেকে খেতে পারো তীব্র চুমো। জীবন আমাকে বাঁচার ছন্দেও দোলা দিয়েছে শিখিয়ে পুনরায়। শুধু একবার এসে দেখে যাও এই আরোগ্যশালায়। দিনভর রাতভর, বল’ যায়, তোমার কথাই ভাবি, মনে মনে কত মূর্তি বানাই তোমার আর পূণ্যবানগণ অকস্মাৎ অতিশয় আতশি মেজাজে পৌত্তলিক ভেবে আমাকে অন্তত দিনে সাতবার পাঠাতে পারেন জাহান্নামে। দিন্‌ তারা যে কোনো বিধান, মাথা পেতে নেবো; অথচ তোমারই স্পর্শ এ ব্যাধিতে আমার নিদান।৮ খানিক আগেই রোজকার নার্সের ইঞ্জেকশন দেয়া হয়ে গ্যাছে; বিকেলে শহীদ নূর হোসেনের পিতা বিনীত এলেন ফলমূল, এক বুক লুকোনো শোকের রেশ, ইতিহাস নিয়ে। দর্শনার্থী একে একে সকলেই চলে যান বিভিন্ন সময়ে। আসমানে কতিপয় তারা, দূরে বাড়িগুলি একাকার, ইউক্যালিপ্টাস, সারি সারি, সতর্ক প্রহরী, একাকিত্বে আমি ইজিচেয়ারে ছায়ার্ত বারান্দায় আধ-শোয়া, আম-জাম গাছের পাতার অভ্যন্তর থেকে গোলগাল চাঁদ উঁকিঝুঁকি দ্যায়, যেমন নাইওরে যাবার সময় নববধূ পাল্কির পর্দাটা লাজুক সরিয়ে। আমার কাতর ক্লান্ত ফুসফুসে অবিরত ঝরে চাঁদের আবীর।রাতে বাড়ে, চোখ বুজে আসে, বহুদূরে কে জানে কোথায় তুমি শুয়ে আছো, তোমার স্তনের চাপে নক্‌শা ফোটে নম্র বিছানার চাদরে, বালিশে ছড়ানো রেশমি চুল, ঠোঁটে নিঃশ্বাস আমার কবিতার; তোমার শরীর জুড়ে আমার স্বপ্নের কী মদির আলিঙ্গন, লবণাক্ত, স্বেদবিন্দুময়।৯ রাত কটা বাজে? ঘড়ি দেখবার সামর্থ্য উধাও। নিস্তব্ধতা ওৎ পেতে আছে চারদিকে; যখন অনেকে যে যার শয্যায় ঘুমের প্রলেপে মজে থাকে, কায়ক্লেশ ক্রমাগত বেড়ে যায় আমার এবং শরীরের ভাঁজে ভাঁজে ডাকিনীর বিশীর্ণ আঙুল ছড়ায় যন্ত্রণা-বিষ। পুরনো নিউজ রীলে দেখা অসউইজের নাৎসী বন্দি নিবাসের উৎপীড়িত বাসিন্দার মতো আমি দেখতে এখন। প্রাণপণে মানুষ থাকতে চাই, তবু আমার ভেতর থেকে ভয়ানক কষ্ট-পাওয়া পশু ভীষণ চিৎকার করে যখন তখন। অন্ধকারে সশ্রদ্ধ আবৃত্তি করি মেয়ে মৌলানা রুমির সুবচন- ‘প্রেমের ব্যাধির চেয়ে অধিক যন্ত্রণাময় ব্যাধি নেই কোনো!   (হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
রূপক
আমাকে যেতেই হবে দূরে, বহু দূরে। যদি পা আমার এখন প্রবল হয়ে যায়, তা হ’লে নিশ্চিত আমার এই সংসারে বেকার হয়ে থাকব এক কোণে থাকব সবার কণ্ঠলগ্নপাত্র হয়ে, যা আমার কস্মিনকালেও নয় বিন্দুমাত্র কাঙ্ঘনীয়, তখন কি বলতেই হবে আমরাই সব স্বেচ্ছায় নিয়েছি গ’ড়ে আমাদের বাসনার প্রবল ইচ্ছায়।বলতে কি হবে কোনও-একটি ঘটনা আমাদের প্রবল ইচ্ছায় ঘ’টে গেলে আমাদের প্রতিটি ইচ্ছাই ঘ’টে যায় সুষ্ঠুভাবে। এমনও তো হয় পরপর কতিপয় অতিশয় জরুরি কাজের ছেঁড়াখোঁড়া অবসান ঘটে।কে তুমি ডাকছ এই ঘোর অন্ধকারে কামেলা নামের এক রমণীকে? কে সে? কোথায় নিবাস তার? কী সম্পর্ক সেই রমণীর সঙ্গে যার নাম ধরে এই অন্ধকারে বারবার ডাকছ ব্যাকুল সুরে? তাকে দেখতে না পেলে, বলি আমিও ব্যাকুল হব খুব।এসো ভাই আমরা দু’জন কণ্ঠ মিলিয়ে ডাকি পরস্পর, আমরা বাংলার আসমান, বাতাস ভাসিয়ে দিই। আমাদের দেখা হোক না-ই হোক, দু’জনের কণ্ঠস্বর বাতাসে ভাসব ঠিক।   (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
কী ভাবছো? কী ভাবছো তুমি অন্তরালে? কাল রাত নির্ঘুম কেটেছে বুঝি? নানা স্তর থেকে অকস্মাৎ অসংখ্য বিলুপ্ত প্রাণী, সংহারপ্রবণ, সংহারপ্রবণ, অতি কোলাহলময় এবং অকুতোভয়, উঠে এসেছিল দিতে হানা তোমার এ জরাগ্রস্ত ঘরে? মেলেছিল রুক্ষ ডানা ভয়ঙ্কর কোনো পাখি ঢেকে দিতে অস্তিত্ব তোমার? নাকি ভুলে-যাওয়া সব পাখি, অস্পষ্ট ফুলের ঝাড় মনের ভিতরে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে দেখছো কর্কশ বালুচরে পড়ে আছো, যেখানে রঙের খেলা নেই, ফুলঘ্রাণ নেই একরত্তি, কতকাল কোনো গান বাজেনি তোমার প্রাণে। কেবলি ক্ষয়ের টানে একা উদাস চলেছো ভেসে, চতুর্দিকে কম্পমান বনরেখা।যে-জন বাজায় বেলা দু’হাতে একেলা, তুমি তার কাছ থেকে বহু দূরে চলে গ্যাছো, যার অন্ধকার ফুলের স্তবক হয়, জ্যোৎস্নায় সাঁতার কেটে, ডুব দিয়ে মল্লিকার বনে যে-জন আড়ালে দ্যাখে খুব মগ্ন হয়ে একটি অস্পষ্ট পরী, দ্যাখে সেই পরী মগের ভিতরে তার আঙুল ডুবিয়ে রত্ন, ঘড়ি, এবং পিঙ্গল চোখ তুলে আনে, তার পরগণা থেকে নির্বাসিত তুমি। তোমার মগজে ধূলিকণা ওড়ে অবিরত ইদানীং। এ ভীষণ বনবাস কখন কাটবে বলো? করে পাবে করোটি সুবাস?স্বপ্নের জটিল লতা-গুল্মময় হৃদয়ের তন্তুগুলি দ্রুত খাচ্ছে উঁই অগোচরে, বেলা যায়। পরিপার্শ্ব বিদেশ-বিভূঁই মনে হয়; কোথায় কী আছে বাসগৃহে, ফুটপাতে, দূরবর্তী গাছে, যেওনা-পল্লীর কাছে, ভুলে থাকো? কী ভাবছো? কী ভাবছো তুমি? ভাবছো কি মানুষের আলুথালু সত্তা দুঃস্বপ্নের জন্মভূমি? ভাবছো কি কৃষ্ণচূড়া প্রায় ডাকঘর অতিশয় শূন্য, মুছে যায় স্বপ্নাক্ষর কালো ফুঁয়ে বারংবার, ঝরণা তলে কেন কুড়োয় না ফুল সুধা, বুলেটের ঝড়ে আর্তস্বরে ডেকে যান দীর্ণ পাবলো নেরুদা?   (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
আমার শিরায় পূর্বপুরুষের রক্ত কী উচ্ছল নাচে আগোচরে। অগ্নিকুন্ড, বর্শা অসি ক্ষুরধার, স্বেদসিক্ত ঘোড়া, চিত্রায়িত রাঙা কাচ, সিংহদ্বার ঝলসানো হরিণ এবং মল্লযুদ্ধ রক্তোৎপল মাঝে মধ্যে আনে ঘোর স্তরে স্তরে অবচেতনের। আমিও ছিলাম সেই দূর শতকের সুবিশাল দূর্গের প্রাকার আর আমার গন্ডারচর্ম ঢাল ঝলসে উঠেছে রণক্ষেত্রে, ডঙ্কা শক্রূ হননেরনেশা ধরিয়েছে রক্তে। আবার এ কোন সুপ্রাচীন ভেসে ওঠে জলজ্ব্যান্ত? নিভৃত প্রকোষ্ঠে বসে শীতে নিমগ্ন কিসের ধ্যানে সে মানব এমন একাকী? চঞ্চল পালক তার হাতে, কোনো মায়াবী সংগীতে যেন সে গভীর আন্দোলিত, তার দিকে চেয়ে থাকি নিষ্পলক; সে-তো আমি, গানে-পাওয়া, আর্ত উদাসীন।    (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
বড় বেশি অস্থিরতা গোধূলিতে আমাকে দখল করে নিয়ে জনহীন ঘরে ডানে বামে ঘোরাচ্ছে ভীষণ। এ বয়সে এ রকম ছটফটে আচরণ খুব বেমানান ব’লে মৃদু হাসবেন অনেকেই। এমনকি কেউ মস্তিষ্কের বিকৃতি ভেবেই দুশ্চিন্তায় মজবেন।ব্যাপারটি বুঝতে পেরেও দ্রুত করি পায়চারি ঘরের ভেতর। ঘন ঘন চোখ যায় পুরনো দেয়ালে, উড়ে-যাওয়া পাখি আর আকাশের নীলে, অকস্মাৎ চুপচাপ লেখার টেবিল-ঘেঁসে দাঁড়ানো চেয়ারে বসে পড়ি। চোখ দু’টি অজান্তেই দ্রুত মুদে আসে।আচানক কার গাঢ় কণ্ঠস্বর যেন আমাকে প্রবল নাড়া দিয়ে চোখ খুলে সামনের দিকে দৃষ্টি মেলে দিতে বাধ্য করে। দেখি একজন সুকান্ত প্রবীণ নিরীক্ষণ করছেন আমাকে প্রকৃত বিশ্লেষণী ভঙ্গিমায়। পরক্ষণে তিনি সাবলীল উচ্চারণ করলেন অনুপম কথামালা। দৃষ্টি থেকে তাঁর হলো বিচ্ছুরিত কিছু হীরাপ্রতিম বাক্যের ফুলঝুরি শুধু।কী করে যে কেটে গেলো নিমেষেই এমন সময়, বুঝতে পারিনি কিছুতেই। শ্রদ্ধেয় প্রবীণ চেনা দৃশ্য থেকে তাঁর অনুপম সৌন্দর্যের আভা নিয়ে কোথায় যে হলেন বিলীন, জানবো না কোনওকালে, শুধু তাঁর সৌম্য মূর্তি স্মৃতির উদ্যানে মাঝে-মধ্যে হবে প্রস্ফুটিত আর তাঁর বাণী বেলা অবেলায় গুঞ্জরিত হয়ে এই ব্যর্থ জ্ঞানপ্রার্থী আমাকে করবে ঋদ্ধ বেলা অবেলায়।  (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
রূপক
আজকাল মাঝে মাঝে কেন যে চকিতে বুদ্ধমূর্তি জেগে ওঠে দৃষ্টিতে এবং আমি সুদূর দিগন্তে হেঁটে যেতে থাকি ব’লে মনে হয় শুধু। উদাস দৃষ্টিতে তাকাই সম্মুখে, দেখি বুদ্ধদেব বোধিদ্রুতলে ধ্যানমগ্ন আছেন একাকী বসে। ধ্যানকে বাতাস ঘন ঘন সশ্রদ্ধ প্রণাম করে বিনম্র ভঙ্গিতে।অস্ত্রধারী ক্ষত্রিয়ের ঝাঁঝালো মেজাজ অকস্মাৎ গর্জে ওঠে যদি কোনও অসহায় বুড়ো ভিখারিকে দেখে, তখনও কি আমি মূক হয়ে এককোণে ঠিক থাকবো দাঁড়িয়ে? সাতে পাঁচে নাক গলাবো না বলে চুপ করে কোমল বালিশে চোখ মুখ গুঁজে থাকা যায় কি সর্বদা? মনুষ্যত্ব থাকবে কি?কোনও কোনও পুস্তকের পাতায় আমরা দেখি এক ক্রুশবিদ্ধ মানবের ছবি যিনি মানুষের কল্যাণের জন্যে ক্রমাগত ভেসেছেন বিপরীত স্রোতে আর হয়েছেন নির্বোধ পেরেকে বিদ্ধ আপাদমস্তক। করেননিকো ক্ষমা প্রার্থনা, রক্তধারার তীক্ষ্ণ কষ্ট তুচ্ছ করে জালিম বিপথগামীদের কল্যাণ কামনা করেছেন।মহত্ত্বের রূপে ঘোর অমাবস্যা পূর্ণ চন্দ্রালোকে পরিণত হয় আর মহামানবের সংস্পর্শে ডাকাত হয়ে যায় অসামান্য দরবেশ। বুঝি তাই মানবের সম্ভাবনা সুপ্রচুর সর্বকালে, শুধু চাই স্পর্শ সাধনার। এই তো নীরব, কালো, কাঁটাময় জঙ্গল কেমন বাগানে রূপান্তরিত, নতুন গানের সুর ভাসে।   (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
শুধু কি ক্ষয়িষ্ণু গ্রামে-গঞ্জে লাঠিসোটা গজরানো বাবরি (ঝড়মত্ত বৃক্ষচূড়া) ভাটা-চোখ, শক্ত কব্জি, রামদা সড়কি আফ্রিকার জুলুদের মতো নেচে ওঠে সংহার নেশায়?শহুরে গলিতে, চোরাস্তায় আলোকিত ফোয়ারার কাছাকাছি, তাড়ি-বুঁদ, শূন্য-হাঁড়ি মহল্লায় হৈ-হল্লা, দাঁত-নখ খিঁচানো প্রহর কটমট তাকায় চৌদিকে, যেন ডালকুত্তা। ইস্তিকরা কাপড়ের মতো কলোনীও অকস্মাৎ বন্দুকের নল, তপ্ত ধোঁয়াময় হয়, রক্তবমি করে সারি সারি ফ্ল্যাটে শহরে শহরে নানা দেশে ঋতুতে ঋতুতে। মেঘে মেঘে অন্ধকার পাতালে এবং দূর পবর্ত শিখরে ধূ ধূ মরুবক্ষে কালান্তক স্বরে অস্ত্র হেঁকে যায়। জলপাইরঙ কিংবা খাকি ইউনিফর্মের ভিড় গোলাপ বাগানে, আপেল বাগানে, শস্যক্ষেতে। রাশি রাশি ভারি বুট পাথরে কাদায় বাজে বনবাদাড়ে এবং সংখ্যাহীন হেলমেটে মাইল মাইল-ব্যাপী সূর্যমুখী ঘন ছায়াচ্ছন্ন হয়ে যায়।মনের ভেতরে খণ্ড প্রলয়ের উন্মত্ত ঝাপটায় মধ্যবিত্ত প্রেমিকের চোখে ওথেলোর ভীষণ সবুজ চোখ নিমেষে প্রবেশ করে, অতিশয় কর্কশ রাত্রির কিনারায় বিচুর্ণ স্বপ্নের মতো, একরাশ বিমর্দিত জুঁইয়ের মতোন প্রেমিকা নিঃসাড় পড়ে থাকে। নানা রাষ্ট্র, বিশেষত উন্নতি-ঊর্মিল, আদিবাসীদের মতো মদির উল্লাসে ধূপ-ধুনো অথবা আগরবাতি জ্বেলে নিয়ত বন্দনা করে নানাধর্মী বোমাকেই। সুদুর দিগন্ত, লোকালয়, দ্বীপপুঞ্জ মুছে-ফেলা। ঝড়ের পরেও কোনোদিন কূল পাবো কি পাবো না। না জেনেই সঙ্গীহীন, পানির দংশনে জর্জরিত একা, প্রায় ক্ষয়ে-যাওয়া মান্দাস আকঁড়ে ধরে ভেসে চলি ক্ষুধার্ত সমুদ্রের ভেসে চলি।   (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
কতকাল তোমার সঙ্গে আমার দেখা নেই, তোমার কণ্ঠস্বর শুনি না কতকাল। যিশুখৃষ্ট ক্রুশে বিদ্ধ হবার পর যতদিন গেছে অস্তাচলে, ততদিন তোমার চোখের চাওয়া আর স্পর্শের বিদ্যুচ্চমক থেকে আমি বঞ্চিত, মনে হয়।যখন তোমাকে ফোন করি, তখন ওপারে একটি ধ্বনি হতে থাকে ক্রমাগত একঘেয়েমির মতো। কোনো সাড়া মেলে না। কখনো কেউ রিসিভার তুলে রডিওর ঘোষকের বলবার ধরন গলায় এনে জানায় তুমি বাড়ি নেই, আবার কখনো শুনি ঘুমোচ্ছ তুমি।যখন ঘুমোবার কথা নয়, তখন ঘুমোচ্ছ জেনে কেমন খটকা লাগে। ভাবি তবে কি তুমি কোনো জাদুবলে রূপকথার সেই ঘুমন্ত সুন্দরী হয়ে গেলে? আবার ভাবনাকে অন্য বাঁকে নিয়ে নিজেকে প্রবোধ দিই, কারো কারো ঘুম রাত থেকে মধ্য দুপুর অব্দি গড়ায়, গড়াতেই পারে। তাই এ নিয়ে নালিশ রুজু করা নিরর্থক। বরং নিজের ভাগ্যকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বলি, আমাদের সংযোগের মুহূর্তটাই রাগুগ্রস্ত।অথচ বাদশাহ সুলেমানের আমলের রত্নের মতো কত মুহূর্ত আমাদের কেটেছে তোমার ড্রইংরুমে। তখন তোমাকে ব্যাবিলনের উদ্যানের কোনো মনোরম, দুর্লভ, তম্বী গাছ ভেবে তাকিয়ে থেকেছি তোমার দিকে। এবং আমার দৃষ্টিতে বিহ্বলতা পাঠ করে বলেছো, কী দেখছো অমন ক’রে? সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে দ্রুত পাতা ওল্টাতাম ম্যাগাজিনের, অথবা দৃষ্টি মেলে দিতাম তোমার বাগানের দিকে। দূর অতীত আর বর্তমান বইতো এক লয়ে পাখির গানে।অসহ্য এই বিচ্ছেদ যা আমাকে দিনের পর দিন রাত্রির পর রাত্রি তোমার ছায়া নিয়ে তৃপ্ত থাকতে জপায়। এই বিচ্ছেদ উজিয়ে আমি বেঁচে আছি, একথা ভেবে নিজেকেই কেমন অপরাধী মনে হয়। অথচ তুমিহীনতা আমাকে জড়িয়ে রাখে কবিতার সঙ্গে সারাক্ষণ, যেমন বিশ্বাস প্রাণের স্পন্দনকে। আর কবিতা তৈরি করে এমন এক পথ, যে-পথ তোমার আসার মুহূর্তের জন্য বারবার মরীয়া কণ্ঠস্বর হয়।আজো দুপুরবেলা তোমাকে ফোন করবার পর ঠাণ্ডা নিঃস্পৃহ এক কণ্ঠস্বর জানালো তুমি ঘুমিয়ে আছো। সেই কণ্ঠস্বর আমাকে এক ঝটকায় ছুড়ে দিলে আমার শহরের জনহীন রাস্তায় আর নৈরাশ্যের সূর্যাস্তের ভেতর। একটা ভয় লিকলিকে সরীসৃপের ধরনে আমাকে চাটতে থাকে-তাহ’লে কি আমি অবিরাম ডায়াল করতে করতে মেথুসেলা হয়ে যাবো? এখন সব পাখি ঘুমের গুহায় পাখা গুটিয়ে নিঝুম, সকল নদী ঘুমে প্লাবিত করছে গ্রাম, জনপদ। আমার আয়না জুড়ে ঘুমিয়ে আছে এক নারী, যে ভুলে গেছে ভালোবাসার ভাষা। তোমার হৃদয় ঘুমিয়ে পড়েনি তো?   (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রকৃতিমূলক
এ এমন কাল বন্ধ চোখ খুলতেই দেখি শরীর-জ্বালানো তেজ নিয়ে আমাদের পোড়ায় কখনও, কখনও-বা উত্তেজিত করে খুব ছড়াতে দ্রোহের অগ্নিশিখা।দিনরাত বৃষ্টিধারা দেয় না ভাসিয়ে নানা শহর ও গ্রাম। কখনও-সখনও বর্ষা, যতদূর জানি, কোনও কোনও কবির, লেখার খাতার উন্মুখ পাতা বর্ষার ধারায় সেজে ওঠে।বয়স হয়েছে ঢের। জীবনের নানা ক্রূর ঘাত-প্রতিঘাতে কেউ-কেউ ভণ্ড বান্ধবের পোশাকে দিয়েছে হানা অতর্কিতে। যখন পেয়েছি টের, ততদিনে বড় দেরি হয়ে গেছে; বয়ে গেছে কৃত্রিমতা। আমার এ বয়সে ও কখনও দাদা, নানা বাবা, চাচাদের জন্মস্থান পাড়াতলী গ্রামে যাই ঢের পথ পেয়েছি মেঘনা নদী। ছলছলে জল, ক্ষেতের সবুজ ঢেউ চোখে কত স্বপ্ন দিত জ্বেলে।শ্রাবণের রাতে শুয়ে বিছানায় অথবা টেবিলে একলা নিঃশব্দে ঝুঁকে কবিতা লেখার কালে চোখে হঠাৎ ঝলসে ওঠে জননীর মুখ। হাতে তাঁর, মনে হ’ল, ঝলসিত কোরানশরিফ। ঘরে ভাসে স্বর্গীয় সুরের রেশ। কখন যে শরতের জ্যোৎস্নাস্নাত রাতে এসে দাঁড়িয়েছি একা হাওয়ায় দোলানো ফসলের ক্ষেতের সান্নিধ্যে, বুঝ উঠতে পারিনি- যেন কেউ দেখাচ্ছে আমাকে স্নেহভরে এই দৃশ্য।শেষরাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখি চাঁদ হাসছে কৌতুকে এই শহুরে লোককে দেখে, যার সমস্ত শরীর ফুঁড়ে কী সহজে বেরুচ্ছে গ্রামীণ রূপ। আমার অন্তর জুড়ে শহুরে-গ্রামীণ সুরধারা।   (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
গোলাপ আমাকে দিয়েছে গোলাপ বৃষ্টিসিক্ত তামস রাত্রিশেষে। অথচ বিশ্ব বিষকালো আজ হিংস্র ছোবলে, ভীষণ ব্যাপক দ্বেয়ে।কাল রাত্তিরে যার পদরেখা পড়েছে আমার নিঝুম স্বপ্নপথে, সেকি সক্ষম প্রলেপ বুলোতে স্মৃতি সংকুল আমার পুরোনো ক্ষতে?কাজের গুহায় আমি ইদানীং শুনি মাঝে মাঝে টেলিফোনে যার গলা, মধ্য বয়সে ম্লান গোধূলিতে তাকে প্রিয়তমা কখনো যাবে কি বলা?স্বরচুম্বনে শিহরণ জাগে অভিজ্ঞ হাড়ে, শিরায় জোনাকি জ্বলে। সভ্যতা দ্রুত ক্ষয়িষ্ণু হয়, মানবতা ক্রমে চলেছে অস্তাচলে।গণবিভ্রমে ভ্রষ্ট জনতা নতজানু কত মেকী দেবতার কাছে। ঘোর মরীচিকা, কাঁপে দশদিক নাৎসী প্রেতের বিকট ঘূর্ণি নাচে।ধর্মপসারী বুড়ো শকুনের পাখসাটে আজ ইরান মধ্যভূমি। ডাগর বর্ষা ডাকে নিরালায়- স্মৃতির প্রতিমা, এখন কোথায় তুমি?বিপর্যস্ত গোলাপ বাগান, পোড়-খাওয়া ডালে বুলবুল ! ভুল লক্ষ্যের দিকে সংকেত দেখায় দিশারী, ডেকে আনে পিছুটান।তেহরানে নামে দুপুরে সন্ধ্যা, যখন তখন ঘাতকের গুলি ছোটে; হাফিজের আর সাদীর গোলাপ কবি সুলতানপুরের হৃদয়ে ফোটে।এবং নাজিম হিকমত পচে কারাকুঠুরিত পুনরায় দিনরাত ফুচিক ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়ায় তোলে গৌরবে মূষ্ঠিবদ্ধ হাত।নেরুদা আবার শিউরে ওঠেন, এখনই পঙ্গু ঈগল সাম্যবাদ? মাদ্রিদ আর চরাচর জুড়ে লোরকা করেন কৃষ্ণ আর্তনাদ।শিকারী কুকুর-তাড়িত একাকী রুশ কবি মৃত তুষার-ধবল ত্রাসে; নিরুদ্দিষ্ট তার ছায়া আজো মৌন স্মৃতিতে বার বার ফিরে আসে।প্রতারিত চোখে দেখি অবিরাম পথে-প্রান্তরে ছিন্ন মুন্ড দোলে। নিষ্ফল আমি, কী ফল ফলবে অবালেই গাছ বজ্রদগ্ধ হ’লে?ঋতু না ফুরাতে গোলাপ ফুরায়, মৃত্যু নিয়ত জীবনের প্রতিবেশী। প্রেত –সৈকতে অদীন ভেলায় আসবে কি তুমি কান্তা মুক্তবেশী?   (ইকারুসের আকাশ কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
