poet
stringclasses 137
values | category
stringclasses 21
values | poem
stringlengths 9
18.7k
|
---|---|---|
আবিদ আনোয়ার | ব্যঙ্গাত্মক | রুনুঝুনুর মেজোচাচা
এবং তাদের চাচী
আজকে যদি ঢাকায় তবে
কালকে থাকেন রাচী,
সিঙ্গাপুরে কাশেন তারা
কাশ্মীরে দেন হাঁচি।বুক-পকেটে পাউন্ড-ডলার
ব্যাক-পকেটে দিনার,
মস্কো থেকে নাস্তা সেরে
লন্ডনে খান ডিনার।জাপান ব’সে চা পান ক’রে
বলেন তুলে হাই:
এই পৃথিবী এত্তো ছোট,
কোথায় বাপু যাই! |
আবিদ আনোয়ার | রূপক | মানতের মতো রেখে যায় কারা যার যার প্রিয় ফুল,
পাপড়ির সাথে মাধুরী মেশানো নানা বর্ণের তোড়া:
শহীদ মিনার নিমেষেই দেখে ফাঁকা তার বেদীমূল
একুশের ফুল খেয়ে চলে যায় বাইশের লাল ঘোড়া!হঠাৎ কখনো জাবরের পরে উৎকট ক্ষেপে ওঠে:
খুঁজে ফেরে তার মৌসুমী মেনু রক্ত-মাখানো জল,
নগর দাপিয়ে পাগলের প্রায় উড়–ক্কু পায়ে ছোটে
পিছে ফেলে আসে গণভবনের নিকানো আস্তাবল।হায়েনার মতো হিংস্র দু’চোখ, কেশর ফুলানো ঘাড়,
গগনচুম্বী দালানের চেয়ে উঁচুতে নাড়ায় কান;
খুরের দাপটে রাজপথে ওঠে মিছিলের হাহাকার,
নড়ে ওঠে কাঁচা টিনশেড থেকে ইটের দরদালান।যবনিকাহীন ধারাবাহিকের চরিত্রগুলো আজও
অসি ঝলকিয়ে অভিষেক করে ক্ষুধিত সরফরাজ
মারে কত রাজা, উজির-নাজির, মরে যায় মহারাজও;
বেঁচে থাকে শুধু রাজকুমারের সাধের পক্ষীরাজ! |
আবিদ আনোয়ার | চিন্তামূলক | ধীরে ধীরে হাট ভাঙছে,
অন্ধকার টেনে ধরছে দিগন্তের ফিকে লালসালু--
ডেকেছি বিস্তর তবু কেউ এসে বলে নাই আমি কার খালু!উল্লোল বাজারি শব্দে ডুবে গেছে হার্দ্য এই ডাক,
বিপণি বিতান থেকে মাছের মহাল, মায় অন্ধগলি ঘুরেছি বেবাক;
কানফাটা শোরগোলেও কেউ কিছু ভোলে নাই কার কী ভূমিকা:
লাভ বুঝে দর হাঁকে বিক্রেতারা,
ক্রেতা কেনে দেখে দেখে ফর্দে কী কী লিখা।
দুরস্ত সাহেব-সুবো, মলিন ভিখিরি থেকে উলঙ্গ টোকাই
এ-হাটে সবাই ব্যস্ত--আমি শুধু দিগ্ভ্রান্ত কিছু মনে নাই
কী করতে এসেছি আর হারিয়েছি কাকে নাকি নিজেকেই খুঁজি!
ছিলো কি আমার কোনো ঠিকানা ও নিজস্ব ঠিকুজি?জানিও না এই হাটে কে আছেন এমন দয়ালু
আমাকে যাবার আগে ঠিকঠাক বলে দেবে আমি কার খালু! |
আবিদ আনোয়ার | প্রেমমূলক | আসর ভরা নারী-পুরুষ,
গাইছে ভালো শিবু কীর্তনিয়া --
বাহুলগ্ন তুমি ও আমি আবেগে আপ্লুত
শিবু যখন বিস্তারিলো রাধার পরকীয়া
হঠাৎ দেখি তোমার হাত আমার মুঠোচ্যূত!দূরের কোনো বাদাড় থেকে বুনো-ফুলের ঘ্রাণ
শুঁকতে গিয়ে চেনা গোলাপ ঠেকছিলো কি বাসি?
শিবুর সুরে শুনছিলে কি বেগানা আহ্বান?
পাশের কোনো বাড়িতে বাজে ব্রজের পোড়া বাঁশি!সেই যে কবে তোমার চোখে পদ্মদীঘি দেখে
ভেবেছিলাম এর গহীনে রত্ন আছে জমা
ডুব-সাঁতারে অতল জলে তুলতে গিয়ে একে
হাতড়ে দেখি কিছু তো নেই, ক্লেদজ নর্দমা! |
আবিদ আনোয়ার | মানবতাবাদী | নারান্দির নূরী পাগলি রাতদিন চষে ফেরে সমস্ত শহর,
পথের সম্রাজ্ঞী যেন, বহুকাল পথই তার ঘর।
সে এখন বৃন্তচ্যুত পাপড়ি-ছেঁড়া অবিন্যস্ত ফুল:
পাথুরে ভাস্কর্যে কারা পরিয়েছে ছিঁড়া-তেনা, এলোমেলো চুল।
ক্লেদে ও চন্দনে মাখা পুরুষ্ট উরুতে, অবারিত পিঠে
নিশ্চিত দোররার ঘায়ে চিত্রাঙ্কিত বাদামী কালশিটে।একদা রমণী ছিলো, হয়তো ছিলো স্বামী ও সন্তান,
‘ভাবী’ ডেকে তৃপ্তি পেতো মুদি ও বেপারী থেকে পাড়ার মস্তান;
অথবা হয়নি বিয়ে, ছিলো কোনো বা-বাবার উছল কুমারী,
নয়তো সে অন্ধকারে বেড়ে-ওঠা অন্য কোনো নারী।কী হবে এসব জেনে, এখন অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি মিছেÑ
প্রায়ই দেখি শূন্যমুঠো আগলে রেখে নিতম্বের পিছে
কী এক সম্পদ যেন লুকোতে লুকোতে বলে “দিমু না দিমু না!
চা’য়া কী দেহস বেডা, দোজহের লাকড়ি আমি, দেহা বড় গুণাহ!
তোগোর মতলব জানি: হাঃ হাঃ হোঃ হোঃ হিঃ হিঃ...
আচ্ছা তবে ক’ তো দেহি এই হাতে কী?কখনো উৎসুক হয়ে কেউ যদি বলে দেখি কী এমন ধন!
মুঠি খুলে নূরী বলে:
ক্যান্ তোর চক্ষু নাই? এই দ্যাখ, আমার যৈবন... |
আবিদ আনোয়ার | চিন্তামূলক | স্রোতে তোমার জন্ম, তুমি স্রোতেই হবে লীন;
ফল্গুধারা নীরবে বয় সাড়াশব্দহীন।
হাট বসালে ক্রেতাও জোটে, খৈ ছিটালে পাখি;
নির্মাতাই জানে কেবল পণ্যে কত ফাঁকি!কালের ডামাডোলের ফাঁকে চক্ষে দিয়ে ধুলো
ভাবছো তুমি গানের সাথে বিকাবে শোরগোলও?
প্রাত্যহিকে রঙ মাখিয়ে শাশ্বতকে জয়
করাও যাবে--জানতে হবে রঙের পরিচয়।কোথায় তুমি জানলা খোলো আদপে নাই ঘর;
যুগ চেনো না কী করে তবে আনো যুগান্তর?স্রোতে তোমার জন্ম, তুমি স্রোতেই হবে লীন;
ফল্গুধারা নীরবে বয় সাড়াশব্দহীন। |
আবিদ আনোয়ার | প্রকৃতিমূলক | নিঝুমদ্বীপের মৎস্যকন্যা কেঁদে কেঁদে অবিরল
ঊর্মিমুখর উপসাগরের বাড়িয়ে চলেছে জল।
হয়তো কোথাও ঘটে গেছে কোনো সমূহ সর্বনাশ!
তা নাহলে কেন উপকূলে ভাসে তরুণ তিমির লাশ?নিঝুমদ্বীপের নিঝুমতা খাবে আধুনিক নৌঘাঁটি
এত বিক্ষোভে ফুুঁসে ওঠে তাই কাটা-পাহাড়ের মাটি!
আন্তঃদেশীয় প্রপেলার খাবে দরিয়ার ঘন নীল
কান্নার মতো করুণ কণ্ঠে কী বলে শঙ্খচিল?নিঝুমদ্বীপের প্রান্তিক জেলে রুপালি স্বপ্ন ফেলে
ছেঁড়া জাল নিয়ে পারে বসে ভাবে শূন্য দৃষ্টি মেলে
ভেসে-ডুবে কত মশকরা করে অচেনা শুশুক-দল
সাদা প্রবালের বুক ফুঁড়ে ঢোকে কৃষ্ণ ধাতব নল।বারুদগন্ধী রোহিঙ্গা নারী বোমার মতন বুক
সব্জির ঝাঁপি ফেলে দিয়ে হাঁটে কাঁধে নিয়ে বন্দুক!সাগর থাকুক সাগরের মতো অরণ্য থাক বন--
প্রকৃতিকে মেরে এর চেয়ে দামী পাবে না গুপ্তধন! |
আবিদ আনোয়ার | মানবতাবাদী | পউষের ঘাসে পরীর পেসাব !
বাতাস ধরেছে বরফের ভাব,
ফাটা পায়ে হেঁটে হাল নিয়ে যায় ক্ষিপ্ত সুন্দরালি―
বিগত রাতের ব্যর্থতা ভাবে:
কী যেন কীসব দেখেছিলো খা’বে,
পাঁচন উঁচিয়ে বিড়বিড় করে গাইটাকে দেয় গালি:বাঁয়ে ক’লে দেহি ডানমুহি যাস,
মইত্যার মা’র দেমাগ দেহাস,
হেট হেট হট, সিধা অ’য়া চল্, ফাডায়া ফালামু বেডি;
মেয়া-মানুষের মন বোঝা ভার
দরদ বোঝে না দিল-কলিজার
পরান দিলেও ফুঁস মারে য্যানো মনুমোড়লের জেডি !হায়রে কপাল ! দোষ ধরি কার,
একবেলা ভাত, দুই বেলা মাড়,
মইত্যার পেডে যাই কিছু ঢোহে কিরমিরা খা’য়া ফ্যালে―
জমিনে ঢোহে না লাঙলের ফাল
মাডি য্যানো দেও-দানবের ছাল
বানে-ডোবা জমি তা-ও ভাসি’ ওডে মরশুম চলি’ গ্যালে।একাত্তরের যুদ্ধ করিছি
দেশের জন্যি অস্ত্র ধরিছি
কান ভরি’ হুনি হগলে আমারে মুক্তিযোদ্ধা ডাহে !
চিল্লায় কারা ‘চেতনা চেতনা’
নেতায়া পড়িছে গোখরোর ফণা―
চেতনা খা’য়া কি কারো কোনোদিন পেড ভরে কও বাহে ? |
আবিদ আনোয়ার | চিন্তামূলক | হয়তো এখনও আছি অর্ধস্ফুট গোলাপের মতো--
বোঝেনি শরীর-সত্তা কাকে বলে পূর্ণ জাগরণ;
দরিদ্র ইন্দ্রিয়গুলো চিনেছে যে বস্তুবাস্তবতা
কখনও জাগ্রত হলে চিনে নিতো আরেক জীবন।যদি এ-রহস্যমালা কোনোদিন এই গূঢ় অন্তর্বাস খোলে
হয়তো দেখবো কিছু বর্গক্ষেত্র ঢুকে বসে আছে
অসংগত পৃথিবীর বেমক্কা বর্তুলে:
প্রকৃত রাজার কাঁধে গোলামের তকমা তুলে দিয়ে
গোলাম রাজত্ব করে জগদ্দল প্রভুত্বের পতাকা উড়িয়ে।
দিব্যদৃষ্টি খুলে গেলে তুমি দেখে নিয়ো
জীবন কামনা করে যা কেবল কবিদের প্রিয়;
মানুষের রিপাবলিকে প্লেটোদেরই প্রয়োজন নাই,
বহুকাল ভুল করে খাকিদের কুচকাওয়াজে বেজেছে শানাই।কোনোদিন সত্যি সত্যি ঘোর কেটে গেলে
তোমারও সিঁথির নিচে দেখা যাবে নাগিনীর টিকা,
রূপের নিকেলে ঢেকে হীন কোপনতা ঘর করো কামার্ত চণ্ডিকা।
নারীর প্রতিমা গড়তে ঈশ্বরের মহামন্ত্রে হয়েছিলো ভুল:
উরু-নাভি-বুক আর মুখের লাবণ্য এঁকে সাত-তাড়াতাড়ি
পৃথিবীতে ছেড়েছেন মোহময়ী খড়ের পুতুল
(তখনও ভেতরে কিছু কুটো রয়ে গেছে!)
এবং এদেরই সঙ্গে আমাদের বহু ব্যর্থ রজনী কেটেছে।এইসব অর্ধনারী পারে শুধু উস্কে দিতে
আলুথালু যৌবনের রুপালি বমন;
নারীর সান্নিধ্য দেবে আরো এক শুদ্ধ শিহরণ
বাৎসায়ন জানে না যা, আফ্রোদিতি আছেন আঁধারে--
এমন রমণী শুধু কবিরাই গড়ে নিতে পারে।আমাকে বিশ্বাস করো কবিতার দিব্যি দিয়ে বলি:
সাক্ষী সেই কাহ্নু থেকে অধুনার এলো-পদাবলি:
শিল্পের জলাঙ্গী জুড়ে গুটিকয় রিক্ত পাতিহাঁস
যেন কিছু ডাঙার গুইসাপ অকথ্য উল্লাসে করি ব্যর্থ জলকেলি!
এসব বুঝবে তুমি
শাশ্বতীর সুকান্ত মরাল যদি কোনোদিন সত্যি ধরে ফেলি।বস্তুর খোলসকেই ভেবে নিয়ে খণ্ড খণ্ড রূপের মহিমা
কেবল বাড়িয়ে চলি আরোপিত উপমা ও প্রতীকের সীমা;
হাজার বছরে তাই পেয়েছি কেবল কিছু প্রতিতুলনার কবি,
জন্মান্ধ শিল্পীর আঁকা এলোমেলো জীবনের ছবি।আরেক ঈশ্বর চাই আমারই চৈতন্যজাত সত্য দিয়ে গড়া;
পৃথিবীতে গড়ে নেবো শব্দের অপ্সরী আর কথার অমরা। |
আবিদ আনোয়ার | চিন্তামূলক | পৌরানিক সরীসৃপে ভরে গেছে আমার আঙিনা--
ওদের লেলিহ জিহবা দেখে-দেখে উপমার খুঁজে
প্রায়শ ঘর্মাক্ত হয়ে পেয়ে যাই অবচেতনায়:
ফিতানৃত্যে মেতে আছে অজস্র ডাকিনী, আর
আমাকেই ঘিরে যেন আয়োজিত ভয়াল উৎসব ।মাঝেমাঝে মনে হয় আমি সেই পাপিষ্ঠ বৃষভ
কলার পাতায় লেখা ম্রো-য়েদের ধর্মগ্রন্থ খেয়ে বসে আছি,
এখন বলির ষাঁড় হতে আর শঙ্কা কেন তবে?তবু ইচ্ছে বলে উঠি আকর্ণবিস্তৃত কোনো সুতীব্র চিৎকারে:
ওহে, তোমরা কে কোথায়,
আমাকে উদ্ধার করো ভেঙে এই ভীতিকর বীভৎস বেষ্টনী । |
আবিদ আনোয়ার | চিন্তামূলক | কখনো নিবিষ্টমনে নোনাধরা দেয়ালে তাকালে
অথবা যখন দেখি শকুনেরা ডানা ঝাড়ে রক্তবর্ণ শিমুলের ডালে
তোমার চিত্রের চেয়ে বেশি দামী শিল্প চোখে পড়ে--
ছাঁটো এ রবীন্দ্র-দাড়ি, অযথা ভড়ং কেন ঝোলা আর মলিন খদ্দরে?আসলে তোমার চেয়ে প্রকৃত বাউণ্ডুলে এই শরতের মেঘ
ভেতরে কান্নায় ভেজা, চেপে রেখে তবু তার সমূহ আবেগ
বাউল-স্বভাবে ঘোরে--এবং এই ঔদাসীন্য তাকে শোভা পায়:
নীলের ক্যানভাসে দেখি নিজেই চিত্রিত হয়ে
কী সহজে শিল্প হয়ে যায়!তোমার ইজেলে কত রঙ ধরে জানি সেও হাঁড়ির খবর,
প্রকৃত জলের ছবি জলরঙে এঁকেছে কি কোনো চিত্রকর?
