poet
stringclasses
137 values
category
stringclasses
21 values
poem
stringlengths
9
18.7k
লালন শাহ
মানবতাবাদী
সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে ।। লালন কয় জাতের কী রূপ আমি দেখলাম না দুই নজরে। সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে ।।কেউ মালা’য় কেউ তছবি গলায়, তাইতে যে জাত ভিন্ন বলায় যাওয়া কিম্বা আসার বেলায় জাতের চিহ্ন রয় কার রে সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে ।।যদি ছুন্নত দিলে হয় মুসলমান, নারীর তবে কি হয় বিধান, বামণ চিনি পৈতা প্রমাণ, বামণি চিনে কিসে রে সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে ।।জগত্ বেড়ে জেতের কথা, লোকে গৌরব করে যথা তথা লালন সে জেতের ফাতা ঘুচিয়াছে সাধ বাজারে’ সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে ।।আরও পড়ুন… জাত গেলো জাত গেলো বলে – লালন শাহ
লালন শাহ
নীতিমূলক
দিন থাকতে দ্বীনের সাধন কেন জানলে না তুমি কেন জানলে না সময় গেলে সাধন হবে নাজানো না মন খালে বিলে থাকে না মিন জল শুকালে ।। কি হবে আর বাঁধা দিলে মোহনা শুকনা থাকে, মোহনা শুকনা থাকে, সময় গেলে সাধন হবে না সময় গেলে সাধন হবে নাঅসময়ে কৃষি কইরে মিছা মিছি খেইটে মরে গাছ যদি হয় বীজের জোরে ফল ধরে না তাতে ফল ধরে না, সময় গেলে সাধন হবে না ।।অমাবস্যায় পূর্নিমা হয় মহা জোগ সে দিনের উদয় ।। লালোন বলে তাহার সময় দনডোমো রয় না, দনডোমো রয় না,দনডোমো রয় না সময় গেলে সাধন হবে নাদিন থাকতে দ্বীনের সাধন কেন জানলে না তুমি কেন জানলে না সময় গেলে সাধোন হবে নাআরও পড়ুন… তিন পাগলে হলো মেলা নদে এসে – লালন শাহ
লালন শাহ
চিন্তামূলক
এই মানুষে সেই মানুষ আছে কতো মুনি ঋষি যোগী তপস্বী তারে খুঁজে বেড়াচ্ছে।।জলে যেমন চাঁদ দেখা যায় ধরতে গেলে হাতে কে পায় আলেক মানুষ অমনই সদাই আছে আলেকে বসে।।অচিন দলে বসতি যার দ্বিদল পদ্মে বারাম তার দল নিরূপণ হবে যাহার সে রূপ দেখবে অনাসে।।আমার হলো বিভ্রান্ত মন বাইরে খুঁজি ঘরের ধন সিরাজ সাঁই কয় ঘুরবি লালন আত্মতত্ত্ব না বুঝে।।
লালন শাহ
চিন্তামূলক
আমারে কি রাখবেন গুরু চরণদাসী? ইতরপনা কার্য আমার অহর্নিশি।। জঠর যন্ত্রণা পেয়ে এলাম যে করার দিয়ে রইলাম তা সব ভুলিয়ে ভবে আসি।। চিনলাম না সে গুরু কি ধন জানলাম না তার সেবা সাধন ঘুরতে বুঝি হল রে মন চোরাশি।। গুরু যার থাকে সদয় শমন বলে তার কিসের ভয় লালন বলে, মন তুই আমার করলি দুষি।।
লালন শাহ
মানবতাবাদী
জাত গেলো জাত গেলো বলে এ কি আজব কারখান ! জাত গেলো জাত গেলো বলে… সত্য কাজে কেউ নাই রাজি সবই দেখি তা না না না জাত গেলো জাত গেলো বলে আসবার কালে কি জাত ছিলে এসে তুমি কি জাত নিলে কি জাত হবা যাবার কালে এ কথা ভেবে বল না জাত গেলো জাত গেলো বলে এ কি আজব কারখান ! ব্রাহ্মন চন্ডাল চামার মুচি এক জলেতে সবাই শুচি দেখে শুনে হয় না রুচি যম তো কাকেও ছাড়বে না ।। জাত গেলো জাত গেলো বলে এ কি আজব কারখান ! গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায় তাতে ধর্মের কি ক্ষতি হয় লালন বলে জাত কারে কয় আ ভ্রম তো গেলো না।। জাত গেলো জাত গেলো বলে এ কি আজব কারখান !আরও পড়ুন… খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায় – লালন শাহ
লালন শাহ
মানবতাবাদী
তিন পাগলে হলো মেলা নদে এসে তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে ।।একটা পাগলামি করে জাত দেয় সে অজাতেরে দৌড়ে গিয়ে আবার হরি বলে পড়ছে ঢলে ধূলার মাঝে ।।একটা নারকেলের মালা তাতে জল তোলা ফেলা করঙ্গ সে পাগলের সঙ্গে যাবি পাগল হবি বুঝবি শেষে ।।পাগলের নামটি এমন বলিতে অধীন লালন হয় তরাসে চৈতে নিতে অদ্বৈ পাগল নাম ধরে সে ।।তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে….. !! আরও পড়ুন… এসব দেখি কানার হাট বাজার – লালন শাহ
লালন শাহ
চিন্তামূলক
দেখ না মন, ঝকমারি এই দুনিয়াদারী। আচ্ছা মজা কপনি-ধ্বজা উড়ালে ফকিরী।। যা কর তা কর রে মন, তোর পিছের কথা রেখে স্মরণ; বরাবরই (ও তার) পিছে পিছে ঘুরছে শমন, কখন হাতে দিবে দড়ি।। (তখন) দরদের ভাই বন্ধুজনা, সঙ্গে তোমার কেউ যাবে না; মন তোমারি, তারা একা পথে খালি আতে বিদায় দিবে তোমারি।। বড় আশার বাসাখানি কোথায় পড়ে রবে মন তোর ঠিক না জানি; সিরাজ সাঁই কয়, লালন ভেরো তুই করিস্‌ নে কার এন্‌তাজারি।।আরও পড়ুন… সময় গেলে সাধন হবে না – লালন শাহ
লালন শাহ
ভক্তিমূলক
বাড়ির কাছে আরশী নগর (একঘর) সেথা পড়শী বসত করে- আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।। গেরাম বেড়ে অগাধ পানি নাই কিনারা নাই তরণী পারে, বাঞ্ছা করি দেখব তারে (আমি) কেমনে সেথা যাই রে।। কি বলব পড়শীর কথা, হস্ত পদ স্কন্ধ মাথা নাই-রে ক্ষণেক থাকে শূণ্যের উপর (ওসে) ক্ষণেক ভাসে নীরে।। পড়শী যদি আমায় ছুঁতো, যম যাতনা সকল যেতো দূরে। সে আর লালন একখানে রয়- (তবু) লক্ষ যোজন ফাঁক রে।।আরও পড়ুন… দেখ না মন,ঝকমারি এই দুনিয়াদারী – লালন শাহ
লালন শাহ
মানবতাবাদী
(ভবে) মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার নদী কিংবা বিল-বাঁওড়-খাল সর্বস্থলে একই এক জল।।একা মেরে সাঁই হেরে সর্ব ঠাঁই ।। মানুষে মিশিয়া হয় বিধান তার মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার…নিরাকারে জ্যোতির্ময় যে, আকার সাকার হইল সে ।। দিব্যজ্ঞানী হয় তবে জানতে পায় ।। কলি যুগে হলেন মানুষ-অবতার মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যারবহু তর্কে দিন বয়ে যায় বিশ্বাসের ধন নিকটে পায় ।। সিরাজ সাঁই ডেকে বলে লালনকে ।। কুতর্কের দোকান সে করে না আর মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার (ভবে) মানুষ গুরু নিষ্ঠা যারআরও পড়ুন… লালন ফকির এর সকল গান 
লালন শাহ
চিন্তামূলক
অনায়াসে দেখতে পাবি কোনখানে সাঁইর বারামখানা। আপন ঘরের খবর লে না। অনায়াসে দেখতে পাবি কোনখানে সাঁইর বারামখানা।।আমি কোমল ফোটা কারে বলি কোন মোকাম তার কোথায় গলি ।। সেইখানে পইড়ে ফুলি মধু খায় সে অলি জনা।।সুখ্য জ্ঞান যার ঐক্য মুখ্য সাধক এর উপলক্ষ ।। অপরূপ তার বৃক্ষ দেখলে চক্ষের পাপ থাকে না।।শুষ্ক নদীর শুষ্ক সরোবর তিলে তিলে হয় গো সাঁতার ।। লালন কয়, কীর্তি-কর্মার কি কারখানা।।
লালন শাহ
চিন্তামূলক
আমার আপন খবর আপনার হয় না। সে যে আপনারে চিনলে পরে, যায় অচেনারে চেনা।।সাঁই নিকট থেকে দূরে দেখায় যেমন কেশের আড়ে পাহাড় লুকায়, দেখ আ। আমি ঢাকা দিল্লী হাতড়ে ফিরি আমার কোলের ঘোটত যায় না।।সে যে আত্মারূপে কর্তাহরি, মনে নিষ্ঠা হলেই মিলবে তারি ঠিকানা। আর বেদ-বেদান্ত পড়বে যত বাড়বে তত লখ্‌না।।আমি আমি কে বলে মন, যে জানে তার চরণ শরণ লে না। ফকির লালন বলে, বেদের গোলে হলাম চোখ থাকতে কানা।।
লালন শাহ
চিন্তামূলক
কে বানাইলো এমন রঙমহল খানা হাওয়া দমে দেখ তারে আসল বেনা।।বিনা তেলে জ্বলে বাতি দেখতে যেমন মুক্তা মতি জলময় তার চতুর্ভিতি মধ্যে খানা।।তিল পরিমাণ জায়গা সে যে হদ্দরূপ তাহার মাঝে কালায় শোনে আঁধলায় দেখে নেংড়ার নাচনা।।যে গঠিল এ রঙমহল না জানি তার রূপটি কেমন। সিরাজ সাঁই কয় নাইরে লালন তার তুলনা।।
লালন শাহ
চিন্তামূলক
আপনার আপনি মন না জান ঠিকানা । পরের অন্তরে কোটি সমুদ্দুর কীসে যাবে জানা ।।পর বলতে পরমেশ্বর আত্মরূপে করে বিহার দ্বিদলে বারামখানা । শতদল সহস্রদলে অনন্ত করুণা ।।কেশের আড়েতে যৈছে পাহাড় লুকায়ে আছে দর্শন হল না । হেঁট নয়ন যার, নিকটে তার সিদ্ধ হয় কামনা ।।সিরাজ সাঁই বলে রে লালন গুরুপদে ডুবে আপন আত্মার ভেদ করলে না । আত্মা আর পরমাত্মা ভিন্ন ভেদ জেন না ।।
লালন শাহ
ভক্তিমূলক
ধর চোর হাওয়ার ঘরে ফান্দ পেতে। সে কি সামান্য চোর ধরবি কোনা-কাঞ্চিতে।। পাতালে চোরের বহর দেখায় আসমানের উপর তিন তারে করেছে খবর হাওয়ার মূল ধরতে তাতে।।১ কোথা ঘর কি বাসনা কে জানে ঠিক ঠিকানা হাওয়ায় তার বারামখানা শুভ শুভ যোগমতে।।২ চোর ধরে রাখবি যদি হৃদ-গারদ কর গে খাঁটি লালন কয়, নাটিখুঁটি থাকতে কি সে দেয় ছুঁতে।।
লালন শাহ
চিন্তামূলক
মন তুই করলি একি ইতরপনা। দুগ্ধেতে যেমন রে তোর মিশলো চোনা।।শুদ্ধ রাগে থাকতে যদি হাতে পেতে অটলনিধি বলি মন তাই নিরবধি বাগ মানে না।।কী বৈদিকে ঘিরলো হৃদয় হ’ল না সুরাগের উদয় নয়ন থাকিতে সদাই হ’লি কানা।।বাপের ধন তোর খেল সর্পে জ্ঞানচক্ষু নাই দেখবি কবে লালন বলে হিসাবকালে যাবে জানা।।
লালন শাহ
চিন্তামূলক
এসব দেখি কানার হাট বাজার বেদ বিধির পর শাস্ত্র কানা আর এক কানা মন আমার।।পণ্ডিত কানা অহংকারে মাতবর কানা চোগলখোরে। সাধু কানা অন বিচারে আন্দাজে এক খুঁটি গেড়ে, চেনে না সীমানা কার।।এক কানা কয় আর এক কানারে চল এবার ভবপারে। নিজে কানা পথ চেনে না পরকে ডাকে বারে বার।।কানায় কানায় উলামিলা বোবাতে খায় রসগোল্লা। লালন তেমনি মদনা কানা ঘুমের ঘোরে দেয় বাহার।।আরও পড়ুন… মিলন হবে কত দিনে – লালন শাহ