রূপক
দর্পণে প্রতিফলিত এই মুখ কার? সত্যি কার? এ আমারই নাকি অন্য কারও? যতদূর মনে হয়, এ আমার নয়। এ রকম অচেনা, বেগানা মুখ কী ক’রে আমার হতে পারে? এই মুখমণ্ডলে কী গাঢ় রেখাবলী প্রস্ফুটিত, চোখ দুটো স্লান অতিশয়।এ কার চেহারা আমি বয়ে বেড়াচ্ছি এখন? ইচ্ছে হয়, এক্ষুণি বাতিল কাগজের মতো ছিঁড়ে ফেলে দিই ডাস্টবিনে। হামেশা সাবানে ঘষলেও কদাকার, জাঁহাবাজ, হিংস্র চিহ্নগুলি কখনও যাবে না মুছে। ধিক, তোকে ধিক, ব’লে এক পাখি উড়ে যায় ভাসমান মেঘে।দর্পণে প্রতিফলিত এই মুখ কফিলের? নাকি অনিলের? বড়ুয়ার? রিচার্ডের বুঝি? নয়, নয়, এদের কারুর নয়। যদি বলি বনের পশুর, তাহ’লে তারাও সমস্বরে প্রতিবাদে ভীষণ পড়বে ফেটে, বলবে ‘কোনো না, অপমান আমাদের। আমরা পারিনি হ’তে হিংস্র এই মতো’।   (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
ব্যঙ্গাত্মক
ধন্য রাজা ধন্য, দেশজোড়া তার সৈন্য! পথে-ঘাটে-ভেড়ার পাল। চাষীর গরু, মাঝির হাল, ঘটি-বাটি, গামছা, হাঁড়ি, সাত-মহলা আছে বাড়ি, আছে হাতি, আছে ঘোড়া। কেবল পোড়া মুখে পোরার দুমুঠো নেই অন্ন, ধন্য রাজা ধন্য। ঢ্যাম কুড় কুড় বাজনা বাজে, পথে-ঘাটে সান্ত্রী সাজে। শোনো সবাই হুকুমনামা, ধরতে হবে রাজার ধামা। বাঁ দিকে ভাই চলতে মানা, সাজতে হবে বোবা-কানা। মস্ত রাজা হেলে দুলে যখন-তথন চড়ান শূলে মুখটি খোলার জন্য। ধন্য রাজা ধন্য।
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
সেদিন তোমাকে কিছু কটু কথা শুনিয়েছিলাম ক্রোধে জ্বলে, এর আগে যা আমি করিনি কোনোদিন কোনোক্রমে। তুমি শরাহত রাজহংসীর মতোই বসেছিলে এক কোণে বেদনার্ত। কোনো নিষ্ঠাবান চিত্রকর যেমন সুন্দর ছবিতে খুঁত দেখে ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলে নিজ শিল্পকর্ম, আমি সেদিন সেই মতো আচরণ করেছি হঠাৎ। তুমি মৃদু প্রতিবাদী স্বরে কিছু বলে চুপ। সে-রাত আমার ক্রোধে, ক্ষোভে নির্ঘুম কেটেছে আর কবিতাও আসেনি শোনাতে প্রবোধের স্নিগ্ধ কোনো বাণী, দগ্ধ হয়েছি অন্তরে অতিশয়। কী ছিলো তোমার ক্রটি যা আমাকে অন্ধ, নাছোড় বৃশ্চিক হয়ে করেছে দংশন? মনে-মনে হয়েছি নিজেরই হন্তারক। সে ক্রটির কথা আমি নিশ্চিত কখনো হাটে লোক ডেকে বলতে যাবে না।   (তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
গৌরী, তোমাকে ঘিরে কত সাধ মঞ্জরিত হয় আমার মনে দিনরাত, তুমি জানো না। হয়তো বিনিদ্র রাতে শয্যায় অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ ক’রে জানলার বাইরে তাকিয়ে তারা গোনার চেষ্টা করছি, তখন মনে হয়, তোমাকে নিয়ে যদি কুষ্টিয়ার সেউড়িয়ায় লালনের মাজারের পাশের কোনো গাছের ছায়ায় দাঁড়াতে পারতাম সাঁঝবেলায়, যদি সেই মুহূর্তে তোমাকে গাঢ় আলিঙ্গনে বেঁধে তোমার মুখ চুম্বন করতে পারতাম, তাহলে আমার হৃদয় হতো বাউলের সুর। লালন সাঁই কি রুষ্ট হতেন? আমার মনে হয় না, বরং এতদিনে একজন কবির মনের মানুষের সনে মিলন হয়েছে জেনে আনন্দ ঝঙ্কারে বেজে উঠতো তার বহুদিনের নিস্তব্ধ দোরাতা। যখন কোনো কোনোদিন কবিতা লেখার সময় কাঙ্ক্ষিত পংক্তিমালা পথ হারিয়ে ফেলে নীলাভ কুয়াশায়, তখন তোমাকে নিয়ে কবিগুরুর শিলাইদহের বোটে চ’ড়ে পদ্মায় ভেসে বেড়াতে বড় সাধ হয়। যদি আমরা কোনো অনুমতি ছাড়াই সেই বোটে গিয়ে উঠতাম, তবে কি রবীন্দ্রনাথ শিল্পসম্মত ভঙ্গিতে উষ্মা প্রকাশ করতেন? আমার বিশ্বাস, তিনি খুশিই হতেন আর তাঁর গীতবিতানের পাতাগুলো রৌদ্র-জ্যোৎস্না হয়ে আদর করতো আমাদের দু’জনকে, জোগাতো ভ্রমণের উৎসাহ।যখন শহরের অশ্লীল হৈ-হুল্লা, বিরক্তিকর যানজট, নিষ্ফল বচসা, তারুণ্যের নষ্টামি, বয়স্কদের হ্যাংলামি আর ভণ্ডামি, বর্বর-বাহিনীর জয়োল্লাস, ন্যায়ের নির্বাসন, আইন-শৃংখলার মুখ-থুবড়ে-পড়া, প্রশাসনের নির্বোধ স্বেচ্ছাচার, মর্গে অশনাক্ত লাশের ভিড়, সন্ত্রসীদের বেলাগাম দাপট, ফাঁপা রাজনীতির করুণ পরিণতি আমাকে খুব ক্লান্ত করে, তখন ইচ্ছে হয়, তোমাকে নিয়ে চলে যাই আমাদের পাড়াগাঁর বাড়িতে। ইচ্ছে হয় পাড়াতলীর প্রজাপতিময় সর্ষে ক্ষেতের ধারে, দিঘীর পারে তোমার হাত ধরে হেঁটে বেড়াই। আমার পরহেজগার পূর্বপুরুষগণ কি নারাজ হতেন খুব? সেরকম ভাবনা আমাকে ডুমো মাছির মতো উত্ত্যক্ত করে না। গৌরী, সেখানে গেলে তুমি দেখতে পেতে তাদের আনন্দ প্রতিফলিত আম-জামের পাতায়, বউ কথা কত্ত পাখির ডাকে।   (তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
যেখানেই হাত রাখি, হাত পুড়ে যায় একটু বাড়ালে মুখ, মুখ ঝলসে যায়। এমনকি লেখার টেবিল যেন গলানো লোহার গনগনে পাত।এখন কোথাও হাত রেখে স্বস্তি নেই। শহরের গাছপালা ভীষণ উগরে দিচ্ছে তাপ, জনপথ ফুটন্ত কড়াই, বাড়িগুলি ড্রাগনের মতো দশদিকে কেবলি ছড়িয়ে দিচ্ছে তরল আগুন। তবে আমি কোন দিকে যাবো আজ?কোথায় রাখবো হাত? মুখ কী ক’রে বাঁচাবো আগুনের হল্কা থেকে? তোমার হাতের নীড় খুঁজে পেলে, মেয়ে, তোমার সুন্দর মুখ ঝুঁকে এলে মুখের উপর, যোজন যোজনব্যাপী আগুনের দারুন আজাব থেকে রক্ষা পেয়ে যাবো।   (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
আজ সন্ধেবেলা চলে যাবে তুমি ভিড়াক্রান্ত সদরঘাটের টার্মিনাল ছেড়ে। যখন দাঁড়াবে ডেকে, হাওয়ায় উড়বে শ্যাম্পুকরা রেশম-মসৃণ চুল, তখন তোয়ার মুখ কোন্‌ দিকে, কোন্‌ ভঙ্গিতে স্থাপিত, জানবো না। সৌন্দর্যখচিত সেই মুখ তখন কি আমার সত্তার উল্টোদিকে ফেরানো বিষণ্নতায় ছাওয়া? নাকি আমার দিকেই প্রসারিত চুম্বনের প্রতীক্ষায় থরথর? তুমি কখনো উচ্ছল জলরাশি দেখবে, কখনো আসমানে লেগে থাকা চিতার স্তিমিত আগুনের মতো কিছু আবীরের ছোপ; যদি আরো কিছুক্ষণ সেখানে নজর রাখো, দেখবে পাখিরা ডানায় আমার যন্ত্রণার ভস্ম মেখে উড়ে যাচ্ছে অতিশয় দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ের লোভে, কে জানে কোথায়।‘আজ সন্ধেবেলা চলে যাবে তুমি’, এই ছোট বাক্যে খৃষ্ট পূর্বকালের করুণ দীর্ঘশ্বাস, মরুচারী কায়েসের দশদিক দীর্ণ-করা উদ্‌ভ্রান্ত, পবিত্র, ব্যক্তিগত আর্তনাদ, ফরহাদ-রচিত অনিন্দ্য নহরের উন্মথিত কান্না আছে আর হঠাৎ শুকিয়ে যাওয়া গোলাপের ঘ্রাণ, ঝরাপাতা আর মৃত দোয়েলের পালকের ফিস্‌ফিসসে শিহরণ আছে, তুমি কি জেনেছো? সন্ধ্যেবেলা তোমার এ যাওয়া যেন ঢাকা শহরের সব রূপ রস গন্ধ নিয়ে চলে যাওয়া। কাল ভোর থেকে কোনো রাগরাগিণী কলাপ মেলবে না, এবং প্রেমিক-প্রেমিকারা ‘ভালোবাসা’ শব্দের বদলে বারংবার ‘ঘৃণা’ উচ্চারণ করে নিজেরাই বিস্ময়ের ঘোরে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হবে। লুটেরা, ছিঁচকে চোর দেখে পুলিশ চম্পট দেবে করতলে প্রাণ ভোমরাটা রেখে, গেরস্তেরা দিনদুপুরেও ভয়ে প্রকাশ্য রাস্তায় বেরুবে না, রাস্ট্রাদূতগণ বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক চুক্তিপত্রে সই করা থেকে নিয়ত বিরত থাকবেন!পানি কেটে যাচ্ছে জলযান। হঠাৎ ফেনিল ঢেউ এসে ঢুকে পড়ে ফ্ল্যাট বাড়িটার ছোট ঘরে, ছিঁটে লাগে চোখে মুখে, কবিতার বই টেবিলে শুইয়ে রেখে ভাবি সেই জলযানটির কথা, যাকে দেখিনি কখনো, যে তোমাকে নিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যে তোমার। সে মুহূর্তে মনে হলো আমার এ মুখের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে একরাশ কালো চুল। আজ রাতে কিছুতেই ঘুম আসবে না; সারারাত তোমার রেশমি চুল আঙুলে জড়িয়ে নিরিবিলি খেলবো, কখন পূর্বদিক রাঙা হয়ে উঠবে আবীরের ছোপে, যেমন ঈষৎ লজ্জায় তোমার গাল। অলৌকিক পঞ্চ ডাল থেকে যুঁই চামেলীর মতো ঝরে যাবে হৃদয়ে কবিতা, তুমি আর কবিতা নিমেষে একাকার। ছিটিয়ে স্মৃতির পানি জলযান যাচ্ছে চলে আমার হৃদয় ভেদ করে।সূর্যোদয়ে আহত আলোর মৃত্যুচিহ্ন দেখে ফেলে আমার আপন কবিতার খাতা মরাল সঙ্গীত গেয়ে ডুবে যাবে সুদূর মানস সরোবরে নাকি বিদ্রোহ বিদ্রোহ বলে রুদ্র রোষে ফেটে পড়বে, চৌদিকে ব্যাপক ছড়িয়ে দেবে মোহন আতশবাজি। তুমি কেবিনে ঘুমুবে গুটিসুটি অথবা নামবে ঘাটে, বহুদিনকার বন্ধ জানালাটা খুলে দিয়ে গাছগাছালির স্তব্ধ শ্যামলিমা মেখে নেবে চোখে, তখন কি মনে পড়বে তোমার বেকার কবির কথা যে সংঘের ভেতরে থেকেও চকিতে কেমন একা, ভীষণ একলা হয়ে যায়। তুমি চলে যাবার পরেই শুরু হলো একটানা টিপ্‌ টিপ্‌ বৃষ্টি, যেন গাছের সবুজ পাতা, ছাদের কার্ণিশ থেকে ঝরে অবিরল ব্যথিত রাজধানীর অশ্রুজল। তুমি নেই বলে কিছুতেই শহরের ক্রন্দন থামে না। গুলীবিদ্ধ চখার চৌদিকে চখী চক্রাকারে উড়ে উড়ে কাঁদে যে ধরনে অবিকল সে রকম আর্তনাদ করে এ শহর, মর্মমূল ছিঁড়ে যেতে চায়।তুমি চলে যাবার পরেই টিপ্‌ টিপ্‌ বৃষ্টি, এ শহর কেমন হতশ্রী হয়ে গ্যাছে, দেখে যাও একবার। আসবে কদিন পরে? অপেক্ষায় আছি নিত্যদিন, যেমন প্রকৃত মোমিন থাকেন প্রতীক্ষায় ঈদের চাঁদের জন্যে রমজানে।আমার নিকট থেকে কতদূরে চলে গ্যাছো শরীরে জড়িয়ে আসমান। কতকাল কেটে গেল, তবু আসোনি এখানে ফিরে স্যুটকেস হাতে, কপালে খয়েরি টিপ, অনিদ্রার ছাপ টাঙ্গাইল শাড়ীটির ভাঁজে। প্রেমের দেবতা বুঝি ফৌত হয়ে গেছেন হঠাৎ গুপ্ত ঘাতকের হাতে। নইলে কেন আজ দিগঙ্গনা জুড়ে দিয়েছে বিলাপ আর আমার প্রেমের পদাবলী কেবলী আছড়ে পড়ে, মাথা কোটে শিলাতটে?  (হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
অনেকদিন যাবত চিলেকোঠা বিষয়ে একটি ধারণা লালন করছি। দূরের আকাশে মেঘেদের কোলে কোথাও যদি আমার নিজস্ব একটা চিলেকোঠা থাকতো তা হলে কী ভালোই না হতো। সেখানে কিছু চমৎকার সময় কাটানোর জন্যে যখন তখন চলে যেতে পারবো; কোনো সিঁড়ির প্রয়োজন হবে না, ব্যবহার করতে হবে না বায়ুযান। আমার সেই চিলেকোঠায় নিষিদ্ধ হবে খবরের কাগজ, থাকবে শুধু বই আর ক্যাসেট প্লেয়ার।চিলেকোঠায় হাত নেড়ে গালিবের ধরনে ডেকে আনবো কবিতাকে, কোনো কোনোদিন তুমি আসবে হাওয়ায় আঁচল উড়িয়ে, বসে গল্প করবে আমার সঙ্গে, ইচ্ছে হলে গান গাইবে কিংবা কিছু না বলে আমার বুকে মাথা রেখে দেখবে কালপুরুষ আর আমি তোমার চুল নিয়ে খেলা করবো। কখনো নীল পাখির গানের সুরে ভেসে আমরা কবিতার শীশমহলে পৌঁছে যাবো।   (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
এটাই তো শেষ কিস্তি প্যাক-করা লটহরের, এরপর কিছুই আমার থাকবে না এখানে। না প্লেট, না পিরিচ, বুক শেলফ। পেট্রোলের গন্ধ জোরে চেঁচায় গলিতে, কিছু চিহ্ন থেকে যাবে ভিন্ন রূপে; তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নেমে কে যাচ্ছে? নির্বাল্ব ঘর,একা মাঝ-ঘরে দাঁড়িয়ে রয়েছি, যেন গুহার ভেতরে আদিম পুরুষ। শ্রাবণ সন্ধ্যায় লাগবে বৃষ্টির ছাঁট জানালায়, শারদীয় রোদ দেবে গড়াগড়ি মেঝে জুড়ে, মাঝে-মাঝে হাওয়া দরকার থুতনি নাড়িয়ে দেবে খোলা বারান্দায় চকোলেট-রঙ বিড়ালিনী, ছানা ওর দুধ খাবে কার্নিশে বসবে কবুতর— দেখবো না। হঠাৎ ঝিকিয়ে ওঠে মনে কবিতার অক্ষরের মতো স্মৃতি,— মখমলী চটিতে লুটিয়ে-পরা শাড়ি, জ্যোৎস্নারাতে কারো কী মদির তাকানো, হৃদয়প্লাবী গান। শেষ বেলা ফ্যালে দীর্ঘশ্বাস, তাড়াতাড়ি চলো, সিঁড়ি বড় অন্ধকার, মালাগাড়ি গলিতে প্রতীক্ষাস্তব্ধ, নীড়ভাঙা পাখির ধরনে আমি কোথায় চলেছি?আরো কিছুক্ষণ এ জায়গায় দাঁড়াবার কিংবা বসবার, চতুর্দিকে তাকাবার সাধ জাগে নাকি? দেয়ালটা চুঁয়ে দেখি একবার? এখনো চড়ুই দু’টি কড়িকাঠের ফোকরে আনে খড়কুটো, নিরর্থক চোখ খচ্‌খচ্‌ করে, রুমালটা কই? সিমেন্ট ও বালি, ইট চুন জানবে না কোনোদিন এই বাড়ি ছেড়ে কে গেল? কোথায় গেল? কেন যেতে হলো?   (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
আমার এ ছোট ঘর সামান্য হলেও আহরণ করেছে জ্ঞানের নুড়ি। ইতিহাস, দর্শন সে জানে কিছু কিছু, বিশ্বকাব্য আর রবীন্দ্রনাথের গানে নিয়ত হয়েছে স্নাত এবং করেছে অন্বেষণ মণিরত্ব নৃতত্ত্বের অন্ধকারে। এ ঘর মোহন বাঁশি শোনে মধ্যরাতে, সর্বক্ষণ প্রগতির টানে মজা খাল নয়, সমুদ্রকে চায়; তিমিরের কানে জপায় আলোর মন্ত্র নিত্য, তা জানে আমার মন।আমার জামার ঘ্রাণ, জুতোর গড়ন, হাঁচি, কাশ, দীর্ঘশ্বাস, হাসি, ঘুম-বেবাক মুখস্থ এ ঘরের। আমার এ ঘর ভিন্ন সাজে হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসে, যখন কবিতা আর গৌরী মাঝে-মধ্যে চলে আসে, আমার নিবিড় কাছে বসেন, যুগপৎ নীলাকাশ আর শান্তি নীড় হয় ঘর, ঢেউ জাগে আনন্দের।   (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
এখনও আকাশ আছে, এই খোলা জানালার বাইরে রাস্তায় অটুট ট্রাফিকের ঐকতান। বাতাসের টোকায় খড়খড়ি জেগে ওঠে স্বপ্ন থেকে, বারান্দায় যুগল পায়রা প্রেমে নিমজ্জিত, গলির বুড়োটা তারাভরা আকাশের মতো শতচ্ছিন্ন তালিমারা কোট গায়ে বিড়ি টানে, বোষ্টমির গানে মাথা নাড়ে, দূরের শূন্যতা শব্দময় প্লেনের গুঞ্জনে।কিন্তু তার শোক নেই, পরিতাপ নেই, তৃষিত বাসনা নেই, নেই পৃথিবীর রৌদ্রছায়া স্থির চোখে। আমি শুধু লাশ নিয়ে বসে আছি পাশে হলুদ চাঁদের নিচে-আর যারা ছিল দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ঘুমভরা ঢুলুঢুলু চোখে গেছে দোকানে চা খেতে।নিস্পন্দ শরীর এক পাশে আছে প’ড়ে, জমে-যাওয়া দশটি আঙুল প্রসারিত দেখছি আমার দিকে- যেন আঁকড়ে ধরবে তারা এখনি আমার স্তব্ধতাকে।নির্বাপিত সত্তার আড়ালে চকিতে উঠল জ্ব’লে গ্রীষ্মের সেঁকা দপদপে কোনো তরুণ ফলের মতো তোমার মুখের প্রখর যৌবন।   (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
(তাকে, আমাকে যে কবি ব’লে উপহাস করত)লিখি না গোয়েন্দা গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী কিংবা চিত্রতারকার বিচিত্র জীবনপঞ্জি লিখে হয়নি প্রচুর অর্থাগম। অথচ যা-করি তা-ও যায় না কখনো বলা অসংকোচে ভদ্রমণ্ডলীকে। আমার উঠোনে সুখ নয় জানি মরালগামিনী সকালের তাজা রোদে অপরাহ্নে অথবা উধাও রাত্রির উপুড় করা অন্ধকারে। যখন প্রেমিক প্রেমিকার উন্মোচিত স্তনে মুখ রেখে ভোলে শোক, ঠোঁটের উত্তপ্ত তটে থরথর জীবনের দিক ঝড়ে-পড়া সারেঙের মতো খোঁজে, গণিকার চোখ যখন কাজলে দীপ্ত ক্লান্তির আড়ালে নগরের অষ্টতম নাগরের আলিঙ্গনে, জেগে থেকে জ্বলিস্বর্গবাসী স্বপ্নের চিন্তায় দ্বন্দ্বক্ষুব্ধ টেবিলের নিষ্কম্প আলোর দিকে দৃষ্টি মেলে। নিজেকে কেবলি ছেড়ে দিই শুভ্রতম জীবনের বিস্তীর্ণ অতলে। নিখাদ বিশ্বাস নিয়ে নির্বীজ মাটির রুক্ষতাকে সাজাই সরেস ফুলে, আমার ঝর্ণার স্নিগ্ধ জলে মরুভূমি আর্দ্র হয়, শুকনো মৃত কাঠ হয় বীণা এবং কর্দমে জেগে ওঠে এমন প্রতিমা যাকে ত্রিলোকে দ্যাখেনি কেউ। প্রত্যহ নগদ মূল্য বিনাদেয়াল পাথর গাছ নদী বালি বাতাস আঁধার বিড়ালের চোখ আর পাখির ডানার কাছে শুধু কথা খুঁজি নিজেকে জীবনপণ যুদ্ধে করে ক্ষয়। অথচ করে না কেউ ক্ষমা, তাই আমি জ্বলি ধু-ধু- বিজ্ঞাপন, করতালি, বরমাল্য, জয়-পরাজয় যা-ই হোক, জানি তবু একরত্তি মূল্য নেই তার।   (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