দেখেছি রোদেল দিনে মাঝেমাঝে গূঢ় কার তুলি
অনায়াসে এঁকে ফেলে অস্তরাগে বেজে-ওঠা রঙিন গোধূলি।
সোহেলীর ঠোঁট দেখে লিওনার্দো দ্যভিঞ্চিও হারাবেন দিশা,
হাসির বিশুদ্ধ কলা শিখে নেয় ওকে দেখে ব্যর্থ মোনালিসা!খুঁটিতে ছাগল বেঁধে এইসব আঁকিবুকি ছাড়ো--
সাগ্রহে জীবন প’ড়ে আমি আঁকি শব্দচিত্র, তুমি কি তা পারো? |
আবিদ আনোয়ার | চিন্তামূলক | পরিচয়পত্রে কোনো সনাক্ত-চিহ্নের কথা কখনো লিখি না
বস্তুতই হাজার মুখের ভিড়ে আমাকে আলাদা করে চেনা যায় কি না
এখনও নিশ্চিত নই:
শ্রীপুরের বড় মীর্জা, রঘুবাবু, দীপালি বাড়ই
থেকে কী অর্থে ভিন্ন আমি বলেনি তা' কেউ
অনাদি মানবস্রোতে বহমান অন্যতম ঢেউ
মিশে আছি জীবনের ফেনা ও কল্লোলে;
বুঝি না অন্ধের মতো কোন্ লগ্নে জন্ম কার কোলে ।মাঝেমাঝে নিজেকেই প্রশ্ন করি: তুই কোন্ দেশী,
কোন্ গাঁয়ে বাড়ি তোর, কে কে প্রতিবেশী?
কোন্ বংশে জন্মেছিলি - মিয়া, মীর্জা, খন্দকার, জেলে?
গীতা না বাইবেল নাকি কোরান শরীফ ছিলো মায়ের রেহেলে?
আছিস অজ্ঞাতবাসে নাকি খুব দোর্দণ্ড প্রতাপে?
সাহিত্যবেত্তারা তোকে মাপে কোন্ দশকের মাপে?
কে যেন ভেতর থেকে ব'লে ওঠে: জ্বী না,
আমি শুধু জন্ম বুঝি প্রজন্ম বুঝি না ।বিশাল সমুদ্র জুড়ে ওঠে-পড়ে ক্লান্তিহীন ঢেউ
কোনোটা সনাক্ত ক'রে বলেছে কি কেউ:
"অই যে, অইটা দেখো, দৈর্ঘ্যেপ্রস্থে বেশ!"
কে-ঢেউ অমান্য ক'রে অনিবার্য বায়ুর আদেশ
বলেছে "অনন্য হবো, আমার ভেতরে চাই আরো বেশি জল?"
মূলতই ঢেউ মানে সমান জলের স্ফীতি, অভিন্ন কলকল,
খোঁজে একই তট,
অবশেষে মাথাকুটে বিরস বালুতে লুপ্ত হয় গতির দাপট ।জীবনের উপমাও অনন্ত সৈকতমুখি তরঙ্গ সফেন:
খণ্ড খণ্ড একা তবু কেমন একাত্ম দেখো চুকিয়ে লেনদেন
সারিবন্দী শুয়ে আছে পাপী ও পরহেজগার, জমিদার, প্রজা,
দাদী-নাত্নী, খালা-খালু, পিতা ও আত্মজা,
কামেল পীরের সাথে নগরীর ধড়িবাজ ঠক
এবং তাদের পাশে কোনোদিন আমি হবো আরেক ফলক । |
আবিদ আনোয়ার | চিন্তামূলক | নিজেরই দুধের ভাণ্ডে মাঝেমাঝে লাথি মারে ছৈরতের গাই--
কারণ খোঁজো না যদি আকষ্মাৎ কোথাও পালাই ।আমি এক পক্ষিণীকে চিনি
যে তার খয়েরি ডিমে ক'সপ্তাহ তা দিয়েছে প্রায় প্রতিদিনই,
তারপর হঠাৎ উধাও--
পড়ে আছে খড়কুটো, তুলার বলের মতো অর্ধস্ফূট একজোড়া ছাও ।কী এমন হয়েছিলো? বড়জোর এই বলা যায়:
হয়তো আকাশ তাকে ডেকেছিলো মৌন ইশারায়!আমাকেও যেতে হবে, হয় যদি হোক পরপারে--
আমি ফের জন্ম নেবো অন্য কোনো সুতীব্র চিৎকারে । |
আবিদ আনোয়ার | প্রেমমূলক | তোমাকে দেখেনি মধ্যযুগের নিপুণ পটুয়া,
অজন্তা কিবা ইলোরার ভাস্কর--
তাহলে দেখতে শত ক্যানভাসে,
ব্রোঞ্জে-পিতলে কষ্টিপাথরে,
টেরাকোটা-কাঠ-সোনার পুতুলে
তুমি সাজিয়েছো পুরাকীর্তির সবগুলো যাদুঘর!কৃষ্ণের পাশে যে আছে দাঁড়িয়ে
যৌবনবতী পাথুরে-স্তনের নারী
লজ্জায় ভেঙে খান খান হবে
তুমি যদি শুধু একটু সাহসে
জোড়ামূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে
খুলে ফেলো এই শাড়ি!তোমাকে মানাতো প্রত্নবেদীতে পঞ্চালিকায়
গোপীচন্দনে তিলক পরালে বৈষ্ণব কবি,
কোলাহলময় বিশ-শতকের শেষপাদে কেন এলে?
নষ্ট কালের ভ্রষ্ট প্রেমিক
কী দিয়ে তোমার বন্দনা করি?
নারী-কীর্তনে ব্যবহৃত সব উপমা দিয়েছি ফেলে!তোমাকে দেখেনি চিতোরের রাজা,
রূপের পূজারী রসিক রত্নসেন--
তাহলে দেখতে নিদারুণ ক্ষোভে
মিথ্যুক সেই হীরামন পাখি,
এমনকি প্রিয় পদ্মাবতীকে এক-শূলে চড়াতেন!নর্তকী নও, তোমার চলার পথ জুড়ে তবু
প্রবাহিত তুমি নৃত্যের নানা মুদ্রায়:
দ্যভিঞ্চি আর হেনরী’র নারী
আমাদের প্রিয় রাজহংসীরা
তোমাকে দেখেই গ্রীবাভঙ্গির অসঙ্গতিকে শোধরায়।তুমি চলে গেলে ঘর জুড়ে হাঁটে তোমার প্রতিমা,
সারা বাড়ি হয় পরাবাস্তব কোনারক ও খাজুরাহো:
সাজের টেবিলে-বিছানা-বালিশে,
ফাঁকা করিডোরে-বিরান হেঁসেলে
থেকে থেকে জলে ‘তুমি নেই’ এই সত্যের দাবদাহ। |
আবিদ আনোয়ার | চিন্তামূলক | আমি যার প্রতিদ্বন্দ্বী
তিনি এক উলঙ্গ সাঁওতাল:
কেবল শিশ্নের কাছে ঝুলে আছে
একপ্রস্ত খাটাশের ছাল;
ধনুক বাগিয়ে তিনি হেঁটে যান
তাক-করে লক্ষ্যভেদী তীর,
বুক ভরা চুল আর পাথরের বাহু,
উরু ও জঙ্ঘায় তিনি রীতিমতো বীর ।'তোমরা কোনঠে বাহে'
বলে যদি ডাক দেন কখনো হঠাৎ
বল্লমের ফলা হয়ে চোখের পলকে
উত্তোলিত হতে পারে লক্ষ লক্ষ হাত!পক্ষান্তরে একা আমি
যৌবনেই লোলচর্ম, নানাবিধ ব্যামোয় কাতর,
উপরন্তু মগজের প্রতিকোষে, মেধায়-মননে
সারাক্ষণ লেগে আছে নান্দনিক জ্বর ।স্বপ্নে ও বাস্তবে এই চিত্রকল্প পেয়েছে আমাকে
যখন যেদিকে যাই পিছে পিছে যায়,
ঘুমের গভীরে ঢুকে কুটিল কৌশলে
উমেদার গুপ্তচর থাকে পাহারায় ।কোথাও পালিয়ে যাবো সে-গুড়েও বালি;
অগত্যা দিয়েছি ছুঁড়ে নিদারুণ ক্ষোভে
ঝটকা-থুতুর মতো গোটাকয় কলমের কালি । |
আবিদ আনোয়ার | চিন্তামূলক | 'গোলাপ গোলাপ' ব'লে
বাগানে ঢুকেই দেখি শুধু কিছু পাপড়ি ছেঁড়া আমাদের কাজ ।
সমগ্রকে কোনোদিন ছুঁতেও পারি নাম,
খণ্ডাংশের মালিকানা নিয়ে শুধু শুধু হীন চতুরালি,
কোনোমতে ছলায়-কলায় দীনতার লজ্জা ঢাকা শুধু ।অনঙ্গ দূরের কথা, বিছানার ফুল্ল নারী ইশারায় ডাকে
মিলন ও শৃঙ্গারে তাকে কতটুকু পাই?
হয়তোবা কাছে গিয়ে
প্রথমে চিবুক ছুঁই
তারপর হাত
বুকের যুগল চাঁদ
কপোলের তিল
খণ্ড খণ্ড করে দেখি
কখনো নিতম্বশোভা
অধরের বাঁক,
জলজ শিল্পের মতো নাকে-জমা ঘামের মহিমা ।
নারীর কাটাক্ষে থাকে যে মহান শিল্পের সুষমা
তাকেও কস্মিনকালে সবটা বুঝি না
তবুও গর্বিত চোখে অবাক তাকিয়ে থাকি,
'সুন্দর সুন্দর' ব'লে কখনো জাপটে ধরি;
জবরদখলকৃত ভূখণ্ডের মতো কনক জঘনে
ব্যক্তিগত পতাকা উড়িয়ে বলি: এ নারী আমার!হয়তোবা আমরা নিজে এরকম মেধার দারিদ্র্যে
মূলতই অন্ধ তবুও সত্যের হাতি দেখি:
ছানিপড়া দৃষ্টিপথে আবছা-আবছা কেঁপে ওঠে চেনা নরলোক
অথচ সত্তায় দোলে এলোমেলো সুন্দরের বিমূর্ত প্রতিমা
যেন কোনো বিকেলের প্রসন্ন পুকুরে
জলের আর্শিতে ভাঙা সখিনার মুখ । |
আবিদ আনোয়ার | প্রেমমূলক | আমার কদর্য হাতে ছোঁবো না এ শুদ্ধতম ফুল--
এমন মুগ্ধতাবশে দূরে স'রে দেখি
ধরা দিলে যাকে সে তো প্রকৃতই দাঁতাল শুয়োর
তোমার সৌন্দর্য খুঁড়ে খোঁজে তার প্রিয় কন্দমূল।'ভালোবাসি' এই শব্দে ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ শুনি আমি;
কিন্নরীর পিছে ঘোরে কার্তিকের কামার্ত কুকুর--
এসব জানালে তুমি শোনাবেই মুখস্ত সংলাপ:
"চিনি না আপনে কেডা, ও আমার বিবাহিত স্বামী!"হায় স্বামী কলমা-পড়া, হে সমাজ, হায়রে বিবাহ!
বৃন্তচ্যুত কত ফুল ভালোবেসে নিথর ফুলদানি
সহজে বিকিয়ে যায় -- কেউ কেউ নিপুণা পার্বতী;
পড়ে শুধু দেবদাস, একা কাঁদে চিতাগ্নির দাহ । |
আবিদ আনোয়ার | প্রকৃতিমূলক | পরাবাস্তব বৃষ্টিতে ভেজে বগলের বর্ষাতি--
শুকনো আষাঢ়, মিছে গর্জায় আকাশের কালো হাতি;
কখনো ধূসর নীলিমায় শু’য়ে গর্ভিনী কোনো মোষ
হতাশার মতো প্রসব করছে সাদা-সাদা খরগোশ!এ-আষাঢ় যাবে সাদাকালো আর নীলের কোলাজ দেখে?
বর্ষাসংখ্যা সাময়িকী জুড়ে মেঘের পদ্য লে’খে?
ঈশানের দিকে চেয়ে দেখি যেই জমছে সম্ভাবনা
‘বৃষ্টি হবে না’ ঘোষণায় বলে ঢাকা বেতারের খনা।অবচেতনের কোথায় তবুও কদমের ঘ্রাণ পাই:
অলীক জলের শিহরণে কাঁপে করিডোরে বনসাই--
স্মৃতির ভেতরে পাঠশালা ভেজে, থকথকে বইখাতা;
আমি আর সাজু--মাথার উপরে যৌথ কলার পাতা।ভেজা কিশোরীর শরীরের ঘ্রাণে সম্বিতে ফিরে দেখি
চৈত্রের মতো গদ্যরমণী চোখ ঠারে তার মেকি।
বৃথা শৃঙ্গারে শরীর কাঁপিয়ে শুয়ে পড়ি নিজ খাটে,
কামনার জলে “বঁধুয়া ভিজিছে দেখিয়া পরান ফাটে...”করাতকলের শব্দেরা বোনে বর্ষাধুমল রাত--
আগামী শাওন বৃথা যাবে না তো, হবে কি বৃষ্টিপাত? |
আবিদ আনোয়ার | রূপক | গর্জমান সমুদ্রের পারে ভরাট পূর্ণিমা--
অসীমের দৃশ্য দেখি আমি আর সীমা ।
পাশে দুই ছায়ামূর্তি - যুগপৎ ক্ষ্যাপা ও নিউটন
পরশ পাথর খোঁজে, নেড়ে দেখে অনির্ণেয় নুড়ির গঠন ।
তরল হাসিতে বড়ো ফেটে পড়ছে সমুদ্রের জল:
তিনভাগ সত্যেরও যেন দুইভাগ করেছে দখল
সেই দম্ভে ফুলে উঠে ছুঁতে চায় আকাশের চাঁদ--
আসলে দেখাতে চায় ব্যাপ্তি তার কতটা অগাধ ।
কে এক সমুদ্রচারী পাখি তার ভেজাকণ্ঠে ডেকে বলে: এ্যাই,
চলো আজ ফিরে যাই, এ-দেখার শেষ কিছু নেই!
সীমা তার পা বাড়ালে চেয়ে দেখি ম্লান হচ্ছে ক্রমশ চন্দ্রিমা,
আমি তার নাম ভুলে তারস্বরে ডেকে উঠি: দাঁড়াও অসীমা...
কী আশ্চর্য চাঁদ নিজে চলে এলো আমার সাথে,
সঙ্গে দুই ছায়ামূর্তি ঘনঘন তাকায় পশ্চাতে ।
সমুদ্রকে ডেকে বলি: এ-রাতের জ্যোৎস্নাটুকু আমারই বেবাক;
তুই বেটা অহংকারী, অন্ধকারে হুমড়ি খেতে থাক । |
বন্দে আলী মিঞা | প্রকৃতিমূলক | আমাদের ছোটো গাঁয়ে ছোটো ছোটো ঘর
থাকি সেথা সবে মিলে কেহ নাহি পর।
পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই
একসাথে খেলি আর পাঠশালে যাই।
হিংসা ও মারামারি কভু নাহি করি,
পিতা-মাতা গুরুজনে সদা মোরা ডরি।
আমাদের ছোটো গ্রামে মায়ের সমান,
আলো দিয়ে বায়ু দিয়ে বাঁচাইছে প্রাণ।
মাঠভরা ধান আর জলভরা দিঘি,
চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি।
আমগাছ জামগাছ বাঁশ ঝাড় যেন,
মিলে মিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন।
সকালে সোনার রবি পূব দিকে ওঠে
পাখি ডাকে, বায়ু বয়, নানা ফুল ফোটে। |
গোবিন্দচন্দ্র দাস | প্রকৃতিমূলক | ভাওয়াল আমার অস্থিমজ্জা
ভাওয়াল আমার প্রাণ!