লালন শাহ
ভক্তিমূলক
মিলন হবে কত দিনে আমার মনের মানুষের সনে।।চাতক প্রায় অহর্নিশি চেয়ে আছে কালো শশী।হব বলে চরণদাসী তা হয় না কপাল গুণে।।মেঘের বিদ্যুৎ মেঘে যেমন লুকালে না পায় অন্বেষণ। কালারে হারায়ে তেমন ঐ রূপ হেরি এ দর্পণে।।ঐ রূপ যখন স্মরণ হয় থাকে না লোকলজ্জার ভয়। লালন ফকির ভেবে বলে সদাই ও প্রেম যে করে সেই জানে।।আরও পড়ুন… লালন ফকির এর সকল গান 
লালন শাহ
মানবতাবাদী
আছে আদি মক্কা এই মানব দেহে দেখ না রে মন চেয়ে। দেশ-দেশান্তর দৌড়ে এবার মরিস্‌ কেন হাঁপিয়ে।। করে অতি আজব ভাক্কা গঠেছে সাঁই মানুষ-মক্কা কুদরতি নূর দিয়ে। ও তার চার দ্বারে চার নূরের ইমাম মধ্যে সাঁই বসিয়ে।। মানুষ-মক্কা কুদরতি কাজ উঠছে রে আজগুবি আওয়াজ সাততলা ভেদিয়ে। আছে সিংহ-দরজায় দ্বারী একজন নিদ্রাত্যাগী হয়ে।। দশ-দুয়ারী মানুষ মক্কা গুরুপদে ডুবে দেখ না ধাক্কা সামলায়ে। ফকির লালন বলে, সে যে গুপ্ত মক্কা আমি ইমাম সেই মিঞে। ওরে সেথা যাই কোন পথ দিয়ে।।
লালন শাহ
চিন্তামূলক
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়। ধরতে পারলে মনবেড়ি দিতাম পাখির পায়।আট কুঠুরী নয় দরজা আঁটা মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাঁটা। তার উপরে সদর কোঠা আয়নামহল তায়।খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।কপালের ফ্যার নইলে কি আর পাখিটির এমন ব্যবহার। খাঁচা ভেঙ্গে পাখি আমার কোন বনে পালায়।খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।মন তুই রইলি খাঁচার আশে খাঁচা যে তোর কাঁচা বাঁশে। কোন দিন খাঁচা পড়বে খসে ফকির লালন কেঁদে কয়।খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।আরও পড়ুন… বাড়ির কাছে আরশিনগর – লালন শাহ
লালন শাহ
ভক্তিমূলক
আমি অপার হয়ে বসে আছি ও হে দয়াময়, পারে লয়ে যাও আমায়।। আমি একা রইলাম ঘাটে ভানু সে বসিল পাটে- (আমি) তোমা বিনে ঘোর সংকটে না দেখি উপায়।। নাই আমার ভজন-সাধন চিরদিন কুপথে গমন- নাম শুনেছি পতিত-পাবন তাইতে দিই দোহাই।। অগতির না দিলে গতি ঐ নামে রবে অখ্যাতি- লালন কয়, অকুলের পতি কে বলবে তোমায়।।আরও পড়ুন… সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে – লালন শাহ
অতুলপ্রসাদ সেন
ভক্তিমূলক
জল বলে চল, মোর সাথে চল তোর আঁখিজল, হবে না বিফল, কখনো হবে না বিফল। চেয়ে দেখ মোর নীল জলে শত চাঁদ করে টল মল। জল বলে চল, মোর সাথে চল। বধু রে আন তরা করি, বধুরে আন তরা করি, কূলে এসে মধু হেসে ভরবে গাগরী, ভরবে প্রেমের হৃদ কলসি, করবে ছল ছল। জল বলে চল, মোর সাথে চল। মোরা বাহিরে চঞ্চল, মোরা অন্তরে অতল, সে অতলে সদা জ্বলে রতন উজল। এই বুকে, ফোটে সুখে, হাসিমুখে শতদল, নহে তীরে, এই নীরে, গভীরে শীতল। জল বলে চল, মোর সাথে চল।
অতুলপ্রসাদ সেন
স্বদেশমূলক
বল, বল, বল সবে, শত বীণা-বেণু-রবে, ভারত আবার জগত-সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে | ধর্মে মহান্ হবে, কর্মে মহান্ হবে, নব দিনমণি উদিবে আবার পুরাতন এ পুরবে! আজও গিরিরাজ রয়েছে প্রহরী, ঘিরি তিনদিক নাচিছে লহরী, যায়নি শুকায়ে গঙ্গা গোদাবরী, এখনও অমৃতবাহিনী | প্রতি প্রান্তর, প্রতি গুহা বন, প্রতি জনপদ, তীর্থ অগণন, কহিছে গৌরব-কাহিনী | বিদুষী মৈত্রেয়ী খনা লীলাবতী, সতি সাবিত্রী সীতা অরুন্ধতী, বহু বীরবালা বীরেন্দ্র-প্রসূতি, আমরা তাঁদেরই সন্ততি || ভোলেনি ভারত, ভোলেনি সে কথা, অহিংসার বাণী উঠেছিল হেথা, নানক, নিমাই করেছিল ভাই, সকল ভারত-নন্দনে | ভুলি ধর্ম-দ্বেষ জাতি-অভিমান, ত্রিশকোটি দেহ হবে এক প্রাণ, একজাতি প্রেম-বন্ধনে || মোদের এ দেশ নাহি রবে পিছে, ঋষি-রাজকুল জন্মেনি মিছে, দুদিনের তরে হীনতা সহিছে, জাগিবে আবার জাগিবে | আসিবে শিল্প-ধন-বাণিজ্য, আসিবে বিদ্যা-বিনয়-বীর্য, আসিবে আবার আসিবে || এস হে কৃষক কুটির-নিবাসী, এস অনার্য গিরি-বনবাসী, এস হে সংসারী, এস হে সন্ন্যাসী, —মিল হে মায়ের চরণে | এস অবনত, এস হে শিক্ষিত, পরহিত-ব্রতে হইয়া দীক্ষিত, —মিল হে মায়ের চরণে | এস হে হিন্দু, এস মুসলমান, এস হে পারসী, বৌদ্ধ, খৃষ্টিয়ান্, —মিল হে মায়ের চরণে ||
অতুলপ্রসাদ সেন
স্বদেশমূলক
হও ধরমেতে ধীর হও করমেতে বীর, হও উন্নত শির, নাহি ভয় | ভুলি ভেদাভেদ জ্ঞান, হও সবে আগুয়ান, সাথে আছে ভগবান,—হবে জয় | নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান্ ; দেখিয়া ভারেতে মহা-জাতির উত্থান—জগজন মানিবে বিস্ময়! তেত্রিশ কোটি মোরা নহি কভু ক্ষীণ, হতে পারি দীন, তবু নহি মোরা হীন! ভারতে জনম, পুনঃ আসিবে সুদিন—ঐ দেখ প্রভাত-উদয়! ন্যায় বিরাজিত যাদের করে, বিঘ্ন পরাজিত তাদের শরে ; সাম্য কভু নাহি স্বার্থে ডরে—সত্যের নাহি পরাজয় ||
অতুলপ্রসাদ সেন
চিন্তামূলক
নীচুর কাছে নীচু হতে শিখলি না রে মন, তুই সুখি জনের করিস পূজা, দুঃখীর অযতন। মূঢ় মন, সুখি জনের করিস পূজা, দুঃখীর অযতন। নীচুর কাছে নীচু হতে শিখলি না রে মন। লাগে নি যার পায়ে ধুলি, কি নিবি তার চরণ ধুলি, নয়রে সোনায়, বনের কাঠেই হয় রে চন্দন। মূঢ় মন, হয় রে চন্দন। নীচুর কাছে নীচু হতে শিখলি না রে মন। এ মোধন মায়ের মতন, দুঃখীটুতেই অধিক যতন, এ ধনেতে ধনি যে জন, সেই তো মহাজন। মূঢ় মন, সেই তো মহাজন। বৃথা তোর কৃচ্ছসাধন, সেবাই নরের শ্রেষ্ঠ সাধন, মানবের পরম তীর্থ দীনের শ্রীচরণ। মূঢ় মন, দীনের শ্রীচরণ। মতামতের তর্কে মত্ত, আছিস ভুলে পরম সত্য, সকল ঘরে সকল নরে আছেন নারায়ণ। মূঢ় মন, আছেন নারায়ণ। নীচুর কাছে নীচু হতে শিখলি না রে মন।
অতুলপ্রসাদ সেন
ভক্তিমূলক
ওগো নিঠুর দরদী, ও কি খেলছ অনুক্ষণ। তোমার কাঁটায় ভরা বন, তোমার প্রেমে ভরা মন, মিছে খাও কাঁটার ব্যথা, সহিতে না পার তা আমার আঁখিজল, ওগো আমার আঁখিজল তোমায় করেগো চঞ্চল তাই নাই বুঝি বিফল আমার অশ্রু বরিশন। ওগো নিঠুর দরদী। ডাকিলে কও না কথা, কি নিঠুর নিরবতা। আবার ফিরে চাও, তুমি আবার ফিরে চাও, বল ওগো শুনে যাও তোমার সাথে আছে আমার অনেক কথন। এ কি খেলছ অনুক্ষণ, ওগো নিঠুর দরদী।
অতুলপ্রসাদ সেন
স্বদেশমূলক
মোদের গরব, মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা! তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালোবাসা!কি যাদু বাংলা গানে! গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে, গেয়ে গান নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা!বিদ্যাপতি, চণ্ডী, গোবিন্‌, হেম, মধু, বঙ্কিম, নবীন- ঐ ফুলেরই মধুর রসে, বাঁধলো সুখে মধুর বাসা!বাজিয়ে রবি তোমার বীণে, আনলো মালা জগৎ জিনে! তোমার চরণ-তীর্থে আজি, জগৎ করে যাওয়া-আসা!ঐ ভাষাতেই নিতাই গোরা, আনল দেশে ভক্তি-ধারা, আছে কৈ এমন ভাষা, এমন দুঃখ-শ্রান্তি-নাশা?ঐ ভাষাতেই প্রথম বোলে, ডাকনু মায়ে ‘মা, মা’ বলে; ঐ ভাষাতেই বলবো হরি, সাঙ্গ হলে কাঁদা হাসা!মোদের গরব, মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা!
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
হেঁটে হেঁটে আমি কি এখন খুব ক্লান্ত? কায়ক্লোশ পা দুটোকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার জন্যে কী একটা গান গায় বৃক্ষতলে গোধূলিতে। এ পথের রেখা ধরে ইতিহাস আর আমি হেঁটে যাচ্ছি। একটি পাখির কলস্বর দিগন্তের চিবুকে বিস্ময় জাগিয়ে কেমন উড়ে যায়, যেন টুক্‌রো মেঘ; দেখ, এবার আমার সত্যিকার লেখার সময় এল। এতকাল শুরু গোলকধাঁধায় ঘুরে কেটেছে সময়।প্রকৃত আলোর বীজ আবিষ্কার করি, আবিষ্কার করি স্বপ্ন আর বাস্তবের দৃষ্টিপাত। কলমের আঁচড়ে আবার বেঁচে উঠি। নিজের ধরনে শূন্যতার মুখোমুখি। নিদ্রার ঠোঁটের ফাঁকে কবিতার ফল পুরে দিয়ে সরিয়ে রাত্রির পর্দা প্রত্যুষের খুব টলটলে সরোবরে দিই ডুব। ভর দুপুরের হৈ-হুল্লোড়ে আমার কবিতা যীশুর রক্তাক্ত শরীরের মতো ঝুলে থাকে ক্রমশ। কারা যেন অদূরে দাঁড়িয়ে বলে, ‘লিখে রাখো ছায়ায় আমেন’।   (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
মাত্র দু’বছর আগে আমাদের এই পরিচয় অকস্মাৎ এ শহরে বিলম্বিত গোধূলি বেলায়। আমরা দু’জন একই ঘাটে মহাকালের খেলায় মিলিত হয়েছি, আমাদের হৃদয়ের পরিণয় বহু যুগ আগেই হয়েছে বীথিকায় মনে হয় সম্পূর্ণ গান্ধর্ব মতে। কদমতলার স্মৃতি আজো রূপালি মাছের মতো ভেসে ওঠে। বাজো, বাঁশি বাজো, উঠুক পায়ের মল নেচে আজ এ শহরময়।গৌরী, তুমি আধুনিকা; উন্নত মানের শিক্ষা দীক্ষা পেয়েছ, বস্তুত তুমি রুচির সৌরভ প্রতিক্ষণ ছড়াও আলাপে, আচরণে; তোমার সময় ভিক্ষা চাই কিছু প্রায়শই; দাও, জানি; কোনো কোনো স্তরে তোমার এবং গ্রাম্য গীতিকার মহুয়ার মন অভিন্ন প্রণয়ে, ঘর-কাঁপানো আবেগে, জলঝড়ে!   (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
রূপক