একদা আমাকে তুমি দিয়েছিলে ঠাঁই মমতায়। আমিও তোমাকে দিনের সোনালী ছটা রাত্রির মায়াবী কত নিমগ্ন প্রহর করেছি অর্পণ। আজ আমি তোমার সান্নিধ্য থেকে দূরে পড়ে আছি অসহায়। তুমি ডাকলেও পারি না নিকটে যেতে। আমাদের মাঝখানে মরু শত মরীচিকা আর অজস্র নিশীর্ণ হাড় নিয়ে ব্যাপ্ত রাত্রিদিন, মাঝে মাঝে তোমার আভাস পাই অগণিত ওষ্ঠে। বেলা যায়, বেলা যায়, সময় আমাকে দেয় প্রবীণের সাজ।যদি কাছে যাই কোনোদিন মনের খেয়ালে, তবে সত্যি বলো, সুদূরের সেই যুবাকে পাবে কি খঁজে এই ভাঙাচোরা মুখচ্ছদে? দেখ আমি কী রকম অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছি বৃষ্টিতে ক্রমাগত। শুষে নেয় মেদমজ্জাজলের দংশন।  (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
শব্দের সংস্রবে কতকাল কেটে গেছে, মেলামেশা ভালোবাসাবাসি হয়েছে শব্দের সঙ্গে বারে বারে। দূর থেকে ওরা কেউ কেউ বহুক্ষণ আড়চোখে তাকিয়ে থেকেছে, কতদিন কানামাছি খেলার প্রস্তাব রেখে দিয়েছে সম্পট অকস্মাৎ আমাকে কিছু না বলে। ধুলো কিংবা মেঘের আড়ালে দূর দিগন্তের দিকে পলায়নপর কাউকে কাউকে আমি উপড়ে এনেছি, বলা যায়, মায়াবী উদ্যান থেকে। কেউ কেউ এমনই নাছোড়, মধ্যপথে তর্ক জোড়ে, কে কোন পরিধি ভালোবাসে বিশদ বুঝিয়ে দ্যায় যুক্তি বিশ্লেষণে। আজকাল, হা কপাল, কোকিলও উকিল হয়ে যায়। বাঁচাই ভাষার ঝরণাধারা। শত নুড়ি, লতাগুল্ম-রঙধনু, কখনো বা খরবেগ চোরা টান থাকে, মাধুর্যের উন্মীলন, বাঘের হুংকার, নবজাতকের স্পন্দমান বুক অথবা লাশের পাশে প্রহর যাপন, পুরোনো বাড়িতে গিয়ে কাউকে না পাওয়া, মর্চেপড়া চাঁদ, স্বাস্থ্যেজ্জ্বল শবাগার থাকে ভাষার চঞ্চল ওষ্ঠে। শব্দের ওপারে গোরখোদক পরখ করে মাটি সন্ধ্যেবেলা, কুকুর প্রভুর দিকে চেয়ে থাকে জ্বলজ্বেল চোখে, একাকী কর্কশ খুনী হাত ধোয় ঝরণাতলে, জননী কন্যায় চুল বাঁধে, বালক ওড়ায় দ্বিপ্রহরে কত সাবানের রঙিন বুদ্ধুদ, পড়ার টেবিলে কেউ এলোকেশী মাথা রেখে স্বপ্ন দ্যাখে, দ্যাখে শাদা ঘোড়া ছুটে যায় অভ্রের প্রান্তরে, পায়ে তার সোনার মুকুট, জলোচ্ছ্বাস,প্রেমিকের মুঠো থেকে প্রেমিকার হাত ছিঁড়ে যায়। ভোরে অপরাহ্নে, চন্দ্রালোকে স্মিত ডানা-অলা ডাকপিয়ন দোলনচাঁপা চিঠি তাড়া তাড়া রেখে আসে লাল বাক্সে, উড়ে উড়ে ফেরে মেঘলোকে, ভীষণ শুকিয়ে-যাওয়া ইঁদারার মতো কিছু মাঝে মধ্যে হাহাকার করে আমার ভেতরে।যদি উচ্চারিত হলে সর্বদা আমার দৃষ্টিপথে একটি খয়েরী বাড়ি উদ্ভাসিত হয়, গেটে যার যুগল রূপালি ছুরি ঝোলে সারাক্ষণ। যখন অথবা বলে কেউ, একটি সুদীর্ঘ পথ, আজোজ্বলা, মনে পড়ে যায়। কাগজে আনলে তুলে অন্যমনে ভ্রমণ নামক শব্দটিকে, আরক্ত কোমল গালে ঝুলে-থাকা কালো চুল, ভেজা চোখ, পুরনো পুকুর, অশ্চিমে সূর্যের হারাকিরি, ফসলবিহীন মাঠ ঘেঁষে রেল লাইনের ধারে বহুদূরে পাশাপাশি হেঁটে যাওয়া, রাজসিক গাছের গুঁড়িয়ে বসে থাকা, খঞ্জের মোহন যানে চেপে কয়েক মাইল সাবলীল চলে যাওয়া, হঠাৎ পাখির সম্ভাষণ, মাধুর্যের স্পর্শ-লাগা, স্মৃতিতে চাঞ্চল্য আনে। অধিকন্তু মানে রৌদ্রঝলসিত বাবুই পাখির বাসা, সূর্যের ভেতর পিকাসোর হাত, মেঘদল নেরুদার সঙ্গীতমুখর পাণ্ডুলিপি, আদিগন্ত চাইকোভস্কির হংসমালা, পাথুরে বেঞ্চিতে সেজানের জাগরণ, জ্যোৎস্নালোকে ধাবমান বুনো অশ্বপাল। হায় মধ্যরাতে ঘুমহীন মুহূর্তের ঝরে-পড়া, বুক-চেরা দীর্ঘশ্বাস, এমন একটি ঘর যেখানে জ্বলে না আলো অনেক বছর, তাকে ছেড়ে এসে পুনরায় বড় একা ঘরহীন ঘরে ফেরা।   (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
শকুন্তলা নও, পতিগৃহেও যাচ্ছো না, তবু দেখি আশ্রমের নয়, শহরের বাগানের চারাগাছ তোমার আঁচল জোরে জড়িয়ে ধরেছে, পাতা নাচ কখন দিয়েছি জুড়ে প্রতিবাদে; ধরন সাবেকি। তোমার যাবার আগে বাঁধা দিতে পারছি না, আছি বিষণ্ন, নিশ্চুপ, তুমি দেখবে না, জানবে না আর সবান্ধবী চলে যাবে বিমানবন্দরে। অন্ধকার ঘরে আমি নৈরাশ্যের সঙ্গে কথোপকথনে বাঁচি।আমার নিকট নেই এমন হরিণ, যার টানে হবে না তোমার যাওয়া, আমার মনের তপোবন অতটা মায়াবী নয়, সব ছেড়ে ছুঁড়ে তুমি ফিরে আসবে এখনই এই শূন্য ঘরে হৃদয়ের গানে আমাকে দুলিয়ে দিতে ঢেউয়ের নাওয়ের মতো। মন ভালো নেই, তবুও যাবো না করুণার ভাঙা তীরে।
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
বহুদিন থেকে তাকে আমি খুব চোখে চোখে রাখি, এবং সে আমাকেও। কতদিন তাকে স্তব্ধ রাতে দেখেছি নিঃশব্দে হেঁটে যেতে কী নির্জন ফুটপাতে। সমুখে চায়ের কাপ নিয়ে নিষ্পলক চেয়ে থাকি পরস্পর মাঝে-মধ্যে। বই পড়ে, লেখে সে একাকী টেবিল ল্যাম্পের নিচে আলোদ্বীপে আত্মবন্দী, মাতে কল্পনায়; সর্বক্ষণ আমরা থাকি গূঢ় এক সাথে, একই রুটি ভাগাভাগি করে খাই, দেখি একই পাখি।অভিমানে মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে বহুকাল তীব্র একাকিত্বের তুহিন কূপে বাস করে ফিরে আসে ফের মনুষ্য নিবাসে অবিশ্বাস ঝেড়ে ফেলে; প্রতিদিন তাকে ভুলিয়ে ভুলিয়ে বেললাইনের দিক নিয়ে যাই, আমার নিশ্বাস কেড়ে নিতে চায় সে প্রায়শ ছোরা গলায় বসিয়ে।   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
দোরগোড়ায় রোজ বসে থাকতো যে-লোকটা, আলো সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না তার। কারণ, সে ছিল জন্মান্ধ। ফলত আরো অনেক কিছুর মতোই আলো নিয়ে সে কোনোদিন ওর কাঁচাপাকা চুল-ভর্তি মাথাটা ঘামায়নি। দোরগোড়ায় হামেশা বসতো লোকটা, কিন্তু কুঁড়েমি ওর ধাতস্থ হয়নি কস্মিনকালেও। ভোরবেলার আলো তার সত্তায় খেলা করতো, ওর জানা ছিল না। ভিক্ষা-টিক্ষা করার কথা আদৌ সে ভাবেনি, তাই ওর দশটি আঙুলের শ্রমশোভন নাচে বাঁশের কঞ্চিগুলো হয়ে উঠতো শিল্পসামগ্রী। এবং এতেই গরম থাকতো ওর উনুন।একদিন সমুদ্র গর্জনের মতো কী একটা ওর কানের ঘুলঘুলিতে আছড়ে পড়ে। চারদিক থেকে রব ওঠে- মিছিল, মিছিল। হঠাৎ বাঁশের চুব্‌ড়ি থেকে হাত সরিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে লোকটা। কী যেন ভাবে কিছুক্ষণ, তারপর লাঠি হাতে এগোতে থাকে সামনের দিকে জন্মন্ধ দৃষ্টি মেলে দিয়ে। তেজী মিছিল ওকে টেনে নিলো, যেমন সমুদ্র মিলনোম্মুখ নদীকে। লোকটা আর ফিরে আসেনি দোরগোড়ায়। হয়তো সে টাইরেসিয়াসের মতো একটা জ্যোতির্বলয় দেখতে পেয়েছিল সেই মিছিলে।  (অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
বর্বরতা অভ্যাস করে না ত্যাগ; ভয়ঙ্কর পশু হয়ে কুশ্রী মাথা তোলে যখন তখন; শান্তিপ্রিয় প্রাণীদের কণ্ঠনালী ছিঁড়ে ফেলে, হৃৎপিণ্ড উপড়ে নেয়, এক লহমায়-বস্তুত জীবন ক্রমাগত আর্তনাদ করে বর্বরের পদতলে। যখন সে নিঃশ্বাসে বাতাস ভারি করে তাড়াতাড়ি নিভে যায় বসতির প্রতিটি ঘরের দীপ, প্রেমিক-প্রেমিকা কোমল প্রণয়বাক্য উচ্চারণে ভয়ে কেঁপে ওঠে।সভ্যতাকে বিদ্রূপের তুমুল ফুৎকারে ভাগাড়ের এক কোণে ফেলে রেখে মুখ খোলে, কষ বেয়ে তার রক্ত ঝরে, সুকুসার বৃত্তি সমুদয় তার নখরের ঘায়ে ভীষণ জখম হয় সময়ের প্রতি পর্বে, তবু তাণ্ডবেও জন্ম নেয় আর্ফিয়ুস যুগে যুগে, বংশীধ্বনি জাগে।   (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
একজন মহিলাকে বহুদিন থেকে ভালোবেসে চলেছি, যেমন মাঝি নিয়মিত নৌকো বেয়ে যায় অনুকূল আবহাওয়া কিংবা ঝড়জলে। সে কোথায় কী রকমভাবে থাকে কেমন বিরূপ পরিবেশে, সেকথা কী করে বলি? আমি কবিতার মতো ভেসে বেড়াই শহরে একা। আমার এ হৃদয়ের জলে মহিলাটা পা ধুলে আনন্দ পাই অতিশয়; ফলে ক্ষণে ক্ষণে বারোয়ারী বিদ্রুপ তাচ্ছিল্য করি হেসে।দেহ মন দিয়ে ভালোবাসি তাকে, যদিও শরীর ছেড়ে ছেড়ে সে মহিলা মনের কথাই বলে বেশি গোপনে আমার কাছে, নক্ষত্রের কাছে কী নিবিড় অনুভবে। এ গহন বর্ষণের রাতে জানি আজ সে ঘুমিয়ে আছে একাকিনী বিছানায় এলোকেশী- বুঝেছি এরূপ ভালোবেসে যাওয়া কী কঠিন কাজ!   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
ন্যাকামোর শিরশ্ছেদ করেছি অনেক আগে আমি, গলা টিপে মেরেছি কৈশোরে গোঁড়ামির একচক্ষু দানোটাকে শিউলিতলায় পাখি আর হাওয়া আর নীলকমল ও লালকমলের চন্দ্রালোক চমকিত গল্প সাক্ষী রেখে। ভাঙো, যত ব্যবহৃত ছাঁচ ভেঙে ফেলো বলে লোক জড়ো করি চারপাশে, অথচ নিজেই আরেক ছাঁচের দিকে এগিয়ে চলেছি সবান্ধব। মধ্যবিত্ত মেজাজে চায়ের কাপে ঠোঁট রেখে দেখি আশির দশক মাদী ঘোড়ার মতন পাছা দোলাতে দোলাতে চলে যাচ্ছে, জরাগ্রস্ত বারান্দায় দাঁড়বন্দি, একা তোতাপাখি বলে আমাদের প্রভুর বছরে কত খড়কুটো, রক্তিচিহ্ন মিশে আছে; বিদায় বিদায়।পুত্রদের তেতে-ওঠা মতবাদঝলসিত কথা শুনে ভয়ে গলা কাঠ হয়ে আসে, কন্যাদের পতিগৃহে যাত্রা চোখে তুলে নিয়ে আমার ভেতর থেকে একজন ব্যথিত পুরুষ বেরিয়ে সন্ধ্যায় ঘাটে গিয়ে পানিতে নিজের ছায়া দেখে ভীষণ চমকে ওঠে। পরিত্রাণ নেই ভেবে মগজের কোষে কিছু মেঘ ভরে নিয়ে ফিরে আসে স্বগৃহে আবার। কিছুটা বিভ্রান্ত বটে ইদানীং তবু চোখ কান খোলা রাখি, সমাজতান্ত্রিক প্রীতি নিয়ে ধান্দাবাজি ঢের হলো আশপাশে, ধর্মযাজকের সত্তায় প্রবল শান দেয় খর রাজনীতি। বিপ্লব ফ্যাশন কোনো-কোনো গুলজার মহলে এবং ধোপার কুকুর যারা, তাদের নিকট ভীতিটাই মৌল অতিশয়; ছাগলের ছাল-ছাড়ানো কসাই নিয়মিত গায় ওহো সাঁই-সাঁই গণতন্ত্রগীতি। অকস্মাৎ ব্রোঞ্জের চওড়া প্লেট থেকে বেমক্কা বেরিয়ে পড়ে সুশোভিত ড্রইংরুমের গালিচায় তিন লাফ দিয়ে রাঙা চোখ তুলে বিপ্লবের নান্দনিক ব্যাখ্যা দাবি করে মহেঞ্জোদারোর ষাঁড় আর রাবীন্দ্রিক সন্ধ্যার উতল মেঘমালা ফুঁড়ে চলে যায় স্তব্ধ পূর্ণিমায় পুলিশের গাড়ি।হায় যৌবনেই বামপন্থা বানপস্থে গেলো বুঝি গায়ে অস্তরাগ মেখে। নাকি মাঝে-মাঝে রাগী সজারুর মতো কাঁটা খাড়া করে ছোটে দিগ্ধিদিক? আমি ভীষণ অস্থির কম্পাসের মতো আচরণে জীবনযাপন করি, পূর্ব-পরিচিতা কারো মুখ ভেবে ভেবে স্ত্রীকে নিয়ে শুতে যাই; আতশী হৃদয়ে স্বপ্নের কোলাজ ফোটে, আঁধারে তাকাই কিছু আবিষ্কারের ব্যাকুল প্রতীক্ষায়। কখনও-কখনও লোকালয় আর উৎসবের স্তব করতে গিয়ে কবিত্বের দিব্যতায় গুমসান প্রান্তর এবং ধ্বংসস্তূপবিষয়ক স্তোত্র লিখে ফেলি। অথচ আমার চৈতন্যের খোলা পথে বুগেনভিলিয়া ফুটে থাকে থরে-থরে, বাজে আনন্দিত রাগমালা। কোনো-কোনো ঋতুতে এবং অমাবস্যা নেমে এলে হরিণ লুকিয়ে রাখে মুখ লতাগুল্মে, কাটে তার কাল, চেষ্টাহীন; শিকারির পদশব্দে, উত্তপ্ত নিঃশ্বাসে নিয়তির ছায়া মিশে থাকে; প্রতীক্ষায় ত্রিকাল দোদুল্যমান।ফাঁসির মঞ্চের আসামির মতো চাঁদ ঝুলে আছে সেই কবে থেকে, বেশ্যালয়ে একদা নতুন মুখগুলি ক্রমশ পুরনো হচ্ছে এবং রবীন্দ্রনাথ একা বড় একা আলখাল্লা দুলিয়ে নিশীথে চলেছেন হেঁটে অ-বনেদী গলি দিয়ে নেয়ামত দর্জির ঈষৎ বাঁকা উঠোন পেরিয়ে। এদিকে দাঁতাল বর্বরেরা ঢুকে পড়ে মায়াবনে। চাদ্দিকে খেমটা নাচ, হল্লাগুল্লা, অবিরত কাজিয়া ফ্যাসাদ বাড়ে, হামেশাই হয় লোকক্ষয় জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে, মহাপুরুষের বাণী শত- শত ক্যানভাসারের কণ্ঠনালী বেয়ে নামে; জয়- পরাজয় কাদা লেপে দেয় মৃত সৈনিকের হাতে, স্থির চোখে, ছেঁড়া টিউনিকে। নানাদেশে রাজনীতি- পরায়ণ ধীমানেরা ধুধু দৃষ্টি ও স্খলিত দাঁতে কাটাচ্ছেন কাল কারাগারে, কোনোখানে নেই স্থিতি।টিনোসোরাসেরা মাটি ফুঁড়ে দ্রুত বেরুচ্ছে আবার পারিপার্শ্বিকের সৌন্দর্যকে তছনছ করে, শুরু হবে সংহারের পালা, হয়ে যাবে নিমেষে কাবার বিভিন্ন গর্বিত জাতি, পারবে না বিপুল অগুরু ঢাকতে লাশের গন্ধ। কূলে-উপকূলে দেশান্তরি মানুষের ভিড় বাড়ে ক্রমাগত। এত কোলাহল, তবু কেন এমন নির্জন বাসভূমি? ভ্রষ্ট তরী কোথায় যে নিয়ে যাবে! চতুর্দিকে খলখলে জল।স্বপ্নাদ্য সিংহের মতো হেঁটে যাই বিনষ্ট প্রান্তরে হেঁটে যাই স্বপ্নভস্মময় চোখে উদ্দেশবিহীন। কুৎসিত মুখোশ আঁটা কতিপয় লোক ঘরে-ঘরে ছড়ায় আগুন, ঘৃণা-বীজ; জানে নাকো চিরদিন প্রেমই শুধু কীর্তনের অভীষ্ট বিষয়। যে ব্যথিত কবি ছিলো এ শহরে, মাথায় ছিলো না শিরস্তাণ তার; ভুলে যাই রণরোল, জয়ীধ্বনি, অভিযান- স্মৃতিতে ধারণযোগ্য কিছু নয় কবিতা ব্যতীত।   (হোমারের স্বপ্নময় হাত কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
রূপক
রাস্তার লোকটা সেই তিনটি নিস্তব্ধ হাঁস রেখে চলে গেলো, প্রায় কিছু না বলেই লম্বাটে পা ফেলে অন্তর্হিত; যেন বোবা, ক্ষমাপ্রার্থী হয়তোবা। দেখি স্কুটার-দলিত শাদা-লাল হাঁসগুলো বারান্দার কংক্রীটে নিঃসাড় চঞ্চু রেখে নির্বিকার পড়ে আছে মূক বেহালার মতো।তাদের শরীর ছুঁয়ে বুঝি বহু যুগ বয়ে গেছে প্রবল হাওয়ার। কে বলবে ওরা তিনজন মৃদু ঘুরতো বাগানে, খেতো খুঁটে খুদকুঁড়ো, তুলতো গুগলি কিছু পুকুরে ফুলের মতো ভেসে কোনে দিন? এখন তো তারা শুধু তিনটি স্তব্ধতা বারান্দায়, আমাদের স্নেহের ওপারে। ছায়াচ্ছন্নবারান্দায় দৃষ্টি মেলে জেদী পিতামহ তাঁর অন্ধকার ঘরে একা সমুদ্রের ঢেউয়ের ফেনার মতো চূল নেড়ে নেড়ে -যেন সেই ঝড়ের রাতের রাজা, উন্মত্ত লীয়ার- চতুর্দিক আর্তনাদে দীর্ণ করে বললেনঃ “ওরে ফিরিয়ে আনলি কেন শীতল কংক্রীটে? এখ্‌খুনি নিয়ে যা তোরা, আমার স্বপ্নের শবগুলি ফিরিয়ে আনলি কেন? নিয়ে যা, নিয়ে যা!”   (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
রূপক
বেজায় ছোটোখাটো একটি পক্ষীশাবক মাটিতে প্রায় গড়াতে গড়াতে এগোচ্ছিল। ওকে দেখে বড় মায়া হ’ল। জানি না কী ঘটবে ওর ভবিষ্যতে। এই খুদে পাখি কি কাঁটাবন, ইট-পাথর কিংবা কারও পায়ের আঘাত পারবে সইতে? পারবে কি বেঁচে থাকতে শেষতক?কিছুদিন পর সেই একই পথ অতিক্রম করার কালে কে যেন আমার কানে সুর ঢেলে করল উচ্চারণ, শোনো হে পথিক, তুমি যে অসহায় ক্ষুদ্র পক্ষীশাবকটিকে দেখে করুণায় আপ্লুত হয়েছিলে অবেলায়, দ্যাখো চেয়ে ঐ গাছটির উঁচু ডালে কেমন যুবরাজের ধরনে বসে আছে। দ্যাখো ওর মাথায় কেমন দুলছে হাওয়ায় তাজ।   (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
এই তো দাঁড়িয়ে আছি তোমার কাছেই কিছু কথা বলার আশায়। জানতে কি চাও সেই কথা এখনই রাত না পোহাবার আগেই? কী করে সম্ভব তা? সে-সাধ্য আমার নেই। অপেক্ষা তোমাকে কিছু করতেই হবে।এই তো আমার হাত ছড়ানো তোমার দিকেই কখন থেকে-স্পর্শ করো, তুলে নাও হাত; দেখবে হাতের স্পর্শ যে-কোনও যুবার চেয়ে কিছু কম স্পষ্ট জলজ্যান্ত নয়।দেখছ তো আমাকে এখন বড় বেশি কাছ থেকে। পাচ্ছ নাকি উষ্ণ বিশ্বাস বয়স্ক মানবের? লক্ষ করলেই, হে মানবী, বুঝবে তোমার গালে, ঠোঁটে পুরুষের চূম্বনের ফুলঝুরি!মেয়ে তুমি আমার মাথায় কিঞ্চিৎ কালির আভা দেখে চমকে উঠো না। যদি ভেবে দ্যাখো, ঠিক দেখতে পাবেই পৌরুষের গুণাবলি এখনও অক্ষুণ্ণ খুব। তোমার কামিনী প্রাণের বাগান তীব্র প্রস্ফুটিত হবে ঠিক। তুমি আমাকে বসন্তকালে ধুলোয় লুটিয়ে ফেলে যাবে না নিশ্চিত।    (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
কখনো আমার মাকে কোনো গান গাইতে শুনিনি। সেই কবে শিশু রাতে ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে আমাকে কখনো ঘুম পাড়াতেন কি না আজ মনেই পড়ে না। যখন শরীরে তার বসন্তের সম্ভার আসেনি, যখন ছিলেন তিনি ঝড়ে আম-কুড়িয়ে বেড়ানো বয়সের কাছাকাছি হয়তো তখনো কোনো গান লতিয়ে ওঠেনি মীড়ে মীড়ে দুপুরে সন্ধ্যায়, পাছে গুরুজনদের কানে যায়। এবং স্বামীর সংসারে এসেও মা আমার সারাক্ষণ ছিলেন নিশ্চুপ বড়ো, বড়ো বেশি নেপথ্যচারিণী। যতদূর জানা আছে, টপ্পা কি খেয়াল তাঁকে করেনি দখল কোনোদিন। মাছ কোটা কিংবা হলুদ বাটার ফাঁকে অথবা বিকেলবেলা নিকিয়ে উঠোন ধুয়ে মুছে বাসন-কোসন সেলাইয়ের কলে ঝুঁকে, আলনায় ঝুলিয়ে কাপড়, ছেঁড়া শার্টে রিফু কর্মে মেতে আমাকে খেলার মাঠে পাঠিয়ে আদরে অবসরে চুল বাঁধবার ছলে কোনো গান গেয়েছেন কি না এতকাল কাছাকাছি আছি তবু জানতে পারিনি। যেন তিনি সব গান দুঃখ-জাগানিয়া কোনো কাঠের সিন্দুকে রেখেছেন বন্ধ ক'রে আজীবন, এখন তাদের গ্রন্থিল শরীর থেকে কালেভদ্রে সুর নয়, শুধু ন্যাপথলিনের তীব্র ঘ্রাণ ভেসে আসে !