তাহার শ্যামল বন, মরকত-নিকেতন,
চরে কত পশুপাখী নিশি দিনমান,
মহিষ ভল্লুক বাঘ, প্রজ্জ্বলিত হিংসারাগ
কঙ্করে নখর শৃঙ্গ ক্ষুরে দেয় শাণ।
তার সে পিকের ডাকে, জোস্না জমিয়া থাকে,
যামিনী মূরছা যায় শ্যামা ধরে তান!
খঞ্জন খঞ্জনী নাচে, বনদেবতার কাছে,
পাপিয়া দোয়েল করে মধুমাখা গান। |
গোবিন্দচন্দ্র দাস | স্বদেশমূলক | জননী গো জন্মভূমি তোমারি পবন
দিতেছে জীবন মোরে নিশ্বাসে নিশ্বাসে!
সুন্দর শশাঙ্কমুখ, উজ্জ্বল তপন,
হেরেছি প্রথমে আমি তোমারি আকাশে।
ত্যাজিয়ে মায়ের কোল, তোমারি কোলেতে
শিখিয়াছি ধূলি‐খেলা, তোমারি ধূলিতে।
তোমারি শ্যামল ক্ষেত্র অন্ন করি দান
শৈশবের দেহ মোর করেছে বর্ধিত।
তোমারি তড়াগ মোর রাখিয়াছে প্রাণ,
দিয়ে বারি, জননীর স্তন্যের সহিত।
জননীর করাঙ্গুলি করিয়া ধারণ,
শিখেছি তোমারি বক্ষে বাড়াতে চরণ।
তোমারি তরুর তলে কুড়ায়েছি ফল,
তোমারি লতার ফুলে গাঁথিয়াছি মালা।
সঙ্গীদের সঙ্গে সুখে করি কোলাহল,
তোমারি প্রান্তরে আসি করিয়াছি খেলা।
তোমারি মাটিতে ধরি জনকের কর,
শিখেছি লিখিতে আমি প্রথম অক্ষর।
ত্যাজিয়া তোমার কোল যৌবনে এখন,
হেরিলাম কত দেশ কত সৌধমালা।
কিন্তু তৃপ্ত না হইল এ দগ্ধ নয়ন,
ফিরিয়া দেখিতে চাহে তব পর্ণশালা।
তোমার প্রান্তর নদী, পথ, সরোবর,
অন্তরে উদিয়া মোর জুড়ায় অন্তর।
তোমাতে আমার পিতা পিতামহগণ,
জন্মেছিল একদিন আমারই মতন।
তোমারি এ বায়ু তাপে তাঁহাদের দেহ
পুষেছিলে, পুষিতেছ আমায় যেমন।
জন্মভূমি জননী আমার যথা তুমি,
তাঁহাদেরও সেইরূপ তুমি—মাতৃভূমি।
তোমারি ক্রোড়েতে মোর পিতামহগণ
নিদ্রিত আছেন সুখে জীবলীলা‐শেষে
তাঁদের শোণিত, অস্থি সকলি এখন
তোমার দেহের সঙ্গে গিয়েছে মা মিশে।
তোমার ধূলিতে গড়া এ দেহ আমার
তোমার ধূলিতে কালে মিশাবে আবার। |
হেলাল হাফিজ | মানবতাবাদী | আমি কোনো পোষা পাখি নাকি?
যেমন শেখাবে বুলি
সেভাবেই ঠোঁট নেড়ে যাবো, অথবা প্রত্যহ
মনোরঞ্জনের গান ব্যাকুল আগ্রহে গেয়ে
অনুগত ভঙ্গিমায় অনুকূলে খেলাবো আকাশ,
আমি কোনো সে রকম পোষা পাখি নাকি?
আমার তেমন কিছু বাণিজ্যিক ঋণ নেই,
কিংবা সজ্ঞানে এ বাগানে নির্মোহ ভ্রমণে
কোনোদিন ভণিতা করিনি। নির্লোভ প্রার্থনা
শর্ত সাপেক্ষে কারো পক্ষপাত কখনো চাবো না।
তিনি, শুধু তিনি
নাড়ীর আত্মীয় এক সংগঠিত আর অসহায় কৃষক আছেন
ভেতরে থাকেন, যখন যেভাবে তিনি আমাকে বলেন
হয়ে যাই শর্তাহীন তেমন রাখাল বিনা বাক্য ব্যয়ে।
কাঙাল কৃষক তিনি, জীবনে প্রথম তাকে যখন বুঝেছি
স্বেচ্ছায় বিবেক আমি তার কাছে শর্তাহীন বন্ধক রেখেছি।
৮.২.৮২ |
হেলাল হাফিজ | প্রেমমূলক | কেউ জানে না আমার কেন এমন হলো।
কেন আমার দিন কাটে না রাত কাটে না
রাত কাটে তো ভোর দেখি না
কেন আমার হাতের মাঝে হাত থাকে না কেউ জানেনা।
নষ্ট রাখীর কষ্ট নিয়ে অতোটা পথ একলা এলাম
পেছন থেকে কেউ বলেনি করুণ পথিক
দুপুর রোদে গাছের নিচে একটু বসে জিরিয়ে নিও,
কেই বলেনি ভালো থেকো সুখেই থেকো
যুগল চোখে জলের ভাষায় আসার সময় কেউ বলেনি
মাথার কসম আবার এসো
জন্মাবধি ভেতরে এক রঙিন পাখি কেঁদেই গেলো
শুনলো না কেউ ধ্রুপদী ডাক,
চৈত্রাগুনে জ্বলে গেলো আমার বুকের গেরস্থালি
বললো না কেউ তরুন তাপস এই নে চারু শীতল কলস।
লন্ডভন্ড হয়ে গেলাম তবু এলাম।
ক্যাঙ্গারু তার শাবক নিয়ে যেমন করে বিপদ পেরোয়
আমিও ঠিক তেমনি করে সভ্যতা আর শুভ্রতাকে বুকে নিয়েই দুঃসময়ে এতোটা পথ একলা এলাম শুশ্রূষাহীন।
কেউ ডাকেনি তবু এলাম, বলতে এলাম ভালোবাসি।
১০.৪.৮১ |
হেলাল হাফিজ | মানবতাবাদী | একটা কিছু করুন।
এভাবে আর কদিন চলে দিন ফুরালে হাসবে লোকে
দুঃসময়ে আপনি কিছু বলুন
একটা কিছু করুন।
চতুর্দিকে ভালোবাসার দারুণ আকাল
খেলছে সবাই বেসুর-বেতাল
কালো-কঠিন-মর্মান্তিক নষ্ট খেলা,
আত্মঘাতী অবহেলো নগর ও গ্রাম গেরস্থালি
বনভূমি পাখপাখালি সব পোড়াবে,
সময় বড়ো দ্রুত যাচ্ছে
ভাল্লাগে না ভাবটা ছেড়ে সত্যি এবার উঠুন
একটা কিছু করুন।
দিন থাকে না দিন তো যাবেই
প্রেমিক যারা পথ তো পাবেই
একটা কিছু সন্নিকটে, আত বাড়িয়ে ধরুন
দোহাই লাগে একটা কিছু করুন।
২২.৩.৮১ |
হেলাল হাফিজ | রূপক | তুমি কে হ?
সোনালী ছনের বাড়ি তছনছ করে রাতে
নির্বিচারে ঢুকে গেলে অন্দর-মহলে
বেগানা পুরুষ, লাজ-শরমের মাথা খেয়ে
তুমি কে হে?
তোমাকে তো কখনো দেখিনি আগে এ তল্লাটে
মারী ও মড়কে, ঝড়ে, কাঙ্ক্ষিত বিদ্রোহে।
আমাদের যুদ্ধের বছরে
ভিন্ গেরামের কতো মানুষের পদচারণায়
এ বাড়ি মুখর ছিলো, তোমাকে দেখিনি ত্রি-সীমায়।
চতুর বণিক তুমি আঁধারে নেমেছো এই বানিজ্য ভ্রমণে,
কে জানে কী আছে পাড়া-পড়শীর মনে!
লোভে আর লালসায় অবশেষে আগন্তুক সর্বস্ব হারাবে,
কেন না প্রভাত হলে চারদিকে মানুষের ঢল নেমে যাবে।
২.৩.৮৫ |
হেলাল হাফিজ | চিন্তামূলক | হলো না, হলো না।
শৈশব হলো না, কৈশোর হলো না
না দিয়ে যৌবন শুরু, কার যেন
বিনা দোষে শুরুটা হলো না।
হলো না, হলো না।
দিবস হলো না, রজনীও না
সংসার হলো না, সন্ন্যাস হলো না, কার যেন
এসব হলো না, ওসব আরও না।
হলো না, হলো না।
সন্দুর হলো না, অসুন্দরও না
জীবন হলো না, জীবনেরও না, কার যেন
কিছুই হলো না, কিচ্ছু হলো না।
হলো না। না হোক,
আমি কী এমন লোক!
আমার হলো না তাতে কি হয়েছে?
তোমাদের হোক।দৈনিক যুগান্তর, ঈদ সংখ্যা ২০০৮কাব্য গ্রন্থঃ- কবিতা একাত্তর |
হেলাল হাফিজ | প্রেমমূলক | আগুন আর কতোটুকু পোড়ে ?
সীমাবদ্ধ ক্ষয় তার সীমিত বিনাশ,
মানুষের মতো আর অতো নয় আগুনের সোনালি সন্ত্রাস।
আগুন পোড়ালে তবু কিছু রাখে
কিছু থাকে,
হোক না তা শ্যামল রঙ ছাই,
মানুষে পোড়ালে আর কিছুই রাখে না
কিচ্ছু থাকে না,
খাঁ খাঁ বিরান, আমার কিছু নাই।
৭.২.৮১ |
হেলাল হাফিজ | প্রকৃতিমূলক | তাকানোর মতো করে তাকালেই চিনবে আমাকে।
আমি মানুষের ব্যকরণ
জীবনের পুষ্পিত বিজ্ঞান
আমি সভ্যতার শুভ্রতার মৌল উপাদান,
আমাকে চিনতেই হবে
তাকালেই চিনবে আমাকে।
আমাকে না চেনা মানে
মাটি আর মানুষের প্রেমের উপমা সেই
অনুপম যুদ্ধকে না চেনা।
আমাকে না চেনা মানে
সকালের শিশির না চেনা,
ঘাসফুল, রাজহাঁস, উদ্ভিত না চেনা।
গাভিন ক্ষেতের ঘ্রাণ, জলের কসম, কাক
পলিমাটি চেনা মানে আমাকেই চেনা।
আমাকে চেনো না?
আমি তোমাদের ডাক নাম, উজাড় যমুনা।
৫.১২.৮০ |
হেলাল হাফিজ | চিন্তামূলক | পরানের পাখি তুমি একবার সেই কথা কও,
আমার সূর্যের কথা, কাঙ্খিত দিনের কথা,
সুশোভন স্বপ্নের কথাটা বলো,–শুনুক মানুষ।
পরানের পাখি তুমি একবার সেই কথা কও,
অলক্ষ্যে কবে থেকে কোমল পাহাড়ে বসে
এতোদিন খুঁটে খুঁটে খেয়েছো আমাকে আর
কতো কোটি দিয়েছো ঠোকর,
বিষে বিষে নীল হয়ে গেছি, শুশ্রূষায়
এখনো কী ভাবে তবু শুভ্রতা পুষেছি তুমি দেখাও না
পাখি তুমি তোমাকে দেখাও,–দেখুক মানুষ।
পরানের পাখি তুমি একবার সেই কথা কও,
সময় পাবে না বেশি চতুর্দিক বড়ো টলোমলো
পরানের পাখি তুমি শেষবার শেষ কথা বলো,
আমার ভেতরে থেকে আমার জীবন খেয়ে কতোটুকু
যোগ্য হয়েছো, ভূ-ভাগ কাঁপিয়ে বেসামাল
কবে পাখি দেবেই উড়াল, দাও,–শিখুক মানুষ।
২১.৭.৮০ |
হেলাল হাফিজ | প্রেমমূলক | নিরাশ্রয় পাচঁটি আঙুল তুমি নির্দ্বিধায়
অলংকার করে নাও, এ আঙুল ছলনা জানে না।
একবার তোমার নোলক, দুল, হাতে চুড়ি
কটিদেশে বিছা করে অলংকৃত হতে দিলে
বুঝবে হেলেন, এ আঙুল সহজে বাজে না।
একদিন একটি বেহালা নিজেকে বাজাবে বলে
আমার আঙুলে এসে দেখেছিলো
তার বিষাদের চেয়ে বিশাল বিস্তৃতি,
আমি তাকে চলে যেতে বলিনি তবুও
ফিরে গিয়েছিলো সেই বেহালা সলাজে।
অসহায় একটি অঙ্গুরী
কনিষ্ঠা আঙুলে এসেই বলেছিলো ঘর,
অবশেষে সেও গেছে সভয়ে সলাজে।
ওরা যাক, ওরা তো যাবেই
ওদের আর দুঃখ কতোটুকু? ওরা কি মানুষ?
২.৪.৭০ |
হেলাল হাফিজ | প্রেমমূলক | ব্যর্থ হয়ে থাকে যদি প্রণয়ের এতো আয়োজন,
আগামী মিছিলে এসো
স্লোগানে স্লোগানে হবে কথোপকথন।
আকালের এই কালে সাধ হলে পথে ভালোবেসো,
ধ্রুপদী পিপাসা নিয়ে আসো যদি
লাল শাড়িটা তোমার পড়ে এসো।
১৬.২.৮৪ |
হেলাল হাফিজ | প্রেমমূলক | তোমাকে শুধু তোমাকে চাই, পাবো?
পাই বা না পাই এক জীবনে তোমার কাছেই যাবো।
ইচ্ছে হলে দেখতে দিও, দেখো
হাত বাড়িয়ে হাত চেয়েছি রাখতে দিও, রেখো
অপূণতায় নষ্টে-কষ্টে গেলো
এতোটা কাল, আজকে যদি মাতাল জোয়ার এলো
এসো দু’জন প্লাবিত হই প্রেমে
নিরাভরণ সখ্য হবে যুগল-স্নানে নেমে।
থাকবো ব্যাকুল শর্তবিহীন নত
পরস্পরের বুকের কাছে মুগ্ধ অভিভূত।
১০.৩.৮২ |
হেলাল হাফিজ | স্বদেশমূলক | মারণাস্ত্র মনে রেখো ভালোবাসা তোমার আমার।
নয় মাস বন্ধু বলে জেনেছি তোমাকে, কেবল তোমাকে।
বিরোধী নিধন শেষে কতোদিন অকারণে
তাঁবুর ভেতরে ঢুকে দেখেছি তোমাকে বারবার কতোবার।
মনে আছে, আমার জ্বালার বুক
তোমার কঠিন বুকে লাগাতেই গর্জে উঠে তুমি
বিস্ফোরণে প্রকম্পিত করতে আকাশ, আমাদের ভালবাসা
মুহূর্তেই লুফে নিত অত্যাচারী শত্রুর নি:শ্বাস।
মনে পড়ে তোমার কঠিন নলে তন্দ্রাতুর কপালের
মধ্যভাগ রেখে, বুকে রেখে হাত
কেটে গেছে আমাদের জঙ্গলের কতো কালো রাত!