(দান্তের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা পূর্বক) মোল্লা-পুরুত এখনো রটায় স্বর্গলোকের বিজ্ঞাপন। নানা মুনি তার নকশা আঁকেন, ব্যাখ্যা করেন বিজ্ঞজন।দৈব দয়ায় একদিন ঠিক পৌঁছে গেলাম স্বর্গলোকে। স্বর্গতো নয়, আমার শহর দেখতে পেলাম চর্মচোখে।সেখানে ও লোক রাস্তা খুঁড়ছে, মন্ত্রী হচ্ছে, কিনছে নাম। চৈত্রদুপুর পুড়ছে সেখানে, গলছে রাতের মধ্য যাম।ইলেকট্রিকের হঠাৎ-আলোয় ঘরের জানলা খুলছে কেউ। ব্যস্ত মানুষ, মন্থর গাড়ি, বড়ো রাস্তায় ভিড়ের ঢেউ।এয়ারপোর্টে প্লেন নেমে আসে, ট্রেন চলে যায় শেষ রাত্রে। সেখানেও দেখি তর্কের থীম ফকনার কামু কিবা সাত্রে।বক্তা ছড়ান ধরতাই বুলি, রাজায়-রাজায় বাঁধে লড়াই। টগবগ করে ফুটছে নিত্য জটিল মতামতের কড়াই।দোকানে সাজানো বিদেশী কবির আনকোরা বই দিচ্ছে উঁকি। ঘটি-বাটি বাঁধা রেখে কেউ ফটকা বাজারে নিচ্ছে ঝুঁকি। ডাক্তার এলে ভিজিট চুকিয়ে গৃহী মোছে তার চোখের খড়খড়ি, রোগীর শিয়রে শুকনো ফল।তরুণী টেবিলে খাবার সাজায়, খবর পড়েন বুড়ো হাকিম। মুড়মুড়ে দুটি টোস্টের ফাঁকে নিবিড় হলুদ সোনালি ডিম।কফির গন্ধে উন্মন মন, কাজ্ঞিভেরাম কৌচে লোটে। প্রেমিকের চোখ বালবের মতো দীপ্ত ভাষায় ঝলসে ওঠে।রাতের আঁধারে ফুটপাতে আসে ভিখিরিণী তার নি-ছাদ ঘরে; ঘাগড়া দুলিয়ে কুষ্ঠরোগীর ঠোঁট চেপে ধরে কামের জ্বরে!অক্ষর গুণে পংক্তি মেলায় রাগী যুবকের দলের চাঁই, ক্ষিপ্রকলায় চিত্র আঁকছে রঙ ছুঁড়ে দিয়ে আচ্ছেতাই!রবিঠাকুরের গান ভেসে আসে, হেঁটে যায় লোক সুরের টানে। পিকাসোর ছবি ড্রইংরুমের দেয়ালকে দেয় অন্য মানে।   (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
যখন সে লেখে তার ধমনীতে নেচে নেচে মেশে গোলাপের পাপড়ি একরাশ, টেবিলের গ্রীবা ঘেঁষে জেগে ওঠে বহুবর্ণ অশ্বপাল কেশর দুলিয়ে, দেবদুত মাঝে সাজে দ্যায় তার মাথাটা বুলিয়ে। যখন সে লেখে, দ্যাখে তার শৈশবের খড়স্তূপে খরগোশ নাকের ডগা থেকে ঝাড়ে খড়কুটো চুপে এবং আলেখ্যবৎ আস্তাবলে সহিস ঘুমায়। যখন সে লেখে, দ্যাখে তার পদাবলী উড়ে যায়,একজন তরুণীর কোলে কোমল লুটিয়ে পড়ে, চুমু খায় ওষ্ঠে তার; যখন সে লেখে, সারা ঘরে জীবনের ঠোঁট নড়ে মৃত্যুর নিতম্ব দোলে শাদা। যখন সে লেখে, লাশময় বিধ্বস্ত ট্রেঞ্চের কাদা উঠে আসে চতুপার্শ্বে আর তারই দিকে অবিরত নিঃশব্দে বাড়ায় গ্রীবা বাংলাদেশ হরিণের মতো।   (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
আমাদের দু’জনের মধ্যে যেন কবরের মতো কিছু আছে, বুঝি তাই অন্তহীন বিচ্ছিন্নতা নিয়ে দু’জন দু’দিকে থাকি। শুকনো ওষ্ঠে পানি ঝরবার অনেক আগেই বেলা যায়, বেলা যায়। তবুও তোমার প্রতি যাই বেলাশেষে, যেমন নিঃসঙ্গ বেদুইন ব্যাকুল প্রবেশ করে মরুদ্যানে। আমি বালির ভেতর থেকে ঝরণার বদলে বেনামি কংকাল তুলে আমি আর প্রিয় কোনো গান হঠাৎ গাইতে গিয়ে বোবার মতোন কিছু শব্দ করে ফেলি।কবরখানার পাশে দ্বিপ্রহর, সোনালি নর্তকী, প্রতিটি মুদ্রায় তার কেমন ঔদাস্য ছিল, কবরের ফুলের মতোন দৃষ্টি নিয়ে কী তন্ময় তাকিয়েছিলাম একজন প্রতিমার প্রতি, তুমি তাকালে না; অথচ আমার ভেতরের দৃশ্যাবলী দুলে উঠেছিল খুব। কবরখানার পাশে দাঁড়ালেই কেবলি আমার সাবানের ঘ্রাণ, যেশাশের অন্তিম ভোজন, শূন্য পানপাত্র, জংধরা হেলমেট চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়া জল মনে পড়ে, মনে পড়ে কুয়াশায় ভীষণ একলা কারো যাওয়া।তোমার নিকট থেকে চলে যেতে ভারি ভয় পাই, যেমন ধার্মিক ধর্ম থেকে, সর্বক্ষণ বুক জুড়ে থাকে তোমাকেই পাওয়ার প্লাবন, কাতরতা। ধ্বংসস্তূপে বসে আমি তোমার অধরে ওষ্ঠ রেখে অমরতা চেয়ে নিতে পারি, তোমাকে বাঁধতে পারি আলিঙ্গনে কবরের পাশে, কবিতাও লেখা যায় লাশময় প্রান্তরে একাকী ট্রেঞ্চে জ্যোৎস্না ব্যেপে এলে মুশকিল নয় দিনপঞ্জী কিংবা চিঠি লেখা।যখন একলা থাকি ঘরে, পোশাক বদলে ফেলি যথারীতি, সিগারেট খাই, ভয় পাই, এ ভয়ের কোনো ব্যাখ্যা চলে না কখনো। কখন যে কবেকার শীতল মোমের গন্ধে ভরে যায় ঘর, অনেকেই ফিস ফিস কথা বলে, মনে হয়, আমি কারো কথা শুনি না স্পষ্টত। বুঝি বা দেয়াল বলে, ‘আত্মসমর্পণ করো’, কিন্তু তার প্রতি? পাই না উত্তর। অনিদ্রার ঘোরে শুধু নিদ্রাকেই ডাকি, পাছে আমি আত্মহত্যা করে ফেলি জাগরণে ক্রুর নিঃসঙ্গতাবোধে।প্রতিদিন দেখি আমি মনশ্চক্ষে একটি বিজন পথরেখা- সে পথে আমরা, তুমি আর আমি, হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে জেনে নিতে চাই প্রকৃতই কতদূর যাওয়া, সে পথে তোমার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে নিরিবিলি কখনো ফিরিয়ে আনতে চাই মরুভূমিতে হারিয়ে যাওয়া দগ্ধ চিৎকারের মতো আমার আহত, অভিমানী কবিতাগুলিকে। এভাবে অনন্তকাল তোমার সঙ্গেই হেঁটে যাওয়া যেতো যদি দয়ার্দ্রে রোদ্দুরে প্রজাপতিদের মধ্যে, তবে আমি বিশ্রামের কথা ভুলে থাকতাম। প্রতিদিন ধু ধু পথে স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলি, যেন মরুদ্যান।বারবার আমাদের দু’জনের মধ্যে কবরের মতো কিছু, বস্তুত কবরই এসে যায়। ‘এ কবর কার? বলে আমরা দু’জন পরস্পর চেয়ে থাকি কিছুক্ষণ দেখি প্রজাপতি ঘাস ছুঁয়ে ঝরণার নিকটের উড়ে যায়। কবরের দীর্ঘ ঘাস আমাকে জড়াতে চায় যত, তত বেশি ভালো লাগে জীবনের সঙ্গে উন্মুখর গলাগলি রৌদ্রালোকে নক্ষত্রের বিপুল জোয়ারে।   (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
তোমার সান্নিধ্যে আমি, হা কপাল, কখনো পারি না ছুটে যেতে ইচ্ছেমতো। অথচ আমার মধ্যে রোজ একটি ঈগল দূর তোমার আসমানের খোঁজ নেয়ার তৃষ্ণায় ডানা ঝাপটায়। হায়, মনোলীনা কী করে হৃদয় পাবো বলো তোমার শরীর বিনা? প্রত্যহ সযত্নে তুমি চুল বাঁধো, কারো সাজগোজে, এখন তা-নয় কিছুতেই আমার দৃষ্টির ভোজ। পড়ে আছি রুক্ষ একা, সঙ্গী শুধু মর্চে-পড়া বাণী।তুমি কি এখনো আসবে না? শিরাপুঞ্জে বাজাবে না মত্ত মঞ্জীরের ধ্বনি? সে কোন্‌ দ্বিধার বেড়াজাল ঘিরেছে তোমাকে আজ? কোন্‌ ভীতি কুন্ডলী পাকায় পথে পথে? মনে কি পড়ে না একজন, চিরচেনা, তিমির-শংকিল রাতে একাকিনী দূর শাল তাল তমালের বনে গ্যাছে বারংবার প্রেমের ডেরায়?   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
শোকমূলক
(খন্দকার মজহারুল করিম স্বরণে)কেন তুমি হুট করে এত প্রিয় এই আসরের আকর্ষণ ছেড়ে চলে গেলে? কেন গেলে? তোমার তো ছিলো না বিতৃষ্ণা, যতদূর জানি, স্বদেশের নদী, মাঠ, গ্রামগঞ্জ, শহরের ঘরবাড়ি, রাজপথ, অলিগলি আর দীপ্ত জনসভা আর জনতা-শোভিত দীর্ঘ মিছিলের প্রতি।সংসার সুখেরই ছিলো; ছিলো না কি? জীবনসঙ্গিনী আর প্রিয় দু’টি সন্তানের সঙ্গ তুমি উপভোগ করেছো সর্বদা। বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে মেতেছো আড্ডায়। দেশ, দেশবাসী, কখনও হতাশা, কখনও-বা ভোরের সূর্যের মতো আশা উঠেছে ঝলসে প্রাণে। দেশের দশের কল্যাণের, প্রগতির পথ কী ক’রে যে প্রসারিত হবে, তার ভাবনায় কেটেছে বিনিদ্র রাত বহুবার। স্বাস্থ্য গেছে ক্ষয়ে।প্রায়শই মধ্যরাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে, একা কোনার টেবিলে ঝুঁকে প্রবন্ধ লিখেছো ঢের চাহিদা মেটাতে পত্রিকার। তোমার জীবনে ছিলো নক্ষত্রের আলো এবং সূর্যের হাসি; প্রগতির পথে হেঁটেছো, তবুও কেন এই অবেলায় চলে গেলে প্রিয় কাজ অসমাপ্ত রেখে?   (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
মজুরের ঘামের ফোঁটার মতো সকালবেলার আলো চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে আমার ঘরে। টেবিলে আর কে, নারায়ণের আত্মকথা ‘আমার দিনগুলি’ যেটি গত রাতে পড়ে শেষ করেছি। আমার কবিতা খাতা একটি অসমাপ্ত কবিতা বুকে ধারণ করে প্রতীক্ষায় আছে আমার কলমের আঁচড়ের। কবিতাটি লতিয়ে উঠেছে তোমাকে ঘিরে। কি আশ্চর্য, আজকাল আমার প্রায় প্রতিটি কবিতা জুড়ে তোমারই আসা-যাওয়া।মেঝেতে যমজ স্যান্ডেল অপেক্ষমাণ আমার পায়ের জন্যে। জানলার লাগোয়া নারকেল গাছে একটি কি দুটি পাখি, মাঝে মাঝে গানে সাজায় প্রতিবেশ। রাস্তার ওপারে হতে চলেছে একটি বাড়ির ইট, বালি, কুপিয়ে-তোলা মাটি, লোহার শিকময় উঠোনে কয়েকজন নারী পুরুষ, যারা একটু পরেই পুরোদমে লেগে যাবে ইট ভাঙার কাজে। তিনটি গাছ এখনো দাঁড়ানো সেখানে, কে জানে কখন পড়বে মুখ থুবড়ে বৃক্ষ ঘাতকের কুঠারের দাপটে। কয়েকজন ছেলেমেয়ে ইউনিফর্ম পরে রওয়ানা হয়েছে মর্নিং ইস্কুলে, যেন ভাসমান এক বাহারি বাগান।