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
মনে হয়, কতকাল প্রেরণার আলোড়ন নেই মনের গহনে, স্থবিরতা বসে আছে মুখোমুখি, শব্দেরা গুঞ্জন তুলে চকিতে উধাও। কবিতার খাতার উম্মুখ পাতা বিধবার শাদা থানের মতোই থাকে। হঠাৎ তোমার মুখ জেগে ওঠে, যেন তুমি এলে হৃদয়ে তরঙ্গ তুলে অলৌকিক কোন হেমবর্ণ দ্বার খুলে। কী আশ্চর্য আমার সম্মুখে উম্মোচিত কবিতার স্তন, নাভিমূল। ভয় হয়, যদি সে হারিয়ে যায় কুয়াশায় তবে কাকে খুঁজে বেড়াবো সর্বদা?   (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
জীবনকে তুখোড় যদি সারাক্ষণ মাতলামো করি আর শরীর গাঁজার গন্ধে ভরে ছট করে চলে যাই সাঙাতের ফুর্তিবাজ রকে, পাপকে হৃদয়গ্রাহী করে তুলি হ্রদের আলোর মতো যদি উৎপীড়িত অন্ধকারে, ঘেয়ো ভিখিরির ছেঁড়া ন্যাকড়ার ভাঁজে নক্ষত্রের ছায়া দেখি যদি অথবা স্বপ্নের ঠাণ্ডা হরিণকে কাঁধে নিয়ে, ওহে, কোথাও অলক্ষ্যে স’রে পড়ি, কনে-দেখা আলো সাক্ষী রেখে বড়বাবু পৃথিবীকে একটা সালাম ঠুকে হো-হো হেসে উঠি অতর্কিতে বদরাগী উর্দি দেখে,তবে কি বেল্লিক ভেবে সরাসরি দেবে নির্বাসন চিরতরে অথবা লেখাবে দাসখৎ শোকাবহ আত্মার সাক্ষাতে? যাই করো, চিরদিন আমি তবু থাকব অনড় সাক্ষী তোমাদের কাপুরুষতার।জানি যারা দেখতে চায় নিষ্কলুষ জ্যোৎস্নার সারস ঘুমেভরা ডানা দুটি গুটিয়ে রয়েছে ব’সে ভাঙা দেয়ালের মস্ত বড় হাঁয়ের ভেতর, দেখতে চায় বয়স্কের তোবড়ানো গালের মতন অতীতের ধসে কয়েকটি ক্লান্ত নর্তকী ঘুঙুর নিয়ে করে নাড়াচাড়া, যারা দেখতে চায় ঝাড়লণ্ঠনের নিচে মোহিনী সৌন্দর্য আবর্তিত কুৎসিতের আলিঙ্গনে রাত্রির স্খলিত গালিচায়, ফেলেনি নোঙর তারা কোনো দিন বণিকের জ্বলজ্বলে সম্পন্ন বন্দরে। নির্বাসন দাও যদি জনহীন অসহ্য সৈকতে, নিহত আত্মার শোকে করব না কখনো বিলাপ। বরং নির্মেষ মনে হাত-পা ছড়িয়ে অবিচল দুর্দশার প্রহার গ্রহণযোগ্য করে দেখব সে ডানপিটে সূর্যটাও সহসা উধাও অন্ধকার বনে; নিশাচর বেদে চাঁদের প্রসন্ন মুখে পাখা ঝাপটায় ঢাউস বাদুড়, ছিঁড়ে ফেলে শুভ্রতাকে।কখনো দেখব স্নপ্ন-কয়েকটি জলদস্যু যেন অবলীলাক্রমে কাটা মুণ্ডুর চামড়া নিচ্ছে তুলে অব্যর্থ ছোরার হিংস্রতায়, গড়ায় মদের পিপে রক্তিম বালিতে আর বর্বর উল্লাসে চতুর্দিকে কম্পিত পাতার মতো শব্দের ধমকে। কখনোবা হঠাৎ দেখব জেগে শুয়ে আছি হাত-পা ছড়ানো বিকেলের সাথে নামহীন কবরের হল্‌দে ঘাসে, দেখব অঢেল রৌদ্রে ঝল্‌সে উঠে ঝরায় চুম্বন ওষ্ঠহীন করোটিতে, জানব না সে করোটি কার, সম্রাট অথবা ভাঁড় যার হোক আমি শুধু একা দেখব রৌদ্রের খেলা একটি নির্মোহ করোটির তমসায় দেখব কে ছুঁয়ে যায় কালের বুড়িকে।   (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
পথিক, পক্ষী ফিরে যায় আশ্রয়ে, দিগন্ত জুড়ে নেমেছে অন্ধ রাত। সময় এখন কী ভীষণ অসময়, আলোর দিকেই বাড়ানো আমার হাত।ধূলিঝড়ে চোখে কিছুই যায় না দেখা, কোথায় হারালো কনকাঁপার কাল? তবু তোমাকেই ব্যাকুল বেড়াই খুঁজে, যদিও আমাকে জড়ায় ঊর্ণাজাল।যখন নিবিড় তাকাও আমার দিকে, হৃদয়ে আমার ফোটে অজস্র তারা; যখন তোমার কথা শুনি কান পেতে, করি অনুভব মন্দাকিনীর ধারা।আজ দুপুরের কাঁপছে চোখের পাতা; হঠাৎ বললে আমাকে কথাচ্ছলে, ‘তোমার মধ্য বয়সে হয়নি দেখা, নিশ্চয় তুমি ছিলে খুব জ্বলজ্বলে।‘এখন আমার শেষ বয়সের রেখা গোধূলিতে আঁকে বেদনার হু হু ছায়া। আমিও তোমার পাইনি তখন দেখা, যখন তোমার নব-যৌবন মায়া।তা’ ব’লে আমার মনে নেই কোন খেদ, হয় না পূর্ণ জীবনের বহু সাধ। তোমার শরীরে যৌবন জ্বলে আজো, আছে রাঙা ঠোঁটে মধুর, মদির স্বাদ।তা’ছাড়া আমাকে তোমার মনের দ্যুতি সবচেয়ে বেশি তোমার দিকেই টানে। এই শহরের অবিরাম কোলাহলে বাঁচি আনন্দে তোমার প্রাণের গানে।   (তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
কৌচের কোমলে ডুবে গৃহিণীর গানের বাগানে হরেক ফুলের শোভা দ্যাখো চোখ বুজে সবখানে, প্রহর বদলায় রঙ গানে; বন্ধু তুমি প্রেমে জল হয়ে যাও গলে। হঠাৎ বহতা সুর থেমেগেলে তুমি “হৃদয় বুড়িয়ে যায় গ্রন্থিল পেশীর সবলতা ক্রমশ শিথিল হলে? শুধু বিদ্বেষীর মতো ক্রোধে সহসা ফেলবো খুলে নিজেরই পাঁজর হাড়ে নিয়ে?”-এইসব প্রশ্ন নেড়েচেড়ে যথারীতিক্লান্ত হও, মাঝে-মাঝে শব্দের গন্ধের কিছু স্মৃতি জিভের ডগায় তুলে হুইস্কির মতো করো পান। তারপর সবান্ধব রাজনীতি, দর্শন, বিজ্ঞান কবিতায় আধুনিক মানুষের আত্মার সন্ধানে জটিল অরণ্যে করো মৃগয়া প্রচুর! ভিন্ন ধ্যানেতোমার ছেলেটা দেখি চকখড়ি চকখড়ি চক ছড়া কেটে ঘরের মেঝেতে বসে নড়বড়ে বক আঁকে আঁকাবাঁকা টানে (মানে না আঁকার ব্যাকরণ) হঠাৎ বকের মুখে গেঁথে দেয় তারা অকারণ।খাঁচার পাখিটা রাগী, নিজেরই নরম ডানা দুটি করেছে রক্তাক্ত শিকে, কী সুন্দর দুর্বিনীত ঝুঁটি ক্রমাগত যাচ্ছে ক্ষয়ে ক্ষত হয়ে-তবুও অবুঝ কেবলি ক’দিন থেকে যেতে চায় বনের সবুজ পাতায়, রোদ্দুরে, মেঘে। তুমিও ফিরিয়ে নাও চোখ, সে কোন অদৃশ্য মোহনায় দ্রবীভূত দুই শোক অভিন্ন ধারায় বয়। যেহেতু তুমিও জানো বিষ দিয়ে বিষ ক্ষয় হয়, জীবনতো অন্ধকারে শিস দিয়ে চলা, ইত্যাদি পাঁচালি,-বুঝি তাই অকাতরে দুঃখের ফসিলগুলি প্রত্যহ সাজাও থরে থরে। পেরিয়ে অনেক রাস্তা নাম ধরে ডাক দিই, সাড়া দাও তুমি, কতোবার আমার অস্থির কড়া নাড়া শুনে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামো, প্রীত, নিয়ে যাও ঘরে, আমিও প্রসন্ন হেসে পোষমানা ঘরের আদরে।প্লাস্টিকের ফুল, মূর্তি কফি সেট- হয় না বিশ্বাস- থাকবে না চিরদিন। ভয় হয়, সমস্ত নিশ্বাস শুষে নেয় যেন কেউ। বড়ো ভয় হয়, যদি আর প্রাণপণে ডেকেও কোথাও না পাই তোমার!   (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
আজকাল খুব বেলা করে ঘুম ভাঙে আমার অথচ এমন একদিন ছিল যখন আমি অন্ধকার থাকতেই জেগে উঠতাম শুনতে পেতাম অনেক দূর থেকে কোনো পাখির গান অনেকক্ষণ ধরে বালিশে মুখ গুঁজে পাখির চাউনি স্বপ্নে দেখা ঘোড়ার চমকিলা পিঠ আর একটি মেয়ের সোমত্থ বুকের কথা ভাবতাম দমকা হাওয়ায় উলটে যাওয়া নীল পদার আড়ালে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে একটি কি দুটি তারা চোখে পড়তআজকাল বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙে আমার ঘুম ভাঙার পরও বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করে না দাড়ি কামাতে ভাল লাগে না এক সময় খুব সিগারেট খেতাম প্যাকেটের পর প্যাকেট এখন সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি কিসসু আমার ভাল লাগে না সকালবেলা মানে ন’টা-দশটার পর থেকেই আমার মন খারাপ থাকে আস্ত সকালবেলাটাকেই চুসকি মনে হয় বিছানার চটকানো চাদরটার দিকে তাকাই গিজগিজে দাড়িতে হাত বুলোই বাকরখানির ঘ্রাণ ভেসে আসে কোত্থেকে রেডিওতে গান বাজে হাসন রাজার একটা মেষপালক আর একটা গয়লানী জবর জোড় খায় ঝোঁপেঝাড়ে কবে যেন কোন তৈলচিত্রে দেখেছিলাম মনে পড়ে চাটা বিস্বাদ লাগছে দাঁত দিয়ে রুটি ছিঁড়ি খেতে হবে বলেই খাওয়া অনেক আগে একজন বুড়োসুড়ো খুব ফর্সা মানুষ যার নাক ছিল ঈগলের চঞ্চুর মতো চায়ের বাটির দেয়ালে লেগে থাকা চায়ের ভেজা পাতার দিকে চোখ রেখে আমাকে বলেছিলেন তোমার জীবন যাবে বুঝেছ হে ছোকরা কালি ছিটোতে ছিটোতে তা কালি নেহাৎ কম ছিটোইনি রবীন্দ্রনাথের মুখ কাজী নজরুল ইসলামের মুখ জীবনানন্দের মুখ বুদ্ধদেব বসুর মুখ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ কমলকুমার মজুমদারের মুখ একরাশ ফুল হয়ে ভাসে আমার চেতনা প্রবাহেইদানীং সকালবেলা থেকেই মন খারাপ থাকে আমার দাড়ি কামাতে ভাল লাগে না মাথায় চিরুনি চালাতে ভাল লাগে না সেলুনে যেতে ভাল লাগে না অফিসে যেতে ভাল লাগে না পরস্ত্রীর সঙ্গে দিল্লাগি ভাল লাগে না টাইপরাইটারের আওয়াজ শুনতে ভাল লাগে না পিকাসোর জীবনী পড়তে ভাল লাগে না বন্ধুর সঙ্গে আড্‌ডা দিতে ভাল লাগে না স্ত্রীকে চুমু খেতে ভাল লাগে না সাদা কাগজ দেখতে ভাল লাগে না খবরের কাগজের হেডলাইনে চোখ বুলোতে ভাল লাগে না মায় কালি ছিটোতে ভাল লাগে না এখন আমি সিগারেট খাই না আবার ধরব কিনা ভাবছি আমার রক্তের ভেতরে গোধূলি একটা স্তোত্র তৈরি করছে আমার মগজের ভেতরে এক ঝাঁক পাখি খড়কুটো জড়ো করছে দিনরাত আমার বুকের ভেতরে ক্রমাগত একটা রুপোলি গাছ থেকে পাতা ঝরে পড়ছে এবং জীবন কুষ্ঠরোগীর ফোলা ঠোঁট নিয়ে চুমো খাছে আমাকেমাঝে মাঝে মনে হয় নিজেকে ফাঁসিতে লটকে দিই কিংবা নিজেই এই মাথাটা পেতে দিই চলন্ত ট্রেনের চাকার নিচে কিংবা সূর্যাস্তের রঙের মতো অনেকগুলো ট্যাচলেট খেয়ে অসম্ভব লম্বা একটা ঘুম দিই কিন্তু হঠাৎ মনে পড়ে যায় একজন বলেছিলেন তোমার জীবন যাবে কালি ছিটোতে ছিটোতে দেখি কালি আমাকে শেষ পর্যন্ত কতটা ডোবাতে পারে কতটা।   (আমার কোন তাড়া নেই কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
সন্ধ্যাবেলা হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যে পৌঁছে যাই, বুঝতে পারি না। আচমকা অচেনা একটি পাখি এই পথচারী আমাকে আলতো ছুঁয়ে উড়ে চলে গেলো না জানি কোথায় আর নিজেরই অজ্ঞাতে কেঁপে উঠে, মুহূর্তে শুকিয়ে যায় তালু, পদযুগল গেঁথে যায় মৃত্তিকায়।তবু আমি মাটি থেকে কোনওমতে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফের সামনের দিকে হেঁটে যেতে শুরু করি। পুরনো দিনের কোনও গীত গাইবার চেষ্টা করি আর আকাশের মেঘের আড়ালে পূর্ণিমার চাঁদ আবিষ্কারে খুব মনোযোগী হই।ঘর ছেড়ে দূরে, বহু দূরে ঘুরে ঘুরে অতিশয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি এখন। যাত্রাকালে মনে হয়েছিলো হীরা, মোতি পেয়ে যাবো ডানে বামে, নক্ষত্রের সুকোমল ঝড় জানাবে অভিবাদন কবিকে এবং আমি শক্রদের উপহাস, বক্রোক্তিকে তুচ্ছ জ্ঞান করে হাসিমুখে বসবো কীর্তির সিংহাসনে। না, আমি কখনও এমনকি ভুলক্রমেও কখনও আত্মগরিমায় ডুবে থাকবো না। যারা আমার স্খলন, ক্রটি দিয়েছেন দেখিয়ে সর্বদা, হাসিমুখে সর্বদা মাথায় পেতে নেবো জীবনের নানা বাঁকে।   (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
সূর্য আকাশে রৌদ্র ছড়ায়, দুপুরের রোদ বিকেলে গড়ায়, অনাবৃষ্টিতে শস্যের ক্ষেত জ্ব’লেপুড়ে যায় খালবিল সব নিমেষে শুকায়, -ইচ্ছে তাঁর ইচ্ছে।মারিতে মড়কে দেশ ছারখার, নব সংসারে ওঠে হাহাকার, মেঘচেরা রোদে বাতাসে নড়ছে গাছের ডালটা, -ইচ্ছে তাঁর ইচ্ছে।জীর্ণ দেয়ালে শুধু থেকে থেকে বেয়াড়া একটা কাক ওঠে ডেকে, চৌধুরীদের বউটা শরীরে জড়ায় আগুন ষোড়শীর মনে জ্বলছে ফাল্গুন -ইচ্ছে তাঁর ইচ্ছে।রাত্রি ফুরোলে জ্ব’লে ওঠে দিন বাঘের থাবায় মরছে হরিণ; কালবোশেখীর তাণ্ডবে কাঁপে পড়ো-পড়ো চাল শূন্য ভাঁড়ারে বাড়ন্ত চাল -ইচ্ছে তাঁর ইচ্ছে।বাতিল কেরানি চেয়ে নিয়ে ক্ষমা মৃত্যুতে খোঁজে ত্রাণে উপমা। ধ্বংসের মুখে গ্রাম আর কত নগর পোড়ালি, মুষড়ে পড়ল জুতোর গোড়ালি। -ইচ্ছে তাঁর ইচ্ছে।(রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
ধুলো গিলে ভিড় ছেনে উকুনের উৎপাত উজিয়ে ক্লান্তি ঠেলে রাত্তিরে ঘুমোতে যাই মাথাব্যথা নিয়ে। না-জ্বেলে ক্ষয়িষ্ণু মোমবাতি স্বপ্নচারী বিছানায় গড়াই, লড়াই করি ভাবনার শক্রদের সাথে- হাত নাড়ি লাথি ছুড়ি পৃথিবীর গোলগালা মুখ লক্ষ্য করে। বিবেকের পিঁপড়ে যদি সত্যি হেঁটে যায়পিচ্ছিল দেয়ালে, মন থেকে মুছে নেব ছোটখাটো পাপবোধ অল্পবিস্তরেণ…পোষমানা মূল্যায়নে পাব সুখ দেখব কি নেড়েচেড়ে এক টুকরো হলদে নিষ্প্রাণ কাগজে মোড়া আত্মা, সত্যি একরত্তি সেই আধ্যাত্মিক পিণ্ড…আর পরাবিদ্যা ভাসাব জ্যোৎস্নায়? দিনে কৃষ্ণচূড়া রাতে রজনীগন্ধার স্পর্শ যারা পেতে চায় অন্তরঙ্গ সাহচর্যে, যদি বলে তারা ‘গুনে-গুনে রেজগি দিয়ে প্রতিদিন অভ্যাসবশত ছুঁয়েছি লাভের বুড়ি, লোকসান বলে কাকে জানি না ইয়ার’ ‘কী দেবে জবাব তবে অসংখ্য তারার ব্যালেরিনা,ভ্যানগগ রক্তে তার কালো কাক ফসলের ক্ষেত সূর্যমুখী এক জোড়া জীর্ণ বুটজুড়ো কেবলি মথিত করে রোদে সূচ্যগ্রে বিদ্ধ হল শাশ্বতীর আকাঙ্ক্ষায়, সহযাত্রী বন্ধু তার হলুদ যেসাস খোঁজে আরেক প্রান্তরে নতজানু, ঊর্ধ্ববাহু, কণ্ঠে কালো বৃষ্টির আরক।এ-পাড়ায় ১৭টি উজবুক ৫ জন বোবা ৭টি মাতাল আর ৩ জন কালা বেঁচেবর্তে আছে আজও দুর্দশার নাকের তলায়। মাঝে-মাঝে দুর্লভ আঙুর চেয়ে কেউ-কেউ তারা বলে থাকে ‘টক সব টক-তার চেয়ে তাড়ির ঝাঁঝালো ঢোঁক ঢের ভালো, ভালো সেই গলির মোড়ে জ্বলজ্বলে পানের দোকান আর বাইজির নাচের ঘুঙুর।বমির নোংরায় ভাসে মেঝে, রুটির বাদামি টুকরো চড়ুই পালাল নিয়ে। তাকাব না কখনো বাইরে… ঘরে জানলা নেই…হলুদ যেসাস বিদ্ধ কড়িকাঠে… রৌদ্রঝলসিত কাক ওড়ে মত্ত রক্তে কাঠফাটা আত্মার প্রান্তরে। সারারাত অনিদ্রা দুঃস্বপ্ন আর ছারপোকা, ছিদ্রান্বেষী ইঁদুরের উৎপাত উজিয়ে ময়লা চাদর ছেড়ে উঠি ফের মাথাব্যথা নিয়ে।   (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
এ কেমন সন্ধ্যা ঘিরে ধরেছে আমার প্রিয় এই শহরকে আজ। চতুর্দিকে গুঁড়িয়ে পড়ছে ঘরবাড়ি। নরনারী, শিশুদের বুকফাটা কান্নায় কাঁপছে পথঘাট, গাছপালা। এই তো নিজেকে আমি ইট, পাথরের স্তূপ থেকে আহত শরীর তুলে দেখি আশেপাশে, সবদিকে অগণিত লাশ, কোনও কোনও স্থানে ভাঙা পুতুল-জড়ানো হাতে নিষ্প্রাণ বালিকা। আমাদের ছোট ঘরবাড়ি খুঁজে খুঁজে আখেরে অধিকতর ক্লান্ত শরীরে অজানা জায়গায় ভগ্নস্তূপে বসে পড়ি। হঠাৎ সমুখে একটি ধূসর খাতা দেখে দ্রুত হাতে তুলে দিই। আবিষ্কৃত খাতার প্রথম দুটি পাতা গায়েব হলেও অবশিষ্ট বেশ কটি পাতা জুড়ে রয়েছে কবিতা, সত্যি বলতে কী, কতিপয় পদ্য পড়তেই উদ্ভাসিত প্রকৃত কবির পরিচয়। কখন যে রাত ওর কোমল শরীর নিয়ে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে, অদূরে গাছের পাতাময় ডাল থেকে পাখির নিঝুম গান ঝরে জ্যোৎস্নার ধরনে। ভেসে ওঠে আকাশে অনেক মুখ।
শামসুর রাহমান
সনেট
নৈঃসঙ্গ্য লালিত আমি। শিরায় শিরায়, লোমকূপে কী শীতল স্রোত বয় সারাক্ষণ, অস্থিমজ্জা নিঝুম পল্লীর মতো। নিজে খাপছাড়া বলে লজ্জা পাই খুব একান্ত নিজেরই কাছে। নৈরাশের যূপে প্রায়শ আমাকে ঠেলে দ্যায়, দ্যায় বিরূপ দঙ্গলে ছুঁড়ে ক্ষিপ্র আমার ভেতরকার কোনো প্রতিপক্ষ এবং মনুষ্যরূপী মড়াখেকেদের সঙ্গে সখ্য জমে ওঠে নিত্য দিকচিহ্নহীন অসিত জঙ্গলে।আমি কি নৈঃসঙ্গপ্রিয় আজীবন? গাছপালা, পাখি পাখালির ভিড়ে, পশুদের কাছে, খরগোশের গায়ে মুখ ঢেকে, জনহীন ঝর্নাতলে আনন্দ আনন্দ ব’লে মেতে থাকতেই চাই জীবনের সব ফাঁকি, উন্মত্ত সংঘর্ষ রক্ত ফেনিলতা ভুলে বনচ্ছায়ে? মানুষের সঙ্গ অভিলাষী আমি, থাক শত দ্বন্দ্ব।   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
আমার এ ছোট ঘরে কিছুক্ষণ বসে চুপচাপ চলে গেলে তুমি নিশীথকে অধিক আন্ধার করে। চেয়ে থাকি শূন্য চেয়ারের দিকে ছায়াচ্ছন্ন ঘোরে, চায়ের পেয়ালা আর্ত বুলবুলি, যেন চায় মাফ বুকে গান নেই বলে। আমরা দুজন যে-আলাপ করেছি তোমার প্রস্থানের আগে তা-ই ফের দোরে, জানালার পর্দায়, বইয়ের র্যাফকে আর ঠাণ্ডা ফ্লোরে ছায়া হয়ে ঝোলে, রয়ে যায় তোমার প্রাণের ছাপ।তুমি চলে গেলেও কেন যে মনে হয় এই ঘরে আছো বসে, হাসছে তোমার চোখ, শাড়িটার ভাঁজ নদীর তীরের মতো; তুমি আছো, যেমন কবিতা আবৃত্তি করার শেষে ছন্দিত মঞ্জুল রেশ নড়ে মর্মমূলে, যে রকম মন্দিরের ঘণ্টার আওয়াজ জমে থাকে স্তব্ধ মাঠে। ভুলে যাই তুমি পরিণীতা   (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
এখন যেখানে আছি, কস্মিনকালেও এখানে আসতে চাইনি। একটা ঘোরের মধ্যে এখানে আমার আসা। ভাবি, কোনো দিন মনের মতো একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াব, যেখানে ইঁদুর দৌড় নেই, কলহ, খিস্তি-খেউড় নেই, দুস্থ ভিড়ের মধ্যে একে অন্যকে কনুইয়ের গুঁতোয় হটিয়ে পায়ে মাড়িয়ে যাবার মতো মনোবৃত্তি কারো নেই।এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে ক্রমাগত, একটা সাঁড়াশি চেপে ধরেছে কণ্ঠনালি, কিছুতেই বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছি না, কেবল ক্লান্তি আমাকে চাদর দিয়ে মুড়ে রেখেছে, স্পষ্ট কিছুই দেখতে পাচ্ছি না আশপাশে, অসুস্থ চোখ জড়িয়ে আসে অবেলায় ঘুমে।আমি কি স্বস্তি পাব কেতাদুরস্ত কপট মিত্রের সঙ্গে একটানা আড্ডা নিয়ে? শান্তি খুঁজব পচা টোমাটোর মতো গণিকার ক্ষীণায়ু আশনাইয়ে? দু’নৌকায় পা রেখে আর কতকাল ঝোড়ো হাওয়ায় চাল সামলে চলব?এবার একটা হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার, এ-কথা কতবার মনে মনে আউড়ে নিজেকে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করেছি, অথচ পুরোনো বৃত্তের বাইরে পা রাখা হ’য়ে ওঠেনি কখনো। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধে হয়,- এই প্রবাদ বারবার আমার জীবনে, সত্যতা যাচাই করে নিয়েছে। পাঁকে থেকে থেকে পঞ্জক হবার স্বপ্ন দেখেছি, কিন্তু শেষ অব্দি।ক্লেদমুক্ত হ’তে পারিনি। আমার অনুভূতিগুলো গান হ’তে গিয়ে আতর্নাদ হ’য়ে উঠেছে। আজ এমন একটা জায়গায় পৌঁছুতে চাই, যেখানে ঘাসে শুয়ে আকাশের তারা দেখে দেখে রাত ভোর করে দিতে পারব, নির্বিঘ্নে আঁজলায় ঝর্ণার পানি তুলে নিতে পারব, দেখতে পারব খরগোশের দৌড়, হরিণের লাফ, যেখানে বকধার্মিকের বকবকানি নেই, রাজনৈতিক টাউটদের ধূর্তামি নেই, নেই নিষ্কর্মা, দাম্ভিক প্রশাসকদের আস্ফালন। কিন্তু নিজেকে বিশুদ্ধ করার জন্যে এখনো যথেষ্ট পুড়িনি রৌদ্রে, ভিজিনি বৃষ্টিতে।   (না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
আমিও বনের ধারে মধ্যে-মধ্যে একা চলে আসি শহর পেছনে ফেলে। কোলাহলহীন বেলা কাটে ঘাসে বসে ঝিলের ঝিলিক আর বীতশস্য মাঠে পাখি দেখে, শিস বাজে ঘন ঘন; ক্লান্ত শীর্ণ চাষী, সূর্যসেঁকা, বৃক্ষতলে স্বপ্ন শোঁকে, আশ্রয়-প্রত্যাশী পান্থজল লম্বা পায়ে বসতির দিকে পথ হাঁটে এবং সূর্যের চোখ বুজে আসে মেঘাচ্ছন্ন খাটে। সহসা শুনবো আমি, আশা রাখি, উত্তেজক বাঁশি।এখনো বনের ধারে আমি কার পথ চেয়ে থাকি? ভীত ত্রস্ত হরিণ তাড়িয়ে এনে কোন্‌ সে শিকারী আসবে বেরিয়ে খোলা ধুধু মাঠে অথবা বেনামি দেবী বাকলের আবরণে এখানে আসবে, নাকি সেই অর্ধছাগ আর অর্ধ মানবের দেহধারী দেবতা আসবে যার বংশীধ্বনি শুনতে চাই আমি।   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