মনে আছে, মনে রেখো
আমাদের সেই সব প্রেম-ইতিহাস।
অথচ তোমাকে আজ সেই আমি কারাগারে
সমর্পণ করে, ফিরে যাচ্ছি ঘরে
মানুষকে ভালোবাসা ভালোবাসি বলে।
যদি কোনোদিন আসে আবার দুর্দিন,
যেদিন ফুরাবে প্রেম অথবা হবে না প্রেম মানুষে মানুষে
ভেঙে সেই কালো কারাগার
আবার প্রণয় হবে মারণাস্ত্র তোমার আমার।
১৫.২.৭২ |
হেলাল হাফিজ | প্রেমমূলক | যুক্তি যখন আবেগের কাছে অকাতরে পর্যুদস্ত হতে থাকে,
কবি কিংবা যে কোনো আধুনিক মানুষের কাছে
সেইটা বোধ করি সবচেয়ে বেশি সংকোচ আর সঙ্কটের সময়।
হয় তো এখন আমি তেমনি এক নিয়ন্ত্রনহীন
নাজুক পরিস্থিতির মুখোমুখি,
নইলে এতদিন তোমাকে একটি চিঠিও লিখতে
না পারার কষ্ট কি আমারই কম!
মনে হয় মরণের পাখা গজিয়েছে। |
হেলাল হাফিজ | প্রেমমূলক | ইচ্ছে ছিলো তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো
ইচ্ছে ছিলো তোমাকেই সুখের পতাকা করে
শান্তির কপোত করে হৃদয়ে উড়াবো।
ইচ্ছে ছিলো সুনিপূণ মেকআপ-ম্যানের মতো
সূর্যালোকে কেবল সাজাবো তিমিরের সারাবেলা
পৌরুষের প্রেম দিয়ে তোমাকে বাজাবো, আহা তুমুল বাজাবো।
ইচ্ছে ছিলো নদীর বক্ষ থেকে জলে জলে শব্দ তুলে
রাখবো তোমার লাজুক চঞ্চুতে,
জন্মাবধি আমার শীতল চোখ
তাপ নেবে তোমার দু’চোখে।
ইচ্ছে ছিল রাজা হবো
তোমাকে সাম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো,
আজ দেখি রাজ্য আছে
রাজা আছে
ইচ্ছে আছে,
শুধু তুমি অন্য ঘরে।
৭.২.৭৩ |
হেলাল হাফিজ | প্রেমমূলক | ছিল তা এক অগ্ন্যুৎসব, সেদিন আমি
সবটুকু বুক রেখেছিলাম স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রে
জীবন বাজি ধরেছিলাম প্রেমের নামে
রক্ত ঋণে স্বদেশ হলো,
তোমার দিকে চোখ ছিলো না
জন্মভূমি সেদিন তোমার সতীন ছিলো।
আজকে আবার জীবন আমার ভিন্ন স্বপ্নে অংকুরিত অগ্ন্যুৎসবে
তোমাকে চায় শুধুই তোমায়।
রঙিন শাড়ির হলুদ পাড়ে ঋতুর প্লাবন নষ্ট করে
ভর দুপুরে শুধুই কেন হাত বেঁধেছো বুক ঢেকেছো
যুঁই চামেলী বেলীর মালায়,
আমার বুকে সেদিন যেমন আগুন ছিলো
ভিন্নভাবে জ্বলছে আজও,
তবু সবই ব্যর্থ হবে
তুমি কেবল যুঁই চামেলী বেলী ফুলেই মগ্ন হলে।
তার চেয়ে আজ এসো দু’জন জাহিদুরের গানের মতন
হৃদয় দিয়ে বোশেখ ডাকি, দু’জীবনেই বোশেখ আনি।
জানো হেলেন, আগুন দিয়ে হোলি খেলায় দারুন আরাম
খেলবো দু’জন এই শপথে
এসো স্ব-কাল শুদ্ধ করি দুর্বিনীত যৌবনেরে।
৮.১২.৭২ |
হেলাল হাফিজ | স্বদেশমূলক | কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
আমি আর লিখবো না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
ভজন গায়িকা সেই সন্ন্যাসিনী সবিতা মিস্ট্রেস
ব্যর্থ চল্লিশে বসে বলবেন,–’পেয়েছি, পেয়েছি’।
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
পাতা কুড়োনির মেয়ে শীতের সকালে
ওম নেবে জাতীয় সংগীত শুনে পাতার মর্মরে।
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
ভূমিহীন মনুমিয়া গাইবে তৃপ্তির গান জ্যৈষ্ঠে-বোশেখে,
বাঁচবে যুদ্ধের শিশু সসন্মানে সাদা দুতে-ভাতে।
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
আমাদের সব দুঃখ জমা দেবো যৌথ-খামারে,
সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে সমান সুখের ভাগ
সকলেই নিয়ে যাবো নিজের সংসারে।
১৩.১২.৮০ |
হেলাল হাফিজ | প্রেমমূলক | এই তো আবার যুদ্ধে যাবার সময় এলো
আবার আমার যুদ্ধে খেলার সময় হলো
এবার রানা তোমায় নিয়ে আবার আমি যুদ্ধে যাবো
এবার যুদ্ধে জয়ী হলে গোলাপ বাগান তৈরী হবে।
হয় তো দু’জন হারিয়ে যাবো ফুরিয়ে যাবো
তবুও আমি যুদ্ধে যাবো তবু তোমায় যুদ্ধে নেবো
অন্যরকম সংসারেতে গোলাপ বাগান তৈরী করে
হারিয়ে যাবো আমরা দু’জন ফুরিয়ে যাবো।
স্বদেশ জুড়ে গোলাপ বাগান তৈরী করে
লাল গোলাপে রক্ত রেখে গোলাপ কাঁটায় আগুন রেখে
আমরা দু’জন হয় তো রানা মিশেই যাবো মাটির সাথে।
মাটির সথে মিশে গিয়ে জৈবসারে গাছ বাড়াবো
ফুল ফোটাবো, গোলাপ গোলাপ স্বদেশ হবে
তোমার আমার জৈবসারে। তুমি আমি থাকবো তখন
অনেক দূরে অন্ধকারে, অন্যরকম সংসারেতে।
২০.১২.৭৩ |
হেলাল হাফিজ | চিন্তামূলক | কষ্ট নেবে কষ্ট
হরেক রকম কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট !
লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট
পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট,
আলোর মাঝে কালোর কষ্ট
‘মালটি-কালার’ কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট ।
ঘরের কষ্ট পরেরর কষ্ট পাখি এবং পাতার কষ্ট
দাড়ির কষ্ট
চোখের বুকের নখের কষ্ট,
একটি মানুষ খুব নীরবে নষ্ট হবার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট ।
প্রেমের কষ্ট ঘৃণার কষ্ট নদী এবং নারীর কষ্ট
অনাদর ও অবহেলার তুমুল কষ্ট,
ভুল রমণী ভালোবাসার
ভুল নেতাদের জনসভার
হাইড্রোজনে দুইটি জোকার নষ্ট হবার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট ।
দিনের কষ্ট রাতের কষ্ট
পথের এবং পায়ের কষ্ট
অসাধারণ করুণ চারু কষ্ট ফেরীঅলার কষ্ট
কষ্ট নেবে কষ্ট ।
আর কে দেবে আমি ছাড়া
আসল শোভন কষ্ট,
কার পুড়েছে জন্ম থেকে কপাল এমন
আমার মত ক’জনের আর
সব হয়েছে নষ্ট,
আর কে দেবে আমার মতো হৃষ্টপুষ্ট কষ্ট । |
হেলাল হাফিজ | প্রেমমূলক | আমি আর কতোটুকু পারি ?
কতোটুকু দিলে বলো মনে হবে দিয়েছি তোমায়,
আপাতত তাই নাও যতোটুকু তোমাকে মানায়।
ওইটুকু নিয়ে তুমি বড় হও,
বড় হতে হতে কিছু নত হও
নত হতে হতে হবে পৃথক পাহাড়,
মাটি ও মানুষ পাবে, পেয়ে যাবে ধ্রুপদী আকাশ।
আমি আর কতোটুকু পারি ?
এর বেশি পারেনি মানুষ।
৯.১০.৮০ |
হেলাল হাফিজ | মানবতাবাদী | অতো বেশ নিকটে এসো না, তুমি পুড়ে যাবে,
কিছুটা আড়াল কিছু ব্যবধান থাকা খুব ভালো।
বিদ্যুত সুপারিবাহী দু’টি তার
বিজ্ঞানসম্মত ভাবে যতোটুকু দূরে থাকে
তুমি ঠিক ততোখানি নিরাপদ কাছাকাছি থেকো,
সমূহ বিপদ হবে এর বেশী নিকটে এসো না।
মানুষ গিয়েছে ভূলে কী কী তার মৌল উপাদান।
তাদের ভেতরে আজ বৃক্ষের মতন সেই সহনশীলতা নেই,
ধ্রুপদী স্নিগ্ধতা নেই, নদীর মৌনতা নিয়ে মুগ্ধ মানুষ
কল্যাণের দিকে আর প্রবাহিত হয় না এখন।
আজকাল অধঃপতনের দিকে সুপারসনিক গতি মানুষের
সঙ্গত সীমানা ছেড়ে অদ্ভুত নগরে যেন হিজরতের প্রতিযোগিতা।
তবু তুমি কাছে যেতে চাও? কার কাছে যাবে?
পশু-পাখিদের কিছু নিতে তুমুল উল্লাসে যেন
বসবাস করে আজ কুলীন মানুষ।
১০.২.৮২ |
হেলাল হাফিজ | প্রেমমূলক | আমার যত শুভ্রতা সব দেবো,
আমি নিপুণ ব্লটিং পেপার
সব কালিমা, সকল ব্যথা ক্ষত শুষেই নেবো।
২৪.৭.৮০ |
হেলাল হাফিজ | প্রেমমূলক | ০১- “অচল প্রেমের পদ্য”
আছি।
বড্ড জানান দিতে ইচ্ছে করে, – আছি,
মনে ও মগজে
গুন্ গুন্ করে
প্রণয়ের মৌমাছি।
০২- “অচল প্রেমের পদ্য”
কোনদিন, আচমকা একদিন
ভালোবাসা এসে যদি হুট করে বলে বসে,-
‘চলো যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাই’,
যাবে?
০৩- “অচল প্রেমের পদ্য”
তোমার জন্য সকাল, দুপুর
তোমার জন্য সন্ধ্যা
তোমার জন্য সকল গোলাপ
এবং রজনীগন্ধা।
০৪- “অচল প্রেমের পদ্য”
ভালোবেসেই নাম দিয়েছি ‘তনা’
মন না দিলে
ছোবল দিও তুলে বিষের ফণা।
০৫- “অচল প্রেমের পদ্য”
তোমার হাতে দিয়েছিলাম অথৈ সম্ভাবনা
তুমি কি আর অসাধারণ? তোমার যে যন্ত্রনা
খুব মামুলী, বেশ করেছো চতুর সুদর্শনা
আমার সাথে চুকিয়ে ফেলে চিকন বিড়ম্বনা।
০৬- “অচল প্রেমের পদ্য”
যদি যেতে চাও, যাও
আমি পথ হবো চরণের তলে
না ছুঁয়ে তোমাকে ছোঁব
ফেরাবো না, পোড়াবোই হিমেল অনলে।
০৭- “অচল প্রেমের পদ্য”
আমাকে ঠোকর মেরে দিব্যি যাচ্ছো চলে,
দেখি দেখি
বাঁ পায়ের চারু নখে চোট লাগেনি তো;
ইস্! করছো কি? বসো না লক্ষ্মীটি,
ক্ষমার রুমালে মুছে সজীব ক্ষতেই
এন্টিসেপটিক দুটো চুমু দিয়ে দিই।
০৮- “অচল প্রেমের পদ্য”
তুমি কি জুলেখা, শিরী, সাবিত্রী, নাকি রজকিনী?
চিনি, খুব জানি
তুমি যার তার, যে কেউ তোমার,
তোমাকে নাই বা দিলাম
ভালোবাসার পূর্ণ অধিকার
০৯- “অচল প্রেমের পদ্য”
আজন্ম মানুষ আমাকে পোড়াতে পোড়াতে কবি করে তুলেছে
মানুষের কাছে এওতো আমার এক ধরনের ঋণ।
এমনই কপাল আমার
অপরিশোধ্য এই ঋণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।
১০- “অচল প্রেমের পদ্য”
হয়তো তোমাকে হারিয়ে দিয়েছি
নয় তো গিয়েছি হেরে
থাক না ধ্রুপদী অস্পষ্টতা
কে কাকে গেলাম ছেড়ে।
১১- “অচল প্রেমের পদ্য”
যুক্তি যখন আবেগের কাছে অকাতরে পর্যুদস্ত হতে থাকে,
কবি কিংবা যে কোনো আধুনিক মানুষের কাছে
সেইটা বোধ করি সবচেয়ে বেশি সংকোচ আর সঙ্কটের সময়।হয় তো এখন আমি তেমনি এক নিয়ন্ত্রনহীন
নাজুক পরিস্থিতির মুখোমুখি,
নইলে এতদিন তোমাকে একটি চিঠিও লিখতে
না পারার কষ্ট কি আমারই কম!মনে হয় মরণের পাখা গজিয়েছে।
১২- “অচল প্রেমের পদ্য”
নখের নিচে রেখেছিলাম
তোমার জন্য প্রেম,
কাটতে কাটতে সব খোয়ালাম
বললে না তো, - ‘শ্যাম,
এই তো আমি তোমার ভূমি
ভালোবাসার খালা,
আঙুল ধরো লাঙ্গল চষো
পরাও প্রণয় মালা’।
১৩- “অচল প্রেমের পদ্য”
তুমি আমার নিঃসঙ্গতার সতীন হয়েছ ! |
হেলাল হাফিজ | প্রেমমূলক | একবার ডাক দিয়ে দেখো আমি কতোটা কাঙাল,
কতো হুলুস্থূল অনটন আজম্ন ভেতরে আমার।
তুমি ডাক দিলে
নষ্ঠ কষ্ঠ সব নিমিষেই ঝেড়ে মুছে
শব্দের অধিক দ্রুত গতিতে পৌছুবো
পরিণত প্রণয়ের উৎসমূল ছোঁব
পথে এতোটুকু দেরিও করবো না।
তুমি ডাক দিলে
সীমাহীন খাঁ খাঁ নিয়ে মরোদ্যান হবো,
তুমি রাজি হলে
যুগল আহলাদে এক মনোরম আশ্রম বানাবো।
একবার আমন্রণ পেলে
সব কিছু ফেলে
তোমার উদ্দেশে দেবো উজাড় উড়াল,
অভয়ারণ্য হবে কথা দিলে
লোকালয়ে থাকবো না আর
আমরণ পাখি হয়ে যাবো, -খাবো মৌনতা তোমার |
হেলাল হাফিজ | রূপক | নিউট্রন বোমা বোঝ
মানুষ বোঝ না !
|
হেলাল হাফিজ | প্রেমমূলক | প্রত্যাবর্তনের পথে
কিছু কিছু ‘কস্ট্লি’ অতীত থেকে যায়।
কেউ ফেরে, কেউ কেউ কখনো ফেরে না।
কেউ ফিরে এসে কিছু পায়,
মৌলিক প্রেমিক আর কবি হলে অধিক হারায়।
তবু ফেরে, কেউ তো ফেরেই,
আর জীবনের পক্ষে দাঁড়ায়,
ভালোবাসা যাকে খায় এইভাবে সবটুকু খায়।
প্রত্যাবর্তনের প্তহে
পিতার প্রস্থান থেকে,
থাকে প্রণয়ের প্রাথমিক স্কুল,
মাতার মলিন স্মৃতি ফোটায় ধ্রুপদী হুল,
যুদ্ধোত্তর মানুষের মূল্যবোধ পালটায় তুমুল,
নেতা ভুল,
বাগানে নষ্ট ফুল,
অকথিত কথার বকুল
বছর পাঁচেক বেশ এ্যানাটমিক ক্লাশ করে বুকে।
প্রত্যাবর্তনের পথে
ভেতরে ক্ষরণ থাকে লাল-নীল প্রতিনিয়তই,
তাহকে প্রেসক্লাব–কার্ডরুম, রঙিন জামার শোক,
থাকে সুখী স্টেডিয়াম,
উদ্গ্রীব হয়ে থাকে অভিজাত বিপনী বিতান,
বাথরুম, নগরীর নিয়ন্ত্রিত আঁধারের বার,
থাকে অসুস্থ সচ্ছলতা, দীর্ঘ রজনী
থাকে কোমল কিশোর,
প্রত্যাবর্তনের পথে দুঃসময়ে এইভাবে
মূলত বিদ্রোহ করে বেহালার সুর।
তারপর ফেরে, তবু ফেরে, কেউ তো ফেরেই,
আর জীবনের পক্ষে দাঁড়ায়,
ভালোবাসা যাকে খায় এইভাবে সবটুকু খায়।
১২.৫.৮০ |
হেলাল হাফিজ | চিন্তামূলক | কোনো প্রাপ্তিই পূর্ণ প্রাপ্তি নয়
কোনো প্রাপ্তির দেয় না পূর্ণ তৃপ্তি
সব প্রাপ্তি ও তৃপ্তি লালন করে
গোপনে গহীনে তৃষ্ণা তৃষ্ণা তৃষ্ণা।
আমার তো ছিলো কিছু না কিছু যে প্রাপ্য
আমার তো ছিলো কাম্য স্বল্প তৃপ্তি
অথচ এ পোড়া কপালের ক্যানভাসে
আজন্ম শুধু শুন্য শুন্য শুন্য।
তবে বেঁচে আছি একা নিদারুণ সুখে
অনাবিষ্কৃত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বুকে
অবর্ণনীয় শুশ্রূষাহীন কষ্টে
যায় যায় দিন ক্লান্ত ক্লান্ত ক্লান্ত।
৪.৭.৮২ |
হেলাল হাফিজ | প্রেমমূলক | আমি কি নিজেই কোন দূর দ্বীপবাসী এক আলাদা মানুষ?