পাড়ার সেই মেয়েমানুষ, যার মাথায় ছিট, গান গায়, ওর গানে নদীর ঢেউ, শূন্য নৌকা, আর ধানের শীষের দুলুনি, কখনো কখনো ওর সুরে সর্বস্ব-হারানো বিলাপ। গ্রীষ্মের সকালে হাওয়া, হঠাৎ কিছু পাওয়ার খুশি চায়ের চুমুকে, গত রাতের স্বপ্ন নিয়ে নাড়াচাড়া। মনে পড়ে, কাল রাতে স্বপ্নে দেখেছিলাম, দাঁড়িয়ে আছি সামন্ত যুগের গোধূলিকালীন এক রাজবাড়ির সিংদরজায়। জানতাম তুমি আছো সেই বাড়ির রহস্যময় কোনো প্রকোষ্ঠে। কণ্ঠস্বর যদ্দূর সম্ভব উচ্চগ্রামে চড়িয়ে ডাকলাম তোমাকে, তুমি এলে না। ভিক্ষুক এলেও তো মানুষ একবার দরজা খুলে দ্যাখে। স্বপ্নের ভেতরেই আমার ভীষণ মন খারাপ। আমি কি পাগলা মেহের আলীর মতো সেই আধভাঙা রাজবাড়ির চারপাশে ক্রমাগত চক্কর কাটতে লাগলাম? নাকি দীর্ঘশ্বাস হয়ে মিলিয়ে গেলাম নিশান্তের হাওয়ায়? সকালবেলা আমার ভারি ভালো লাগার কথা, অথচ আমার মন আজ সীসার মতো ভারী। এক ধরনের দার্শনিকতা আমাকে খামচে-খুমচে, ঘাড় ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে প্রতিধ্বনিময় প্রকাণ্ড সব গুহায়। রাতের স্বপ্নটিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে মনোভার কমাবার চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হলাম। ভাবনার হার ধরে অন্য মোড়ে নিয়ে গেলাম ভুলিয়ে ভালিয়ে। সেই মুহূর্তে নিজেকে ভাবতে দিলাম, তুমি বসে আছো শুধু আমারই প্রতীক্ষায়, কায়মনোবাক্যে আমারই কথা ভাবছো, একথা ভাবতেই আমার সমগ্র সত্তা কদম ফুল, ভাবতে ভালো লাগছে, তুমি আমার জন্যে ফুঃ বলে তুচ্ছ করতে পারো যা কিছু কাঙ্ক্ষণীয়। আর আনন্দে ডগমগ সারা ঘর। এই বিভ্রান্ত যুগে তোমার অনুপস্থিতিকেই উপস্থিতি বলে জেনেছি! হঠাৎ একটা বিকট অট্রহাসিতে আমার ঘর থরথর, যেমন ভূমিকম্পে হয়। কিন্তু সেই ঠা ঠা হাসিকে অনুসরণ করে টাল সামলে কাছে পিঠে কাউকে দেখতে পেলাম না।   (হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
তোমার ভয়ের কথা বলেছ আমাকে বহুবার কখনো গল্পের ছলে, কখনো বা ভয়ে কেঁপে উঠে; হঠাৎ নিশুত রাতে ঘুম ভেঙে গেলে দ্যাখো ছুটে আসে শত সরীসৃপ তোমার দিকেই দুর্নিবার বেগে, ভীতসন্ত্রস্ত তোমার কাছে সে বেডকভার অজগর হয়ে যায় এবং দর্পণে ওঠে ফুটে খুব ভয়ঙ্কর মুখ কারো, যেন সে সম্ভ্রম লুটে নেবে কিংবা খুনী রূপে চকিতে ছোরায় দেবে ধার।রাত্তিরে তোমাকে ছেড়ে যায় না কখনো ভয়, তাই ঘাটতি তোমার ঘুমে। আমার মৃত্যুর দিন তুমি আসবে না দেখতে আমার লাশ, পাছে মৃত মুখ আমার তোমার রাতে হানা দেয়, ভীতিকর ছাই ওড়ায় ঘুমের ঘরে, অথচ তোমার মনোভূমি সে মুখের আলোয় হয়েছে নিত্যদিন গুলরুখ।   (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
কখনও-সখনও পারবে না যেতে একা যদি বলি, প্রকৃত বন্ধুর কথা অত্যন্ত বিরল এমন সুন্দর এই গলিতে আমাকে হেঁটে যেতে দ্যাখে প্রায়শই তারা কিংবা তাদের আত্মীয়-স্বজনেরা প্রায়শ দেখতে পেয়ে কেউ-কেউ হেসে সালাম করেন। কেউ ঠোঁটে খেলিয়ে মুচকি হাসি দ্রুত চলে যান যে যার গন্তব্যে আর আমি কিছু মনে না করেই হেঁটে যেতে থাকি কোনও বন্ধুর বাসায়।যদি বলি আমিও ভণ্ডামি ক’রে বসি কখনও-সখনও কোনও মজলিশে, তা হ’লে হবে না ভুল; তাই নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয়। তখন স্মৃতির জাল ফুঁড়ে বেরিয়ে আসেন মরহুমা মা আমার, তখন দু’চোখ দিয়ে তাঁর ঝরছে আগুন আর পরমুহূর্তেই করুণ দু’চোখ দিয়ে আমাকে দেখেন ভালোবেসে,- যেন আমি ছোট খোকা-পারব না যেতে একা!মধ্যরাতে ছিলাম নিজের ঘরে শুয়ে বড় একা,- আচানক মনে হ’ল, যেন কার নরম হাতের মৃদু স্পর্শ ছুঁয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত আর তাঁর কণ্ঠস্বর বেদনার্ত লোকটির জননীর বটে। খানিক পরেই কোখায় যে মিলায়, যায় না বোঝা কিছুই তো। বারবার শুধু বড় করুণ গানের সুর শোনো চলন্ত পথিক আর অতিশয় দিশেহারা চাকরির সন্ধানে কখনও-সখনও দূর থেকে ভেসে-আসা মৃদু সুর শোনা যায়।   (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
সীসার মতো আকাশ বিনত, গাছগুলি স্থাপত্য, তরতাজা রৌদ্রর রঙে অকস্মাৎ ধরেছে জং; ক’দিন ইঁদুরগুলোর জোটে নি এক কণা খাদ্য, বাঁধানো কবরগুলোয় মস্ত ফাটল।পেঁচা মূক, স্থবির; শ্মশান পেরিয়ে সৌন্দর্য ব্যান্ডেজ বাঁধা পা নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে নিরুদ্দেশ যাত্রায় লীন। একজন কবির বুক বুলেটে ঝাঁঝরা করে উল্লাসে মত্ত ওরা। ঘাসবঞ্চিত মাটি সন্তানহারা জননীর মতো দমকে দমকে ডুকরে ওঠে আর কবির কণ্ঠস্বর অমর্ত্য উৎসব স্পন্দমান লোকালয়ের অন্তরে।   (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
হে বান্ধব, এই যে এখানে তুমি এক কোণে ব’সে প্রত্যহ ঘণ্টার পর ঘণ্টা একা দেয়ালের কিংবা বাইরের কোনও গাছ অথবা প্রশান্ত আকাশের দিকে দৃষ্টি মেলে দিয়ে কাটাও সময় তাতে তোমার কী লাভ হয়, বলবে কি?প্রশ্ন করে করে ক্লান্ত হয়ে গেছি, তবু আজ অব্দি পাইনি উত্তর, শুধু তুমি ঠোঁটে হাসি খেলিয়ে তাকাও এই উৎসুক ব্যক্তির দিকে আর এলেবেলে কী-যে বলো, শত চেষ্টাতেও অর্থের সন্ধান মেলা ভার। ডুবন্ত সূর্যের দিকে কিছুক্ষণ তাকালেই সম্ভবত মিলবে হদিস বক্তব্যের।হে বান্ধব, দেখছি তোমাকে ভ্রাম্যমাণ মেঘলোকে। বুঝি না কী ক’রে ফের ফিরে আসবে এখানে এই মৃত্তিকায় আর স্বাভাবিক ভাষা উচ্চারণ করবে আবার সাধারণ মজলিশে। এই তো জাগলো চাঁদ ঘুমের সাগর ভেদ ক’রে ; হে বান্ধব, দেখছি তোমার হাতে অপরূপ চলিষ্ণু কলম।খাতার পাতার পর পাতা অক্ষরের চুমোয় লাল হয়ে ওঠে পুনরায় কিছুদিন পর। জানি অনেকেই ভেবে নেচে উঠেছিলো সুখে-এবার তোমার কলমের গতি চিরতরে থেমে গেলো সুনিশ্চিত! অথচ বেজায় একগুঁয়ে কলম তোমার বন্ধু, কোনও অভিশাপ পুড়ে ছাই করতে পারে না কলমকে।  (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
ভক্তিমূলক
[মতিউল ইসলামকে স্মরণে রেখে]বার্ধক্যের ভগ্ন স্বর, মাঝে-মধ্যে শ্বাসকষ্ট, কখনো আবার পিত্তশূল, আর কখনো-বা মনোভার নিয়ে কাটিয়েছো বেলা। কখনো কি হয়েছে সংশিত সাধ ভেলা ভাসাতে অলক্ষ্যে রাতে তিতাসের জলে? কিংবা ঘুম ভেঙে গেলে কোকিলের আহ্বানে নিঝুম হয়েছে কি মনে পৃথিবীকে বড় বেশি? হঠাৎ গোপনে খুলেছিলে কবিতার ধূলিম্লান খাতা? কত কথা দিয়েছিল উঁকি মনে, শিউরে উঠলে দেখে মরুর শূন্যতা।একদা সুদূর ঝাঁঝাঁ যৌবনের উদ্দাম আবেগে যেসব সুন্দরী তুমি দেখেছিলে বারবার ভাসমান মেঘে, বনের কিনারে, ডাগর নদীর ঢেউয়ে, লতাঘেরা পাখি-ঝলসিত ঝোপঝাড়ে, যাদের বুকের উপত্যকা তোমার হৃদয়ে বিলিয়েছে পুষ্পঘ্রাণ, পলাতকা অকস্মাৎ তারা সেই কবে উধাও সৌরভে স্মৃতির প্রচ্ছায়া রেখে। যে-স্বপ্ন তোমার চিদাকাশে ক্ষণে ক্ষণে বীতখেদ কুসুমের মাসে স্মরণাতীতের অলো জ্বেলেছিল, সে-ও হায়, ছায়ার মতোই ধু-ধু ছায়ায় মিলালো।মাঝে-মাঝে আমার সংশয়ী মনে জাগে এক প্রশ্ন, অস্বস্তির কাঁটাবেঁধা-তোমার অন্তরে অস্তরাগে দুরুহ টানেনি, বুঝি তাই যার পর নাই সহজিয়া অধ্যাত্মবাদের আমন্ত্রণী মরীচিকা জ্বেলেছিলো শিখা তোমার বিহবল চোখে, নাকি অন্য কোনো ফাঁকি তোমাকে ভুলিয়ে অন্য পথে ছন্দমবেশী ঠিকানার দিলো খোঁজ আর মনে পড়ে অত্যন্ত ঝিমিয়ে-পড়া পাখির মতন দ্বিপ্রহরে প্রগাঢ় বলেছিলে দূর বনান্তের স্তব্ধতায়- সমাধিফলক ছুঁয়ে ফড়িং এবং প্রজাপতি উড়ে যায়।   (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
আমরা দু’জন ছিলাম দু’দিকের যাত্রী, অথচ তড়িঘড়ি উঠে পড়ি বেঠিক ট্রেনের এক্‌ ভুল কম্পার্টমেন্টে। যখন ভুল বুঝতে পারলাম, তখন ট্রেন বেশ জোরে চলতে শুরু করেছে। আমরা পরস্পরের দিকে ঘনঘন তাকাচ্ছিলাম, যেন দূরের দু’টি গ্রহ। ট্রেন যখনই একটি ইস্টিশানকে ছোঁয় গাঢ় অন্তরঙ্গতায়, ভাবি এখানে নেমে পড়ব। অথচ নামা হয় না। আমাদের দুজনের মধ্যে কোনও বাক্য, পুরো কিংবা টুকরো, নিবিময়ে সম্ভাবনাই জাগে না। বাক্য উচ্চারণ ছাড়াও কথা বলার জন্যে অন্য ইন্দ্রিয়ের ব্যবহার জীব সমাজে প্রচলিত। আমরা দুজন আপাতত চোখের সহযোগিতা গ্রহণ করি। অন্য যাত্রীরা আমাদের লক্ষ করছে কি করছে না-বিষয়টিকে তেমন আমল দিচ্ছি না। আমার ব্যাকুলতা সারসের মতো গ্রীবা বাড়ায় আমার সিটের উল্টো দিকে, যেখানে সে বসে আছে প্রার্থনার মতো। সারসের চঞ্চু প্রার্থনার প্রবাহে ডোবে, ভিজে ওঠে স্নিগ্ধতায়।হঠাৎ প্রার্থনা কেমন ছড়িয়ে পড়ে শ্রাবণের ভেজা রোদের ধরনে। রোদের মুকুলগুলো কুড়িয়ে নিই। হ্যান্ডব্যাগ হাতে নিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসা ইস্টিশানে নেমে পড়ার উদ্যোগ নিই মনে-মনে। আর দেরি করা ঠিক হবে না, ভাবি। ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছুঁয়ে কিছুক্ষণের জন্যে জিরোয় তৃষ্ণার্ত ঘোড়ার মতো। এদিক ওদিক তাকাই, হ্যান্ডব্যাগ অলস কেরানির মতো আগের জায়গাতেই ঝিম ধরে বসে থাকে। সে-ও শাড়ির আঁচল ঈষৎ গুছিয়ে নিয়ে নিজের সিটে অনড়।আখেরে ট্রেন এসে থামে সব শেষের ইস্টিশানে। এই অন্ধকার, ছন্নছাড়া জায়গাটির পর আর কোনও গন্তব্যের হদিশ ট্রেনের ড্রাইভার, গার্ড কিংবা ইস্টিশান মাস্টার কারুরই জানা নেই। ট্রেনের কামরায় তখন শুধু আমরা দু’জন মুখোমুখি বসে আছি নিশ্চুপ নিষ্পৃহ। কয়েক মুহূর্ত পর আমরা ধূসর, নির্জন প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়ি। দু’জন হাঁটতে থাকি ছায়া-পোহানো কোনও প্রাণীর পিঠের মতো প্ল্যাটফর্মের দুদিকে।কিন্তু এ কী, চোখ ফেরাতেই দেখি, আমরা দু’জন পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছি। হাওয়ায় নড়ছে ওর কানের দুল আর কালো চুলের ঢালে জোনাকির জ্বলা আর নেভা, নেভা আর জ্বলা। একটি শক্ত আর একটি নরম অন্য রকম সঙ্গীত পিপাসু হাতে বেজে ওঠে যুগলবন্দি।   (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