তোমার কথাই ভাবি রাত্রিদিন; পল, অনুপল তোমার মুখের রেখা, চক্ষুদ্বয়, অধর, চিবুক চুলের অসিত ঝর্না, স্বর্গের স্বপ্নের মতো বুক মনে পড়ে। তোমাকেই ভাবি, যেমন কল্পানাজ্জ্বোল কবি ভাবে কাব্যের শরীর তার লেখার টেবিলে, কোনো গ্রন্থপাঠের মুহুর্তে, খেতে বসে, ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে, বিছানায় দারুণ বিনিদ্র রাতে- সর্বদাই ব্যেপে আছো তুমি আমার হৃদয় নীলে।ভাবিনি তোমাকে পাবো সাতচল্লিশের সীমানায় অকস্মাৎ ভাবিনি যখন আমি রুক্ষ, ধূ-ধূ এই পথে বড়ো দিশেহারা, তৃষ্ণায় কাতর, তুমি এসে আমার আঁজলা ভরে দেবে ফোয়ারায় দিনশেষে। তোমার আসার কথা ছিলো জানি অনেক আগেই, তিরিশ বছর আমি ছিলাম তোমারই প্রতীক্ষায়।   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
আমার ভেতরে করে বসবাস অচিন মানব একজন; আহার্য, পানীয় কোনো কিছু তার কাছে মোটেই জরুরি নয়। বড়ো নিরালায় থাকে, নাচে মাঝে-মধ্যে, সুর ভাঁজে অন্তরালে, কখনো-বা শব সাধনায় মেতে ওঠে। অকস্মাৎ করে কলরব, শূন্যে ছোঁড়ে প্রাচীন করোটি, তার শীর্ণ দুটি হাতে সাপ ক্রীড়ামগ্ন আর নির্জন নিথর মধ্যরাতে ঠোঁটে তার ঘন ঘন স্পন্দমান তন্ত্রের উৎসব।যে-আমি স্নানের পরে চুলে সিঁথি কাটি, দাঁত ব্রাশ করি ভোরে, রাতে ঘুমোবার আগে, বই পড়ি, হেসে কথা বলি অতিথির সঙ্গে, সাহিত্য সভায় যাই, তোমার উদ্দেশে গড়ি তারাচূর্ণ শব্দ, যে সন্ত্রাস শাসক ছড়ায় দেশে, তাকে তীব্র ধিক্কার জানাই- এ-আমিকে না কি সেই তান্ত্রিককে যাবে ভালোবেসে?   (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
এখন আমি আগেকার মতো নেই আর। ক’দিন থেকে আমার বুকের ভেতর একটা ছায়ার ত্রিভুজ জেগে উঠেছে। সেই ত্রিভুজের শীর্ষবিন্দুতে কালো ঝুঁটি-অলা আজনবি এক বিষণ্ন পাখির বসবাস। ওর দু’ফোটা কালো চোখ ঘিরে সিঁদুর রঙের বাহার। পাখিটাকে কথা বলাবার জন্যে, নিদেনপক্ষে একটি কি দু’টি শিস যাতে শোনায় আমাকে, কত যে সাধ্য-সাধনা করেছি সে জন্যে। অথচ সে নিস্তব্ধতার কঠিন মোড়ক ছিঁড়তে প্রবল অনাগ্রহী। মধ্যে-মধ্যে শুধু কালো ঝুটি নাচায় আর কেমন আড়চোখে তাকায় আমার দিকে। যখন আমি তোমার সঙ্গে কথা বলি, যখন আমার কণ্ঠ থেকে আবেগবিহ্বল মুহূর্তে রৌদ্র জ্যোৎস্নাময় এবং ঘনঘোর মেঘবিদ্যুৎ ভরা পদাবলীপ্রতিম কিছু বাণী নিঃসৃত হয়, তখন পাখিটি সুতীক্ষ্ণ চঞ্চু দিয়ে কখনও আমার ফুসফুস, কখনও ওর নিজের বুক ঠোকরাতে থাকে জন্মান্ধ আক্রোশে। আমি তার বিরুদ্ধে কোনও নালিশ রুজু করছি না কারও কাছে। ভেব না, ওর লাগাতার জুলুমের কেচ্ছা রটিয়ে ফিরিস্তি সাজিয়ে আমি তোমার সহানুভূতি কিংবা করুণার কোমল ছায়ায় দাঁড়াতে চাই। হঠাৎ কোনও কোনওদিন দুপুরে অথবা সন্ধ্যায় তোমাকে দেখলে আমার ভেতরকার ছায়ার ত্রভুজবাসী কালো ঝুঁটি-অলা পাখিটির অস্তিত্ব ভুলে থাকি।   (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
ভোরবেলা বাতাসের চুমোয় ঘুমের মাতলামি কী মধুর ন’ড়ে ওঠে। জানালার বাইরে নজরে পড়তেই নেচে ওঠে পুষ্পিত গাছের ডালে দু’টি প্রেমমুগ্ধ পাখির চুম্বন আমাকে পূর্বের কে প্রভাতের প্রণয়-বিলাস বড় বেশি আলোড়িত করে। যেন ফের নতুনের স্বাদ পাই।এই ঋতু যুবক এবং যুবতীর একান্ত নিজস্ব ঋতু- যদি বলা হয় চতুর্দিক জুড়ে, তবে বিন্দুমাত্র হবে না সত্যের অপলাপ। তাই আজও শরতের সৌন্দর্যের মহিমা সর্বদা তারুণ্যের অন্য নাম। বুঝি তাই বয়স বাড়তে থাকলেও সতর্ক, নিপুণ যারা বার্ধক্য তাদের কাবু পারে না করতে!জানা আছে বিলক্ষণ, মানুষের মরণের মুখোমুখি হতে হবেই, নিস্তার নেই মৃত্যুর করাল অন্ধকার থেকে। তবু আমরা কি সবাই খেলার ছলে লুপ্ত হতে চাই? হয়তো এমন কেউ-কেউ আছেন সংসারে যাঁরা বিলক্ষণ মরণ-পিয়াসী। কিন্তু যে যা-ই বলুক যৌবন কি বার্ধক্য কখনও পৃথিবীকে ছাড়তে প্রস্তুত নই।   (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
ঘরের বাইরে নুয়ে আছে নিরিবিলি বারান্দায় বুগেনভেলিয়া, যেন শূন্য রাঙা মন্দিরে প্রণতা দেবদাসী একাকিনী। ঘরের ভেতরে আচ্ছন্নতা গদ্যের পদ্যের, আমাদের দু’জনের চেতনায় কত যে শতাব্দী বয়ে যায়। আমাদের বাক্যালাপে খৃষ্টপূর্ব সূর্যোদয়, বিশ শতকের অস্তরাগ, কত তক্কো গপ্পো মেশে। তোমার কপালে মৃদু দাগ কবেকার হেসে ওঠে, দূরে বুগেনভেলিয়া কাঁপে!ঐযে লতাপাতা, ফুল, ওরা মানুষের খুব কাছে প্রত্যহ আসতে চায়, কখনো হঠাৎ পায় ভয়- এমন দোটানা মনোভাব ওদের স্বভাবে আছে। আপাতত দীর্ঘ লাল বারান্দার থেকে, মনে হয়, আমাদের ভালোবাসা দেখে, নিয়ে অলৌকিক রেশ বুগেনভেলিয়া ঘরে কী প্রবল করেছে প্রবেশ।   (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
রূপক
তিন-চার মাস ধরে সমগ্র সত্তায় জ্বরোভাব। মুখ তেতো সারাক্ষণ, খুক খুক কাশি। ফুসফুস থেকে অবিরাম মিলকভিটা মাখনের মতো কফ পড়ে, যদিও খাই না টোস্ট মাখন লাগিয়ে কতকাল, সে কবে পঞ্চাশ পেরিয়েছি বলে। বন্ধুদের কেউ কেউ বলেছেন অনেক আগেই, ‘তোমার কাশিটা ভাই সুবিধের নয়, ভয় হয়, ভালো করে চিকিৎসা করাও। অন্তর্গত তেজে কারো পরামর্শে এতদিন তেমন করিনি কর্ণপাত। এমনই ছিলাম, আছি; থাকব কি বহুদিন?এখন শরীরটাকে নিয়ে পারছি না আর, ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে যাই গ্রিন সুপার মার্কেটে এক্স-রে করাতে বুকের, রক্ত পরীক্ষাও হলো; সব খুঁটিয়ে অভিজ্ঞ চোখে দেখেশুনে ডাক্তার বললেন, ‘আপনাকে, শুনুন, করেছে দখল ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস, তারপর কাগজে দিলেন লিখে প্রেসক্রিপশান। অকস্মাৎ মনে পড়ে গ্রিন সুপার মার্কেটে দোতলায় সন্ধ্যেবেলা এক্স-রে ঘরে একজন তরুণীকে দেখে চম্‌কে উঠেছিলাম। সে কেন এখানে এল? তার পূর্ণিমায় কোন অমাবস্যা বাসা বেঁধেছে হঠাৎ? অচেনা সে যুবতীকে দেখে কেবলি তোমার কথা মনে পড়ছিল বারবার, আর দ্রুত বেড়ে গেল আমার এ বুকের অসুখ। তোমার স্পর্শের জন্যে বুক কাঙালের মতো অত্যন্ত করুণ চোখ মেলে চেয়ে থাকে অন্তহীন প্রতীক্ষায়।   (না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
আমি তো একাই থাকি রাত্রিদিন, হৃদয়ের ক্ষত শুঁকি, চাটি বারংবার। বোমাধ্বস্ত শহরে যেমন নিঃসঙ্গ মানুষ ঘোরে, খোঁজে চেনা মুখ কিংবা স্বজনের মৃতদেহ, প্রত্যহ আমি তেমনি করি চলাফেরা একা একা। ধ্বংসস্তূপে চোখ পড়লেই আমার অস্তিত্ব করে আর্তনাদ। কবেকার গাঢ়বেহালার সুর বাজে পুনরায়, সভ্যতার পোকা-ছাওয়া মাংস স্পন্দিত সে সুরে। একটি ভালুক, লাল, বড় স্তব্ধ, বহুদিন থেকে নিরিবিলি ঘরে রয়েছে দাঁড়িয়ে ঠায়। যদি প্রাণ পায় চলে যাবে তাড়াতাড়ি মৌচাকের খোঁজে দূরে বাড়িটিকে ফেলে। বিটোফেনি সুর ঝরে তার গায়, চক্ষুদ্বয় অত্যন্ত সজীব হতে চায়। নিরুপায় অন্ধতায় তার বেলা যায়।একটি চিঠির খাম পড়ে আছে টেবিলের বুকে গোধূলিতে নিষ্প্রাণ পাখির মতো। পুরোনো চেয়ার অকস্মাৎ দূর শতাব্দীর সিংহাসন হ’য়ে মিশে যায় ফ্যাক্টরির কালো পেঁচানো ধোঁয়ায়। চতুষ্পার্শ্বে সভ্যতার মতো কিছু গড়ে ওঠে, ভেঙ্গে যায় ফের, কম্পমান অন্ধকারে একরাশ বেহালা চোখের মতো জ্বলে। কবির মেধার কাছে সভ্যতা কী চেয়ে বিমুখ হয়ে থাকে বারংবার? মরণের সঙ্গে দাবা খেলে অবসন্ন কবি, পাণ্ডুলিপি, ফুল মেঘে ছড়াতে ছড়াতে চলে যায় অবেলায়। আমিতো একাই থাকি রাত্রিদিন। কবি জনস্রোতে, মোটরের ভিড়ে বুনো ঘোড়ার মতোন থতমত; আর্তনাদ করে তার পেশী, চক্ষুঃশিরা যেন স্মৃতি ক্রন্দনের মতো আসে ব্যেপে অস্তিত্বের কন্টকিত তটে! চতুর্দিকে বাজে ট্রাফিকের কলরব, চোখ বেয়ে ঝরঝর মুহূর্ত ঝরে, জনতার পাশাপাশি মৃত্যু হাঁটে, কোথায় সে গোধূমের ক্ষেত পুড়ে যায়, শূন্য ঘরে টেলিফোন একটানা বেড়ে চলে, শুনেছো তো, হায়, রেডিয়োর সন্ধ্যার খবরে।এলভিস প্রেসলির মৃত্যু রটে গেছে চরাচরে। চারখানায় আড্ডা জমে, পপ সুরে মারফতী গান শুনে মাথা নাড়ে বিগত-যৌবন ফেরিঅলা। অন্ধকারে তরুণ কবির চোখে পড়ে অপ্সীরর স্তন, হিজড়ের সুবজাভ গাল, নর্দমায় ভাসমান সুন্দরীর মৃতদেহ। দ্যাখো দ্যাখো এ শহরে কী ঘর বানায় ওরা শূন্যের মাঝার।আমিতো একাই থাকি রাত্রিদিন। এখন কোথায় তুমি কোন সভ্যতার আলো চোখে নিয়ে আছো শূন্য বারান্দায়? সৌন্দর্য তোমার সাথে আছে, তোমাতেই মিশে আছে। পাথরের সিঁড়ি ভেঙ্গে ভেঙ্গে হেঁটে বহুদূর চলে গেছে বুঝি? একজন কবি তার ব্যাকুলতা, শব্দপ্রেম রেখেছিলে। তোমার কোমল অঞ্জলিতে- মনে পড়ে নাকি? থেমে-যাওয়া ক্যাসেটের কথা মনে পড়ে? মনে পড়ে জানালার বাইরে কি যেন দেখানোর ছলে আমার আপন হৃদয়ের অন্তলীন গুহার আঁধার কত সজীব জাগ্রত দেখে নিতে চেয়েছিলে? অদৃশ্য হরিণ কাঁদে তোমার বাগানে গভীর রাত্তিরে ঘুরে ঘুরে।বারান্দায়, ছাদে আর সিঁড়িতে অস্পষ্ট পদধ্বনি, বাড়িটার দু’চোখে পা ঠোকে ঘোড়া, কার জেল্লাদার পোশাকের স্পর্শ লাগে তার গালে, বুকে বিদ্ধ কামার্ত নিশান। বিপ্লবের আগুনের মতো কিছু চক্রাকারে ঘোরে চতুর্দিকে, কেউ হাত সেঁকে, কেউ পুড়ে ছারখার হয়। হৃদয় কী ঘোরে সময় আবৃত্তি করে, প্রতীক্ষায় থাকে, জ্বলে আবেগকম্পিত, স্মৃতিভারাতুর কোনো গজলের মতো। আমি তো একাই থাকি রাত্রিদিন। কখনো সখনো লোকজন থাকে বটে আশেপাশে কিংবা চেনা মহলের চৌহদ্দিতে বসবাস করতেই হয়, কণ্ঠ মেলাতেই হয় সংসারের ঐকতানে, তবু আমি দৈনন্দিন কলরবে অকস্মাৎ কেমন রহস্যময় হয়ে উঠি নিজেরই অজ্ঞাতে, কেমন নিশ্চুপ এবং প্রকৃত বিপ্লবীর মতো জেগে থাকি নিজস্ব ভূগর্ভে উদাসীন, একা।   (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
কে আমাকে দিন দুপুরে রাত দুপুরে কাপড় কাচার মতো ক’রে নিঃড়ে নিচ্ছে? আমার মেদ আমার মজ্জা শুষে নিচ্ছে? কে আমাকে এভাবে রোজ কষ্ট দিচ্ছে?কে আমাকে পাগল-করা নিঝুম সুরে ঘর ছড়িয়ে পথের ধারে দিচ্ছে ঠেলে? মাথার ভেতর পিঁপড়ে শত দিচ্ছে পুরে? হাত-পা বেঁধে যখন তখন শাস্তি দিচ্ছে?যখন কিছু লিখতে বসি, মত্ত পাখি ডাকাডাকি করতে থাকে শিরায় শিরায়, কলম ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ি, মাথা টলে। কে রোজানা সকল কিছু ভেস্তে দিচ্ছে?চায় না সেতো রাত্রিবেলা ঘুমিয়ে থাকি, আমার দিকে হাজার বাদুড় দিচ্ছে ছুঁড়ে, আমাকে সে নিজের কবর খুঁড়তে বলে; কে আমাকে এভাবে রোজ দন্ড দিচ্ছে?কে আমাকে ব্যস্ত রাখি অস্থিরতায়? হাতে গুঁজে দিচ্ছে দীর্ঘ ফাসির দড়ি, কখনো বা রেললাইনে বলছে শুতে, আজকে আমি ফাঁদে-পড়া জখমি জন্তু।কে আমাকে সব প্রহরে কেবল ভোগায়, মুঠোয় পুরে দিচ্ছে অঢেল ঘুমের বড়ি? প্রতি পদেই খাচ্ছি হোঁচট, মুষড়ে পড়ি; তবু তাকেই চাই যে কাছে অধিকন্তু।   (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
আমি কি থাকবো পড়ে লোকালয় থেকে দূরে এমন একাকী? বহুদিন তুমি চোখ তুলে দ্যাখোনি আমাকে, বহুদিন আমার আকাঙ্ক্ষাগুলি আঙুলের ডগায় নাচিয়ে দিয়েছো হেলায় ছুঁড়ে। আমি অভিমানে নিশ্চুপ গিয়েছি চলে নিজের নৈঃসঙ্গ্যে পুনর্বার, তোমার সান্নিধ্য থেকে দূরে যেতে শ্বাসকষ্ট হয় জেনেও নিভিয়ে আলো হৃদয়ের অন্ধকার দীপের মতোই ভেসে গেছি খরস্রোতে, ঝড়বাদলের প্রতি বড় উদাসীন।এখানে একাকী পড়ে আছি কতকাল আমার শরীরের লতাগুল্ম গজিয়েছে ক্রমান্বয়ে, পোকামাকড়ের আনাগোনা চতুর্দিকে, মনে হয় উঠে আর দাঁড়াবো না পায়ের ওপরে কোনোদিন, তুমি এসে দেখে যাও একজন মানুষের ভীষণ অনুপস্থিতি অন্যজন নিজের সত্তায় কী রকম বোধ করে, কী রকম মনে হয় জীবনযাপন।একটি চুম্বন আমি তোমার নিকট বারংবার প্রার্থনা করতে গিয়ে দেখেছি আমাকে দুঃখ তীব্র চুমু খায় প্রতিবার আর যখনই তোমাকে বুকে নিয়ে স্বর্গসুখ নিরিবিলি পেতে চাই, তখনই শূন্যতা নরখাদকের মতো আমাকে কেবলি গিলে খায় এবং আমাকে ঘেঁষেহাঁটে দূর শতাব্দীর কতিপয় বেনামি কংকাল প্রেমিকের। তোমার চুম্বন জানি ঝরে যাবে ভিন্ন ওষ্ঠে সকল ঋতুতে; হয়তো সে বীতপ্রেম চুম্বনকালীন দৃশ্যে একটি রঙিন পায়ের আঙুলে কিংবা উন্মোচিত স্তনে, তাকে তুমি দিওনা উড়িয়ে কখনো বিরক্তি ভরে-সে আমার আরম্ভ বাসনা। নিজের ভেতরে আমি বাজি, যেন করুণ বেহালা, কী এক ক্ষুধায় নিজেকেই প্রতিদিন করছি আহার গাছের প্রতিটি পাতা ছিঁড়ে এনে পত্র লিখি, হটাৎ আবার কুটি কুটি ছিঁড়ে ফেলি সব। মাঝ-মধ্যে মনে হয় তুমিহীনতায় ভয়ানক সেলে আছি, যাচ্ছি ক্ষয়ে ক্রমাগত। যদি তুমি দূর থেকে বলো, ‘এখনো লোকটা এত দুঃখে ডুবে আছে?’- তাহলে আমার অহংকার প্রবল জাগিয়ে আমি নিরুত্তর সেলে মাথা রেখে দুঃখের অধরে চুমু খেয়ে, হৃদয়ের চোখের জলধারা দেখে খর বিবেকের শরশয্যায় থাকবো শুয়ে একা।   (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
আকাশে নিমগ্ন শারদ রোদ্দুর, শস্যদানা খুঁটে তিনটি হাঁস খায়। নামিয়ে মাঝপথে যাত্রী কতিপয় দৃশ্য থেকে ফের দৃশ্যে বাস যায়!অতীত-চেরা মৃদু আলোর ঝলকানি- দাঁড়ানো ছিলে তুমি একলা গৃহকোণে। বিবাগী মেঘ বুঝি গাছকে চায় ছুঁতে, তোমার চোখ দুটি কুহক জাল বোনে।শহরতলী দিলো বাড়িয়ে বাহু তার, ছুটির দিন যেন গুণীর হাতে বীণ; তোমার দৃষ্টিতে হৃদয় বিম্বিত, সেদিকে তাকালেই আমার বাড়ে ঋণ।তোমার ওষ্ঠের ব্যাকুল তট জুড়ে স্তব্ধ ছিল কথা সেদিন প্রথমত, এবং আমাকেও বন্দি করেছিল কে এক মূক লোক দুপুরে মুখ্যত।পথের ধুলো ধুয়ে দিঘির কালো জলে চকিতে চেয়ে দেখি ভেসেছে ঘাটে ঘড়া। আমার পাশে তুমি শরীরে নিয়ে ঢেউ গহন নিসর্গে হলে স্বয়ম্বরা।পড়ে না দৃষ্টিতে শরীরজোড়া শাড়ি, বাকল গেছে এঁটে প্রখর যৌবনে। শিরায় ছোটে কত যুগের হরিণেরা, তৃষিত ঠোঁট রাখি তোমার যৌবনে।নিমেষে খসে যায় মদির আদিমতা, তোমার সত্তায় লজ্জা পুষ্পিত, আমিও ভব্যতা আবার ফিরে পাই, লোকের কথা ভেবে ঈষৎ হই ভীত।সাজালে চৌকিতে পঞ্চ ব্যঞ্জন, শরীরে চুমো খায় হাতপাখার হাওয়া। রাখবে চোখে তুমি হাতের নড়া গেঁথে, দেখবে গোধূলিতে আমার চলে-যাওয়া। আমার অন্তরে তোমার অঞ্জলি অর্ঘ দেয় মেলে, ঋদ্ধ হই আমি। কখনো এ-অর্ঘ অসার হয়ে যাবে- এ-কথা সরাসরি বলতে গিয়ে থামি।শহরে ফিরে গিয়ে হয়তো ভুলে যাবো, দগ্ধ মনে কত স্মৃতির ধোঁয়া জমে। কখনো এটা আর কখনো ওটা ভুলি, তোমার প্রেম বাঁচে অনাথ আশ্রমে।   (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
(আবুল হোসেনকে) এতদিন আছি তার কাছাকাছি তাই দুটি চোখে দেখেছি কৌতুক শ্লেষ, টকরো হাসি। স্তব্ধতায় ঠায় টেবিলে দাঁড়িয়ে আছি আঠারো বছর এক পায় ধ্যানী আলো-অন্ধকারে। প্রতিদিন তার প্রাণলোকে কতো কী-যে ঘটে দেখি, ঘোরালো তর্কের তীক্ষ্ণ নখে ছেঁড়ে ঢের জটিল তত্ত্বের সূত্র, কাটায় হেলায় সময় শব্দের প্রেমে, বুদ্ধির দেউড়ি আগলায় সারাক্ষণ। বাষ্পাকুল হয় না সে আনন্দ কি শোকে।কিছুতে পাই না ভেবে কৌচে বসে কী-যে বলে অত বুদ্ধিজীবী বন্ধুদের সঙ্গে রোজ। না খাদ্য, না ঘুম কিছুই পারে না তাকে বাধা দিতে; হয়তো নিছক বাজে কথা, গা ভাসায় তবু সেই স্রোতে অবিরত। যদিন মেয়েটা গেলো, কাঁদলো সে নিশ্চুপ নিঝুম   (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
কালেভদ্রে একটুখানি দেখার জন্যে ঘুরে বেড়াই যত্রতত্র, দাঁড়িয়ে থাকি পথের ধারে। রোদের আঁচে গা পুড়ে যায় যখন তখন, জল-আঁচড়ে আত্মা থেকে রক্ত ঝরে; দূর দিগন্ত আস্তেসুস্থে রক্ত চাটে।স্কুটার থেকে নামো যখন রোদ-ঠেকানো চশমা চোখে, যখন তোমার শরীর জুড়ে তাড়ার ছন্দ নেচে ওঠে, ‘ঐ যে এলো, ঐ যে এলো’ বলে ছুটি তোমার দিকে একটু খানি দেখার জন্যে, কুশল বিনিময়ের জন্যে। ‘কখন এলে? নিরালা এই প্রশ্ন ঝরে, শিউলি যেন তোমার ফুল্ল অধর থেকে। ইচ্ছে করে বলি হেসে, ‘দিল্লীজোড়া গোধুলিতে গালিব যখন ছিলেন বেঁচে।কিন্তু এখন আগামী এক শতক-ছোঁয়া হাওয়ায় কাঁপে তোমার খোলা চুলের শিখা। তখন ও কি সেই সময়ে থাকবো আমি? গহন কোনো দুপুরবেলা চোখে নিয়ে কৃষ্ণচূড়ার মোহন আভা ব্যাকুল ছুটে আসবো আবার তোমার কাছে? যখন তুমি ধূসর দূরে বসে থাকো, হিস্পানী এক গিটার বাজে করুণ সুরে মনের ভেতর, যখন তোমার হৃৎকমলে চুপিসারে ভ্রমর কালো ছায়া ফেলে, পানিমগ্ন শিলার মতো অবচেতন নড়ে ওঠে ঠারে ঠোরে, আমার বুকে ধাক্কা লাগে, দদ্মবেশী আদিবাসী বিস্ফোরিত আর্তনাদে। যখন তোমার আঁটো স্তনে জ্যোৎস্না কোমল শুয়ে থাকে, রহস্যময় একলা গাছে নিভৃতে ফল পাকতে থাকে। যখন তোমার গালে জমে রাতের শিশির, কবন্ধ পাঁচ অশ্বারোহী ছুটে বেড়ায় তেপান্তরে। আলতো তোমার হাতের ছোঁয়া পাওয়ার জন্যে হঠাৎ রোদের ঝলক-লাগা ঝর্ণাধারার মতো তোমার গলার আওয়াজ শোনার জন্যে, খুচরো কিছু চুমোর জন্যে, দুটি বাহুর বন্দরে ঠাঁই পাওয়ার জন্যে, কালেভদ্রে একটুখানি দেখার জন্যে আর কতকাল ভিক্ষু হয়ে পুড়বো রোদে? ভিজবো একা জল-বাজানো পথের মোড়ে?(হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
সকালে গলির মোড়ে, দ্বিপ্রহরে রেস্তোঁরায়, অপরাহ্নে পার্কে, সন্ধেবেলা বাস-স্টপে, মধ্যরাতে ইস্টিশানে কিংবা গিজগিজে বাণিজ্যিক এলাকায়, দরজির দোকানে, ঘ্রাণময় সেলুনে বকুলবনে, যেখানেই যখন ডাকোনা কেন তুমি, তোমার কাছেই যেতে হয়।কী শীত কী গ্রীষ্ম সকল ঋতুতেতোমার কাছেই যেতে হয়। নিমেষেই কী বিপ্লব বিস্ফোরিত অস্তিত্বের নিঝুম পাড়ায়। অকস্মাৎ অন্তরাল থেকে নীল পতাকা উড়িয়ে দাও আর রক্তচক্ষু ট্রাফিক বাতির মতো পিতার নিষেধ, মাতার কাতর অনুনয়, হৈ হুল্লোড়ময় রাস্তার কিনারে ফেলে রেখে তড়িঘড়ি পা বাড়াই তোমারই উদ্দেশে। বার-বার ঝঞ্ছাহত চৈতন্যের দায়ভাগ নিয়ে তোমার কাছেই যেতে হয়।কোনো কোনো রাতে কাক না জাগার আগেই কী ছলে আমাকে জাগিয়ে দাও। শোচনীয় পিপাসায় গলা কাঠ হ’য়ে যায়, তুমি জলের বদলে স্পঞ্জ থেকে বিন্দু বিন্দু সির্‌কা নিংড়ে দাও। কখন যে হেলাভরে আমাকে দেয়াল ঠুকে খুন করো কর্কশ পেরেকে, চৈত্য থেকে টেনে এনে আবার বাঁচাও-বোঝা দায়। নিজের রক্তের নক্‌শা দেয়ালে মেঝেতে দেখে দেখে কতো যে নিষ্ফল বেলা কাটে, পাই না তোমার সাড়া বহুদিন। যেন তুমি নেই ত্রিলোকে, ছিলে না কোনোদিন। পুনরায় অকস্মাৎ বেজে ওঠে রক্তের ভেতর সোনাটার মতো তোমার গোপন টেলিগ্রাম। আলুথালু গৃহিণী নদীকে প্রবল আনেন ডেকে চোখে, আমার পায়ের তটে আছড়ে পড়েন বার-বার, মেয়েটা কেবলই টানে পাঞ্জাবির খুট আর আমি যেন শক কিংবা হুন, দু’পায়ে মাড়িয়ে আঁচল, পুতুল ছুটে যাই ভূতগ্রস্ততায় যা’ কিছু সম্মুখে পাই লন্ডভন্ড ক’রে সব ছুটে যাই। জানি, তুমিই গন্তব্য চিরদিন।কোন্‌ ইন্দ্রজাল ধরো অক্ষি তারকায়? হাতের মুদ্রায়? বাসি স্বপ্নে মশগুল তাজা যুবা, বিবেচক প্রৌঢ়, এমনকি শ্লেষ্মা-কবলিত বেতো বৃদ্ধ, যাঁর ভূরুসুদ্ধ কী রকম শাদা হয়ে গেছে, তারা তোমার পেছনে ছোটে দিগ্ধিদিক, তবে কেন আমি মিছেমিছি দাঁড়াবো সংকীর্ণ কাঠগড়ায়? খেলাচ্ছলে ফেলে যাও আমার দুয়ারে কী উজ্জ্বল রাঙা চিরকুট, বুঝি তোমারই ঠিকানা। এবং আড়াল থেকে দ্যাখো খুঁজে পাই কিনা, দ্যাখো অপার কৌতুকে আমার সকল কিছু পাতালে ভাসিয়ে। আমি তো কুড়িয়ে সেই লিপি সংসার শ্মশান ক’রে ছুটি।বুকের ভেতর কম্পমান বেয়াল্লিশ বছরের ভীতু হাড়, যদি বনবাদাড় পেরিয়ে, সারা রাত খাদ ঘেঁষে হাঁটার পড়েও, টপ্‌কে অজস্র কাঁটাতার বৈদ্যুতিক বেড়া আখেরে সেখানে গিয়ে তোমাকে না পাই, যদি পৌঁছে যাই, হায়, ভুল ঠিকানায়!   (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