নাকি বাধ্যতামূলক আজ আমার প্রস্থান,
তবে কি বিজয়ী হবে সভ্যতার অশ্লীল স্লোগান?
আমি তো গিয়েছি জেনে প্রণয়ের দারুণ আকালে
নীল নীল বনভূমি ভেতরে জন্মালে
কেউ কেউ চলে যায়, চলে যেতে হয়
অবলীলাক্রমে কেউ বেছে নেয় পৃথক প্লাবন,
কেউ কেউ এইভাবে চলে যায় বুকে নিয়ে ব্যাকুল আগুন।
আমার কী এসে যাবে, কিছু মৌল ব্যবধান ভালোবেসে
জীবন উড়ালে একা প্রিয়তম দ্বীপের উদ্দেশ্যে।
নষ্ট লগ্ন গেলে তুমিই তো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে
সুকঠিন কংক্রিটে জীবনের বাকি পথ হেঁটে যেতে যেতে
বারবার থেমে যাবে জানি
‘আমি’ ভেবে একে-তাকে দেখে।
তুমিই তো অসময়ে অন্ধকারে
অন্তরের আরতির ঘৃতের আগুনে পুড়বে নির্জনে।
আমাকে পাবে না খুঁজে, কেঁদে-কেটে, মামুলী ফাল্গুনে।
৪.৮.৮০ |
হেলাল হাফিজ | রূপক | জলের আগুনে পুড়ে হয়েছি কমল,
কী দিয়ে মুছবে বলো আগুনের জল।
১৫.১১.৮০ |
হেলাল হাফিজ | প্রেমমূলক | নখের নিচেরেখেছিলাম
তোমার জন্য প্রেম,
কাটতে কাটতেসব খোয়ালাম
বললে না তো, - ‘শ্যাম,
এই তো আমি তোমার ভূমি
ভালোবাসার খালা,
আঙুল ধরোলাঙ্গল চষো
পরাও প্রণয় মালা’। |
হেলাল হাফিজ | মানবতাবাদী | দুই ইঞ্চি জায়গা হবে?
বহুদিন চাষাবাদ করিনা সুখের।
মাত্র ইঞ্চি দুই জমি চাই
এর বেশী কখনো চাবো না,
যুক্তিসঙ্গত এই জৈবনিক দাবি খুব বিজ্ঞানসম্মত
তবু ওটুকু পাবো না
এমন কী অপরাধ কখন করেছি!
ততোটা উর্বর আর সুমসৃণ না হলেও ক্ষতি নেই
ক্ষোভ নেই লাবন্যের পুষ্টিহীনতায়,
যাবতীয় সার ও সোহাগ দিয়ে
একনিষ্ঠ পরিচর্যা দিয়ে
যোগ্য করে নেবো তাকে কর্মিষ্ঠ কৃষকের মত।
একদিন দিন চলে যাবে মৌসুম ফুরাবে,
জরা আর খরায় পীড়িত খাঁ খাঁ
অকর্ষিত ওলো জমি
কেঁদে-কেটে কৃষক পাবে না।
১২.১১.৮১ |
হেলাল হাফিজ | রূপক | ‘অদ্ভুত, অদ্ভুত’ বলে
সমস্বরে চিৎকার করে উঠলেন কিছু লোক।
আমি নগরের জ্যেষ্ঠ শামুক
একবার একটু নড়েই নতুন ভঙ্গিতে ঠিক গুটিয়ে গেলাম,
জলে দ্রাঘিমা জুড়ে
যে রকম গুটানো ছিলাম,
ছিমছাম একা একা ভেতরে ছিলাম,
মানুষের কাছে এসে
নতুন মুদ্রায় আমি নির্জন হলাম,
একাই ছিলাম আমি পুনরায় একলা হলাম।
২৯.৭.৮০ |
হেলাল হাফিজ | মানবতাবাদী | আমি আর আহত হবো না,
কোনো কিছুতেই আমি শুধু আর আহত হবো না।
যে নদী জলের ভারে হারাতো প্লাবনে
এখন শ্রাবণে সেই জলের নদীর বুকে
জলাভাবে হাহাকার দেখে আমি আহত হবো না।
সবুজ সবুজ মাঠ চিরে চিরে
কৃষকের রাখালের পায়ে গড়া দু’পায়া পথের বুকে
আজ সেই সরল সুন্দর সব মানুষের চিতা দেখে
আহত হবো না, আর শুধু আহত হবো না।
বৃক্ষ হারালে তার সবুজ পিরান, মৃত্তিকার ফুরালে সুঘ্রাণ,
কষ্টের ইস্কুল হলে পুষ্পিত বাগান, আমি আহত হবো না।
পাখি যদি না দেয় উড়াল, না পোড়ে আগুন,
অদ্ভুত বন্ধ্যা হলে উর্বরা ফাগুন, আমি আহত হবো না।
মানুষ না বোঝে যদি আরেক মানুষ
আমি আহত হবো না, আহত হবো না।
কবিতার কসম খেলাম আমি শোধ নেবো সুদে ও আসলে,
এবার নিহত হবো
ওসবের কোনো কিছুতেই তবু শুধু আর আহত হবো না।
১৭.৭.৮০ |
হেলাল হাফিজ | মানবতাবাদী | বলাই বাহুল্য আমি রাজনীতিবিদ নই, সুবক্তাও নই
তবু আজ এই সমাবেশে বলবো কয়েক কথা
সকলের অনুমতি পেলে।
–’বলুন, বলুন’।
রঙিন বেলুন দিয়ে মন ভোলানোর কোনো ইচ্ছে আমার নেই,
উপস্থিত সুধী, কেউ ভুলে মনেও করবেন না আমি
পারমিট, পেঁয়াজ আর পারফিউম ন্যায্যমূল্যে দেবো।
–’পেঁয়াজটা পেলে ভালো হত’।
আর কতো? যারা দিতো তারা আর দেবে না বলেছে।
–’কী হবে? কী হবে এখন উপায়’?
হেলায় খেলায় হয়েছে অনেক বেলা ফুরিয়েছে দিন
অবহেলা প্রপীড়িত মানুষেরা শোধ চায় ঋণ,
তবু দেবে, ভাত দেবে–ভোট দেবে, তবে
সামান্য তক্লিফ করে মাঝে মধ্যে গ্রামে যেতে হবে।
–’তবে কি সত্যি সব যা কিছু রটেছে’?
ঘটনা ঘটেছে এক মারাত্মক স্বাধীনতা-উত্তর এদেশে
প্রাপক দিয়েছে জেনে কারা ভদ্রবেশে
হিজলতলীর সুখ জবর-দখল করে রেখেছে এদ্দিন,
একটা কিছু তো আজ যথার্থই খুব সমীচীন।
৪.১২.৮১ |
হেলাল হাফিজ | মানবতাবাদী | মানব জন্মের নামে হবে কলঙ্ক হবে
এরকম দুঃসময়ে আমি যদি মিছিলে না যাই,
উত্তর পুরুষে ভীরু কাপুরুষের উপমা হবো
আমার যৌবন দিয়ে এমন দুর্দিনে আজ
শুধু যদি নারীকে সাজাই।
১৪.২.৭১ |
হেলাল হাফিজ | মানবতাবাদী | অসম্ভব ক্ষুধা ও তৃষ্ণা ছিলো,
সামনে যা পেলো খেলো,
যেন মন্বন্তরে কেটে যাওয়া রজতজয়ন্তী শেষে
এসেছে সে, সবকিছু উপাদেয় মুখে।
গাভিন ক্ষেতের সব ঘ্রাণ টেনে নিলো,
করুণ কার্নিশ ঘেঁষে বেড়ে ওঠা লকলকে লতাটিও খেলো,
দুধাল গাভীটি খেলো
খেলো সব জলের কলস।
শানে বাধা ঘাট খেলো
সবুজের বনভূমি খেলো
উদাস আকাশ খেলো
কবিতার পান্ডুলিপি খেলো।
দু’পায়া পথের বুক, বিদ্যালয়
উপাসনালয় আর কারখানার চিমনি খেলো
মতিঝিলে স্টেটব্যাংক খেলো।
রাখালের অনুপম বাঁশিটিকে খেলো,
মগড়ার তীরে বসে চাল ধোয়া হাতটিকে খেলো
স্বাধীনতা সব খেলো, মানুষের দুঃখ খেলো না।
১৮.৩.৮১ |
হেলাল হাফিজ | প্রেমমূলক | বুকের সীমান্ত বন্ধ তুমিই করেছো
খুলে রেখেছিলাম অর্গল,
আমার যুগল চোখে ছিলো মানবিক খেলা
তুমি শুধু দেখেছো অনল।
তুমি এসেছিলে কাছে, দূরেও গিয়েছো যেচে
ফ্রিজ শটে স্থির হয়ে আছি,
তুমি দিয়েছিলে কথা, অপারগতার ব্যথা
সব কিছু বুকে নিয়ে বাঁচি।
উথাল পাথাল করে সব কিছু ছুঁয়ে যাই
কোনো কিছু ছোঁয় না আমাকে,
তোলপাড় নিজে তুলে নিদারুণ খেলাচ্ছলে
দিয়ে যাই বিজয় তোমাকে।
১৩.১০.৮০ |
হেলাল হাফিজ | চিন্তামূলক | আমার কবিতা আমি দিয়ে যাবো
আপনাকে, তোমাকে ও তোকে।
কবিতা কি কেবল শব্দের মেলা, সংগীতের লীলা?
কবিতা কি ছেলেখেলা, অবহেলা রঙিন বেলুন?
কবিতা কি নোটবই, টু-ইন-ওয়ান, অভিজাত মহিলা -সেলুন?
কবিতা তো অবিকল মানুষের মতো
চোখ-মুখ-মন আছে, সেও বিবেক শাসিত,
তারও আছে বিরহে পুষ্পিত কিছু লাল নীল ক্ষত।
কবিতা তো রূপান্তরিত শিলা, গবেষণাগারে নিয়ে
খুলে দেখো তার সব অণু-পরমাণু জুড়ে
কেবলি জড়িয়ে আছে মানুষের মৌলিক কাহিনী।
মানুষের মতো সেও সভ্যতার চাষাবাদ করে,
সেও চায় শিল্প আর স্লোগানের শৈল্পিক মিলন,
তার তা ভূমিকা চায় যতোটুকু যার উৎপাদন।
কবিতা তো কেঁদে ওঠে মানুষের যে কোনো অ-সুখে,
নষ্ট সময় এলে উঠানে দাঁড়িয়ে বলে,–
পথিক এ পথে নয়
‘ভালোবাসা এই পথে গেছে’।
আমার কবিতা আমি দিয়ে যাবো
আপনাকে, তোমাকে ও তোকে।
১৭.৩.৮১ |
হেলাল হাফিজ | মানবতাবাদী | কে আছেন ?
দয়া করে আকাশকে একটু বলেন -
সে সামান্য উপরে উঠুক,
আমি দাঁড়াতে পারছি না ।ময়মনসিংহ, ১৯৯০কাব্য গ্রন্থঃ- কবিতা একাত্তর |
হেলাল হাফিজ | প্রেমমূলক | কেন নাড়া দিলে?
নাড়ালেই নড়ে না অনেক কিছু
তবু কেন এমন নাড়ালে?
পৃথিবীর তিন ভাগ সমান দু’চোখ যার
তাকে কেন একমাস শ্রাবণ দেখালে!
এক ওভাবে নাড়ালে?
যেটুকু নড়ে না তুমুলভাবে ভেতরে বাহিরে
কেন তাকে সেটুকু নাড়ালে?
ভয় দেখালেই ভয় পায় না অনেকে,
তবু তাকে সে ভয় দেখালে?
যে মানুষ জীবনের সব ক’টি শোক-দ্বীপে গেছে,
সব কিছু হারিয়েই সে মানুষ
হারাবার ভয় হারিয়েছে,
তার পর তীর্থ হয়েছে।
৩.৬.৮০ |
হেলাল হাফিজ | স্বদেশমূলক | কতো দিন তোমাকে দেখি না
তুমি ভালো আছো? সুখে আছো? বোন নেত্রকোনা।
আমাকে কি চিনতে পেরেছো? আমি
ছিলাম তোমার এক আদরের নাগরিক নিকট-আত্মীয়
আমাদের বড়ো বেশি মাখামাখি ছিলো,
তারপর কী থেকে কী হলো
আভাইগা কপাল শুধু বিচ্ছেদের বিষে নীল হলো।
দোহাই লক্ষ্মী মেয়ে কোন দিন জিজ্ঞেস করো না
আমি কেন এমন হলাম জানতে চেয়ো না
কী এমন অভিমানে আমাদের এতো ব্যবধান,
কতোটা বিশৃংখলা নিয়ে আমি ছিমছাম সন্নাসী হলাম।
কিছু কথা অকথিত থেকে যায়
বেদনার সব কথা মানুষ বলে না, রমনী-কাতর
সবিতা সেনের সূতী শাড়িও জানে না
সোনালী অনল আর কতো জল দিদির ভেতর।
কেউ কি তাকিয়ে থাকে নিষ্পলক দাঁড়িয়ে প্রাঙ্গণে?
কারো কি তোলপাড় ওঠে ট্রেনের হুইসেল শুনে মনে?
তোমার মাটির রসে পরিপুষ্ট বৃক্ষ ফুল।
মগড়ার ক্ষীণ কলরোল
অমল কোমল এক মানুষের প্রতীক্ষায় থাক বা না থাক,
তুমি আছো আমার মজ্জায় আর মগজের কোষে অনুক্ষণ,
যে রকম ক্যামোফ্লাজ করে খুব ওতোপ্রোতভাবে থাকে
জীবনের পাশাপাশি অদ্ভুত মরণ।
২৫.১১.৮১ |
হেলাল হাফিজ | চিন্তামূলক | আমাকে দুঃখের শ্লোক কে শোনাবে?