রূপক
জাভেদ, তোমার কথা বেশ কিছুদিন ধরে আমি ভাবছি প্রত্যহ। কবে কোন্‌ সালে কোন্‌ সে শ্রীহীন পাড়ায় জন্মেছো তুমি, কী যে নাম সে বিদ্যালয়ের, ছিমছাম সেনার কদমছাঁট চুলের মতন ঘাসময় অনুপম উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে যার পড়েছিল তোমার প্রথম পদচ্ছাপ, কবে বিশ্বাবিদ্যালয় থেকে কতিপয় পুস্তকের জ্ঞানগাম্যি চেখে নিয়েছিলে সডিগ্রী বিদায়, তারপর জুটিয়ে মাঝারি চাক্‌রি বে-থা করে বেঁধেছিলে ঘর- যথারীতি পুত্র কন্যা এনে বছর বছর, চোখ-বাঁধা বলদের মতো নিত্য ঘানি টেনে অকালে পাকালে চুল,-এই সব কথা ইতস্তত; বুঝেছো প্রায়শ ভাবি আজকাল। কত ঝড়-ঝাপটা, কত যে জাহাজডুবি দেখছো জাভেদ সচক্ষে, অথচ কোনো নিষ্কুল নির্বেদ কখনো তোমাকে খুব ভুগিয়েছে বলে জানা নেই; এড়িয়ে গিয়েছো ঠিক নিঁভাজ কৌশলে।অনেক ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে তুমি কি মাঝরিদের চেয়ে কিছু উঁচূ হতে চেয়েছিল বাড়িয়ে নিজস্ব গলা নিত্য জিয়াফের মতো? ঊর্ধ্বারোহণের ছলাকলা অনেকেরই আয়ত্তে সম্প্রতি। ধিক, ধিক জাভেদ তোমাকে ধিক, তুমি বাস্তবিক সর্বদা মাঝারি রয়ে গেলে। সেই আপিশের সিঁড়ি বেয়ে ওঠা ক্রমাগত সপ্তাহে ছ’দিন, আর ভীষণ বিচ্ছিরি গলিতে প্রত্যহ ফিরে আসা, সুপ্রাচীন কংকালের মতো অস্থায়ী, ক্ষয়িষ্ণ বাসা নিয়ে পরিণামহীন ভাবনা এবং দূর স্মৃতি অপ্রেমের খাটস্থিত কাঁথা মুড়ি দিয়ে যথারীতি ঘুমানো, আবার জেগে ওঠা ভোর, ছড়া কাটা সন্তানের সঙ্গে আর জবর খবর পড়া চা খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে, আবার আপিশ, ঘড়ির শাসন, কালি ছিটানো খাতায় আর কিছু ফিস্‌ ফিস্‌, নিত্যদিন নিষ্প্রভ মাইম দেখিয়ে জাভেদ তুমি নাছোড় লোলুপ ঊর্ণাজালে বিপন্ন আটকে পড়ে এই মতো জীবন কাটাল।যুগপৎ গবেষণা আর তদন্তের ঘোরে বারংবার বিশ্লেষণ করে দেখেছি আসলে তোমার বৈশিষ্ট্য নেই কোনো, তুমি সাধারণ মাঝারির দলে রয়ে গেলে আজীবন। কোনো স্বপ্ন, কোনো অভিলাষ আনেনি খ্যাতির ছটা তোমার আঁধারে। দীর্ঘশ্বাস হয়ে আছো শুধু অত্যন্ত নেপথ্যে আর মরুর মতন অতি ধু-ধু জীবনে চলেছো রয়ে চায়ের কাপের স্পষ্ট ফাটলের মতো কিছু দাগ; জাভেদ যমজ ভাই আমার, সতত তুমি কোন্‌ ত্রাসে পুরাণ পুতুল হলে নড়বড়ে বিপন্ন নিবাসে জীবনকে ব্যাধি ভেবে নিজেকেই রূঢ় উপহাস করছো নিয়ত আর দেখছো কেমন নিস্পৃহ বিবশ ছন্দে লক্ষ লক্ষ জাভেদের পঙক্তিতে আরো একজন জাভেদ চলেছে মাথা নিচু করে, যেন প্রেতচ্ছায়া, গন্তব্যের প্রতি উদাসীন, সম্মুখে বিস্তীর্ণ ইন্দ্রধনু মায়া।   (আমার কোন তাড়া নেই কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
স্বপ্নগুলো অবিন্যস্ত টেবিলে টুকরো টুকরো জ্যোৎস্না; জ্যোৎস্নায় উড়ে এসে পড়ে পোড়া ঘরের ছাই। ধুলোবালি খিলখিলিয়ে হেসে ঢেকে দেয় তাকে, যে সবেমাত্র তার স্বপ্নগুলোকে গুছিয়ে রাখছিল চায়ের পেয়ালায়; সে এখন পুরনো কালের বিকৃত মূর্তির মতো।এখানে প্রতি মিনিটে জন্ম নিচ্ছে হাজার হাজার প্রেত, লহমায় বেড়ে উঠে গিলে ফেলছে ঘড়ির মিনিট এবং সেকেন্ডের কাঁটাগুলো। সময় এখানে ভারি পাথরের মতো, প্রেতবাহিনী হাতে গোণা কয়েকটি প্রকৃত মানুষকে ঘরছাড়া করে ঠা ঠা রোদ্দুরে বজ্রপাতের দরনে হাসছে। ওদের মুখ-গহ্বর থেকে গলগল করে বেরোয় রক্ত।লোকগুলো প্রেতবাহিনীর সঙ্গে হাত মেলায় মহা আহলাদে, জুড়ে দেয় খোশগল্প, কী এক রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় ওরা একটু-একটু করে প্রেত-প্রেত হ’য়ে উঠছে খেদহীন। রাতের তৃতীয় প্রহরে তাড়া-খাওয়া কবিগণ ভয়ার্ত ভাঙা গলায় আর্তনাদ করছেন তাঁদের পাণ্ডুলিপিসমূহ পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে বলে নয়, নাগরিকদের মুখগুলো ক্রমাগত নিজস্ব মানুষের চামড়া ত্যাগ করে বিচিত্র জীবজন্তুর রূপ ধারণ করছে বলে।অবিন্যস্ত টেবিলে স্বপ্নগুলো পেরেকময় মাথার দুঃস্বপ্নের সঙ্গে জায়গা বদল করে নিচ্ছে। স্বপ্নচারীর সারা শরীরে পেরেক গাঁথা, শুধু চোখ দুটো জলপায়রার পালকের স্পর্শ পাওয়ার আশায় জাগ্রত, তৃষিত।   (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
হৃদয় নিঃসঙ্গ চিল হয়ে কেঁদেছে ক’দিন তার খবর রাখেনি কেউ। শূন্যতায় বেড়িয়েছি ভেসে, যেন আমি কাটা ঘুড়ি, অনেক কষ্টেও মৃদু হেসে সহজে নিয়েছি মেনে সামাজিকতার অত্যাচার। আমাকে নিষণ্ন পেয়ে গৌরী প্রশ্ন করে, ‘কবি তুমি এমন নিষ্পৃহ কেন আজকাল, এমন শীতল উচ্চারণে, আচরণে? আমি কি ঢেলেছি ঠাণ্ডা জল তোমার উদ্দীপনায়? ভাবাচ্ছে সন্ত্রন্ত জন্মভূমি?কী দেবো উত্তর আমি? নিজেই জানি না, শুধু জানি অন্ধকার গোলকধাঁধায় ঘুরি দিনরাত কেঁপে উঠি ঘন ঘন একা ঘরে, ছায়াচ্ছন্ন এক প্রাণী শিঙ নাড়ে, কষ বেয়ে তার রক্ত ঝরে, আসে ব্যেপে কুঞ্জটিকা হৃদয়ে আমার, তবু তোমাকেই খুঁজি প্রতিক্ষণ, এদিকে ফুরায় দ্রুত পরমায়ু-পুঁজি।   (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
জীবন কেটেই গেল প্রায়, তবু এই স্বদেশের রৌদ্র ছায়া, জ্যোৎস্নাধারা, বুড়িগঙ্গা, মেঘনা নদীর তীর, আপনজনের মধুর সংসর্গ ছেড়ে যাওয়ার ভাবনা কখনও দিইনি ঠাঁই এমনকি মনের গহন কন্দরেও। কারও সাতে-পাঁচে নেই আমি, কখনও দিইনি ছাই কারও বাড়া ভাতে, শুধু একাকী নিজের ঘরে লিখেছি কবিতা।আমার অনেক প্রিয়জন উচ্চাশায় মজে জ্বলজ্বলে এক জীবনের সন্ধ্যানে দিয়েছে পাড়ি ভিন্‌ দেশে, আমি রয়ে গেছি এই প্রিয় বাংলায় আমার বিপদের উদ্যত বর্শা, বন্দুকের মুখে, কাটিয়েছি কত না বিনিদ্র থরথর রাত, এমনকি রক্তরাঙা ঢের দ্বিপ্রহর। বিভীষিকা জীবনের গায়ে পড়া ইয়ার এখন!বুক খুব ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে হাঁটে পথে সিটি বাজাতে বাজাতে সন্ত্রাসের জগতের কত যে মোড়ল, কে তার হিসের রাখে? ধর্মের আড়ালে কত কট্রর সন্ত্রাসী মাঠে ময়দানে, সরকারী ক্যামেরায় দাপট দেখিয়ে বলে, ‘এক্ষুণি বিদায় হও, যাও জাহান্নামেঃ তোমাদের ঠাঁই নেই আমাদের মুলুকে এখন।‘যখন নিঝুম বিষণ্নতা আমাকে দখল করে, দু’পাশের গাছপালা, গোলাপ, চামেলি কৃষ্ণচূড়া, চন্দ্রমল্লিকা এবং বুড়িগঙ্গা, মেঘনা নদীর তীর, শ্যামলীর নীড়, পাড়াতলী গাঁয়ের কাজল মাটি বলে সমস্বরে,- ‘আমাদের ছেড়ে প্রিয় কবি যেও না কোথাও, তুমি আমাদের একান্ত আপন। আমি কাদের প্রস্তাব নেব মেনে?
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
একটি গাছের হাত অভিবাদনের ভঙ্গিতে আমার দিকে উঠে আসে; তাকে কিছু কথা বলতে গিয়েও থেমে যাই। হাত নাড়া দেখি, দূরে পাথরের বুকে জলরেখা ফোটে, তবু গলে না হৃদয় মানুষের। বীণার ধ্বনিকে বোবা করে এখন প্রধান হয়ে ওঠে অস্ত্রের ঝংকার, চারা গাছের পাতারা ছোরার আদলে বাড়ে। এক পাল জন্তু সগৌরবে হেঁটে যায় বিপুল আঁধারে, একদা যাদের নাম মানুষ বলেই জানা ছিল।  (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
কর্ণমূল থেকে খুলে যে ফুল আমাকে দিয়েছিলে একঘর অতিথির দৃষ্টি থেকে দূরে বারান্দায়, এখনো সুগন্ধ তার জীবিত আমার চেতনায়। যখন নিমগ্ন থাকি ফাইলের ধূসর নিখিলে, অথবা কাজের ফাঁকে চোখ রাখি আকাশের নীলে, উড়ন্ত পাখির প্রতি, অকস্মাৎ মনে পড়ে যায় তোমার সে পুষ্পদান কোলাহলময় নিরালায় এবং সুরভি মিলে থাকে মধ্যমিলে, অন্ত্যমিলে।সে ফুলে শুকিয়ে গেছে, কে জানে কোথায় আগোচরে এক ফোঁটা হাহাকার হয়ে আজ হয়েছে বিলীন। মাঝে মাঝে মধ্যরাতে কোনো একজন চক্ষুহীন মুখ নিয়ে এসে আস্তে দাঁড়ায় খাটের পাশে, বলে প্রেতের মতন স্বরে, দারুণ বিরূপ ঝড়জলে তোমাদের প্রেমদীপ্ত তৃষিত হৃদয়ও যাবে ঝরে।   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
কত না জায়গায় চলে যাই, কত বেগানা শহরে, শহরতলীতে ঘুরি, অথচ যাই না দীর্ঘকাল পিতৃপুরুষের গ্রামে। সেখানে ঘুমন্ত পিতামহ, মাতামহ এবং আমার পিতা, স্বল্পায়ু আত্মজ, আরো অনেকেই পারিবারিক কবরস্থানে। ভাবি, কবরের স্তব্ধতাকে প্রায়শই ঈষৎ বিব্রত করে ঝিঁ ঝিঁ পোকা আর আন্ধারকে বুঝি চম্‌কিয়ে দেয় জোনাকির দল, ঘাসগুলো দীর্ঘশ্বাস ফ্যালে।কোনো কোনো মধ্যরাতে মনে হয়, দূর থেকে ভেসে আসে গাঢ় কণ্ঠস্বর, ‘আমার কেমন পুত্র তুই এখানে আমার পাশে দাঁড়াবার সময় হয় না তোর?’ আর একটি সবুজ জলমগ্ন কণ্ঠ ‘বাবা’ বলে থেমে যায় অভিমানে। আমি এই নাগরিক জীবনঘানিতে বাঁধা দিনরাত, কী করে বোঝাবো?   (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