থাকুক না; থাকলে দোষ কী? আজ ওদের হটাতে করা সভা ডেকে করবে ঘোষণা লাগাতার হরতাল? বলো, কারা মানববন্ধনে মেতে চাঁদ আর চন্দ্রমল্লিকাকে কবিতার খাস জমিনের চতুঃসীমা থেকে দেবেনির্বাসন? না, ওরা থাকবে নিজ নিজ জায়গায় অটুট। কারো কোনো ক্ষতি নেই; কবিতার বুকে নিত্য ফুটবে গোলাপ আর দুলবে দোয়েল।কবিতা কি ধুলোবালি থেকে ইস্ত্রি করা কাপড় বাঁচিয়ে খুব সন্তর্পণে দূরে দূরে অশোক ফুটিয়ে হেঁটে যাবে অথবা রুমালে নাক ঢেকে এঁদো বস্তি পার হবে মখমলী চটি পায়ে? যদি মানুষের বসতিতে হঠাৎ আগুন আগে, তবে কবিতা কি মাউথ অর্গানে সুর তুলে আর্তনাদ মুছে দেবে?যদি কোনো চিত্রকল্পে বেজে ওঠে কংকালের হাড়, উপমায় ভীষণ শীতার্ত, খাদ্যহীন, তাপহীন নারী আর শিশুদের নীল মুখ ভেসে ওঠে, তবে ঘোর নান্দনিক কম্বুকণ্ঠে উচ্চারিত হবে কি ধিক্কার? এ প্রশ্ন তুলে যারা পথে হাঁটে, মিছিলে দুর্বার ছোটে, তারা উত্তরের প্রতীক্ষায় থাকবে না। রোদ্দুরে মন্দিরা বাজে, নতুন আঙ্গিকে ওরা হয়ে ওঠে দীপ্ত মানবিক।   (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
ভাবিনি কখনো আগে এরকম হবে। এরকম ব’লে আমি ঠিক কী বোঝাতে চাই, খুব সাবলীলভাবে বলা মুশকিল। দেখতো আমার মধ্যে আজ আশ্চর্য কিছু কি পাও? মানে এরকম কিছু যা দেখলে অকস্মাৎ চমকে উঠতে হয়? না, আমি আমার এই চেনা মুখমণ্ডলের কথা বলছি না। আমার দু’চোখ অক্ষিকোটরের ভেতরেই আছে, নাক নাকের জায়গায় ঠিক। ঠোঁটেরও হয়নি স্থানান্তর।বলা যায় খেয়ে দেয়ে নিত্য দাড়ি কামিয়ে এবং স্বপ্ন দেখে দু’দিন আগেও যা ছিলাম, তা-ই আছি। তবে কি স্বতন্ত্র কোনো প্রগাঢ় আবীর দিয়েছে রাঙিয়ে আজ আমার গহন মর্মমূল? নইলে কেন আমি আমার ভিতরে বাদশাহী আমলের ঝাড় লণ্ঠনের শোভা এবং ঝুলন্ত উদ্যানের অন্য বৈভব দেখে নিজেই আটকে থাকি বিস্ময়ের ধু ধু রশ্মিজালে। সরোদ বাজাতে আমি জানিনা, তবুও সরোদের মতো বেজে ওঠে অস্তিত্ব আমার আর দেখি আমার ভেতর থেকে বিশ বছরের যুবক বেরিয়ে এসে জ্যোৎস্নার ঝালর ছিঁড়ে বন্ধ দরজার দিকে যায়।   (অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
তোমার সঙ্গে দেখা হলো কোন্‌ দশকে ? নাকি সুদূর ধূসর কোনও ভিন শতকে ? তখন তুমি এই আমাকে চিনতে পেরেছিলে কি ? আমি তোমায় চিনতে পেরে হ্রদের দিএক গিয়েছিলাম।কিন্তু তুমি অচেনা এক যুবার সাথে গল্পে মেতে ছিল বটে। আমি তোমার দৃষ্টিপথে পড়িনি যে, বুঝতে আমার হয়নি কষ্ট। হয়তো খানিক চিন্‌তে পেরে ইচ্ছে করেই অবহেলা করেছিলে। এখন কিছু পুষ্প জানি ঝরেছিলো মাটির বুকে।আচ্ছা তুমি এই আমাকে এমন ঝাঁ ঝাঁ অবহেলা করলে কেন ? না হয় আমি ক্ষয়ে গেছি কালের চড়ে, কিন্তু আমার মন এখনও সজীব কোনও ফুলের মতোই রয়ে গেছে। এই তো আমি তোমায় দেখে অনেক পরে হয়ে গেছি আবার যুবা সন্ধ্যা রাতে!কিন্তু তুমি এই আমাকে রাখলে দূরে হেলায় ঠেলে। মেতে আছো যুবার সঙ্গে হ্রদের ধারে। জানি না কোন্‌ সুখের টানে যাচ্ছো ভেসে! ঈর্ষা-বিছা আমায় জ্বালায় ক্ষণে ক্ষণে!   (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
বকুলতলায় যাবে? তুমি বড়ো সন্দেহপ্রবণ, সেখানে, বিশ্বাস করো, সাপখোপ নেই, মাস্তানের আড্ডা নেই। বিপদের আবর্তে তোমাকে কোনোদিন ডোবাতে পারি না। পাখি আসে সেখানে এবং কয়েকটি প্রজাপতি হয়তো-বা। কবিতার বই ইচ্ছে করলে আনতে পারো, পাশাপাশি পড়বো দু’জন।সেকেলে টেকেলে যা-ই ভাবো, প্রাণ খুলে যত দুয়ো দাও আধুনিকা, তবু তোমাকেই বকুলতলায় নিয়ে যাবো; করো না বারণ। যদি পাখি না-ও ডাকে, না-ও থাকে এক শিখা ঘাস সেই বকুলতলায়, তবু নিয়ে যাবো। না, ওভাবে ফিরিয়ে নিও না মুখ, ভেবো না আমার নেই কালজ্ঞান। বস্তুত আমিওঅনেক উত্তাল দীপ্র মিছিলে শামিল হ’য়ে যাই, যখন ভিয়েতনামে পড়ে বোমা, আমায় হৃদয় হয় দগ্ধ গ্রাম মেঘে মেঘে খুনখারাবির চিহ্ন খুঁজে পাই; উপরন্তু বসন্তের পিঠে ছুরি মেরে হত্যাকারী সেজে বসে আছি। কেন এ প্রহরে তোমাকে হঠাৎ দূরে বকুলতলায় যেতে বলি?বহুকাল হলো আমি অতিশয় নষ্ট হয়ে গেছি। আমার ভেতর এক দুঃস্বপ্ন-দুনিয়া পরিব্যাপ্ত, ভয়াল নখরময় প্রাণীকুল অন্তর্গত তন্তু ছিঁড়ে খুঁড়ে খায় সর্বক্ষণ এবং জীবাশ্মগুলো জ্যান্ত হয়ে ওঠে ভয়াবহভাবে হঠাৎ কখনো। বহুকাল হলো আমি অতিশয় নষ্ট হয়ে গেছি। বকুলতলায় ব্যাপ্ত আমার উধাও শৈশবের উন্মুখর দিনগুলি, সেই রাঙা পবিত্রতা তোমার সত্তায় মেখে দিতে চাই। তবু, হে মহিলা, তুমি কি যাবে না?   (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
এ কোন খাঁচায় আছি? চাবি দেয়া পুতুলের মতো ঘুরি ফিরি, মাথা নাড়ি; ক্লান্ত হ’লে শিক গুনে গুনে ঘুমের খাঁচায় ঢুকি। বস্তুত এমন খাঁচাব্রত একনিষ্ঠ সাধকেরও সাধ্যাতীত। যতদূর শুনে কিংবা গ্রন্থপাঠে জানি দীপঙ্কর অথবা মেধাবী শ্রীজ্ঞান, ইবনে সিনা ছিলেন না এমন খাঁচায় কোনো দিন, সত্যসন্ধ ইতিহাস করবে না দাবি ওরা খুটেছেন করুণার ছোলা দৈনিক বাঁচায়।আমি তো ভালো আছি, কী বিমূঢ়; যা খুশি রটাক নিন্দুকে, পাতি না কান কিছুতেই। যদি তর্ক ওঠে বলব বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে, ‘বুঝেছ হে, এই দুনিয়ায় সকলেই নিজস্ব খাঁচায় বন্দি’; যাক, দিন মন্ত্রেতন্ত্রে কেটে যাক, স্বপ্ন শিকে মাথা কোটে কুটুক, এখন দ্বার খুললেও থাকব খাঁচাতেই।   (উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
মেধার কিরণে স্নান করে শব্দাবলী ফিরে আসে আপন নিরালা ঘাটে, কখনো বিস্তর মেঠো পথ এবং সুদূর সাঁকো পেরিয়ে, ঔদাস্যে ফুটপাতে গায় গান, কখনো বা দরদালানের দেয়াল, রেস্তোরাঁ, পুলিশের পিঠ বেয়ে উঠে পড়ে কাঠবিড়ালীর মতো নিঝুম ভঙ্গিতে। মধ্যরাতে জ্যোৎস্না-ধোয়া চা-খানায় ফোকটে চা খেয়ে গলিতে আড়াল খোঁজে ওরা, প্রত্যুষে সংবাদপত্রে শিস দেয় অকস্মাৎ মেধার সম্ভ্রম ভুলে দিয়ে।মেধার কিরণে স্নান করে শব্দাবলী উঠোনে বেড়ায় নেচে, ঘরে প্রহরে প্রহরে শুয়ে-বসে, হামাগুড়ি দিয়ে আর মেঝেতে গড়িয়ে কাটায় সময়। কখনো বা স্বপ্নের ঝরণায় মুখ রেখে দূর ঝুলন্ত উদ্যানে বাড়ায় স্বপ্নার্দ্র হাত, অন্তরালে অজস্র বেহালা বেজে ওঠে।শব্দের ভেতরে শব্দ অবলুপ্ত সভ্যতায় স্মৃতির মতোন জেগে থাকে, উড়ে যায় মেঘে, যেন হাওয়ায় হরিণ ওড়ে এক পাল। সভ্যতার দ্বিপ্রহর কখনো প্রোজ্জ্বল মরীচিকা, কখনো বা ঐন্দ্রজালিকের ভুল খেলা বিশ্বব্যাপী জনসমাবেশে। যখন সিংহের পায়ে মরুসীমা শিহরিত হয়, স্ফীত কেশরে কেশরে সমাহিত সাম্রাজ্যের দিকগুলি সুনীল শোভায় প্রস্ফুটিত বারংবার, জগৎ-সংসার নানা গুঞ্জরণে দৃশ্যে দৃশ্যে অর্থ আর অর্থহীনতায় ক্রমাগত অত্যন্ত দোদুল্যমান। শব্দাবলী সভ্যতার স্তর, শোকগাথা আর্তরব কত বিপুল ধ্বংসের। রেস্কিউ পার্টির উদ্ধারের অতীত সে ধ্বংসলীলা, মনে রেখো। তরুণ কবির থর থর হৃদয়ের মতো কিছু অদৃশ্য পলাশ জ্বলে দ্বিপ্রহরে। ফাল্গুনের পথে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি, মুখচ্ছবি বহু গান। দুপুরেই অকস্মাৎ চুতর্দিকে কেমন আঁধার হয়ে আসে। মেধার কিরণে স্নান করে শব্দাবলী অন্ধকারে কাকে ডাকে? উন্মুথিত নগর, বনানী উপত্যকা এবং পাহাড়ি পথ স্বপ্নে কথা বলার মতোন সাড়া দেয়, শব্দাবলী অভ্যাসের সীমা ছিঁড়ে যায়।   (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
কেমন অবাক লাগে ভেবে মন্দ ভালোয় অর্ধেক শতাব্দী কেটেছে প্রায়। পুঁথি পড়ে, তর্ক করে, নানা দৃশ্যাবলি দেখে কখনো বা ঘোর কর্দমাক্ত খানা- খন্দে পড়ে, খুব স্বপ্নাশ্রয়ী হয়ে এবং হরেক সুউচ্চ মিনারে পৌঁছে দেখেছি বর্ণাঢ্য অভিষেক নিঃসঙ্গ কবির আর মাঝে-মাঝে পেয়েছি নিশানা সেই সুন্দরীর, ভঙ্গি যার বড় নিষ্ঠুর, বেগানা, ভালোবেসে বার বার দুঃখ আমি পেয়েছি অনেক।তবুও লড়ছি নিত্য নিয়তির সঙ্গে অবিরত, কাঁটায় রক্তাক্ত হয়ে নিশিদিন গোলাপের গান গাই আর শান্ত মহিমায় একা ভীষণ আহত গরুড়ের মতো ভাবি আজ-কবে হবে অবসান এ ট্রাজিক সংগ্রামের? স্বপ্নাকুল দেখি ক্রমাগত আবহ-মোরগ ঘোরে, রৌদ্রে পোড়ে, বৃষ্টি করে পান।   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
অন্ধের মতোন আমি অন্ধদের মধ্যে সারাক্ষণ হাতড়ে বেড়াই কী-যে বুঝি না নিজেই। পুরোনো চিঠির খাম? চকচকে শূন্য থালা, নাকি টগর, মল্লিকা ফুটফুটে? দলছুট কাকাতুয়া? রঙিন টিকিট? কোথাও না-পাওয়া কখনো না-দেখা মানুষের হৃৎপিণ্ডের মতো থর থর কোনো প্রাণী? মেঘের জঙ্গল থেকে নেমে আসা এবং হাওয়ায় ভাসা নানারঙা ঘোড়াদের ফুল্ল দানাপানি? শোনো, যা হোক একটা কিছু হাতে এলে, ছুঁতে গেলে স্মৃতিময়, স্মৃতিহীন যে-কোনো জিনিশ, স্বস্তি পাবো ভেবে ঘুরি সবখানে। কখনো বাড়াই হাত ডানে, কখনো-বা যাই বাঁয়ে, একটানা খুঁজি। মাঝে-মধ্যে প্রশ্ন করি-দোটানায় এভাবে ফুরোবে তবে জীবনের পুঁজি রুক্ষ পথে, বধিরের আস্তানার? বিবর্ণ যুগল চেয়ারের অভ্যন্তর থেকে ভেসে আসে স্বর এখানে খুঁজো না কিছু, হবে প্রতিহত। দেয়ালে সন্তের চোখ, ধারালো, সুদুর- চোখ ডেকে বলে এখানে খুঁজো না কিছু, হবে প্রতিহত। তুমি শত লোক হয়ে খুঁজলেও আহতের ব্যান্ডেজের মতো সান্তনা পাবে না। ফিরে যাও, তুমি ফিরে যাও। ভয়-পাওয়া শিশুর মতোন ভয় চোখ ঢেকে থাকে পাঁজরের ভেতরে, আমার, বলে শিউরোনো কণ্ঠস্বরেঃ এখানে খুঁজো না কিছু অন্ধ নিকেতনে, ফিরে যাও, তুমি ফিরে যাও।মানুষের হৃদয়ের ভেতরে চালিয়ে দিয়ে খুব কম্প্রমান পাঁচটি আঙুল ভীষণ পাথুরে কিছু করি অনুভব, বাড়ে উপদ্রব। গোলাপের গল্প শুনে সাত তাড়াতাড়ি গোলাপ বাগানে যাই, দরজা পেরিয়ে বুঝি, রকের বাশিন্দা অতিশয় ধাপ্পাবাজ সে কথক। কীটের পাহাড়ে গৌতম বুদ্ধের পোজে বাহারী পোশাক পরে বসে আছে সঙ, কোলে তার কংকালের ভায়োলিন, তার চক্ষুদ্বয় পাখির পুরীষে ঢাকা, আমি দ্রুত ফিরে এসে দেখি ক্রমাগত উল্টো দিকে ছুটে যাচ্ছে ট্রেন।   (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
কখনো কখনো স্মৃতি রাজনীতির মতোন তীব্র হয়ে ওঠে, ক্রমাগত জিভ তার এগোতেই থাকে। কোনো কোনো বস্তু কিংবা ব্যক্তি রশ্মির আকারে স্মৃতির জিহ্বায় নাচে, কখনো বা স্মৃতি অকস্মাৎ ভীষণ অসামাজিক। কুয়োতলা,সাঁকো, মুখচ্ছবি ধু-ধু হৃদয়কে করে গোপনে লেহন। বেঁচে থাকা আপাতত গলি, পার্ক ফুটপাতে সমর্থন পেয়ে আমার নিজের মধ্যে সুড়ঙ্গ বানায় রাত্রিদিন।কুয়োজলে স্নান সেরে কেন নদীতীরে চলে যাই? এখনো মাথার চুল অতিশয় ভেজা, বেলাবেলি আবার ফিরলে ঘরে দেখবো কি অম্লান বাসন সাজিয়ে রেখেছে কেউ। হাত-পাখা মাদুরের কাছে স্বপ্নের হাতের মতো শুয়ে আছে দেখবো কি খর মধ্যাহ্নে অথবা পাবো শুধু ধবধবে শূন্যতাকে?   (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
মাথায় ভাবনা নিয়ে খুপরিতে আছি শুয়ে এই নিজের আঁধারে লগ্ন, দেখি ময়লা দেয়ালে আঁকা দুঃখের নিভৃত ফুল আর মনকে প্রবোধ দিই রাত্রিদিন দুর্দশার ঢাক বাজিয়ে কী লাভ?প্রাণধারণের কত অমাবস্যা, কত না পূর্ণিমা, বৈশাখের দীপ্ত দিন, শ্রাবণের সন্ধ্যা সুনিবিড়- জীবনের এই রূপান্তর, আবর্তিত ইতিহাস, ব্যক্তি-সমাজের চেতনায় সোনার রোদ্দুর দিয়ে বোনে প্রত্যহ স্বপ্নের পাড় বিমুগ্ধ খেলায়।আত্মদান স্মৃতি আর সম্প্রীতির নিবিড় পূর্ণিমা মানুষে মানুষে পড়ে আশ্চর্য সংলাপ জীবনের মতো ব্যাপ্ত একটি সিম্ফনি ঝরায় ঝরনার পানি ফোটায় বাগানের ফুল স্বপ্নে জাগরণে।দ্যাখো এই ঘরে জ্যোতির্ময় হতে পারে আজও, আবার আমার আত্মা নতুন জন্মের প্রতিভায় হতে পারে নিবিড় বাগান তোমার দৃষ্টির তারাময় প্রস্রবণে।যখন নিরুদ্ধ হতাশায় জীবনকে মনে হয় একমুঠো বালি আর আকাশের চাঁদ প্রতিভাত হয় ভিক্ষুকের ভাঙা পাত্র বলে, তোমার স্বপ্নের দীপ জ্ব’লে ওঠে নরকে আমার- বুভুক্ষায় ঝরে চকিতে স্বর্গের কান্তিবিগলিত দ্রাক্ষার মদিরা।   (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
হে আমার সনেটের নিঃসীমা, তোমাকেই কী ব্যাকুল চায় খরাচিহ্নময় কবিতার খাতা তুচ্ছতা সরিয়ে পাশে। ‘সেজে ওঠো তুমি শূন্যে পাতা’ বলে প্রার্থনার স্বরে আর প্রায় প্রতিদিন এই রোগশয্যা খুব মেতে ওঠে সকলের আড়ালেই নক্ষত্রের কণাসমূহের নাচে, বসন্ত-উৎসবে; অষ্টক ঘটক আসে বারে বারে উল্লাসে গৌরবে। হে সনেটমালা তোমাদের বিনা আজ সুখ নেই।রোগশয্যা ক্রমশ উন্নীত হয়, যেন নীলিমায় নিশ্চিন্ত আশ্রয় নেবে। শয্যাগত আমি মেঘ ছুঁই, কে এক সুন্দরীতমা ছুঁয়ে যায় আমাকে আঁচল দিয়ে তার; অভ্রের গুঁড়োর মতো শব্দ ঝরে যায় চারপাশে; কোনো শব্দ কল্যাবতী, কোনো শব্দ জুঁই, কোনো শব্দ বেলী রূপে হয় সনেটের শতদল।  (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
এরকম চমকে থমকে দাঁড়ালাম যেমন নাবিক খুব একলা দাঁড়িয়ে মধ্যরাতে ডেকে থেকে স্তিমিত জ্যোৎস্নায় দেখেফেলে কোনো জলকন্যার আশ্চর্য উদ্ভাসন। তরঙ্গের পর তরঙ্গ গড়ায় বিছানায় ক্রমাগত তোমার ঘুমের কী নিঝুম কিনারায়। হে নিদ্রিতা, তোমার পা ছুঁয়ে রঙ-বেরঙের মাছ মোহন সাঁতার কাটে, ছায়ার পাখিরা তোমার কপালে-ঠোঁটে আলতো ছুঁইয়ে চলে যায়।নাছোড় ঘোরের মধ্যে কোন চিত্রকর মুগ্ধাবেশে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিনরাত এঁকেছেন তাঁর নিমগ্ন অস্তিত্ব থেকে ঠিকরে বেরুনো আলো অন্ধকার দিয়ে? কৃত্রিম আলোর ছটা নয়, তোমার ত্বকেরই আভা করেছে দখল ঘরটিকে। তোমার সান্নিধ্যে যাব না কি দূর থেকে জ্ঞান যোগে দু’চোখের পিপাসা মিটিয়ে বিষাদে বিদায় নেব? একটি তুফান আমার বুকের মধ্যে বে-লাগাম বুনো ঘোড়া, তার খুরের ঝাপট লাগলে নিমেষে তুমি অভ্রের মতোই গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়বে বিছানার চারপাশে অথবা মিলিয়ে যাবে সুবেসাদিকের স্বপ্নের ধরনে।এই তো এখন ক’পা এগোলেই আমার দু’হাত অনাবৃত তোমার শরীরে হতে পারে চকিতে পিয়ানো বাদকের সুরেলা চাঞ্চল্য। তুমি জেগে উঠবে এই ভয়ে আমি দূরত্বকে কাঙ্ক্ষনীয় ভেবে নিথর দাঁড়িয়ে থাকি। তোমার নিদ্রিত আঙ্গুলের ফাঁকে ফাঁকে কনক চাঁপার বিচ্ছুরণ, শব্দহীন স্তোত্রপাঠ হয়, চৈত্ররাত্রি গান গায় তোমার শরীরে। নক্ষত্রের যমজ সুচারু তোড়া নিতম্ব তোমার নিশীথের কাফ্রি-ঠোঁট অক্লান্ত লেহন করে, তোমার অলস এলানো স্তনটিকে, ঈষৎ স্ফুরিত রক্তিমাভ ঠোঁটে স্বপ্নভাষা স্মৃতি তৈরি করে, পদ্মের মতন পেটে কতিপয় অলৌকিক আঙুলের খেলা, তুমি যেন কোনো দূর-দ্বীপে সদ্যোজাত স্বপ্নের মতন শুয়ে আছ একাকিনী সেই কবে থেকে।তোমার অত্যন্ত কাছে গেলেই শুনতে পাব নিঃশ্বাসের মৃদু ধ্বনি, সুরভিত, দেখব বুকের ওঠা-নামা। তোমার শরীর থেকে উৎসারিত উষ্ণতা আমাকে জড়িয়ে ধরবে সাবলীল মালার মতন, দূর থেকে তোমার মধ্যেই দেখি স্বর্গীয় উদ্যান নিরিবিলি, নিষিদ্ধ ফলের আভা জায়মান চতুর্দিকে, অথচ এখনো কম্পিত হৃদয়ে আমি দাঁড়ানো ঘরের মাঝখানে।   (না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
আমাকে থাকতে হবে অপেক্ষার ধু ধু সাহারায় আরো কিছুকাল, মনে হয়ঃ স্বৈরাচারী আঁধিঝড় চতুর্দিকে ক্রমান্বয়ে উপড়ে নিয়েছে বহু ঘর। সন্ত্রাসশাসিত মানুষের মুখ দেখে দিন যায় কোনো মতে, দুঃস্বপ্নের ভয়ে রাত কাটে অনুদ্রায়, মাঝে মাঝে অজান্তে শিউরে উঠি না জানি কীসের শংকায়; আমার হাতেও কি ক্রূরা ঘাতক বিষের পাত্র তুলে দেবে আজ? আছি সত্যি কসাইখানায়।কত আর ধৈর্য ধরি প্রিয়তমা? তোমার চৌদিকে উঁচিয়ে রয়েছে মাথা প্রথার শান্ত্রীরা সর্বক্ষণ, আমিও কপাল ঠুকি দিনরাত নিষেধের শিকে। তোমাকে না দেখার বেদনা করে ক্রমশ হরণ প্রাণশক্তি; ভয়ংকর রাহুগ্রাসমুক্ত হলে দেশ, আমাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার রুদ্ধ কাল হবে শেষ।   (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
কী ক’রে আমরা হয়েছি দুপুর বেলা পরস্পরের এরকম মুখোমুখি? নষ্ট তারার ভস্ম কণার কাছে ঋণী হ’য়ে আজ তোমার দিকেই ঝুঁকি।কখনো হয়তো ব্যাপ্তির দূর টানে সূর্যের মুখ, লাল দৈত্যের মুখ, কাছের সকল গ্রহকেই গিলে খাবে; হবে সে বামন ভীষণ শৈত্যভুক।সুপার নোভার হঠাৎ বিষ্ফোরণ প্রাচীন স্মৃতিতে কখনো বাঁধেনি বাসা; ভাবি না কী হবে পৃথিবীর পরিণতি; মনের কোটরে বাঁচবার প্রত্যাশা।আমরা দু’জন যেন দু’ট উপগ্রহ, দিনরাত্তির ঘুরি শুধু ছায়াপথে। তীব্র আবেগে চেয়ে থাকি অসহায়, কিছুতেই, হায়, পারি না লগ্ন হ’তে।দু’চার ঘন্টা কেটে গেলে অবশেষে ড্রইং রুমের কথোপকথনে ছেদ, সোফার কাছেই শজারু, শূকর-ছানা; শিরায় শিরায়া জমে বিদায়ের খেদ।এভাবে দাঁড়াও যদি দরজার কাছে, তাহ’লে কী ক’রে বলবো, ‘বিদায় দাও?’ তোমার দু’চোখ, সোনালি শরীর বলে- ‘হে কবি আমাকে মাত্রাবৃত্তে নাও’।বইছে সময়, বয়েস উর্ধ্বগামী, তোমার শরীরে জ্যোৎস্না-জোয়ার আজো রয়েছে অটুট; মনে মনে আওড়াই, সময়ের মাঝে সময়হীনতা বাজো।উন্মাদনায় মেতে আছি কিছুকাল; নিশ্চিত জানি, অচিরে আমার লয়। পরের পর্বে কোন্‌ ঘাটে ব’সে তুমি হবে উজ্জ্বল, গ্রাস করে সেই ভয়।নভোমণ্ডলে কালো গর্তের ভিড়ে অস্তিত্বের এতটুকু নেই ঠাঁই। মহাশূন্যের আলো-তরঙ্গে প্রেম এক লহমায় জ্বলে পুড়ে হবে ছাই।জ্যোতিশ্চক্র থামবে ভবিষ্যতে,- এই জ্ঞানে আছে বিষবৃক্ষের বীজ। নশ্বরতার আতঙ্কছুট ক্ষণে হৃদয়ে আসন পেতেছেন মনসিজ।   (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