কে দেখাবে আমাকে দুঃখের চিহ্ন কী এমন,
দুঃখ তো আমার সেই জন্ম থেকে জীবনের
একমাত্র মৌলিক কাহিনী।আমার শৈশব বলে কিছু নেই
আমার কৈশোর বলে কিছু নেই,
আছে শুধু বিষাদের গহীন বিস্তার।
দুঃখ তো আমার হাত_ হাতের আঙুল_আঙুলের নখ
দুঃখের নিখুঁত চিত্র এ কবির আপাদমস্তক।আমার দুঃখ আছে কিন্তু আমি দুঃখী নই,
দুঃখ তো সুখের মতো নীচ নয় যে, আমাকে দুঃখ দেবে।
আমার একেকটি দুঃখ একেকটি দেশলাই কাঠির মতন,
অবয়ব সাজিয়েছে ভয়ঙ্কর সুন্দরের কালো কালো অগি্নতিলকে,
পাঁজরের নাম করে ওসব সংগোপনে
সাজিয়ে রেখেছি আমি সেফটি-ম্যাচের মতো বুকে। |
হেলাল হাফিজ | প্রেমমূলক | আমি এখন অন্য মানুষ ভিন্ন ভাবে কথা বলি
কথার ভেতর অকথিত অনেক কথা জড়িয়ে ফেলি
এবং চলি পথ বেপথে যখন তখন।
আমি এখন ভিন্ন মানুষ অন্যভাবে কথা বলি
কথার ভেতর অনেক কথা লুকিয়ে ফেলি,
কথার সাথে আমার এখন তুমুল খেলা
উপযুক্ত সংযোজনে জীর্ণ-শীর্ণ শব্দমালা
ব্যঞ্জনা পায় আমার হাতে অবলীলায়,
ঠিক জানি না পারস্পরিক খেলাধূলায়
কখন কে যে কাকে খেলায়।
অপুষ্টিতে নষ্ট প্রাচীন প্রেমের কথা যত্রতত্র কীর্তন আমার
মাঝে মধ্যে প্রণয় বিহীন সভ্যতাকে কচি প্রেমের পত্র লিখি
যেমন লেখে বয়ঃসন্ধি-কালের মানুষ নিশীথ জেগে।
আমি এখন অন্য মানুষ ভিন্নভাবে চোখ তুলে চাই
খুব আলাদা ভাবে তাকাই
জন্মাবধি জলের যুগল কলস দেখাই,
ভেতরে এক তৃতীয় চোখ রঞ্জনালোয় কর্মরত
সব কিছু সে সঠিকভাবে সবটা দেখে এবং দারুণ প্রণয় কাতর।
আমি এখন আমার ভেতর অন্য মানুষ গঠন করে সংগঠিত,
বীর্যবান এক ভিন্ন গোলাপ এখন কসম খুব প্রয়োজন।
১০.১১.৮১ |
হেলাল হাফিজ | প্রেমমূলক | এখন তুমি কোথায় আছো কেমন আছো, পত্র দিয়ো৷
এক বিকেলে মেলায় কেনা খামখেয়ালী তাল পাখাটা
খুব নিশীথে তোমার হাতে কেমন আছে, পত্র দিয়ো৷
ক্যালেন্ডারের কোন পাতাটা আমার মতো খুব ব্যথিত
ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকে তোমার দিকে, পত্র দিয়ো৷
কোন কথাটা অষ্টপ্রহর কেবল বাজে মনের কানে
কোন স্মৃতিটা উস্কানি দেয় ভাসতে বলে প্রেমের বানে
পত্র দিয়ো, পত্র দিয়ো৷
আর না হলে যত্ন করে ভুলেই যেয়ো, আপত্তি নেই৷
গিয়ে থাকলে আমার গেছে, কার কী তাতে?
আমি না হয় ভালোবেসেই ভুল করেছি ভুল করেছি,
নষ্ট ফুলের পরাগ মেখে
পাঁচ দুপুরের নির্জনতা খুন করেছি, কী আসে যায়?
এক জীবনে কতোটা আর নষ্ট হবে,
এক মানবী কতোটা আর কষ্ট দেবে! |
হেলাল হাফিজ | প্রেমমূলক | হিরণবালা তোমার কাছে দারুন ঋণী সারা জীবন
যেমন ঋণী আব্বা এবং মায়ের কাছে।
ফুলের কাছে মৌমাছিরা
বায়ুর কাছে নদীর বুকে জলের খেলা যেমন ঋণী
খোদার কসম হিরণবালা
তোমার কাছে আমিও ঠিক তেমনি ঋণী।
তোমার বুকে বুক রেখেছি বলেই আমি পবিত্র আজ
তোমার জলে স্নান করেছি বলেই আমি বিশুদ্ধ আজ
যৌবনে এই তৃষ্ণা কাতর লকলকে জিভ
এক নিশীথে কুসুম গরম তোমার মুখে
কিছু সময় ছিলো বলেই সভ্য হলো
মোহান্ধ মন এবং জীবন মুক্তি পেলো।
আঙুল দিয়ে তোমার আঙুল ছুঁয়েছিলাম বলেই আমার
আঙুলে আজ সুর এসেছে,
নারী-খেলার অভিজ্ঞতার প্রথম এবং পবিত্র ঋণ
তোমাকে নিয়ে কবিতা লিখে সত্যি কি আর শোধ হয়েছে? |
হেলাল হাফিজ | চিন্তামূলক | আমাকে দুঃখের শ্লোক কে শোনাবে?
কে দেখাবে আমাকে দুঃখের চিহ্ন কী এমন,
দুঃখ তো আমার সেই জন্ম থেকে জীবনের
একমাত্র মৌলিক কাহিনী।
আমার শৈশব বলে কিছু নেই
আমার কৈশোর বলে কিছু নেই,
আছে শুধু বিষাদের গহীন বিস্তার।
দুঃখ তো আমার হাত–হাতের আঙুন–আঙুলের নখ
দুঃখের নিখুঁত চিত্র এ কবির আপাদমস্তক।
আমার দুঃখ আছে কিন্তু আমি দুখী নই,
দুঃখ তো সুখের মতো নীচ নয়, যে আমাকে দুঃখ দেবে।
আমার একেকটি দুঃখ একেকটি দেশলাই কাঠির মতন,
অবয়ব সাজিয়েছে ভয়ঙ্কর সুন্দরের কালো কালো অগ্নিতিলকে,
পাঁজরের নাম করে ওসব সংগোপনে
সাজিয়ে রেখেছি আমি সেফ্টি-ম্যাচের মতো বুকে।
৯.২.৭৪ |
হেলাল হাফিজ | মানবতাবাদী | পতন দিয়েই আমি পতন ফেরাবো বলে
মনে পড়ে একদিন জীবনের সবুজ সকালে
নদীর উলটো জলে সাঁতার দিয়েছিলাম।
পতন দিয়েই আমি পতন ফেরাবো বলে
একদিন যৌবনের শৈশবেই
যৌবনকে বাজি ধরে
জীবনের অসাধারণ স্কেচ এঁকেছিলাম।
শরীরের শিরা ও ধমনী থেকে লোহিত কণিকা দিয়ে আঁকা
মারাত্মক উজ্জ্বল রঙের সেই স্কেচে
এখনো আমার দেখো কী নিখুঁত নিটোল স্ট্র্যাটেজী।
অথচ পালটে গেলো কতো কিছু,–রাজনীতি,
সিংহাসন, সড়কের নাম, কবিতার কারুকাজ,
কিশোরী হেলেন।
কেবল মানুষ কিছু এখনো মিছিলে, যেন পথে-পায়ে
নিবিড় বন্ধনে তারা ফুরাবে জীবন।
তবে কি মানুষ আজ আমার মতন
নদীর উলটো জলে দিয়েছে সাঁতার,
তবে কি তাদের সব লোহিত কণিকা
এঁকেছে আমার মতো স্কেচ,
তবে কি মানুষ চোখে মেখেছে স্বপন
পতন দিয়েই আজ ফেরাবে পতন।
৪.১.৭৪ |
হেলাল হাফিজ | চিন্তামূলক | প্রতীক্ষায় থেকো না আমার
আমি আসবো না, থাকলো কথার কবুতর
কখনো বাইষ্যা মাসে পেয়ে অবসর
নিতান্তই জানতে ইচ্ছে হলে আমার খবর
পাখিকে জিজ্ঞেস করো নিরিবিলি,
পক্ষপাতহীন পাখি বিস্তারিত সংবাদ জানাবে
কী কী ব্যথা এবং আর্দ্রতা
রেখেছে দখল করে আশৈশব আমার একালা,
আমি কতো একা,
কতোখানি ক্ষত আর ক্ষতি নিয়ে
বেদনার অনুকূলে প্রবাহিত আমার জীবন।
নিপুণ সন্ধান করো
পাখির চঞ্চুতে-চোখে-কোমল পালকে
আমার বিস্তার আর বিন্যাসের কারুকাজ পাবে,
কী আমার আকাঙ্ক্ষিত গঠন প্রণালী আর
আমার কী রাজনীতি কবুতর জানে।
জীবন যাপনে কতো মানবিক,
কবিতায় কতোটা মানুষ,
পরিপাটি নির্দোষ সন্ত্রাস নিয়ে
আমি কতো বিনীত বিদ্রোহী,
পাখিকে জিজ্ঞেস করো সব জেনে যাবে
অবিকল আমার মতন করে কবুতর নির্ভুল জানাবে।
১৯.১১.৮১ |
হেলাল হাফিজ | প্রেমমূলক | আমার জীবন ভালোবাসাহীন গেলে
কলঙ্ক হবে কলঙ্ক হবে তোর,
খুব সামান্য হৃদয়ের ঋণ পেলে
বেদনাকে নিয়ে সচ্ছলতার ঘর
বাঁধবো নিমেষে। শর্তবিহীন হাত
গচ্ছিত রেখে লাজুক দু’হাতে আমি
কাটাবো উজাড় যুগলবন্দী হাত
অযুত স্বপ্নে। শুনেছি জীবন দামী,
একবার আসে, তাকে ভালোবেসে যদি
অমার্জনীয় অপরাধ হয় হোক,
ইতিহাস দেবে অমরতা নিরবধি
আয় মেয়ে গড়ি চারু আনন্দলোক।
দেখবো দেখাবো পরস্পরকে খুলে
যতো সুখ আর দুঃখের সব দাগ,
আয় না পাষাণী একবার পথ ভুলে
পরীক্ষা হোক কার কতো অনুরাগ।
২২.৬.৮৩ |
হেলাল হাফিজ | চিন্তামূলক | একদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম
শুধু আমাকেই দেখা যায়,
আলোর প্রতিফলন প্রতিসরণের নিয়ম না জানা আমি
সেই থেকে আর কোনদিন আয়না দেখি না।
জননীর জৈবসারে বর্ধিত বৃক্ষের নিচে
কাঁদতাম যখন দাঁড়িয়ে
সজল শৈশবে, বড়ো সাধ হতো
আমিও কবর হয়ে যাই,
বহুদিন হলো আমি সেরকম কবর দেখি না
কবরে স্পর্ধিত সেই একই বৃক্ষ আমাকে দেখে না।
কারুকার্যময় চারু ঘরের নমুনা দিয়ে
একদিন ভরা ছিল আমার দু’রেটিনার সীমিত সীমানা,
অথচ তেমন কোনো সীমাবদ্ধতাকে আর কখন মানি না।
কী দারুণ বেদনা আমাকে তড়িতাহতের মতো কাঁপালো তুমুল
ক্ষরণের লাল স্রোত আজন্ম পুরোটা ভেতর উল্টে পাল্টে খেলো,
নাকি অলক্ষ্যে এভাবেই
এলোমেলো আমাকে পাল্টালো, নিপুণ নিষ্ঠায়
বেদনার নাম করে বোন তার শুশ্রূষায়
যেন আমাকেই সংগোপনে যোগ্য করে গেলো।
১৬.১.৭৩ |
হেলাল হাফিজ | প্রেমমূলক | ভাদ্রের বর্ধিত আষাঢ়ে সখ্য হয়েছিলো।
সে প্রথম, সে আমার শেষ।
পথে ও প্রান্তরে, ঘরে,
দিতে রাতে, মাসে ও বছরে
সমস্ত সাম্রাজ্য জুড়ে
সে আষাঢ় অতোটা ভেজাবে আমি ভাবিনি কসম।
আমার সকল শ্রমে, মেধা ও মননে
নিদারুণ নম্র খননে
কী নিপুণ ক্ষত দেখো বানিয়েছে চতুর আষাঢ়।
একদিন
সব কিছু
ছিলো তোর
ডাক নামে,
পোড়ামুখী
তবু তোর
ভরলো না মন,—
এই নে হারামজাদী একটা জীবন।
৭.১২.৮০ |
হেলাল হাফিজ | চিন্তামূলক | আমি ছেড়ে যেতে চাই, কবিতা ছাড়ে না।
বলে,–’কি নাগর
এতো সহজেই যদি চলে যাবে
তবে কেন ঘর বেঁধেছিলে উদ্ধাস্তু ঘর,
কেন করেছিলে চারু বেদনার এতো আয়োজন।
শৈশব কৈশোর থেকে যৌবনের কতো প্রয়োজন
উপেক্ষার ‘ডাস্টবিনে’ ফেলে
মনে আছে সে-ই কবে
চাদরের মতো করে নির্দ্বিধায় আমাকে জড়ালে,
আমি বাল্য-বিবাহিতা বালিকার মতো
অস্পষ্ট দু’চোখ তুলে নির্নিমেষে তাকিয়েছিলাম
অপরিপক্ক তবু সন্মতি সূচক মাথা নাড়িয়েছিলাম
অতোশতো না বুঝেই বিশ্বাসের দুই হাত বাড়িয়েছিলাম,
ছেলেখেলাচ্ছলে
সেই থেকে অনাদরে, এলোমেলো
তোমার কষ্টের সাথে শর্তহীন সখ্য হয়েছিলো,
তোমার হয়েছে কাজ, আজ প্রয়োজন আমার ফুরালো’?
আমি ছেড়ে যেতে চাই, কবিতা ছাড়ে না।
দুরারোগ্য ক্যান্সারের মতো
কবিতা আমার কোষে নিরাপদ আশ্রম গড়েছে
সংগোপনে বলেছে,–’হে কবি
দেখো চারদিকে মানুষের মারাত্মক দুঃসময়
এমন দুর্দিনে আমি পরিপুষ্ট প্রেমিক আর প্রতিবাদী তোমাকেই চাই’।
কষ্টে-সৃষ্টে আছি
কবিতা সুখেই আছে,–থাক,
এতো দিন-রাত যদি গিয়ে থাকে
যাক তবে জীবনের আরো কিছু যাক। |
হেলাল হাফিজ | চিন্তামূলক | বেরিয়ে যে আসে সে তো এভাবেই আসে,
দুর্বিনীত ধ্রুপদী টংকার তুলে
লন্ডভন্ড করে চলে আসে মৌলিক ভ্রমণে, পথে
প্রচলিত রীতি-নীতি কিচ্ছু মানে না।
আমি এক সেরকম উত্থানের অনুপম কাহিনী শুনেছি।
এমন অনমনীয় পৃথক ভ্রমণে সেই পরিব্রাজকের
অনেক অবর্ণনীয় অভিমান থাকে,
টসটসে রসাল ফলের মতো ক্ষত আর
ব্যক্তিগত ক্ষয়-ক্ষতি থাকে। তাকে তুমুল শাসায়
মূলচ্যুত মানুষের ভুল ভালোবাসা, রাজনীতি,
পক্ষপাতদুষ্ট এক স্টাফ রিপোর্টার। আর তার সহগামী
সব পাখিদের ঈর্ষার আকাশে ভাসে ব্যর্থতার কিচির-মিচির।
এতো প্রতিকূলতায় গতি পায় নিষ্ঠাবান প্রেমিক শ্রমিক,
আমি এক সে রকম পথিকের প্রতিকৃতি নির্ভূল দেখেছি।
ইদানিং চারদিকে সমস্বরে এক প্রশ্ন,–কে? কে? কে?