মাঝে-মধ্যে দূরে যাওয়া ভালো ভেবে মনস্থির করি একটি ব্রিজের কাছে সাবলীলভাবে চলে যাবো তুমি আর আমি ধুলিময় পথ হেঁটে একদিন। মেঘার্ত দুপুরে সেই ব্রিজটির কাছে গিয়ে দেখি- সমুখেই তৃণভূমি, একটি স্বপ্নিল ঝিল বেঁকে গেছে দূরে, বুঝি ছুঁতে চায় কোথাও কাউকে আর তিনটি বাছুর মাঠে দৌড়ায়, লাফায় কখনো বা। ট্র্যাক্টর মাঠের স্বপ্নে তুলে তীব্র ঢেউ নিদ্রা যায়। … কোথাও সোনালি ঘণ্টা বাজে বহুদূরে…‘এই দ্যাখো আমাদের আপন দোচালা ঘর এইতো দাঁড়িয়ে আছে দেয়ালবিহীন’, বলে তুমি সেদিকে এগিয়ে গেলে। যেন নিরিবিলি কাচময় স্বপ্নের ডেরায় পেয়ে গেছি ঠাঁই আমরা দু’জন শুকনো খড়ে বসে পড়ি। আমাদের আপ্যায়ন করে গাছপালা, উড়ে-যাওয়া পাখি, দূরবর্তী শান্ত ঝিল। … কোথাও সোনালি ঘণ্টা বাজে বহুদূরে… হাওয়ায় উড়ছে চুল মাঝে-মাঝে, একটি কি দু’টি গুচ্ছ নেমে আসে গালে, তোমার দু’চোখ কালজয়ী প্রাচীন সোন্দর্য যেন। তোমার হাতের সাথে হয় আমার হাতের দৃষ্টি বিনিময় নিসর্গের ঘরে। … কোথাও সোনালি ঘণ্টা বাজে বহুদূরে…একজন বুড়ো লাঠি দিয়ে নাড়ে খড় দূরে, যেন আপন অতীতরাশি নিয়ে মেতেছে খেলায়। তুমি হঠাৎ দুলিয়ে কালো ব্যাগ প্যাস্টোরাল অপরাহ্নে বললে, ‘চলো, ফেরা যাক, গোধূলির ঘ্রাণ আমার শরীরে মেশে, সমাজতো ধৃতরাষ্ট্র নয়। আমি গোধূলির মতো গলে আবার সংহত হই। … কোথাও সোনালি ঘণ্টা বাজে বহুদূরে…গভীর হৃদয়জলে হৃদয় চলেছে ভেসে আজ নিরুদেশে, বিদায়ের বাক্য থাকে প্রতিটি যাত্রায়। দু’জন দু’দিকে যাই, সামনে পথ, শুধু দীর্ঘ পথ ফুলপাতা, গাছ করে উচ্চারণ বাল্মীকির শ্লোক। …কোথাও সোনালি ঘণ্টা বাজে বহুদূরে…   (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
একটি বাদামি ঘোড়া সঙ্গীহীন অপরাহ্নে এসে পড়েছে চওড়া পথে শহরের। মাংসের ভিতর তার জীবনের মর্মমূল যেন করে থরথর অবিরত; ট্রাফিক দ্বীপের ঘাস গাঢ় স্বপ্নাবেশে খাচ্ছে সে নিঝুম আস্তে সুস্থে, প্রায় তার ল্যাজ ঘেঁষে একটি মোটরকার ছুটে যায় অকস্মাৎ খর গতিতে এবং দূরে একজন বামন লজঝড় গাড়ি ঠেলে কোত্থেকে আওয়াজ আসে ভেসে সর্বনেশে।এসব কিছুই তাকে, ঘোড়াটাকে, করে না বিব্রত। পথের আক্রোশ, চোরা আঘাত অথবা পুলিশের বাঁশি, যানবাহনের প্রতি সীমাহীন উদাসীন সারাক্ষণ, মাঝে মাঝে চোখ তুলে এখানে কিসের ডামাডোল দেখে নিতে চায় কিছু। বুঝি সে প্রাচীন শাপভ্রষ্ট গ্রীক দেব, আগন্তুক ভ্রান্তিবশত।  (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
এখনো আমার নামে কোনো গেরেপ্‌তারী পরোয়ানা নেই, আমি অপরাধী তার কোনো সাক্ষী-সাবুদ কোথাও কখনো পাবে না খুঁজে কেউ। তবু কেন হাতকড়া, কয়েদখানার কালো শিক চোখে ভেসে ওঠে বারবার। চারপাশে শুনি কত চোখে ভেসে ওঠে বারবার। চারপাশে শুনি কত গুঞ্জরণ, মনে হয় যেন সবাই আমাকে নিয়ে নানা কথা বলাবলি করে আমার আড়ালে-আবডালে। তাহলে কি হাড়কাঠে গলা দিয়ে বসে আছি? নইলে কেন আজ খামকা নিজের ছায়া দেখে ভয় পাই? কথা বলি ঘুমের ভেতরে? সেদিন রাস্তার ধারে একটি কাফেতে নিরিবিলি কফি খেতে লাগছিল ভালো; অকস্মাৎ খালি সিটগুলো ফিটফাট যুবকেরা নিমিষে দখল ক’রে নিয়ে মেতে ওঠে গালগল্পে। কান পেতে থাকি,- একটি যুবক সিগারেট নিখুঁত ধরিয়ে, ধোঁয়া ছেড়ে আড়চোখে তাকায় আমার দিকে। তার নজর সরিয়ে কাঠের টেবিলে ঠোকে তাল; একজন সুরূপা তরুণী ঠোঁট থেকে ঠোঁটান্তরে ভাসমান মর্গে-শুয়ে থাকা কোনো তন্বীর মতন। তরুণীর একা-একা পথ হাঁটা, বই পড়ার ধরন আর দেহের গড়ন, চুলের কী রঙ দৈর্ঘ্য কীরকম, কণ্ঠস্বর সুরেলা বাঁশির প্রতিধ্বনি কিনা, ওর দুটি চোখে হরিণীর চোখের আদল আছে কিনা, মুখের লাবণ্য আর স্বভাবের নম্রতা অথবা বন্যতার চর্চা হলো বেশ কিছুক্ষণ।সে নাকি হঠাৎ নিরুদ্দেশ কিছুকাল থেকে, না যায়নি সে বিদেশে; এই শহরেই আছে, যদিও সম্প্রতি কাউকে কিছু না বলে দিয়েছে গা ঢাকা। সকলেই জানে তার খেয়ালীপনার পরিচয় কম-বেশি, যুবকেরা বলাবলি করে তাকিয়ে আমার দিকে।যুবাদের বাক্যালাপ শুনে আমার হৃৎপিণ্ড শুধু খাঁচার পাখির মতো ডানা ঝাপটায় ঘন ঘন। কী করে সবাই ওরা চেনে তাকে, যাকে উন্মত্ততাবশে খুন ক’রে দিয়েছি কবর আমার খাটের নিচে। কখনো কখনো মধ্যরাতে সে হেঁটে বেড়ায় স্বপ্নচারিতায় ঝুল বারান্দায়, ছাদের কার্নিশে।   (না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
সাধক যেমন ধ্যানে জপেন নিয়ত পুণ্যশ্লোক, আমার হৃদয়ও তেম্‌নি বার-বার করে উচ্চারণ তোমার মধুর নাম। ঘরে ভ্রমরের গুঞ্জরণ, বাইরে পাখির শিস, হাওকেয়ার বিলাপ, যাই হোক- সবই তো বিশেষ ধ্বনি, সুর বলে কোনো কোনো লোক। শুধু সুর এসব তাদের কাছে। কিন্তু বলে মন, আমার বিস্মিত মন কী তন্ময় যখন তখন- সেই সুর তোমারই নামের ধ্বনি, ধ্বনির কোরক।আমার শিরায় ফোটে নক্ষত্রের মতো অবিরাম কেবলই তোমার নাম, আর যেখানেই চোখ রাখি দেয়ালে কপাটে কিংবা গাছ-গাছালিতে, ঘর দোরে, বেড়ালের পিঠে, দেখি সদা জ্বলছে তোমারই নাম। বলি না কাউকে নাম, শুধু কবিতায় রাখি ধরে আড়ালে, সে-নাম ভাবীকালে গুঞ্জরিত হবে নাকি?   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
আজকাল মাঝে মাঝে সকালে কি সাঁঝে আমাকে ঘিরে বেহাগের করুণ সুরের মতো বাজে তোমার নালিশ। আমার কথা না কি এখন আগেকার মতো তোমার হৃদয়ে সরোবর তৈরি করতে পারে না, পারে না লাল নীল পদ্ম ফোটাতে হাওয়ায় ঈষৎ দুলে-ওঠা মানস সরোবরে আমার কথার মুখ এখন তোমাকে লতাগুল্ম, ফুল, ফলমূল, আর রঙ বেরঙের পাখির গানে গুঞ্জরিত দ্বীপে পৌঁছে দিতে না পারার ব্যর্থতার কালি মেখে নিশ্চুপ থাকে প্রায়শ, এইটুকু তুমি স্পষ্টতই উচ্চারণ করেছ। কস্মিনকালেও বাকপটু নই আমি, প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারিনি কোনও চারুবাকের। এই দড় কথা গুছিয়ে বলার খেলায়। তুমি যথার্থই বলেছি আমি লোকটা ঘোর স্বার্থপর। স্বীকার করি, অনেক কথাই সযত্নে সঞ্চিত রাখি কবিতার জন্যে। কথোপকথনের মুহূর্তে কথা পাখির কোন্‌ পালক কখন ছোঁব, বুঝতেই পারি না। পরিণামে কিছু অনাবশ্যক, বেসুরো কথা অথবা দীর্ঘ নীরবতা।থাক এসব বকুনি। এই যে আমি আমার ভালোবাসার মঞ্জরী সাজিয়ে রাখি তোমাকে বুকে, তোমার কালো চুলের ঢালে, তোমার আসা-যাওয়ার পথে, সেগুলো তুমি কুড়িয়ে নাও না কেন?  (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
যে আমার সহচর আমি এক কংকালকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটি, প্রাণ খুলে কথা বলি পরস্পর। বুরুশ চালাই তার চূলে, বুলোই সযত্নে মুখে পাউডার, দর্জির দোকানে নিয়ে তাকে ট্রাউজার, শার্ট, কোট ইত্যাদি বানিয়ে ভদ্রতাকে সঙ্গীর ধাতস্থ করি; দু’ বেলা এগিয়ে দিই নিজে প্রত্যহ যা খাই তাই। কখনো বৃষ্টিতে বেশি ভিজে এলে ঘরে মাথাটা মুছিয়ে তপ্ত চায়ের পেয়ালা রাখি তার টেবিলে সাজিয়ে আর শোনাই বেহালামধ্যেরাতে বন্ধ ঘরে। মাঝে –মাঝে তাকে হৈ-হৈ রবে নিয়ে যাই বন্ধুদের গুলজার আড্‌ডার উৎসবে। সেখানে সে বাক্যবীর, দর্শনের অলিগলি ঘুরে শোনায় প্রচুর কথামৃত, সাহিত্যের অন্তঃপুরে জলকেলি করে তার বেলা যায়, কখনো যা ফের “শোনো বন্ধুগণ, আত্মাটা নিশ্চয় দামী পাথরের বাক্স নয়,—সংশয়ের কালো জলে পারবে কি ভেসে যেতে এই আত্মার পিছল বয়া চেপে নিরুদ্দেশে? পাবে তীর কোনোদিন?”-ইত্যাকার চকিত ভাষণ দিয়ে সেও প্রগল্‌ভ আড্‌ডাকে করে প্রভূত শাসন।গলির খেলুড়ে ছেলে যে আনন্দে কাগজের নৌকো ছেড়ে দেয় রাস্তা-উপচানো জলে কিংবা কিছু চৌকো ডাক টিকিটের লোভে পিয়নের ব্যাগের ভিতর দৃষ্টি দেয়-তারই খুশি কংকালের দুটি যাযাবার চোখ ধরে রাখে। তারপর অকস্মাৎ, “মনে আছে হাতের বইটা ফেলে রেখে বারান্দায় খুব কাছে টেনে নিয়েছিলে কাকে? মনে পড়ে সে কার ফ্রকের অন্তরালে উন্মীলিত হিরণ্ময় মসৃণ ত্বকের অন্তরঙ্গতায় তুমি রেখেছিলে মুখ? মনে পড়ে গোধূলিতে কৌমার্য হরণ সেই কৈশোরের ঘরে?” -বলে সে কৌতুকী উচ্চারণে, যে আমার সহচর, রয়েছে যে রৌদ্রজলে পাশাপাশি ছত্রিশ বছর।আমি এক কংকালকে সঙ্গে নিয়ে চলি দিনরাত অসংকোচে, আতংকের মুখোমুখি কখনো হঠাৎ তাকে করি আলিঙ্গন, প্রাণপণে ডাক নামে ডাকি দাঁড়িয়ে সত্তার দ্বীপে নি-শিকড়, একা, আর ঢাকি ভীত মুখ তারই হতে। যে কংকাল বান্ধব আমার তাকে নিয়ে গেছি নিজের প্রিয়তমার কাছে আর অকাতরে দয়িতার তপ্ত ঠোঁটে কামোদ চুম্বন আঁকতে দিয়েছি সঙ্গীটিকে! কী যে নিবিড় বন্ধন দু’জনের অস্তিত্বের গ্রন্থিল জগতে, বুঝি তাই ঘৃণায় পোড়াই তাকে, কখনো হৃদয়ে দিই ঠাঁই!   (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