সেদিন এক ফালি জ্যোৎস্না দেখে চমকে উঠেছিলাম, যেমন সাপের চকচকে চোখ দেখে পথচারী। জ্যোৎস্না যে-কোনো স্থানে তন্বীর সুরের মতো গুঞ্জরিত হতে পারে- নৈসর্গিক যে কোনো বস্তুতে, যে-কোনো প্রতিষ্ঠানে। ডিমভরা পাখির বাসায় টলটলে জ্যোৎস্নাঃ শৈশব। হরিণের পিঠে কিংবা চিতাবাঘের জ্বলজ্বলে চোখে জ্যোৎস্নাঃ যৌবন। বারান্দায় হেলান-দিয়ে-থাকা লাঠি আর পার্কের বিবর্ণ বেঞ্চিতে জ্যোৎস্নাঃ বার্ধক্য।সিগারেটের ধোঁয়ায় বৃত্ত এঁকে প্রায়শই জ্যোৎস্নার কথা ভাবি- কিছু জ্যোৎস্না আমার সঙ্গে পারফিউমের মতো থাকে সর্বক্ষণ আর এমনও তো হয়, এক টুকরো বখাটে কাগজ কোত্থেকে উড়ে আসে, কবিতা হয়, জ্যোৎস্না হয়।আততায়ীর কানপট্রিতে-জ্যোৎস্না ফিক করে হেসে ওঠে। কখনো রাষ্ট্রদূতের ট্রিম-করা গোঁফে, কখনোবা বন্দুকের নলে, উদাস প্রান্তরে মৃত সৈনিকের নীল ওষ্ঠে, শাদা প্রজাপতির মতো বসে থাকে জ্যোৎস্না। বুনো জ্যোৎস্নায় আমি তাকে কখনো দেখিনি হয়তো দেখবো না কোনোদিন তার চোখ চন্দ্রালোকে কীরকম হয়, কীভাবে সে হাঁটে জ্যোৎস্নার ভেতরে স্বপ্ন-গাঁথা শাড়ি পরে, জানবো না কখনো।আঁজলাভরা জ্যোৎস্না দিয়ে ওজু করে আমি তাকে আবৃত্তি করি মধ্যরাতে, সহসা এক পাল ঘোড়া, শহুরে জ্যোৎস্নায় নাচতে নাচতে আমার সস্মুখে শুয়ে পড়ে, যেন কিছু গল্প আছে ওদের, এভাবে তাকায়। মুহূর্তে লুপ্ত ঘোড়া আর ফুলের তোড়ার ব্যবধান।চন্দ্রালোকে কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টো কখনো পড়িনি, পড়লো আরো বেশি ভালো লাগতো কী? গোইয়ার মগজে খুব রাঙা বিপ্লবী পূর্ণিমা ছিল বুঝি! জ্যোৎস্নায় বিয়াত্রিচে আর সে একই স্বপ্নের একাকার।   (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
রূপক
এ-গভীর রাতে চুপচাপ আমার শয্যার পাশে কে তুমি দাঁড়িয়ে আছ? কে তুমি এমন স্তব্ধতা সত্তায় নিয়ে আমার শোণিত চুষে নিতে তীক্ষ্ণ শাদা দাঁত উন্মোচিত ক’রে সেই কবে থেকে দাঁড়িয়ে রয়েছ? যাও চলে যাও মানবের ডেরা ছেড়ে অন্য কোনওখানে দূর বিরানায়। এখানে তোমার ছায়া বিশিক্ষণ পড়লেই অশুভের জন্ম হবে।কিছুতে নড়ে না সেই ভয়ঙ্কর মূর্তি, আজ রাতে ধ্বংসের প্রবল সাধ নিয়ে এসেছে আমার ঘরে। এখানে পূরণ হলে সাধ যাবে সে প্রতিটি ঘরে এই শহরের। আমি তাকে নিশ্চহ্ন করার বাসনায় অস্ত্রাঘাত করি তাকে, অথচ সে ক্রূর হাসি হেসে আমাকে আঘাত করে খুব জোরে নিজেই গুঁড়িয়ে প’ড়ে থাকে গৃহস্থের পদতলে। কিয়দ্দূরে শান্তির প্রশান্ত বাণী মধুর ধ্বনিত হতে থাকে।  (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
আমি কি এমনই নষ্ট? পুঁজ ঝরে নাসারন্ধ্র থেকে, কষ বেয়ে রক্ত পড়ে সারাক্ষণ? সমস্ত শরীরে দগদগে ক্ষত আর কিল্‌বিলে পোকা, ভাবো তুমি? আমাকে উগরে দিয়ে মৃত্যু কিয়দ্দূরে ব’সে আছে ফুলবাবু, ভুল ক’রে আনাড়ি তস্কর-প্রায় নিয়ে গিয়েছিলো শুইয়ে দিতে পুরানো কবরে। আমি কথা বল্‌লে বুঝি শ্মশানের ধোঁয়া তোমার দু’চোখে জ্বালা ধরায়, গড়ায় মেঝেময় পশুর গলিত শব।তা’ না হ’লে কেন তুমি থাকতে পারো না বেশিক্ষণ সান্নিধ্যে আমার? কাছে গেলে হঠাৎ ইলেকট্রিক শক্‌-খাওয়া ধরনে কেমন ছিট্‌কে দূরে স’রে যাও। নরকের ফুটন্ত গন্ধক-গন্ধ পাও? মুখ থেকে অম্লজল বেরোয়, ফোরায়া যেন; সে পানিতে খাই হাবুডুবু, ভেসে যাই, চলে হাঙরের স্বৈরাচার।  (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
তুমি ও ঘুমিয়ে ছিলে ছোট খাটে, পাছে ঘুম-দ্বীপে ঝড় ওঠে, পাছে বানচাল হয় চাঁদের মতোই স্বপ্নের মোহন নৌকো, হাঙরের দাঁত ছিঁড়ে ফেলে শান্তির রুপালি মাছ কিংবা অপদেবতার ক্রূর দৃষ্টি পড়ে কচি মুখে, ঘুমের মোমের ডানা পুড়ে হয় ছাই, পাছে ভয় পাও তাই মায়ের প্রার্থনা একা ঘরে সারাক্ষণ ছিল জেগে তোমার শয্যার চতুষ্পার্শ্বে; উদ্ভিদের মতো তুমি ঘুমে ভাসমান।কে এক ভীষণ দৈত্য তোমার ঘুমের দ্বীপটিকে অকস্মাৎ দিল নেড়ে প্রাণপণে, অভ্রের প্রাসাদ হলো গুঁড়ে, বিচূর্ণিত প্রবালের সিঁড়ি। সান্তিয়াগো উঠলো নড়েঃ দরদালানের ভিতে কে বলবে আজ কী ঘুণ লুকিয়ে ছিল? এবং তোমাকে কী আক্রোশে স্বপ্ন দেখে দুঃস্বপ্নের গোলকধাঁধায় দিলো ছুঁড়ে! সান্তিয়াগো, যেন সে তাসের ঘর, এক ফুঁয়ে হলো আস্তাকুঁড়; শহরের কণ্ঠ হলো তীব্র হাহাকার।তোমার বিভ্রান্ত চোখ কী যেন খুঁজছে প্রতিক্ষণ, কাকে খোঁজো ধ্বংসস্তূপে? মাকে? নাকি বিমর্ষ পিতাকে- যিনি রোজ শূন্য ঘরে বাজাতেন রাত্তিতে বেহালা, বিকেলে তোমার ছোট হাত ধরে নিজেরই বাগানে বেড়াতেন অন্য মনে, শুনতেন পাতার মর্মর।মাঝে মাঝে “দ্যাখো চেয়ে কী সুন্দর পাখি, ওরা ডালে শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখে,” বলে যিনি সূর্যাস্তের দিকে দু’চোখ দিতেন মেলে-বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে খোঁজো তাঁকে?সেখানে যেও না আর। কেউ নেই, কিছু নেই, কালো একটি বেড়াল শুধু বসে আছে হলুদ জজ্ঞালে। ছেঁড়া কাগজের টুকরো উড়ে এসে তোমার পায়ের কাছে থামে। না, সেখানে নেই কোনো রঙিন পুতুল- যা আছে দেখলে বড়ো ভয় পাবে, যেও না সেখানে। কে এক বর্বর তার সর্বনাশা খেলার নেশায় ভেঙেছে তোমার শান্ত খেলাঘর। হে দুঃস্বপ্নচারিণী আমার হৃদয় হলো তোমাদের বিধ্বস্ত শহর!   (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
মিশমিশে ঘোর অন্ধকারে কনুই দিয়ে ধাক্কা মারে, রহিম পড়ে রামের ঘাড়ে, কেউবা দেখি চুপিসারে অন্য কারুর জায়গা কাড়ে পাচ্ছি তা টের হাড়ে হাড়ে। লাইন থেকে সরছি ক্রমে সরছি।জল খেয়েছি সাতটি ঘাটে, ফল পেয়েছি বাবুর হাটে, কিন্তু সে-ফল পোকায় কাটে, ঘুণ ধরেছে নক্‌শি খাটে, কানাকড়ি নেইকো গাঁটে, চলছি তবু ঠাটে বাটে, রোজানা ধার করছি শুধুই করছি।পক্ষিরাজের ভাঙা ডানা, রাজার কুমার হলো কানা। দিনদুপুরে দৈত্যপানা মানুষগুলো দিচ্ছে হানা, নিত্য চলে ঘানি টানা, জগৎ-জোড়া খন্দখানা- হোঁচট খেয়ে পড়ছি কেবল পড়ছি।২ ফসল ক্ষেতে পোকা পড়ে, ঘর উড়ে যায় ঘূর্ণিঝড়ে, মাতম ওঠে ঘরে ঘরে। কত ভিটায় ঘুঘু চরে, কঙ্কালেরা এই শহরে বাঁচার জন্যে ধুঁকছে ম’রে। বাঁচার লড়াই লড়ছি, সবাই লড়ছি।   (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
সকল সময় নয়, কোনো কোনো মুহূর্তে হঠাৎ তোমাকে হাওয়ার পাই, পাই সিগারেটের ধোঁয়ায়। কখনো দরজা খুলে দাঁড়ালেই স্মিত অন্ধকারে, কখনো বা সুরভিত বারান্দায় মৃদু চন্দ্রলোকে, গোলাপের অন্তঃপুরে, কখনো সড়কে, মৃত্যু আর জীবনের গুঞ্জরণময় হাসপাতালের বেডে সহসা তোমাকে দেখি। গাছগাছালির অন্তরালে মেঘের উড্ডীন দ্বীপে, এমন কি গোষ্পদেও তুমি।তুমি এলে আমার চৌদিকে অবলীলাক্রমে দৃশ্য কেবলি পাল্টাতে থাকে, তুমি এলে হাজার হাজার নক্ষত্রের তোড়া আমার সম্মুখে দীপ্র উপস্থিত, সুনীল সমুদ্র ওঠে দুলে, দিগন্তের পাড় চিরে উদ্ভাসিত জাহাজের গর্বিত মাস্তুল; নীল জলে কুহকের কেশপাশ, জাগে প্রতিধ্বনিময় দ্বীপ।তুমি এলে একরাশ ভেলভেটপ্রতিম গোলাপ মোহন আলাপে মাতে বেহালার সাথে, মাথাভরা অজস্র উকুন নিয়ে রুক্ষ্ম, একাকিনী ভিখারিনী খিস্তি খেউড়ের মধ্যে অকস্মাৎ পুঁটলি দুলিয়ে গায় ঘুমপাড়ানিয়া গান এবং ভাগাড়ে কতো পোকাকীর্ণ পশুর নিথর চোখে ভাগবত লীলা! তুমি এলে কংকালের দশটি আঙুল ঘুণধরা, হিহি অন্ধকারে নেচে ওঠে অর্গানের রীডে রীডে।কতদিন তোমার জন্যেই ধুই সিঁড়ি অনুরাগে, সযত্নে সাজাই ফুল করোটিতে, পোড়াই লোবান, জ্বলে বাতি পিলসুজে কিন্তু তুমি আসো না তখন। যখন প্রস্তুতি নেই, আয়োজন-রহিত যখন আমি, এলোমেলো, বিভ্রান্তির চক্রে ঘূর্ণমান রুক্ষ, তখনই ঝাঁপিয়ে পড়ো কী প্রবল আমার ওপর।চুমোয় চুমোয় রক্তে বাজাও দীপক, দৃষ্টি মেলে তোমার উদ্ভিন্ন দিকে ভাবি শুধু, তুমি কি এমনই? তোমার সুগন্ধে আমি এতো বার হই সমাচ্ছন্ন, তোমারই ভেলায় ভাসি, তবু আজো তোমাকে বুঝি না।   (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
১ ডাক-হরকরা বিলি করলেও রাজা রামমোহন রায়ের পত্র ঘরে ঘরে পৌঁছেনি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর লিখে জবাব না পেয়ে আখেরে নিজেকে আবৃত করেছিলেন নিঃসঙ্গতায়, অশ্রদ্ধা তাঁর মুখাবয়বে বসিয়ে দিয়েছিল কাঠিন্যের রেখা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পত্রাবলী রচনায় অনলস, এমনকি শেষ বয়সের গোধূলিতে কম্পিত হস্তে রচনা করেছেন বিস্তর চিঠি। টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন বারবার। মনে হয় না, সেসব চিঠি কেউ পড়েছে। পড়লেও মর্মোদ্ধারে ব্যর্থ অনেকে, কেউ কেউ বুঝলেও তেমন আমল দেয়নি, অনেকে খাম পর্যন্ত খোলেনি। অবশ্যি অধিকাংশ লোকের কাছে ক-অক্ষর হারাম বলে তারা শুধু ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে রয়েছে। সেসব চিঠি মানবচিত্তে মনুষ্য ধর্মকে পদ্মের মতো প্রস্ফূটিত করতে চেয়েছিল। এখন সেই প্রাতঃস্মরণীয় ত্রয়ীর সুসমাচার ফাঁপা পথচারীদের কাছে ইলেকট্রিকের তারে আটকে থাকা কাটা ঘুড়ির ছিন্নাংশ কিংবা নর্দমার পানিতে ভাসমান ছেঁড়াখোঁড়া কাগজের নৌকা, যা বস্তির ছেলেমানুষদের তৈরি।২ যখন বয়স ছিল কম, তখন ক্ষীণায়ু কীটস্‌ এবং তরুণ রবীন্দ্রনাথের মতো মৃত্যুবন্দনায় ছিলাম উচ্ছ্বসিত। ভাবতাম জ্যোৎস্নাপ্লাবিত কোনও চৈতীরাতে আবেগাতুর কবিতা পাঠকালীন আমার ওপর মৃত্যু যদি নেমে আসত, সুশীল পাখির মতো কি ভালোই না লাগত আমার। মৃত্যুকে দয়িতা ভেবে মরণের প্রেমে পড়েছিলাম তারুণ্যে। অথচ আজ ষাটের ধূসরতায় বিবর্ণ হয়েও বেঁচে থাকার সাধ তীব্র সুরার মতো উদ্দীপিত করে আমাকে। কেননা, এই তো সেদিন দেখলাম তোমাকে-তন্বী এবং সুন্দর।৩ ভেবেছিলাম নাছোড় অভিমান এক আমাকে রাখবে লোকালয় থেকে বহুদূরে নুড়িময় ঝর্ণাতলায় সুখে বুঁদ। বুনো ছাগ-যূথে, গাছগাছালির ভিড়ে, পাখাপাখালির রাজ্যে জীবনযাপন মাধুর্যে মোড়া চিরদিন, ছিল আশা। পাথর আর জলধারার ভাষা শেখা হবে। সুখের সংজ্ঞা কখনও কখনও ভাবায়। গাছতলায় শুয়ে পাখির গান শোনা, বৃষ্টিধোয়া আকাশে রঙধনুর পেখম দেখা, সূর্যের আলোয় নেয়ে ওঠা, চৈতালি জ্যোৎস্নায় হেঁটে বেড়ানো, সূর্যাস্তের দিকে মুখ রেখে দাঁড়ানো-এসবই তো সুখকর; তবু কেন মানুষের মুখ দেখার ব্যাকুলতা? লোকালয়ের উত্তাপ ফিরে না পেলে টইটম্বুর হবে না আমার সুখের কলস।৪ কখনো সেজেগুজে, পরিপাটি দাড়ি কামিয়ে সুগন্ধি মেখে, কখনও বা উশ্‌কো খুশ্‌কো ৩ দিনের না কামানো দাড়ি নিয়ে তার নিবাসে গিয়ে কড়া নাড়ি। ব্যাকুলতা আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় সর্বক্ষণ। যতক্ষণ না ওর ড্রইং রুমের সোফায় বসি, কথা বলি এলোমেলো, তাকাই বারান্দায় লুটিয়ে পড়া রৌদ্রের দিকে, ততক্ষণ আমার স্বস্তি নদারৎ। আলবৎ ওকে ভালোবাসি, এরকম ভালোবাসিনি কোনও নারীকে। আমাকে সে ভালোবাসে কিনা, সঠিক জানি না। যেমন জন্মান্ধের অজ্ঞাত চৈত্ররাত্রির জ্যোৎস্নার সৌন্দর্য। সন্দেহের কাল বেড়াল ফিরোজা চোখ নিয়ে চেয়ে থাকে আমার দিকে, ভীত আমি উদাসীনতায় ডুবে থাকার ভান করি। কোনও কোনওদিন আমার ঠোঁট থেকে লতার মতো দুলতে থাকে একটা প্রশ্ন, ‘তুমি কি সত্যি ভালোবাস আমাকে?’ কখনও নিরুত্তর সে নোখ দিয়ে খুঁটতে থাকে সোফার হাতল কিংবা বলে, ‘চাই, চা করে আনি। কখন কি খেয়াল হয়, আমার দিকে না তাকিয়েই ফ্লাওয়ার ভাস সাজাতে উচ্চারণ করে, ‘ভালোবাসি’। সেই মুহূর্তে তার কণ্ঠস্বরে যেশাসের জন্মের আগেকার সুদূরতা। প্রাচীনতম লেখনের পাঠোদ্ধারের চেষ্টায় ক্লান্ত আমি বর্তমানকে মুছে ফেলি নিজেরই অজান্তে। এর পায়ের কাছে ছড়িয়ে থাকে আমার অনুভুতিগুলো, জড়ো করার উৎসাহ সবুজ শিখার মতো জ্বলে ওঠে না। আমার ভেতরকার দুরন্ত যুবার অবয়বে বৃদ্ধের মুখচ্ছন্দ দোদুল্যমান।৫ তার কাছে পৌঁছেই বলি, ‘বড় তৃষ্ণার্ত আমি। সে নিমেষে ফ্রিজের বোতল থেকে এক গ্লাস পানি হাজির করে আমার সামনে। ঢক ঢক খেয়ে ফেলি সবটুকু পানি। একটু পরে বলি, ‘বড় তৃষ্ণার্ত আজ। আবার এক গ্লাস পানি, আর ধোঁয়াওঠা চায়ের পেয়ালা। পানির গ্লাস এবং চায়ের বাটি উজাড় করেও আমার তৃষ্ণা মেটে না। উসখুস করি, যেন পিঁপড়ে কামড়াচ্ছে। জালালউদ্দীন রুমির মতো নিজের শরীরের উদ্দেশে বলি, ‘হে দেহ, এই তো তুমি বিটকেল যুবরাজ। অধৈর্য আমি শেষটায় বলি, ‘তেষ্টায় আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। ঘরের ভেতর তখন এক হাজার একরাত্রির রহস্যময়তা আর পারস্য গালিচার সৌকর্য; অথচ সে দিনানু-দৈনিক কাজে মশগুল, হঠাৎ ব্যেপে আসা অনির্বচনীয় সৌন্দর্যের প্রতি উদাসীন। আখেরে আরও এক গ্লাস পানি গলায় ঢেলে আমি পথচারী, একা, স্পর্শহারা, চুম্বনবিহীন। বুকজোড়া দাউ দাউ তৃষ্ণা আর হাহাকার, যা আমার একাকিত্বকে আরও দুঃসহ করায় ব্রতী। কি করে তৃষিত পায়রার ঘাড় মটাকে হয় বারবার, সে ভালো করেই জানে।৬ এখনও আছো, পরে থাকবে না। ভালোই, তখন আমি এই পৃথিবীর কেউ নই। দর্পণে বিম্বিত নিজেকে উপভোগ করা চমৎকার খেলা তোমার। একদিন ফুরাবে খেলা, তখনও দর্পণে ছায়া, আকাশে আদমসুরত। আবার বন্দনায় যে সৌন্দর্য অক্ষরের পরতে পরতে ধৃত, সংরক্ষিত, তা হারানোর বুকজোড়া হাহাকার কে আর শুনবে তুমি ছাড়া? কাকের ডাকে চমকে উঠে তুমি নিরর্থক তরুণী পরিচারিকাকে করবে ভর্ৎসনা। হয়ত মনে পড়বে তাকে, যে তোমার খুব কাছে আসতে চেয়ে ফিরে গেছে বারবার ব্যর্থ, অসহায়। কোনও কোনও মধ্যরাতে দুঃস্বপ্নে কুরূপার বীভৎসতা, করোটিতে সাপের ফণা দেখে জেগে উঠবে। তখনও দর্পণে ছায়া, আকাশে সপ্তর্ষিমণ্ডল। ভূতুড়ে জ্যোৎস্নায় স্তব্ধতা চিরে ডেকে উঠবে যুগপৎ কাক ও কোকিল।৭ বৃষ্টি নেই, রোদও নয় চড়চড়ে। তবু যাই না। আজকাল ইচ্ছে করেই তোমার নিবাসে আমি অনুপস্থিত। তোমার কাছ থেকে দূরে থাকার সাধনায় গলায় অন্যমনস্কতার রুদ্রাক্ষের মালা আর হাতে ঔদাস্যের তস্‌বি। তবুও কোনও কোনওদিন তোমাকে দেখতে যাব বলে গলির মোড়ে উঠে পড়ি রিক্‌শায়। রিক্‌শাচালক ঠিকানা জানতে চাইলে বলি, ‘নীলিমায় উড়ে যেতে পার? আরোহীকে উন্মাদ ঠাউরে শীর্ণকায় লোকটা প্যাডেলে অসাবধানতা ছড়ায় দুর্ঘটনা এড়ানোর উদ্দেশে বলি, ‘হোলি ফ্যামিলি হাসপাতালে চলো। কেন সেখানে যেতে হবে, নিজেই জানি না। শুনেছি তুমি বেশ ভালোই আছ, তৃপ্তিতে টইটম্বর। আগের চেয়ে ফরসা, স্বাস্থ্যে স্বর্ণলতার সজীবতা। আর যেখানেই হোক তুমি এ শহরের কোনও হাসপাতালে, ক্লিনিকে নেই। তোমার কাছ থেকে বহুদূরে টেনে টুনে রেখেছি নিজেকে এবং তোমাকে তিল তিল করে গড়ে তুলছি পঙ্‌ক্তির পর পঙ্‌ক্তিতে। সেই হরফের মূর্তি তোমার মতোই অথচ তুমি নও। তোমার চেয়েও নমনীয়, দয়াময়ী। তার হাত দৈনন্দিনতায় নয়, নক্ষত্রপুঞ্জে মিশেছে। কখনও সে আমাকে পাতালে টেনে নেয়, কখনও বা তুমুল মন্দিরা বাজিয়ে নিয়ে যায় প্রাণবন্ত জীবজগতে।৮ নিস্তব্ধ বাড়ি ধ্যানী দরবেশের মতো জেগে আছেন, তার মাথা আকাশকে স্পর্শ করার স্পর্ধা রাখে। বৃষ্টিভেজা মধ্যরাতে ঘুম ভাঙে, হাত লাগে দেয়ালে, যেখানে রক্তের দাগ। বিছানায় বেনামী ভয় লেপ্টে থাকে, নিজেকে মনে হয় ছন্নছাড়া আগন্তুক; আর ক’দিনই বা আছি এই ডেরায়? আজ আমি যে জায়গায় খাট পেতেছি, সাজিয়েছি টেবিল, বুকশেলফ-এসব কি এরকমই থাকবে অবিকল বহুবছর পর? এ জায়গায় ভিন্ন কোনও খাটে, কবোষ্ণ শয্যায় হয়ত ঘুমোবে আমার কোনও ষাটপেরুনো বংশধর। তার নিদ্রিত হাত কি জেগে উঠবে দেয়ালের স্পর্শে? তাকেও কি ডালকুত্তার মতো কামড়ে ধরবে এমনি কোনও চিন্তা যা আমাকে এই মুহূর্তে গ্রাস করেছে? সে কি আমার মতোই ভুগবে অর্থকষ্টে নাকি দু’হাতে ওড়াবে টাকা? সে কি কোনও অধ্যাপকের পদ অলংকৃত করবে, অথবা হবে আমৃত্যু দুঃখের জোয়াল বয়ে বেড়ানো কোনও কবি?   (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
চিন্তামূলক
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
১ ডাক-হরকরা বিলি করলেও রাজা রামমোহন রায়ের পত্র ঘরে ঘরে পৌঁছেনি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর লিখে জবাব না পেয়ে আখেরে নিজেকে আবৃত করেছিলেন নিঃসঙ্গতায়, অশ্রদ্ধা তাঁর মুখাবয়বে বসিয়ে দিয়েছিল কাঠিন্যের রেখা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পত্রাবলী রচনায় অনলস, এমনকি শেষ বয়সের গোধূলিতে কম্পিত হস্তে রচনা করেছেন বিস্তর চিঠি। টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন বারবার। মনে হয় না, সেসব চিঠি কেউ পড়েছে। পড়লেও মর্মোদ্ধারে ব্যর্থ অনেকে, কেউ কেউ বুঝলেও তেমন আমল দেয়নি, অনেকে খাম পর্যন্ত খোলেনি। অবশ্যি অধিকাংশ লোকের কাছে ক-অক্ষর হারাম বলে তারা শুধু ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে রয়েছে। সেসব চিঠি মানবচিত্তে মনুষ্য ধর্মকে পদ্মের মতো প্রস্ফূটিত করতে চেয়েছিল। এখন সেই প্রাতঃস্মরণীয় ত্রয়ীর সুসমাচার ফাঁপা পথচারীদের কাছে ইলেকট্রিকের তারে আটকে থাকা কাটা ঘুড়ির ছিন্নাংশ কিংবা নর্দমার পানিতে ভাসমান ছেঁড়াখোঁড়া কাগজের নৌকা, যা বস্তির ছেলেমানুষদের তৈরি।২ যখন বয়স ছিল কম, তখন ক্ষীণায়ু কীটস্‌ এবং তরুণ রবীন্দ্রনাথের মতো মৃত্যুবন্দনায় ছিলাম উচ্ছ্বসিত। ভাবতাম জ্যোৎস্নাপ্লাবিত কোনও চৈতীরাতে আবেগাতুর কবিতা পাঠকালীন আমার ওপর মৃত্যু যদি নেমে আসত, সুশীল পাখির মতো কি ভালোই না লাগত আমার। মৃত্যুকে দয়িতা ভেবে মরণের প্রেমে পড়েছিলাম তারুণ্যে। অথচ আজ ষাটের ধূসরতায় বিবর্ণ হয়েও বেঁচে থাকার সাধ তীব্র সুরার মতো উদ্দীপিত করে আমাকে। কেননা, এই তো সেদিন দেখলাম তোমাকে-তন্বী এবং সুন্দর।৩ ভেবেছিলাম নাছোড় অভিমান এক আমাকে রাখবে লোকালয় থেকে বহুদূরে নুড়িময় ঝর্ণাতলায় সুখে বুঁদ। বুনো ছাগ-যূথে, গাছগাছালির ভিড়ে, পাখাপাখালির রাজ্যে জীবনযাপন মাধুর্যে মোড়া চিরদিন, ছিল আশা। পাথর আর জলধারার ভাষা শেখা হবে। সুখের সংজ্ঞা কখনও কখনও ভাবায়। গাছতলায় শুয়ে পাখির গান শোনা, বৃষ্টিধোয়া আকাশে রঙধনুর পেখম দেখা, সূর্যের আলোয় নেয়ে ওঠা, চৈতালি জ্যোৎস্নায় হেঁটে বেড়ানো, সূর্যাস্তের দিকে মুখ রেখে দাঁড়ানো-এসবই তো সুখকর; তবু কেন মানুষের মুখ দেখার ব্যাকুলতা? লোকালয়ের উত্তাপ ফিরে না পেলে টইটম্বুর হবে না আমার সুখের কলস।৪ কখনো সেজেগুজে, পরিপাটি দাড়ি কামিয়ে সুগন্ধি মেখে, কখনও বা উশ্‌কো খুশ্‌কো ৩ দিনের না কামানো দাড়ি নিয়ে তার নিবাসে গিয়ে কড়া নাড়ি। ব্যাকুলতা আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় সর্বক্ষণ। যতক্ষণ না ওর ড্রইং রুমের সোফায় বসি, কথা বলি এলোমেলো, তাকাই বারান্দায় লুটিয়ে পড়া রৌদ্রের দিকে, ততক্ষণ আমার স্বস্তি নদারৎ। আলবৎ ওকে ভালোবাসি, এরকম ভালোবাসিনি কোনও নারীকে। আমাকে সে ভালোবাসে কিনা, সঠিক জানি না। যেমন জন্মান্ধের অজ্ঞাত চৈত্ররাত্রির জ্যোৎস্নার সৌন্দর্য। সন্দেহের কাল বেড়াল ফিরোজা চোখ নিয়ে চেয়ে থাকে আমার দিকে, ভীত আমি উদাসীনতায় ডুবে থাকার ভান করি। কোনও কোনওদিন আমার ঠোঁট থেকে লতার মতো দুলতে থাকে একটা প্রশ্ন, ‘তুমি কি সত্যি ভালোবাস আমাকে?’ কখনও নিরুত্তর সে নোখ দিয়ে খুঁটতে থাকে সোফার হাতল কিংবা বলে, ‘চাই, চা করে আনি। কখন কি খেয়াল হয়, আমার দিকে না তাকিয়েই ফ্লাওয়ার ভাস সাজাতে উচ্চারণ করে, ‘ভালোবাসি’। সেই মুহূর্তে তার কণ্ঠস্বরে যেশাসের জন্মের আগেকার সুদূরতা। প্রাচীনতম লেখনের পাঠোদ্ধারের চেষ্টায় ক্লান্ত আমি বর্তমানকে মুছে ফেলি নিজেরই অজান্তে। এর পায়ের কাছে ছড়িয়ে থাকে আমার অনুভুতিগুলো, জড়ো করার উৎসাহ সবুজ শিখার মতো জ্বলে ওঠে না। আমার ভেতরকার দুরন্ত যুবার অবয়বে বৃদ্ধের মুখচ্ছন্দ দোদুল্যমান।