বেরিয়ে যে আসে সে তো এই পথে এইভাবে আসে, নিপুণ ভঙ্গিতে।
১৫.২.৮২ |
হেলাল হাফিজ | মানবতাবাদী | এই নাও বাম হাত তোমাকে দিলাম।
একটু আদর করে রেখো, চৈত্রে বোশেখে
খরা আর ঝড়ের রাত্রিতে মমতায় সেবা ওশুশ্রূষা দিয়ে
বুকে রেখো, ঢেকে রেখো, দুর্দিনে যত্ন নিও
সুখী হবে তোমার সন্তান।
এই নাও বাম হাত তোমাকে দিলাম।
ও বড়ো কষ্টের হাত, দেখো দেখো অনাদরে কী রকম
শীর্ণ হয়েছে, ভুল আদরের ক্ষত সারা গায়ে
লেপ্টে রয়েছে, পোড়া কপালের হাত
মাটির মমতা চেয়ে
সম্পদের সুষম বন্টন চেয়ে
মানুষের ত্রাণ চেয়ে
জন্মাবধি কপাল পুড়েছে,
ওকে আর আহত করো না, কষ্ট দিও না
ওর সুখে সুখী হবে তোমার সন্তান।
কিছুই পারিনি দিতে, এই নাও বাম হাত তোমাকে দিলাম।
২৩.৭.৮০ |
হেলাল হাফিজ | প্রকৃতিমূলক | দারুন আলাদা একা অভিমানী এই ক্যাকটাস।
যেন কোন বোবা রমণীর সখী ছিলো দীর্ঘকাল
কিংবা আজন্ম শুধু দেখেছে আকাল
এরকম ভাব-ভঙ্গি তার।
ধ্রুপদী আঙিনা ব্যাপী
কন্টকিত হাহাকার আর অবহেলা,
যেন সে উদ্ভিদ নয়
তাকালেই মনে হয় বিরান কারবালা।
হয় তো কেটেছে তার মায়া ও মমতাহীন সজল শৈশব
অথবা গিয়েছে দিন
এলোমেলো পরিচর্যাহীন এক রঙিন কৈশোর,
নাকি সে আমার মত খুব ভালোবেসে
পুড়েছে কপাল তার আকালের এই বাংলাদেশে।
বোকা উদ্ভিদ তবে কি
মানুষের কাছে প্রেম চেয়েছিলো?
চেয়েছিলো আরো কিছু বেশি।
৩০.৬.৮২ |
হেলাল হাফিজ | চিন্তামূলক | আমার কষ্টেরা বেশ ভালোই আছেন,
প্রাত্যহিক সব কাজ ঠিক-ঠাক করে চলেছেন
খাচ্ছেন-দাচ্ছেন, অফিসে যাচ্ছেন,
প্রেসক্লাবে আড্ডাও দিচ্ছেন।
মাঝে মাঝে কষ্টেরা আমার
সারাটা বিকেল বসে দেখেন মৌসুমী খেলা,
গোল স্টেডিয়াম যেন হয়ে যায় নিজেই কবিতা।
আজকাল আমার কষ্টেরা বেশ ভালোই থাকেন,
অঙ্কুরোদ্গম প্রিয় এলোমেলো যুবকের
অতৃপ্ত মানুষের শুশ্রূষা করেন। বিরোধী দলের ভুল
মিছিলের শোভা দেখে হাসেন তুমুল,
ক্লান্তিতে গভীর রাতে ঘরহীন ঘরেও ফেরেন,
নির্জন নগরে তারা কতিপয় নাগরিক যেন
কতো কথোপকথনে কাটান বাকিটা রাত,
অবশেষে কিশোরীর বুকের মতন সাদা ভোরবেলা
অধিক ক্লান্তিতে সব ঘুমিয়ে পড়েন।
আমার কষ্টেরা বেশ ভালোই আছেন, মোটামুটি সুখেই আছেন।
প্রিয় দেশবাসী;
আপনারা কেমন আছেন?
২.১০.৮০ |
হেলাল হাফিজ | চিন্তামূলক | আমি ছেড়ে যেতে চাই, কবিতা ছাড়ে না।
বলে,–’কি নাগর
এতো সহজেই যদি চলে যাবে
তবে কেন ঘর বেঁধেছিলে উদ্ধাস্তু ঘর,
কেন করেছিলে চারু বেদনার এতো আয়োজন।
শৈশব কৈশোর থেকে যৌবনের কতো প্রয়োজন
উপেক্ষার ‘ডাস্টবিনে’ ফেলে
মনে আছে সে-ই কবে
চাদরের মতো করে নির্দ্বিধায় আমাকে জড়ালে,
আমি বাল্য-বিবাহিতা বালিকার মতো
অস্পষ্ট দু’চোখ তুলে নির্নিমেষে তাকিয়েছিলাম
অপরিপক্ক তবু সন্মতি সূচক মাথা নাড়িয়েছিলাম
অতোশতো না বুঝেই বিশ্বাসের দুই হাত বাড়িয়েছিলাম,
ছেলেখেলাচ্ছলে
সেই থেকে অনাদরে, এলোমেলো
তোমার কষ্টের সাথে শর্তহীন সখ্য হয়েছিলো,
তোমার হয়েছে কাজ, আজ প্রয়োজন আমার ফুরালো’?
আমি ছেড়ে যেতে চাই, কবিতা ছাড়ে না।
দুরারোগ্য ক্যান্সারের মতো
কবিতা আমার কোষে নিরাপদ আশ্রম গড়েছে
সংগোপনে বলেছে,–’হে কবি
দেখো চারদিকে মানুষের মারাত্মক দুঃসময়
এমন দুর্দিনে আমি পরিপুষ্ট প্রেমিক আর প্রতিবাদী তোমাকেই চাই’।
কষ্টে-সৃষ্টে আছি
কবিতা সুখেই আছে,–থাক,
এতো দিন-রাত যদি গিয়ে থাকে
যাক তবে জীবনের আরো কিছু যাক।
২৬.১০.৮১ |
হেলাল হাফিজ | চিন্তামূলক | কবির জীবন খেয়ে জীবন ধারণ করে
কবিতা এমন এক পিতৃঘাতী শব্দের শরীর,
কবি তবু সযত্নে কবিতাকে লালন করেন,
যেমন যত্নে রাখে তীর
জেনে-শুনে সব জল ভয়াল নদীর।
সর্বভূক এ কবিতা কবির প্রভাত খায়
দুপুর সন্ধ্যা খায়, অবশেষে
নিশীথে তাকায় যেন বয়ঃসন্ধিকালের কিশোরী,
কবিকে মাতাল করে
শুরু হয় চারু তোলপাড়,
যেন এক নির্জন বনের কোনো হরিণের লন্ডভন্ড খেলা
নিজেরই ভিতরে নিয়ে সুবাসের শুদ্ধ কস্তুরী।
কবির কষ্ট দিয়ে কবিতা পুষ্ট হয়
উজ্জ্বলতা বাড়ায় বিবেক,
মানুষের নামে বাড়ে কবিতার পরমায়ু
অমরতা উভয়ের অনুগত হয়।
১০.২.৮১ |
হেলাল হাফিজ | মানবতাবাদী | ভোলায়া ভালায়া আর কথা দিয়া কতোদিন ঠাগাইবেন মানুষ
ভাবছেন অহনো তাদের অয় নাই হুঁশ।
গোছায়া গাছায়া লন বেশি দিন পাইবেন না সময়
আলামত দেখতাছি মানুষের অইবোই জয়।
কলিমুদ্দিনের পোলা চিডি দিয়া জানাইছে,–’ভাই
আইতাছি টাউন দেখতে একসাথে আমরা সবাই,
নগরের ধাপ্পাবাজ মানুষেরে কইও রেডি অইতে
বেদম মাইরের মুখে কতোক্ষণ পারবো দাঁড়াইতে।’
টিকেট ঘরের ছাদে বিকালে দাঁড়ায়ে যখন যা খুশি যারা কন
কোনো দিন খোঁজ লইছেন গ্রামের লোকের সোজা মন
কী কী চায়, কতোখানি চায়
কয়দিন খায় আর কয়বেলা না খায়া কাটায়।
রাইত অইলে অমুক ভবনে বেশ আনাগোনা, খুব কানাকানি,
আমিও গ্রামের পোলা চুত্মারানি গাইল দিতে জানি।
৯.২.৮১ |
হেলাল হাফিজ | প্রেমমূলক | প্রেমের প্রতিমা তুমি, প্রণয়ের তীর্থ আমার।
বেদনার করুণ কৈশোর থেকে তোমাকে সাজাবো বলে
ভেঙেছি নিজেকে কী যে তুমুল উল্লাসে অবিরাম
তুমি তার কিছু কি দেখেছো?
একদিন এই পথে নির্লোভ ভ্রমণে
মৌলিক নির্মাণ চেয়ে কী ব্যাকুল স্থপতি ছিলাম,
কেন কালিমা না ছুঁয়ে শুধু তোমাকেই ছুঁলাম
ওসবের কতোটা জেনেছো?
শুনেছি সুখেই বেশ আছো, কিছু ভাঙচুর আর
তোলপাড় নিয়ে আজ আমিও সচ্ছল, টলমল
অনেক কষ্টের দামে জীবন গিয়েছে জেনে
মূলতই ভালোবাসা মিলনে মলিন হয়, বিরহে উজ্জ্বল।
এ আমার মোহ বলো, খেলা বলো
অবৈধ মুদ্রার মতো অচল আকাঙ্ক্ষা কিংবা
যা খুশী তা বলো,
সে আমার সোনালি গৌরব
নারী, সে আমার অনুপম প্রেম।
তুমি জানো, পাড়া-প্রতিবেশী জানে পাইনি তোমাকে,
অথচ রয়েছো তুমি এই কবি সন্নাসীর ভোগে আর ত্যাগে।
১১.৩.৭৩ |
হেলাল হাফিজ | প্রেমমূলক | আমাকে স্পর্শ করো, নিবিড় স্পর্শ করো নারী।
অলৌকিক কিছু নয়,
নিতান্তই মানবিক যাদুর মালিক তুমি
তোমার স্পর্শেই শুধু আমার উদ্ধার।
আমাকে উদ্ধার করো পাপ থেকে,
পঙ্কিলতা থেকে, নিশ্চিত পতন থেকে।
নারী তুমি আমার ভিতরে হও প্রবাহিত দুর্বিনীত নদীর মতন,
মিলেমিশে একাকার হয়ে এসো বাঁচি
নিদারুণ দুঃসময়ে বড়ো বেশি অসহায় একা পড়ে আছি।
তুমুল ফাল্গুন যায়, ডাকে না কোকিল কোনো ডালে,
আকস্মিক দু’একটা কুহু কুহু আর্তনাদ
পৃথিবীকে উপহাস করে।
একদিন কোকিলেরো সুসময় ছিলো, আজ তারা
আমার মতোই বেশ দুঃসময়ে আছে
পাখিদের নীলাকাশ বিষাক্ত হয়ে গেছে সভ্যতার অশ্লীল বাতাসে।
এখন তুমিই বলো নারী
তোমার উদ্যান ছাড়া আমি আর কোথায় দাঁড়াবো।
আমাকে দাঁড়াতে দাও বিশুদ্ধ পরিপূর্ণতায়,
ব্যাকুল শুশ্রুষা দিয়ে আমাকে উদ্ধার করো
নারী তুমি শৈল্পিক তাবিজ,
এতোদিন নারী ও রমনীহীন ছিলাম বলেই ছিলো
দুঃখের আরেক নাম হেলাল হাফিজ।
৩.৩.৭৪ |
হেলাল হাফিজ | চিন্তামূলক | নারী কি নদীর মতো
নারী কি পুতুল,
নারী কি নীড়ের নাম
টবে ভুল ফুল।
নারী কি বৃক্ষ কোনো
না কোমল শিলা,
নারী কি চৈত্রের চিতা
নিমীলিত নীলা।
১৫.৬.৮০ |
হেলাল হাফিজ | মানবতাবাদী | দুরভিসন্ধির খেলা শেষ হয়ে কোনোদিন
দিন যদি আসে,
এই দেশে ভালোবেসে বলবে মানুষ,
অনন্বিত অসন্তোষ অজারকতার কালে এসে
লাবন্যের লকলকে লতা এক খুব কায়ক্লেশে
একদিন তুলেছিলো বিনয়াবনত মাথা
এতোটুকু ছিলো না দীনতা।
অকুলীন এই দিন শেষ হয়ে কোনোদিন
দিন যদি আসে,
শুভ্রতায় স্নিগ্ধতায় সমুজ্জল মানুষ এদেশে
বলবে সূর্যের দিকে ছিলো সেই লতাটির মুখ
বলবে মাটির সাথে ছিলো তার গাঢ় যোগাযোগ,
কিছু অক্সিজেন সেও দিয়েছিলো
নিয়েছিলো বিষ
বলবে পুষ্পিত কিছু করেছিলো ধূসর কার্নিশ।
ভালোবাসাবাসিহীন এই দিন সব নয়– শেষ নয়
আরো দিন আছে,
ততো বেশি দূরে নয়
বারান্দার মতো ঠিক দরোজার কাছে।
৩০.১০.৮১। |
হেলাল হাফিজ | স্বদেশমূলক | এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
মিছিলের সব হাত
কন্ঠ
পা এক নয় ।
সেখানে সংসারী থাকে, সংসার বিরাগী থাকে,
কেউ আসে রাজপথে সাজাতে সংসার ।
কেউ আসে জ্বালিয়ে বা জ্বালাতে সংসার
শাশ্বত শান্তির যারা তারাও যুদ্ধে আসে
অবশ্য আসতে হয় মাঝে মধ্যে
অস্তিত্বের প্রগাঢ় আহ্বানে,
কেউ আবার যুদ্ধবাজ হয়ে যায় মোহরের প্রিয় প্রলোভনে
কোনো কোনো প্রেম আছে প্রেমিককে খুনী হতে হয় ।
যদি কেউ ভালোবেসে খুনী হতে চান
তাই হয়ে যান
উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায় ।
এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় ।
১.২.৬৯ |
চণ্ডীদাস | ভক্তিমূলক | “ব্রহ্মাণ্ড ব্যাপিয়া আছয়ে যে জন, কেহ না জানয়ে তারে।
প্রেমের আরতি যে জন জানয়ে সেই সে চিনিতে পারে।।”
“মরম না জানে, মরম বাথানে, এমন আছয়ে যারা।
কাজ নাই সখি, তাদের কথায়, বাহিরে রহুন তারা।
আমার বাহির দুয়ারে কপাট লেগেছে – ভিতর দুয়ার খোলা।”
“কহে চণ্ডীদাস, কানুর পীরিতি – জাতিকুলশীল ছাড়া।”
“প্রণয় করিয়া ভাঙ্গয়ে যে। সাধন-অঙ্গ পায় না সে।”
“কি লাগিয়া ডাকরে বাঁশী আর কিবা চাও।
বাকি আছে প্রাণ আমার তাহা লৈয়া যাও। ”
সহজিয়া গুরুবাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে তিনি লেখেন,
“শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ বড়, তাহার উপরে নাই।”
|
চণ্ডীদাস | নীতিমূলক | সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই। |
চণ্ডীদাস | প্রেমমূলক | এ ঘোর রজনী, মেঘের ঘটা,
কেমনে আইল বাটে?
আঙ্গিনার কোণে তিতিছে বঁধুয়া,
দেখিয়া পরাণ ফাটে।
সই, কি আর বলিব তোরে,
বহু পুণ্যফলে সে-হেন বঁধুয়া
আসিয়া মিলল মোরে।
ঘরে গুরুজন, ননদী দারুণ,
বিলম্বে বাহির হৈনু –
আহা মরি মরি, সংকেত করিয়া |
ইমরান কামাল | স্বদেশমূলক | শীতেরা গর্তে ফিরে যাচ্ছে
বসন্ত এসেছে… অবশেষে…
কে-জানি হঠাৎ আজ ভোরে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে গেলো
এবার বসন্তের রঙ হবে শুধুই সবুজ আর লাল
এ কেমন বসন্ত?
আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম, দুই রঙের বসন্ত কেমন হবে
আর আকাশে আগুন লাগতেই
আগুন যেমন পোড়ায়, আমি রঙের দহে পুড়তে শুরু করলাম
দেখলাম শহরের মাটিয়াল দেহে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে অগুণতি ঘাস
বসন্তের প্রথম দিনেই ওরা অদ্ভূত গাঢ় সবুজ…
যেন মাটির তলা থেকেই সবুজে পেকে উঠেছে
আমি দেখলাম শহরের প্রতিটি গাছে লাললাল ছোপ
ওরা ফুল, এ বসন্তের শহরে আজ প্রতিটি ফুলের রঙ লাল
ওরা যেন রক্তের তীব্র দহন নিয়ে ফুটেছেকে-জানি হঠাৎ কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে গেলো
এ বসন্তে কোকিল কুহু রবে ডাকবে না
পাপিয়ারা থাকবে নিশ্চুপ
আর সাদা বক তার ডানা লুকিয়ে ফেলবে কচুরীপানার আড়ালেসুদর্শন উড়বে না
গাঁদা ফুল ফুটবে না
ফুল খুঁজবে না মধুকীট
মৌচাক খুঁজবে না মৌয়াল
এ বসন্তে ধনুর্ভঙ্গ-পণে বসবে পেঁয়াজের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসা
সদ্যজাত লাল-সবুজ প্রজাপতির দল,
চলবে খোলস-ভাঙার মেলা
আর এক সলাজ দেহের মৌনতা-ভাঙা তরুণীর চিৎকারে চিরে যাবে আকাশ
আমি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি…!
একটি বাক্যই হবে এ বসন্তের শিরোনাম
আমি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি…!
নদীর প্রতিটি জলবিন্দু থেকে
মাটির প্রতিটি কণায় প্রতিধ্বনিত হবে সেই স্বর
আমি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি…!
অনুরিত হবে প্রতিটি গাছের শিকড় থেকে প্রতিটি প্রাণের শিরায়
আমি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি…!বসন্ত এসেছে…অবশেষে…
শীতেরা গর্তে ফিরে যাচ্ছে।বাংলাদেশ সময় : ১৭৪৭ ঘণ্টা, ০৬ মার্চ ২০১৩ |
কামিনী রায় | নাট্যগীতি | জড়ায়ে মায়ের গলা শিশু কহে আসি,-
“মা, তোমারে কত ভালোবাসি!”
“কত ভালবাস ধন?” জননী শুধায়।
“এ-ত।” বলি দুই হাত প্রসারি’ দেখায়।“তুমি মা আমারে ভালবাস কতখানি?”
মা বলেন “মাপ তার আমি নাহি জানি।”
“তবু কতখানি, বল।”“যতখানি ধরে
তোমার মায়ের বুকে।”
“নহে তার পরে?”“তার বাড়া ভালবাসা পারি না বাসিতে।”
“আমি পারি।” বলে শিশু হাসিতে হাসিতে! |
কামিনী রায় | চিন্তামূলক | করিতে পারি না কাজ
সদা ভয় সদা লাজ
সংশয়ে সংকল্প সদা টলে,-
পাছে লোকে কিছু বলে।আড়ালে আড়ালে থাকি
নীরবে আপনা ঢাকি,
সম্মুখে চরণ নাহি চলে
পাছে লোকে কিছু বলে।হৃদয়ে বুদবুদ মত
উঠে চিন্তা শুভ্র কত,
মিশে যায় হৃদয়ের তলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।কাঁদে প্রাণ যবে আঁখি
সযতনে শুকায়ে রাখি;-
নিরমল নয়নের জলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।একটি স্নেহের কথা
প্রশমিতে পারে ব্যথা,-
চলে যাই উপেক্ষার ছলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।মহৎ উদ্দেশ্য যবে,
এক সাথে মিলে সবে,
পারি না মিলিতে সেই দলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।বিধাতা দেছেন প্রাণ
থাকি সদা ম্রিয়মাণ;
শক্তি মরে ভীতির কবলে,
পাছে লোকে কিছু বলে। |
কামিনী রায় | মানবতাবাদী | ওরা ভেবেছিল মনে আপনার নাম
মনোহর হর্ম্মরূপে বিশাল অক্ষরে
ইষ্টক প্রস্তরে রচি চিরদিন তরে
রেখে যাবে ! মূঢ় ওরা, ব্যর্থ মনস্কাম।
প্রস্তর খসিয়াছে ভূমে প্রস্তরের পরে,
চারিদিকে ভগ্নস্তূপ, তাহাদের তলে
লুপ্ত স্মৃতি ; শুষ্ক তৃণ কাল-নদী-জলে
ভেসে যায় নামগুলি, কেবা রক্ষা করে!
মানব হৃদয় ভুমি করি অধিকার,
করেছে প্রতিষ্ঠা যারা দৃঢ় সিংহাসন,
দরিদ্র আছিল তারা, ছিল না সম্বল
প্রস্তরের এত বোঝা জড় করিবার ;
তাদের রাজত্ব হের অক্ষুণ্ণ কেমন
কাল স্রোতে ধৌত নাম নিত্যসমুজ্জ্বল।ওরা ভেবেছিল মনে আপনার নাম
মনোহর হর্ম্মরূপে বিশাল অক্ষরে
ইষ্টক প্রস্তরে রচি চিরদিন তরে
রেখে যাবে ! মূঢ় ওরা, ব্যর্থ মনস্কাম।
প্রস্তর খসিয়াছে ভূমে প্রস্তরের পরে,
চারিদিকে ভগ্নস্তূপ, তাহাদের তলে
লুপ্ত স্মৃতি ; শুষ্ক তৃণ কাল-নদী-জলে
ভেসে যায় নামগুলি, কেবা রক্ষা করে!
মানব হৃদয় ভুমি করি অধিকার,
করেছে প্রতিষ্ঠা যারা দৃঢ় সিংহাসন,
দরিদ্র আছিল তারা, ছিল না সম্বল
প্রস্তরের এত বোঝা জড় করিবার ;
তাদের রাজত্ব হের অক্ষুণ্ণ কেমন
কাল স্রোতে ধৌত নাম নিত্যসমুজ্জ্বল। |
কামিনী রায় | মানবতাবাদী | এদেরও তো গড়েছেন নিজে ভগবান্ ,
নবরূপে দিয়েছেন চেতনা ও প্রাণ ;
সুখে দুঃখে হাঁসে কাঁদে স্নেহে প্রেমে গৃহ বাঁধে
বিধে শল্যসম হৃদে ঘৃণা অপমান,
জীবন্ত মানুষ এরা মায়ের সন্তান।।এরা যদি আপনারে শেখে সম্মানিতে,
এরা দেশ-ভক্ত রূপে জন্মভূমি-হিতে
মরণে মানিবে ধর্ম বাক্য নহে — দিবে কর্ম ;
আলস্য বিলাস আজো ইহাদের চিতে
পারেনি বাঁধিতে বাসা, পথ ভুলাইতে ।।এরা হতে পারে দ্বিজ—যদি এরা জানে,
এরা কি সভয় সরি’ রহে ব্যবধানে ?
এরা হতে পারে ,বীর, এরা দিতে পারে শির,
জননীর, ভগিনীর, পত্নীর সম্মানে,
ভবিষ্যের মঙ্গলের স্বপনে ও ধ্যানে ।
এরা যদি জানে।।উচ্চ কূলে জন্ম ব’লে কত দিন আর
ভাই বিপ্র রবে তব এই অহংকার ?
কৃতান্ত সে কুলীনের রাখে না তো মান,
তার কাছে দ্বিজ শূদ্র পারীয়া সমান ।
তার স্পর্শে যেই দিন পঞ্চভূতে দেহ লীন
বাহ্মণে চণ্ডালে রহে কত ব্যবধান ? |
সলিল চৌধুরী | প্রেমমূলক | আমার ইচ্ছেগুলো প্রজাপতি হয়ে
ঘাসে ঘাসে বনে বনে
ওড়ে আর ফেরে
আমার মনের মতো ছোট এক ছেলে
জাল নিয়ে পিছু পিছু
ঘোরে আর ফেরে
ইচ্ছে ধরার সাধ জাল দিয়ে বেঁধে
তাই তার দিন গেল কেঁদে আর কেঁদে।
আমার আর একটা ইচ্ছা
‘তুমি’ তার নাম
তারও হাতে জাল ছিল
পরে জানলাম
আমার মনের মতো ছোট শিশুটিকে
জাল দিয়ে বেঁধে ফেলে এখে দিলে বুকে
মনকে ধরার সাধ জাল দিয়ে বেঁধে
তাই তার দিন গেল কেঁদে আর কেঁদে। |
সলিল চৌধুরী | মানবতাবাদী | সেদিন রাত্রে সারা কাকদ্বীপে হরতাল হয়েছিলো
সেদিন আকাশে জলভরা মেঘ
বৃষ্টির বেদনাকে বুকে চেপে ধরে থমকে দাঁড়িয়েছিলো
এই পৃথিবীর আলো বাতাসের অধিকার পেয়ে
পায়নি যে শিশু জন্মের ছাড়পত্র
তারই দাবী নিয়ে সেদিন রাত্রে
সারা কাকদ্বীপে
কোন গাছে কোন কুঁড়িরা ফোটেনি
কোন অঙ্কুর মাথাও তোলেনি
প্রজাপতি যতো আরও একদিন গুটিপোকা হয়েছিলো
সেদিন রাত্রে সারা কাকদ্বীপে হরতাল হয়েছিলো
তাই
গ্রাম নগর মাঠ পাথার বন্দরে তৈরী হও
কার ঘরে জ্বলেনি দীপ চির আঁধার তৈরী হও
কার বাছার জোটেনি দুধ শুকনো মুখ তৈরী হও
ঘরে ঘরে ডাক পাঠাই তৈরী হও জোটবাঁধো
মাঠে কিষান কলে মজুর নওজোয়ান জোট বাঁধো
এই মিছিল
এই মিছিল সবহারার সবপাওয়ার এই মিছিল
প্রতিভা আর যশোদা মার রক্তবীজ এই মিছিল
স্বামীহারা অনাথিনীর চোখের জল এই মিছিল
শিশুহারা মাতাপিতার অভিশাপের এই মিছিল
এই মিছিল সবহারার সবপাওয়ার এই মিছিল
হও সামিল
আমর বুকে এলো যখন কোটি প্রাণের স্বপ্ন
কোটি মনের বরফ জমা অগাধ সম্ভাবনা
কোটি দেহের ঘৃণার জ্বালা অগ্নিগিরি বুকে
কোটি শপথ পাথর জমা গোনে শেষের লগ্ন
তবে আমার বজ্রনাদে শোন রে ঘোষনা
কোটি দেহের সমষ্টি এই আমিই হিমালয়
আমি তোদের আকাশ ছিঁড়ে সূর্য পড়ি ভালে
তুচ্ছ করি কুজ্ঝ্বটিকা মেঘের ভ্রুকুটিও
জানাই তোদের কারা আছিস ঘৃণ্য পরগাছা
কোটি বুকের কলজে ছিঁড়ে রক্ত করিস পান
বুকে শ্বাপদ মুখে তোদের অহিংসা অছিলা
এবার তবে করবি তো আয়
আমার মোকাবিলা |
সলিল চৌধুরী | চিন্তামূলক | এমন কোনও অনুভূতি আসে যদি কখনো
যে আমার বৌ-এর মতো
নাম যার সবিতা।
অনুভব করা যাকে যায় না কখনো
অথচ সে সর্বক্ষণ ছেয়ে থাকে বুকে
শত সুখে দুখে
নাম তার কবিতা। |
সলিল চৌধুরী | রূপক | এক বড় ঝড়কে পোষ মানিয়ে
হাতপাখা নাম দিয়ে ঘরে এনেছি
দুরন্ত বন্যাকে কোণঠাসা করে
একটি গেলাসে তাকে পান করেছি
সূর্যের পিঠে আমি হাত বুলিয়ে
কিছু তার তেজ এনে আলো জ্বেলেছি
তারা ভরা বিশ্বকে অক্ষর করে
ছোট এক বই লিখে পড়ে ফেলেছি |
সলিল চৌধুরী | চিন্তামূলক | উত্তরাধিকার সূত্রে
পেয়েছি শুধু এক গুচ্ছ চাবি
ছোটো-বড়ো মোটা-বেঁটে
নানারকমের নানা ধরনের চাবি
মা বললেন, যত্ন করে তুলে রেখে দে…তারপর যখন বয়স বাড়লো
জীবন এবং জীবিকার সন্ধানে
পথে নামতে হোল
পকেটে সম্বল শুধু সেই এক গুচ্ছ চাবি
ছোটো বড়ো মোটা বেঁটে
নানারকমের নানা ধরনের চাবি……কিন্তু যেখানেই যাই
সামনে দেখি প্রকান্ড এক দরজা
আর তাতে ঝুলছে
প্রকান্ড এক তালা
পকেট থেকে চাবির গুচ্ছ বের করি
এ চাবি সে চাবি
ঘোরাই ফেরাই-লাগেনা-খোলেনা
শ্রান্ত হয়ে ঘরে ফিরি-
মা দেখেন আর হাসেন
বলেন-‘ওরে তোর-বাবার-হাতেও
ঐ চাবি দিয়ে ঐ দরজাগুলো খোলেনি-
শুনেছি নাকি তাঁর বাবার- হাতে খুলত…আসল কথা কি জানিস?
এ সব চাবি হোল
সততার সত্যের যুক্তির নিষ্ঠার
এসব দরজাগুলো খোলেনা…তবুও তুই ফেলে দিস্ না
তুই যখন চলে যাবি
তোর সন্তানদের হাতে দিয়ে যাস
এসব চাবির গুচ্ছ-হয়তো তাদের হাতে
হয়তো কেন নিশ্চয়ই তাদের হাতে একদিন
ঐসব সততার সত্যের যুক্তির নিষ্ঠার চাবি দিয়ে
জীবনের বন্ধ দরজাগুলো
খুলে যাবে-খুলে যাবেই….’ |
সলিল চৌধুরী | প্রেমমূলক | এমনও মুহূর্ত আসে
মনে হয়
হাজার বছর ধরে বাঁচার যে সুখ
এ মুহূর্তে তাই পেয়ে গেছি –
সে হিসেবে আমার বয়স
কয়েক সহস্র কোটি অর্বুদেরও
প্রায় কাছাকাছি।
অন্যথায় এমনও বলতে পারো
যে ক’টি মুহূর্ত তুমি কাছাকাছি ছিলে…
সে ক’টি মুহূর্ত শুধু
আমি বেঁচে আছি |
আলাউদ্দিন আল আজাদ | স্বদেশমূলক | স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার ? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো
চারকোটি পরিবার
খাড়া রয়েছি তো ! যে-ভিত কখনো কোনো রাজন্য
পারেনি ভাঙতে
হীরের মুকুট নীল পরোয়ানা খোলা তলোয়ার
খুরের ঝটকা ধুলায় চূর্ণ যে পদ-প্রান্তে
যারা বুনি ধান
গুণ টানি, আর তুলি হাতিয়ার হাঁপর চালাই
সরল নায়ক আমরা জনতা সেই অনন্য ।
ইটের মিনার
ভেঙেছে ভাঙুক ! ভয় কি বন্ধু, দেখ একবার আমরা জাগরী
চারকোটি পরিবার ।এ-কোন মৃত্যু ? কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন,
শিয়রে যাহার ওঠেনা কান্না, ঝরেনা অশ্রু ?
হিমালয় থেকে সাগর অবধি সহসা বরং
সকল বেদনা হয়ে ওঠে এক পতাকার রং
এ-কোন মৃত্যু ? কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন,
বিরহে যেখানে নেই হাহাকার ? কেবল সেতার
হয় প্রপাতের মোহনীয় ধারা, অনেক কথার
পদাতিক ঋতু কলমেরে দেয় কবিতার কাল ?
ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙুক । একটি মিনার গড়েছি আমরা
চারকোটি কারিগর
বেহালার সুরে, রাঙা হৃদয়ের বর্ণলেখায় ।
পলাশের আর
রামধনুকের গভীর চোখের তারায় তারায়
দ্বীপ হয়ে ভাসে যাদের জীবন, যুগে যুগে সেই
শহীদের নাম
এঁকেছি প্রেমের ফেনিল শিলায়, তোমাদের নাম ।
তাই আমাদের
হাজার মুঠির বজ্র শিখরে সূর্যের মতো জ্বলে শুধু এক
শপথের ভাস্কর । |