কাউকে কিছু না বলে কখন যে ফাল্গুন হঠাৎ সটকে পড়েছে। এখন তো বাংলাদেশ চৈত্রের চিৎকার পাতার আড়ালে, শ্রমিকের পাতের গরম ভাতে, নিউজপ্রিন্টের ভাঁজে ভাঁজে পঙ্গু প্রেমিকের হাহাকারে, নিশাচর কুকুরের চোখে, চন্দ্রাহত হা ভাতে বস্তির অরক্ষিতা তরুণীর যৌবনের উদগ্র চিতায়।মুংকের চিত্রের চিৎকারের মতো একটি চিৎকার, চরাচরব্যাপী, ইদানীং এ শহরে কী ব্যাপক ছড়িয়ে পড়েছে, মনে হয়, মূক বিপর্যয়বোধ নিয়ে।বিপর্যয়ে অনেকেই ভীষণ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। বারংবার নানান উদ্ভট চিত্রকল্প ঘিরে ধরে তাদের এবং ওরা ভয় পায়, বড় ভয় পায় এমনকি নিজেদের ছায়া দেখলেও।কেউ কেউ উন্মাদের মতো আচরণে পাড়া-পড়শিকে আরও বেশি করুণ ভয়ার্ত করে তোলে। বিপর্যয়ে কেউ কেউ মাথা ঠাণ্ডা রাখে, থাকে স্থির, যেনবা নক্ষত্র এক, দিগ্‌দর্শনের আলো আছে, স্বতন্ত্র স্বভাবে এক কর্তব্যরত প্রহরীর মতো কেউ কেউ সুষ্ঠুভাবে শিবিবের তদারক করে। অকস্মাৎ রসদ ফুরিয়ে গেলে, শিরায় শিরায় কুয়াশার হিম ছড়িয়ে পড়লে দাঁতে দাঁত চেপে, কষে ধরে মুঠোয় পতাকা সটান দাঁড়িয়ে থাকে পতাকারই মতো গহন সৌন্দর্যে একা। বিপুল ধ্বংসের তাণ্ডবেও কবিতার ডানা লীলায়িত হয়, বিধ্বস্ত ছাদের নিচে, ভাঙা দেয়ালের আড়ালে জ্যোৎস্নায় তীব্র চুমো খায় যুবক-যুবতী। বসন্ত বরের মতো আসে ভাঙাচোরা পথে অভ্যর্থনাহীন, বৃদ্ধেরও সংগমস্পৃহা খুব বেড়ে যায় রাতারাতি। ধ্বংসস্তূপ থেকে কেউ তুলে নেয় পিতলের বাঁশি, কেউবা নিঃসীম প্রেতায়িত পূর্ণিমায় কী ব্যাকুল কণ্ঠস্বরে পাষাণপুরীর পাথুরে বাসিন্দাদের স্তব্ধ ঘুম ভাঙাবার চেষ্টা করে প্রহরে প্রহরে।   (উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
প্রতিদিন ভিড় ঠেলে পথ চলি, দেখি সবখানে দলাদলি, মরমুখো সব দল, খুন খারাবির জন্যে তৈরী সর্বক্ষণ অনেকেই, শান্তির দাবির যেন মূল্য নেই কোনো। মোহময় শ্লোগানে শ্লোগানে মুখর চৌদিক, অতিকায় জন্তু বিধ্বস্ত উদ্যানে ভীষণ চঞ্চল, অন্ধ ওরা আর জন্মেই বধির- তাহলে কোন্‌ দলে ভিড়ে ঢেকে নেবো মাথা শিরস্ত্রাণে?আমার শিবির নেই কোনো, আমি অত্যস্ত একাকী পড়ে আছি এক কোণে নিরস্ত্র এবং বর্মহীন কী জানি কিসের প্রতীক্ষায় দৃষ্টি জ্বেলে রাত্রিদিন। মাঝে মধ্যে বিরানায় ডাকে একলা ভয়ার্ত পাখি, আমি কবিতার রক্তোৎপল বুকে মুখ ঢেকে থাকি কী অমোঘ ঘৃণা আর উপেক্ষার প্রতি উদাসীন।   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
অমন তাকাও যদি একবিন্দু অনন্তের মতো চোখ মেলে, আমি বারবার তোমার দিকেই ছুটে আসবো প্রত্যহ।যেখানে তোমার দৃষ্টি নেই, তোমার পায়ের ছাপ পড়ে না যেখানে কেনোদিন সেখানে কী করে থাকি? তোমাকে দেখার জন্যে আমি যশের মুকুট ছুঁড়ে দেবো ধূলায় হেলায়, তাকাবো না ফিরে ভুলে কস্মিনকালেও আর। মেনে নেবো হার, এই খর মধ্যাহ্নেই হয়ে যাবো স্বেচ্ছায় সূর্যাস্ত; জেনে রাখো, তোমাকে দেখার জন্যে বেহেস্তী আঙুর আর কয়েক ডজন হুরীর লালচ আমি সামলাতে পারবো নিশ্চিত।তোমার নিদ্রার ঢেউয়ে ঢেউয়ে যাবো বেয়ে ছিপ নৌকো এবং লাফিয়ে প’ড়ে তোমার স্বপ্নের তটে আবিষ্কারকের মতো দেবো পুঁতে আমার নিঃশ্বাসে আন্দোলিত এক পবিত্র নিশান।কখনো নিদ্রার রাজপথে, কখনো-বা জাগরণে বাগানে কি পার্কে সড়কে ট্রাফিক দ্বীপে, বাসে গোলাপ শ্লোগান হাঁকে একরাশ, উড়ন্ত কপোত অকস্মাৎ দিগ্বিদিক লুটোয় নিষিদ্ধ ইস্তাহার হ’য়ে, পড়ি, ‘নরকেও ভালোবাসা ম্যানিফেস্টো হিরন্ময়। অমন দাঁড়াও যদি নিরিবিলি পা রেখে চৌকাঠে, সমর্পণ করতে পারি আমার সমস্ত আয়ুষ্কাল তোমারই আঁচলে। যদি পাপ তোমার শরীর হ’য়ে নত নয়, হয় উন্মোচিত, দ্বিধাহীন তাকে খাবো চুমো গাঢ়, বাঁধবো ব্যাকুল আলিঙ্গনে।   (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
রূপক
এই যে কবি ভর দুপুরে হন্তদন্ত হয়ে এখন যাচ্ছো কোথায় কোন্‌ ঠিকানা লক্ষ্য ক’রে? উশকো খুশকো ঢেউ-খেলানো লম্বা চুলের নিচে আছে মস্ত দামি মগজ বটে, সেখানে এক ফুল-বাগানে গানের পাখি সৃষ্টি করে সুরের আলো।হায়রে কবি, ধুলোয় তোমার পাঞ্জাবি আর পায়জামাটা ধূসর হলো, তবু হাঁটা থামছে না যে। আর কতটা পথ তোমাকে হাঁটতে হবে? দুপুরটি কি বিকেল হবে? নাকি কালো সন্ধ্যা হয়ে ভেঙচি কেটে ভয় দেখাবে ক্লান্ত এই পথচারীকে! কবি তুমি পথ হারালে বেলা শেষে?পথ হারালে যাবে কোথায় এ শহরে আলোবিহীন কোন্‌ অজানা আস্তানেতে? কেউ কি তোমার হাতটি ধ’রে নিয়ে যাবে শান্তিময়ী কারও কাছে, যার মোহিনী ছোঁয়ায় তুমি ক্লান্তি থেকে মুক্তি পাবে ? কবি তোমার মনে তখন ফুলের মতো পদ্য কোনও উঠবে ফুটে।এইতো দ্যাখো কবি, তোমার কল্পনাকে ধনী ক’রে চতুর্দিকে আঁধার ছিঁড়ে জ্বলে ওঠে হাজার বাতি, এখন তুমি এই শহরে রাজা বটে। হাতে একটি কলম পেলে আলাদা এক রাজ্য জানি উঠবে গড়ে।   (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
স্বদেশমূলক
‘এসো সখি’বলে বহু যুবরাজ তোমাকে সর্বদা’ তেপান্তরে, নদীতীরে, কাশবনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছায়াচ্ছন্ন শাল তাল তমালের ভিড়ে টেনে এনে মধ্যদিনে শুনিয়েছে রাখালের বেণু। বড়ো বেশি জলজ কণিকা ফুসফুসে জমেছিলো বলে তুমি ভুগেছো সর্দিতে খুব, এত ছিঁচকাঁদুনে হয়েছো আদরিণী কাব্যলক্ষ্মী আমাদের, এত আলুথালু!তোমাকে বালিকা ভেবে অনেক চটুল মান্যবর অক্লান্ত বাজিয়েছেন ঝুমঝুমি আর লজেজ্ঞুস সেধেছেন, কেউ কেউ রঙিন রিবনে বাঁধা কিছু মনোহারী বাক্স-তুমি হাসিমুখে করেছো গ্রহণ।(মাঝে-মাঝে ক’জন ঐন্দ্রজালিক নালিমার থেকে ছিনিয়ে হাঁসের মালা দিয়েছে তোমার কোলে ছুঁড়ে) দেখেছি তো কতিপয় বিদূষক সাতপুরুষের কাহন কাহন সোনারূপো দিয়ে নাকছাবি আর কেয়ূর, পায়ের মল দিয়েছে গড়িয়ে, তুমি গর্বে গরবিনী, বেড়িয়েছো পাড়া সেই কিঙ্কিণী বাজিয়ে।না, আমি নিন্দুক নই। তুমিতো জানোই কী আনন্দে তোমার সান্নিধ্য চাই, একনিষ্ঠ প্রেমিকের মতো বসে থাকি তোমারই বাগানে। বেল জুঁই কি টগর ইত্যাদি বটেই, এমনকি মরাপাতা নিই তুলে ব্যগ্র হাতে। যখন উধাও সব পুষ্পল স্বপ্নেরা তখন ও তোমার তীব্র আধিপত্য চৈতন্যে আমার।না, আমি নিন্দুক নই। আপাতত অসহ্য তোমার চটকসর্বস্ব মুখ-এতকাল একই অঙ্গরাগ দেখে ঘেন্না ধরে গেছে। যখন ঝুলন্ত বারান্দায় দাঁড়াও, বাড়াও মুখ আর হৃদয় দুয়ার খুলে উঁকি মারো জনপথে, কিংবা নিশীথ টেবিলে রেখে অলংকার, বিবর্ণ দস্তানা তুমি শস্তা হোটেলের কামরায় ভাসমান প্রমোদ হিল্লোলে, অনেকটা বুক-পেট দেখিয়ে দুপুরে ত্রভিনিউ ঘুরে ঘুরেযখন উত্তাল ঢেউ তুলে হাঁটো নিতম্ব দুলিয়ে, লজ্জা কি পাও না তুমি? আমি মুখ নিচু করে থাকি। একই প্রসাধিত মুখ, একই ছলাকলা দেখে দেখে আলোড়িত অন্ত্রতন্ত্র-বিবমিষা, শুধু বিবমিষা!বারোয়ারী যে মালা পরেছো সেতো পচে পচে আজ এক স্তূপ দুর্দশার মতো আর অভিনবত্বমাতাল কিছু যুবা তোমাকে নামালো পথে, বনেদী জরির শাড়ি সাতফালা করে ছিঁড়ে গুঁড়ো এলাচের মতো নক্ষত্রখচির সার্বভৌম অন্তর্বাস কুটি কুটি করলো সখেদে। তুমি ধুলোয় উবুড় হয়ে রইলে লাস্যময়ী! স্বেচ্ছাসেবকের দল প্রবল উদ্যমে তোমার মরালকণ্ঠে দিলো পুরে কতো দুর্ভিক্ষের বিশীর্ণ পাঁচালি। পচা মাখনের মতো দুর্বিষহগন্ধ-প্রসবিনী শরীরে তোমার ভনভনে মাছি এক ঝাঁক। বলো, বিদ্যাধরী, বলো ন্যক্কার, নেইকি কিছুতেই? ঘেন্না, বড়ো ঘেন্না, বড়ো বেশি ঘেন্না লাগে- কালের মন্দিরা বাজে ডানে বাঁয়ে দুই হাতে, শোনো, এসো ভিন্ন সাজে বিদ্যাধরী ওগো ঘেন্না-জাগানিয়া!   (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
নির্জন গুহায় থাকি হাঁটু মুড়ে, কখনো নিদ্রায় অভিভূত। আলো নেই কোনোখানে, বেরুতে পারি না, পাছে ওরা শিকারি কুকুরগুলো আমার পেছনে ভীষণ লেলিয়ে দেয়। আমার রক্তের ধারা বয়ে গেলে ওরা হো হো হেসে আর কাড়া নাকাড়া বাজিয়ে দশদিক আনন্দ ধ্বনিতে ভরে দেবে। পড়ে আছি এক কোণে অসহায়; ভাবনার ভেলা পারাপার করে এই দুঃখিত আমাকে। গুহাগাত্রে হিজিবিজিছায়াগুলো সঙ্গ দেয়। অন্ধকারের চাঙড় ভেঙে কেবলি পড়তে থাকে আমার উপর; চেষ্টাহীন থাকবো কী পড়ে সর্বক্ষণ? যতই আলোর দিকে যেতে চাই, ততই আঁধার আসে ব্যেপে, যেন ক্রূর বাইসন আমাকে ধারালো শিঙে গেঁথে নিয়ে ছোটে দিগ্ধিদিক; আমি আলো, আলো বলে দীপ্র ধ্বনি তুলি।
শামসুর রাহমান
সনেট
কখন মিটিঙ ভেঙে গ্যাছে, মিটে গ্যাছে বেচা-কেনা সকল দোকানপাটে, ফলের বাজার শূন্য; ঘরে ফিরি দীর্ঘ পথ হেঁটে একা-একা, বুকের ভেতরে কী একটা কষ্টবোধ, ভিড়ে কাউকে যায় না চেনা। পাঁশুটে জ্যোস্নায় দেখি মৃতের মিছিল। তাকাবে না ফিরে ওরা, মনে হয়, কপ্সিমকালেও; চরাচরে আর কোন টান নেই জেনেই বুঝি বা এ শহরে নির্বিকার হেঁটে চলে, দেবে না চুকিয়ে কোনো দেনা।পাঁশুটে জ্যোৎস্নায় অকস্মাৎ ডানা-ঝাপটানি, ডাক শোনা যায়; এক দুই, তিন, সংখ্যাহীন পক্ষী এসে ছাদের কার্নিশে, ফুটপাতে আর রিক্ত রেস্তোরাঁয় বসে; ওরা তৃষাতুর, মানুষের মগজের নিভৃত প্রদেশে প্রবেশ করতে চায়। যেন ওরা জয়নুলী কাক, বিংশ শতাব্দীর কবিতার মতো গূঢ় ডেকে যায়।   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
না, আমি ভাস্কর নই, রোজ তাল তাল কাদামাটি নিয়ে মূর্তি গড়ি না, অথবা পাথরের স্তব্ধতায় পারি না জাগাতে কোনোক্রমে মৃত্যুঞ্জয় ধ্বনি, হায়, প্রতিমার। আমার আঙুলে নয় দীপ্র জাদুকাঠি, স্পর্শে যার দেয়াল চকিতে যাবে ছেয়ে কিছু খাঁটি অজর ফ্রেস্কোয় কিংবা জাগবে জোয়ার সাহারায়, অথবা উঠবে গড়ে মরুদ্যান; আমিতো ভূতল আস্তানায় একা ছন্দমিল খুঁজে খনি শ্রমিকের মতো খাটি।   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