৫ তার কাছে পৌঁছেই বলি, ‘বড় তৃষ্ণার্ত আমি। সে নিমেষে ফ্রিজের বোতল থেকে এক গ্লাস পানি হাজির করে আমার সামনে। ঢক ঢক খেয়ে ফেলি সবটুকু পানি। একটু পরে বলি, ‘বড় তৃষ্ণার্ত আজ। আবার এক গ্লাস পানি, আর ধোঁয়াওঠা চায়ের পেয়ালা। পানির গ্লাস এবং চায়ের বাটি উজাড় করেও আমার তৃষ্ণা মেটে না। উসখুস করি, যেন পিঁপড়ে কামড়াচ্ছে। জালালউদ্দীন রুমির মতো নিজের শরীরের উদ্দেশে বলি, ‘হে দেহ, এই তো তুমি বিটকেল যুবরাজ। অধৈর্য আমি শেষটায় বলি, ‘তেষ্টায় আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। ঘরের ভেতর তখন এক হাজার একরাত্রির রহস্যময়তা আর পারস্য গালিচার সৌকর্য; অথচ সে দিনানু-দৈনিক কাজে মশগুল, হঠাৎ ব্যেপে আসা অনির্বচনীয় সৌন্দর্যের প্রতি উদাসীন। আখেরে আরও এক গ্লাস পানি গলায় ঢেলে আমি পথচারী, একা, স্পর্শহারা, চুম্বনবিহীন। বুকজোড়া দাউ দাউ তৃষ্ণা আর হাহাকার, যা আমার একাকিত্বকে আরও দুঃসহ করায় ব্রতী। কি করে তৃষিত পায়রার ঘাড় মটাকে হয় বারবার, সে ভালো করেই জানে।৬ এখনও আছো, পরে থাকবে না। ভালোই, তখন আমি এই পৃথিবীর কেউ নই। দর্পণে বিম্বিত নিজেকে উপভোগ করা চমৎকার খেলা তোমার। একদিন ফুরাবে খেলা, তখনও দর্পণে ছায়া, আকাশে আদমসুরত। আবার বন্দনায় যে সৌন্দর্য অক্ষরের পরতে পরতে ধৃত, সংরক্ষিত, তা হারানোর বুকজোড়া হাহাকার কে আর শুনবে তুমি ছাড়া? কাকের ডাকে চমকে উঠে তুমি নিরর্থক তরুণী পরিচারিকাকে করবে ভর্ৎসনা। হয়ত মনে পড়বে তাকে, যে তোমার খুব কাছে আসতে চেয়ে ফিরে গেছে বারবার ব্যর্থ, অসহায়। কোনও কোনও মধ্যরাতে দুঃস্বপ্নে কুরূপার বীভৎসতা, করোটিতে সাপের ফণা দেখে জেগে উঠবে। তখনও দর্পণে ছায়া, আকাশে সপ্তর্ষিমণ্ডল। ভূতুড়ে জ্যোৎস্নায় স্তব্ধতা চিরে ডেকে উঠবে যুগপৎ কাক ও কোকিল।৭ বৃষ্টি নেই, রোদও নয় চড়চড়ে। তবু যাই না। আজকাল ইচ্ছে করেই তোমার নিবাসে আমি অনুপস্থিত। তোমার কাছ থেকে দূরে থাকার সাধনায় গলায় অন্যমনস্কতার রুদ্রাক্ষের মালা আর হাতে ঔদাস্যের তস্‌বি। তবুও কোনও কোনওদিন তোমাকে দেখতে যাব বলে গলির মোড়ে উঠে পড়ি রিক্‌শায়। রিক্‌শাচালক ঠিকানা জানতে চাইলে বলি, ‘নীলিমায় উড়ে যেতে পার? আরোহীকে উন্মাদ ঠাউরে শীর্ণকায় লোকটা প্যাডেলে অসাবধানতা ছড়ায় দুর্ঘটনা এড়ানোর উদ্দেশে বলি, ‘হোলি ফ্যামিলি হাসপাতালে চলো। কেন সেখানে যেতে হবে, নিজেই জানি না। শুনেছি তুমি বেশ ভালোই আছ, তৃপ্তিতে টইটম্বর। আগের চেয়ে ফরসা, স্বাস্থ্যে স্বর্ণলতার সজীবতা। আর যেখানেই হোক তুমি এ শহরের কোনও হাসপাতালে, ক্লিনিকে নেই। তোমার কাছ থেকে বহুদূরে টেনে টুনে রেখেছি নিজেকে এবং তোমাকে তিল তিল করে গড়ে তুলছি পঙ্‌ক্তির পর পঙ্‌ক্তিতে। সেই হরফের মূর্তি তোমার মতোই অথচ তুমি নও। তোমার চেয়েও নমনীয়, দয়াময়ী। তার হাত দৈনন্দিনতায় নয়, নক্ষত্রপুঞ্জে মিশেছে। কখনও সে আমাকে পাতালে টেনে নেয়, কখনও বা তুমুল মন্দিরা বাজিয়ে নিয়ে যায় প্রাণবন্ত জীবজগতে।৮ নিস্তব্ধ বাড়ি ধ্যানী দরবেশের মতো জেগে আছেন, তার মাথা আকাশকে স্পর্শ করার স্পর্ধা রাখে। বৃষ্টিভেজা মধ্যরাতে ঘুম ভাঙে, হাত লাগে দেয়ালে, যেখানে রক্তের দাগ। বিছানায় বেনামী ভয় লেপ্টে থাকে, নিজেকে মনে হয় ছন্নছাড়া আগন্তুক; আর ক’দিনই বা আছি এই ডেরায়? আজ আমি যে জায়গায় খাট পেতেছি, সাজিয়েছি টেবিল, বুকশেলফ-এসব কি এরকমই থাকবে অবিকল বহুবছর পর? এ জায়গায় ভিন্ন কোনও খাটে, কবোষ্ণ শয্যায় হয়ত ঘুমোবে আমার কোনও ষাটপেরুনো বংশধর। তার নিদ্রিত হাত কি জেগে উঠবে দেয়ালের স্পর্শে? তাকেও কি ডালকুত্তার মতো কামড়ে ধরবে এমনি কোনও চিন্তা যা আমাকে এই মুহূর্তে গ্রাস করেছে? সে কি আমার মতোই ভুগবে অর্থকষ্টে নাকি দু’হাতে ওড়াবে টাকা? সে কি কোনও অধ্যাপকের পদ অলংকৃত করবে, অথবা হবে আমৃত্যু দুঃখের জোয়াল বয়ে বেড়ানো কোনও কবি?   (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
https://www.bangla-kobita.com/shamsurrahman/dakhorkora-bili-korleo/ 2020-06-01T20:23:04.442725
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
সেই কবে কাকে যেন কথা দিয়েছিলাম, আবার আসবই। কখন কোথায় দেখা হবে, ছন্নছাড়া এই আমি জানাতে পারিনি। সুকোমল দুটি হাত ছেড়ে চলে গেছি নিরুদ্দেশে।আমার তো আজও পথ চলার বিরাম নেই, নানা দিকে যাত্রা করি, হই মুখোমুখি কত চেনা, অচেনা জনের, শুধু দেখি না দেখতে যাকে চাই। নতুন পথের দিশা খুঁজে এগিয়েছি বহুবার, কত না সকাল সন্ধ্যারাগে পরিণত হয়েছে, কেটেছে রাত অজানা জায়গায়, হিসাব রাখিনি।সম্মুখে চলার দৃঢ় ভরসায় পথ হাঁটি, দূর দিগন্তের দিকে চোখ রেখে চলি, অথচ বিস্মিত পথচারী আমি দেখি শুধুঘুরছি, ঘুরছি একই সীমানায়। কে পাখি পাখার ঝাপ্টায় আহত করে আমাকে এবং আওড়ায় বার বার, ‘শোনো হে পথিক, প্রকৃত কোথাও কারও কোনও যাওয়া নেই’।   (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
আবার সেখানে তুমি হুবহু আগের মতো সব পেয়ে যাবে, এরকম ভাবা ঠিক নয়। বহু পথ পাড়ি দিয়ে অখ্যাত স্টেশনে নেমে খানিক জিরিয়ে হেঁটে যাবে, তারপর উঠবে নৌকায়, পালে হাওয়া লাগবে, মেঘনার বুক চিরে, যাবে তুমি বহুদূরে ভাটিয়ালি টানে। ধান-রঙ অপরাহ্নে আলুঘাটা পৌঁছে শহুরে পা রেখে ভেজা মাটিতে এবং দৃর্ষ্টি মেলে গাছগাছালির ভিড়ে, ছনছাওয়া ঘরে কী তুমি প্রত্যাশা করো আজ?কৈশোর ও যৌবনের মাঝখানে থমকে দাঁড়ানো সেই মেয়ে আসবে কি ছুটে শাড়ির কোঁচড়ে তার একরাশ বৈঁচি ফল নিয়ে? কিংবা সে কিশোর, যাতে তুমি এই তো সেদিন ভরা শ্রাবণের নিঝুম ধারায় কী ব্যাকুল ছুঁয়ে পরখ করতে চেয়েছিলে সে প্রকৃত সজীব প্রতিভূ কিনা বাস্তবের, সেও কি আবার তোমার সতৃষ্ণ বুকে পড়বে ঝাঁপিয়ে নিরাশ্রয় পাখির ধরনে?বাঁশঝাড় পেরুনোর সময় তোমার পড়বে কি মনে কত উদাস দুপুরে পাখির ডিমের লোভে ক’জন বালক দিতো হানা জরাগ্রস্ত কাচারি বাড়ির আশেপাশে থমথমে সান্নাটায়? পড়বে কি মনে পূর্ণিমায় পুরনো পুকুর পাড়ে ঢ্যাঙা নাঙা ফকিরের নিসর্গ-মাতানো নাচ? মধ্যরাতে বৈঠকখানায় মাইজভাণ্ডারি গান? পড়বে কি মনে সেই দৃশ্যবলি, খুব ছলছলে হাল-আমলের গ্রামভিত্তিক বঙ্গীয় উপন্যাসে যে রকম থাকে? কষ্ট দেয় প্রাচীনতা বড় কষ্ট দেয়, ভাবো তুমি, দরবারি কানাড়ার মতো। ত্রস্ত খরগোশ ঝোপ থেকে ঝোপান্তরে ছুটে যাবে, ঝরবে পায়ের কাছে আম জাম কাঁঠালের পাতা, দাওয়ায় দাঁড়ানো কেউ উঁকি দেবে, ধরা যাক। পাখি চকিতে উঠবে ডেকে সন্ধ্যাকে চমকে দিয়ে খুব। হয়তো সেখানে গিয়ে দেখবে আগের মতো নেই কোনো কিছু, হয়তো বা কোনো চোখের অনাশ্রয় তোমাকে ফিরিয়ে দেবে শূন্য নদীতীরে, তবু অনিচ্ছা সত্ত্বেও আজ হোক কাল হোক তোমাকে যেতেই হবে সুদূর সেখানে।   (হোমারের স্বপ্নময় হাত কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
শৈলাবাস, যা স্যানাটরিয়ামও বটে, ভিড়াক্রান্ত। এখন সেখানে প্রজ্ঞা ভীষণ শ্বাসকষ্টে ভুগছে। তপ্ত শলাকা দিয়ে উপড়ে ফেলা হয়েছে বিবেকের চোখ; উপরন্তু ওর হাতে ভারী শেকল, পায়ে বেড়ি। বোধি নির্বাসিত। মিথ্যার বারফট্রাই আর মাস্তানিতে সত্য গা ঢাকা দিয়েছে। আমাদের কোনও কোনও স্বপ্ন বিশ্বাসঘাতকতায় মেতে আমাদের বিদ্রূপ করে যখন তখন। এখানে অনেকে একজনের নাম বলতে গিয়ে দিব্যি অন্যজনের নাম উচ্চারণ করে সগৌরবে। সেজন্যে কারও বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ নেই। অনুশোচনা তো অনেক আগেই বেপাত্তা। পাড়াপড়শিরা শরমের মাথা খেয়ে বরং কোমরে ঘুনসি এঁটে হাসির গিটকিরি ছড়ায় চৌরাস্তায়। ন্যায় প্রতিষ্ঠায় ঢের হ্যাপা আছে জেনে বড় মেজো সেজো অনেকেই দল বদলের রঙে মাতোয়ারা, অনেক জাঁকালো চণ্ডীমণ্ডপের ফরাসে বসে ফরাসি টানে। কেউ কেউ দেশ অ্যাকোরিয়াম হোক, এই মতো স্বপ্ন দ্যাখে ভয়ে ভয়ে।কয়েকটি কলহংস-শব্দ বাড়িটার পাছদুয়ার দিয়ে ভেতরে আস্তেসুস্থে প্রবেশ করে। কলহংসগুলোর শরীরে রৌদ্র-জ্যোৎস্না, জল-হাওয়ার দাগ, দীর্ঘশ্বাসের ছায়া কম্পমান। শেষ রাতের প্রহরকে চমকে দিয়ে মীরা বাঈ-এর ভজনস্নিগ্ধ হাতের কঙ্কন নগ্ন মেঝেতে গড়ায়। ছাদ, দেয়াল, সিঁড়ি মেঝে ফুঁড়ে রক্তের ফোয়ারা। আলাওলের পুঁথি আর রবীন্দ্র রচনাবলী রক্তবমনে অচেতন। আলাওলের পদ্মাবতী রক্তস্নান সেরে ওঠে গভীর গভীরতর বেদনায়। সারা গায়ে আনারের দানার মতো রক্তফোঁটা নিয়ে হু হু বুকে লেকের কিনারে ছুটে যায় ‘পদ্মাবতী’র কবির রাজহাঁসের পালকে বানানো লেখনীর সঙ্গে জলে সহমরণের অভিলাষে। রক্তভেজা অচিন পাখিকে দেখে ছেঁউড়িয়াতে আচমকা ছিঁড়ে যায় লালনের একতারার স্তব্ধ অথচ সপ্রাণ তার। অতিকায় এক সোনালি দেয়ালের পিঠ থেকে নেমে আসেন তিনি। তাঁর চোখে যুগপৎ বেদনা আর কৃতজ্ঞতার অশ্রুকণা চিক চিক করে শ্রাবণের শেষ রোদে। ক্ষতবিক্ষত মানচিত্রের মতো বুক চেপে তিনি দেখছেন কি দ্রুত তাঁর প্রাণের বাংলাকে এক প্রকাণ্ড পাগলা গারদে রূপান্তরিত করা হয়েচে। এখানে সবাই বড় বেশি স্বাভাবিক সুস্থতার নাটুকে ঢঙ দেখিয়ে চলেছে। একটা বদ হাওয়া এতকাল আচ্ছন্ন করে রেখেছে স্বদেশভূমিকে। দেখা যাক, মনে মনে বলেন তিনি, আমার উত্তরাধিকার অতীতাশ্রয়ী না হয়ে সুবাতাস বইয়ে দিতে পারে কিনা। সারাক্ষণ শুধু অতীতের দিকে মুখ রেখে চললে প্রগতির চাকা ডোবে পিছল কাদায়। আমার উত্তরাধিকার পেছনে কিংবা সামনের চোরাবালিতে পা রাখলে আমার দ্বিতীয় মৃত্যু হবেই হবে স্বজনেরই হাতে।অনন্তর তিনি অপেক্ষমাণ সোনালি দোয়েলটির দিকে খানিক তাকালেন, তাঁর চোখে একটি প্রশ্ন নক্ষত্রমালা হয়ে দুলতে থাকে।     (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
স্বদেশমূলক
দাগী অপরাধী ঠাউরে নিয়ে শহীদ মিনারকে ওরা গ্রেপ্তার করেছে, গোঁয়ার শেকলে বেঁধেছে কোমর বজ্র-আঁটুনিতে, আক্রোশে পরিয়েছে হাতকড়া।যেখানে এখন রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল গীতি, বাউলগুরু লালনের গান নয়, নয় প্রতিবাদী কবিকণ্ঠে উচ্চারিত পঙ্‌ক্তিমালা, তেজী বক্তাদের আগুন-ঝরানো ভাষণ, শান্তির বাণী।এখন দিনরাত শহীদ মিনার ঘিরে ধ্বনিত অগণিত বুটের কর্কশ আওয়াজ। শহীদ মিনারে শত শত স্রোতার মিলন-মেলা নয়, বসেছে হুকুম বরদার রাইফেলের বৈঠক। শহীদ মিনারে আজ ফুলের স্তবক প্রগতি, কল্যাণ আর আশাবাদের পতাকা নেই; সেখান এখন চোখ-রাঙানো উদ্ধত উর্দির ধমক।হায়, এ কেমন কাল এলো জন্মভূমিতে আমার, যখন নন্দিত ভাষা-সৈনিক, কবি, কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক, চিত্রকর, সঙ্গীতশিল্পী-সবাই অবাঞ্ছিত শহীদ মিনারের পবিত্র প্রাঙ্গণে! তবে কি বায়ান্নোর ভাষা শহীদের আত্মা, নিরস্ত্র অগণিত জীবিত মানুষ প্রতিবাদে গর্জে উঠবে না ফের?  (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
আমার ভেতর থেকে আশ্চর্য এক যুবক সামুরাই তরবারির ঝলসানির আঙ্গিকে বেরিয়ে সরাসরি হেঁটে যায় তোমার নিবাসে রাস্তার ভিড় আর কোলাহলের চারদিকে পর্দা টেনে দিয়ে। তুমি তাকে না দেখে তাকাও এক স্তূপ ধূসরতার দিকে; তোমার ভুরুর মাঝখানে দ্বিধাদ্বন্দ্বের দোলক।এই হাত দুটো আমার, দেখ এই এক জোড়া চোখ, এই ওষ্ঠ আমার; শোনো, বুকের এই ধুকপুকুনি আমার-এক স্তূপ ধূসরতা ব্যাকুল কণ্ঠস্বর।সেই কণ্ঠস্বর তোমার হৃদয়কে স্পর্শ করেছে, মনে হয় না। তুমি জানালার বাইরে তাকিয়ে আছো, যেন একটি একটি করে গুনছ পাখির পালক, জেনে নিতে চাইছ গাছের পাতার রহস্য। তোমার উদাসীনতায় প্রতিহত কণ্ঠস্বর আত্মসমর্পণ করে স্তব্ধতার হাতে।কিছুতেই তোমাকে বুঝতে পারি না আমি, যেমন একট বাই চার পাঁচবার পড়বার পরেও তার মাথামুণ্ড কিছুই বোধগম্য হয় না নিবিষ্ট পড়ুয়ার।বলেই ফেলি তোমাকে ঘিরে অষ্ট প্রহরের ছটফটানি আমার ছুটির দরখাস্ত দাখিল করেছে দিনের আলোকরশ্মি আর নক্ষত্রের কাছে এবং আমার ভালোবাসা গ্রীষ্মমণ্ডল ছেড়ে নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলের সৈকতের চিকচিকে বালিতে শুয়ে রোদ পোহায়।   (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
কিছু না কিছু নিয়ে ভাবনা থেকেই যায় শেষ তক করুরি কাজে যখন নিমজ্জিত মনে হয় কিছু ভাবার নেই অথচ তখনও মগজে চিন্তা-ভ্রমরের গুঞ্জরণকখন ভোকাট্রা চাকরির প্রবঞ্চক ঘুড়ি ভিসা অফিসে লাইনে দাঁড়ানোর ঝুট ঝামেলা প্রবাসে কন্যার সুবিধা-অসুবিধার জটাজাল কনিষ্ঠার বিয়ের ফুল ফুটেও ফুটছে নাবাইয়োস্‌ফিয়ারে আমরা পরস্পর জড়ানো পরিবেশের উপর লাগাতার বলাৎকার কি সমীচীন সূর্যের আয়ু ফুরিয়ে যাবে কোন সুদূরে কবে শিঙ-ভাস্কর্যকে দোলাবে গণতন্ত্রের সোনার হরিণ পথ চলতে রেস্তোরাঁয় চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বন্ধুর সৌহার্দ্যের ঘ্রাণ নেওয়ার সময় বই পড়ার ফাঁকে ঘামেভেজা ব্রা শোঁকাকালীন কিছু না কিছু ভেবেই চলিআকাঙক্ষার ছায়ায় তার মুখোমুখি ব’সে থাকার লগ্নে ঘুমাতে যাবার আগে জেগে ওঠার পরে জনৈক বিদেশী যুবক আত্মহত্যার প্রাক্‌ মুহুর্তে কী-যেন লিখেছিলো খাতার শেষ পাতায় দীর্ঘশ্বাসের হরফেভাঙাচোরা পূর্ব ইউরোপকে কি সারানো যাবে রাংঝালে কবিতার স্বায়ত্তশাসন কি প্রতিষ্ঠিত মুল্যবোধের পোড়াবাড়িতে পরাবাস্তবতার মৃত্যুঘন্টা কি বাজলো বনকপোতের ডাক কবে শুনবো আবারস্বৈরতন্ত্রের কটমটে পাহারা আর কতকাল ক’জন পুতুল মন্ত্রী নিলেন শপথ দবিজ কার্পের দাঁড়িয়ে যে ডোরাকাটা শার্দুলের সওয়ার গর্বাচভ সেই কি খাবে তাঁকে আখেরেবুদ্বুদের উপর দাঁড়িয়ে সটান পায়রা ওড়ানো কতটা সম্ভবপর নিঃসঙ্গতার বুদোয়ারে ছায়াবৃতা গ্রেটা গার্বোর প্রয়াণ রবীন্দ্রনাথ মূঢ় ময়রাদের হস্তাবলেপে নিদারুণ চটচটে সুরম্য দালান থেকে বেরিয়ে আসে ভেড়ার পাল কালো চুলের জালে আটকে-পড়া মাথা কয়েকটি ভুতুড়ে তারা হাসে নিপস্টিক-হাসি চুমু খেতে না পারার বাস্তুহারা ডুকরানোভাবছি গরহাজির-তুমি কেন ঘুমোতে দাও না আমাকে শেকড়হীন চাঁদের পায়ে মিলিটারি বুট হিস্পানি ঘাগরায় দ্রাক্ষাবনের স্বপ্ন জ্যোৎস্নার নাগরদোলায় তুমিযেদিন মৃত্যু হবে আমার তুমি কি আসবে ছুটে প্রসাধন উপেক্ষা ক’রে মাঝিবিহীন ফাঁকা নৌকা চলেছে ঢেউ ছুঁয়ে ছুঁয়ে এরপরও থাকে কিছু না কিছু ভাবার   (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
নেমেছে অসিত নম্র ডানা মেলে নিশীথ নিঝুম চৌদিকে এবং বাতিজ্বলা ছোট আমার এ ঘরে স্তব্ধতা ঘুমন্ত বেড়ালের মতো গাঢ় আছে প’ড়ে, রয়েছি চেয়ারে বসে বহুক্ষণ, চোখে নেই ঘুম, হাতে প্রস্ফুটিত বোদলেয়ারের ক্লেদজ কুসুম। মনে পড়ে, নিঃসংগ অসুস্থ কবি প্রহরে প্রহরে হেঁটেছেন কৃষ্ণ বেশে। তাঁরই মতো আমিও শহরে একা-একা ঘুরি নিয়ে অস্তিত্বে ব্যাধির গুপ্ত ধুম।যে-নারী দেয়নি শান্তি তাঁকে বরং কুটিল পাকে করেছে অত্যন্ত ক্লান্ত তারই জন্যে কত দুঃখশোক সয়েছেন, নিজেকে ক্ষইয়ে শুধু গড়েছেন তাকে। আমি কি পারবো হতে দান্ত মহিমায় সমাসীন তাঁর মতো? পারবো কি ক্ষিপ্র তুলে নিতে কোনোদিন গরল আঁজলা ভরে অমৃতে ভাসিয়ে বিশ্বলোক?   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
দেখছি আমার পাশ কাটিয়ে একটি লোক লাঠি হাতে খুব খোঁড়াতে খোঁড়াতে আমাকে পেছনে ফেলে যেতে চায় যেন। কিছুক্ষণ পর একজন অন্ধ বৃক্ষতলে শীর্ণ হাত পেতে ব’সে আছে। তাকে কিছু দেব ভেবে হাতড়াই পকেট; অথচ পকেট ধূসর মরুভূমি।মনে-মনে নিজেকে ধিক্কার দিতে-দিতে বড় ক্লান্ত বোধ করি। কিয়দ্দূর হেঁটে গেলে পর চোখে পড়ে গাছের ছায়ায় কে এক বিচ্ছিরি বিকলাঙ্গ পুরুষ রয়েছে শুয়ে, পাশে তার একটি মাটির পাত্র। আমি সেই পাত্রে কোনও কানাকড়ি কিংবা টাকা দিতে ব্যর্থ হয়ে কষ্ট পাই বাস্তবিক।নিজেকে ধিক্কৃত জীব ভেবে হেঁটে যেতে থাকি পথে। পথময় কত-না মোটরকার, ঢের চোখ-জুড়োনো দৃশ্যের মিছিল এবং পাশাপাশি বড় বেশি কষ্টময় ক্রন্দনের রোল, শৌখিন আসরে নরনারীদের নৃত্য, কোথাও উল্লাস আর কোথাও মাতম! ক্লান্তির দংশন মনে হ’ল মৃত্যুপুরী গিলে খাবে।গা ঝেড়ে দৃষ্টিতে অপরূপ পুষ্পরাজি টেনে আনি কল্পনার মায়াজালে বুনে। চকিতে কখনও আমার দু’কাঁধে মখমলি পাখা গজাতেই দূর মেঘমালায় উড়তে থাকি- মনে হয় নীল পরী, লাল পরী আমাকে চুম্বনে ঢেকে দেবে। খানিক পরেই মনে হয়, প’ড়ে আছি রুক্ষ দ্বীপে।   (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
যখন বেরোই পথে দিন কিংবা রাতে চোখে পড়ে নানা ধরনের কিছু লোক ডানে বামে। আচমকা কেন যেন মনে হয় কারও ঘাড়ে শুধু একখানা মাথা নয়, দুটো কি তিনটি মাথা লগ্ন বলে মনে হয়। সাধ জাগে লোকটিকে গিয়ে প্রশ্ন করি, সত্যি আপনার মাথা কি তিনটি?মাঝে মাঝে কী-যে হয় মধ্যরাতে একলা দূরের বাগানে হাজির। চোখে পড়ে, এক কোণে ক’জন জুয়াড়ি দিব্যি মেতেছে খেলায়, কেউ খুব হেরে গিয়ে গিন্নির গয়না কিছু বেঘোরে খুইয়ে বসে আর আচানক দৃশ্যটি তিমিরে মিশে যায়। বহু দূরে বিধবার বুকফাটা কান্নার ধরনে এক পাখি ডেকে ওঠে বারবার।রাত আরও গাঢ় আর বয়সী হতেই চোখে পড়ে এক মধ্যবয়সী বেখাপ্পা লোক দূরে তিন জন যুবকের সঙ্গে, মনে হলো বড় বেশি গুপ্ত কিছু করছেন স্থির। আসমানে অন্ধকার ভেদ করে মিছিলের আভা জেগে ওঠে। বয়সের দৌরাত্ম্য উপেক্ষা করে নেতা দৃপ্ত পায়ে যান হেঁটে।স্বপ্ন নাকি বাস্তব সহজে বোঝা মুশকিল। তেজী সেই মিছিলে জালিম লাঠি ডানে বামে চালায় পুলিশ আর ভাড়াটে গুণ্ডারা। রক্ত ঝরে।নিরস্ত্র পুরুষ আর নারীদের। আন্দোলনরত যারা, তারা স্বপ্ন দ্যাখে পুষ্পশোভিত আগামী আর প্রকৃত মুক্তির আলোকিত জনতার শ্রেয় দেশ।   (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
অনেক বছর আগে আমি ভালোবেসেছিলাম যাদের তারা আজ অতিশয় আবছা বিবর্ণ ফ্রীজ শটে। অকস্মাৎ কোনো কোনোদিন ওরা স্মৃতির নিকটে চাঞ্চল্য প্রার্থনা করে গূঢ় ইন্দ্রজালে শরীরের খুব কাছে এসে। অশরীরী ছায়ার মতন ফের করে ব্যবহার নিমেষেই। দৃশ্যপটে কী-যে ঘটে, ওরা মিশে যায় বায়ুস্তরে; শোনো, বলি অকপটে- চিরদিন কিছু ছায়ামোহ থেকে যায় মানুষের।কিন্তু তুমি ছায়া নও, নও তুমি অশরীরী কেউ, তোমার বেদেনী-চোখ, ক্ষীণ কটি আর স্তনভার নিয়ে তুমি আজো কী সজীব জ্বলজ্বলে উপস্থিতি। যেখানেই থাকো, যতদূরে বিস্মৃতির ক্রূর ঢেউ তোমাকে সরিয়ে নিতে পারে না কখনো; বারবার ফিরে আসে আমাদের কী মদির অসামান্য তিথি।   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)