কবীর চৌধুরী ঠিকই বলেছেন, জ্বলছে স্বদেশ- প্রায় প্রতিদিন মরে লোক গুলি খেয়ে খোলা পথে, পুলিশের জুলুমে জর্জর দেশবাসী, কোনো মতে দিন কাটে প্রতিবাদী নেতাদের প্রত্যহ অশেষ ঝুঁকিতে এবং অনেকেই হচ্ছেন আটক। বেশ আছেন আনন্দে মেতে নারী নীরো, বাজাচ্ছেন বাঁশি মসনদে বসে, ঠোঁটে তার খেলে যায় ক্রূর হাসি ক্ষণে ক্ষণে, পারিষদবর্গ তার কাছে সুখবর করে পেশ।অবৈধ শাসক যারা, তারা সাধারণ মানুষের ইচ্ছা অনিচ্ছায় সারে দাফন নিমেষে, স্বৈরাচারে বুঁদ হয়ে থাকে; কিন্তু বোঝে না দেশের জনগণ শক্তিমান স্যামসন, অন্ধ করে রাখলেও টের পায় অনাচার, অবিচার আর প্রবল হুঙ্কারে কেশর দুলিয়ে ত্বরান্বিত করে শক্রর পতন।   (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
“না, আমি কস্মিনকালে তোমার এ নৈঃসঙ্গ্য ঘোচাতে পারবো না”, বলে তুমি সেই ছোট ঘরটি গোছাতে মন দিলে। এটা-সেটা নেড়ে চেড়ে তুলে নিলে দুল বালিশের নিচে থেকে, পরলে আবার। এলোচুল সহযে বিন্যস্ত হলো; পরিচিত গন্ধমাখা ঘরে বিধ্বস্ত স্নায়ূর রাজ্য, বন্দী আমি ভয়ের নিগড়ে!বুঝি তাই অকস্মাৎ বুকে টেনে নিলাম তোমাকে সংক্রামক হতাশায়। বললামঃ “হত্যা করো তাকে,- আমার এ নৈঃসঙ্গ্যকে; তোমার স্বপ্নের পাটাতনে তুলে নাও হাত ধরে। বাকল-বঞ্চিত গাছ বনে যেমন দাঁড়িয়ে থাকে তেম্‌নি তুমি থাকে আজ পাশে, আলিঙ্গনই জানি রক্ষাকবচ এমন সর্ব নাশে।“নৈঃসঙ্গ্য হত্যায় মেতে খুলে নিলে দুল, নিরুত্তাপ বালিশে নামলো কালো উচ্ছল প্রপাত। কার ছাপ খুঁজি তবু সবখানে? উন্মীলিত তোমার দু’চোখ আমার চোখের নিচে, যেন দুটি সভ্যতার শোক ভ্রষ্টলগ্নে শুধু কাঁপে পাশাপাশি। দু’চোখের তটে সে মুহূর্তে দেখি মহাপ্লাবনের দাগ জেগে ওঠে।   (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
আমি ভূমিষ্ঠ হয়েছিলাম এই শহরের অখ্যাত গলির এক মাটির ঘরে; এতকাল পরেও হঠাৎ যখন আমার হাত নিজের অজান্তেই নাকের কাছে এসে যায়, একটা মন-কেমন করা সোঁদা গন্ধ পাই। যে ঘরে প্রথম চোখ মেলেছিলাম কার্তিকের রৌদ্রে, সে-ঘরে পড়ত একটা গেয়ারা গাছের ছায়া, সে ছায়া এখনও ঘন হয়ে আছে আমার চোখে। এখনও পেয়ারা গাছের আনন্দিত সবুজ পাতাগুলি মর্মরিত আমার শিরায় শিরায়। গাছটার ডালে অনেক দূর থেকে-আসা পাখি যে সুর ঝরিয়ে দিত ঋতুতে-ঋতুতে তা’ এখনও খুব গুঞ্জরণময় স্মৃতিতে আমার। যে-ঘরে আমি জন্মেছিলাম তাকে কিছুতেই বলা যাবে না গানের ঘর। সে ঘরে সেতার কি সরোদ, এস্রাজ কি সারেঙ্গি গুমরে ওঠেনি কোনো দিন। কখনো বোল ফোটেনি তবলায় কিংবা কারো কণ্ঠে জাগেনি চমকিলা কোনো তানকারি। তবে ছেলেবেলায় আমাদের সরু গলিতে সেই কবে কোন মধ্যরাতে কে পথিক আমার মনের ভেতর সুদূর এক নদীতীরের ছবি জাগিয়ে হেঁটে গিয়েছিল, আজও মনে পড়ে। আজও কোনো-কোনো রাতে যখন আমার ঘুম আসে না কিংবা মন ভালো থাকে না, হঠাৎ আমি শুনতে পাই রাতের গলায় দরবারি কানাড়া, পায়ে স্বপ্নের নূপুর। এবং একজন মানুষের পুতুলনাচ ঝলসে ওঠে বারংবার। হ্যাঁ, চিনতে পারছি এঁকে; এই লোকটাই কৈশোরে চুল ছেঁটে দিত আমার সাবান, ফিটকিরি আর সস্তা পাউডারের ঘ্রাণময় সেলুনে। ওর মাথায় পাগড়ি, যুগল ভোজালির মতো উচ্চকিত গোঁফ, তার সালোয়ারের ভাঁজে ভাঁজে সুদূর পাহাড়ি কোনো দেশের নানা চিত্রকল্প।এখন আমার ঘর কাঁটা চুলের স্তূপে নিমজ্জিত; সেই স্তূপ থেকে এই মাত্র উঠে এলো এক নারী, যার গ্রীবায় মীরার ভজনের ছায়া, দু’চোখের যমজ গোলাপ, ওষ্ঠে চন্দ্রভস্ম। সে এক মাটির ঘরে প্রবেশ করে আস্তেসুস্থে আমার অভিলাষকে উসকে দিয়ে। কখনো দেখি, সে মাটির ঘরের দিকে স্মৃতি ফিরিয়ে দেখি, আমার আশার গুচ্ছ-গুচ্ছ মঞ্জরি ইলেকট্রিকের তারে আটকে-থাকা ঘুড়ির মতো ক্রমশ বিবর্ণ হচ্ছে, কখনোবা চাঁদকে বিশ্বাস করে দেখি পূর্ণিমা চাঁদের মতো টেবিলের দু’দিকে দু’জন নাবিক খেলছে রামি; একজনের চোখ থেকে ঝুলছে অত্যন্ত পাথুরে স্বপ্ন, অন্যজনের ঠোঁট থেকে ঝুলছে ঈগলের চঞ্চুর মতো পাইপ।মেশকে আম্বরের অস্পষ্ট ঘ্রাণময় আতরদানি, হুঁকোর দীঘল নল, পোষা পায়রা, তাকে-রাখা বিষাদসিন্ধু, একটি চোখ আমার নানার কণ্ঠনিঃসৃত সুবে-সাদেকের মতো আয়াত, নানীর দীর্ঘশ্বাসসমেত সেই মাটির ঘর এখন আমার উদরে। সেই ঘরের কথা ভাবতে গিয়ে আমি সে ঘর আর দেখি না।   (উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
আমি তো ছিলাম ভস্মরাশি হয়ে গৌরববিহীন অন্ধকারে সুনসান এলাকায় অনেক বছর। আমার ওপর বয়ে গ্যাছে কত যে বৈশাখী ঝড়, তুহিন বাতাস তীক্ষ্ম ছুঁয়েছে আমাকে রাত্রিদিন। তবুও নিস্পন্দ একা ছিলাম নিয়ত গমগীন্‌ অগ্নিদগ্ধ বেহালার ভস্মের মতন স্তব্ধতায়; করেনি আমার প্রতি দৃষ্টিপাত কেউ, বেলা যায় বলে আমি করেছি চিৎকার, তবু ছিলো উদাসীনপ্রতিবেশ সারাক্ষণ, পাইনি জীয়ন স্পর্শ কারো। আমাকে জাগালে তুমি রুক্ষ অবেলায়, দিলে গান অস্তিত্বের তন্তুজালে। অথচ আমি তো জানি গাঢ় এই দান ব্যর্থ হবে, যদি নাও বিদায় হঠাৎ। তোমাকে ডাকছে দূরযাত্রা, বেজে ওঠে অবসান- সূর্যোদয় দিলে কেন, পাবোই যখন অন্ধ রাত?    (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
ঢের পথ হেঁটে আখেরে আঁধারে জনহীন স্থানে এক কৃষ্ণকায় দালানের কাছে এসে থামতেই অকস্মাৎ বড় বেশি কুচকুচে কালো রুমে দরজার বুক খুলে গেল।শূন্য, অতিশয় ছমছমে ঘরে অকস্মাৎ চার দেয়ালের বুক চিরে রক্তধারা বইতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে ক’জন অদেখা যুবতীর কান্নায় চৌদিক বুকফাটা মাতমের ডেরা হয়!শোণিতের ধারাময় অন্ধকার ঘর থেকে যত তাড়াতাড়ি বেরুবার স্পৃহা জেগে ওঠে মনে, যত পা বাড়াই দরজার দিকে, তত পদদ্বয় যেন শীতল পাথরে বেশি গেঁথে যেতে চায়।তবে কি আমার মুক্তি নেই কিছুতেই? তবে কি আখেরে মরণপ্রতিম চার দেয়ালের ভেতরেই এক অজানা কঙ্কাল হয়ে থেকে যাব চিরকাল? আখেরে সহসা বুক-ফাটা শব্দ করে মুক্তি পেতে চাই। পড়ে থাকি যেন পথে!   (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
যখন আমার কেউ থাকে না, তখনও সে থাকে। সকল সময় ওর ঠোঁটে শরতের রোদ্দুরের মতো হাসি জড়ানো। ওর ঘন কালো চুলের বিন্যাস কখনো বিপর্যস্ত; শরীরের ঢেউ স্বপ্নের নক্‌শা আঁকে অবিরত সন্ধ্যার আবছা স্বপ্নাভায়, রাত্রির স্তব্ধতায়। তার কাছে যেন আমি প্রার্থনা করি ভালোবাসবার অবসর এবং অমিতরায়ের ধরনে তার কানে কানে বলি, আমার ভালোবাসা নয় ঘড়ার জল, ওতে আছে দিঘির সাঁতার। আমাদের ভালোবাসাবাসি শেষ অব্দি টিকবে কিনা জানিনা, তবে এই মুহূর্তগুলি সত্যের জ্যোর্তবলয়ে ঘূর্ণ্যমান। ওকে নিয়ে পার্কে বেড়াই বিকেল বেলা, ফুচকা, চটপটি খাই, মাঝে-মধ্যে রেঁস্তরার কেবিনে বসি; পায়ে পা ঘষি, চুমু চুমু খেলা খেলি, একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমীর গ্রন্থমেলায় যাই, কখনো পাশাপাশি হাঁটি মীনাবাজারে।কোনো কোনো মধ্যরাতে দেয়াল থেকে নামিয়ে আনি তাকে, চোখে তুলে নিই, আলিঙ্গন করি বারবার। তখন হঠাৎ আমার ভেতর জেগে ওঠে পাগলা মেহের আলি।   (অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
আমার এই পুরোনো ঘরের ভেতরে আলো চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে বাইরে। পাখিটাখির ডাকও শোনা যাচ্ছে আমি রোজকার মতো আজো চোখ কচলাতে কচলাতে জেগে উঠলাম। তাকালাম চাদ্দিকে, একটা প্রত্যাশা নিয়ে, না আমি আমার সেই আকাঙ্ক্ষিত সূর্যোদয় ধারে কাছে কোথাও দেখতে পেলাম না।আজ একথা আমার কাছে আমার হাতের রেখার মতোই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, তুমি মিথ্যা বলেছিলে, জাভেদ তুমি বলেছিলে-আমার মনে পড়ছে এইতো আমি তোমার সেই কণ্ঠস্বর শুনতে পাই; ঝড়ে পড়া জাহাজের কাপ্তান যেমন তার নাবিকদের উদ্দেশে বলেন- তুমিও তেমনি বলেছিলে- এই আবলুশ কাঠের মতো অন্ধকারই শেষ কথা নয়। আমাদের সামনে এক নতুন সূর্যোদয় যা ভবিষ্যৎ রাঙা পোস্টারের মতো টানিয়ে দেবে, আমরা সবাই জোরে শোরে হাততালি দিয়েছিলাম সেদিন তোমার সেই উচ্চারণে। আমার শিথিল পেশীগুলি সেদিন টান টান হয়ে গিয়েছিল- আমার চোখে উড়ে এসে বসেছিল স্বপ্নের অজস্র পাখি- পোস্টম্যানের মতো হনহনিয়ে চলেছে সময়। পাড়ার ইয়াসিন দর্জি বয়সের ভারে বেঁকে ঈদের চাঁদের মতো হয়ে গেছে, নেয়ামত ওস্তাগার পুব দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অন্ধ হয়ে গেল জাভেদ রিকশাঅলা তার নুন আনতে পান্তা ফুরানো সংসারটাকে বিরান ক’রে, হাড়গুলোকে জুড়োতে চলে গেল কব্বরে এই দ্যাখো জাভেদ আমার কালো চুল দেখতে দেখতে কেমন শাদা হয়ে গেল, জাভেদ আজ আমি জেনে গেছি তুমি একটা মিথ্যাকে সত্যের সাজ পরিয়ে ডুগডুগি বাজাতে বাজাতে নাচুনে বানরের মতো ছেড়ে দিয়েছিলে আমাদের সামনে।জাবেদ ভেবনা আমি তোমার নিন্দামন্দ করার জন্যে কোমর বেঁধে লেগেছি; আমি জানি অনেক মোটা মোটা বইয়ের সূক্ষ্ণ আলো তোমার মনের ঘুলঘুলিতে খেলা করে অষ্টপ্রহর বহুবার জেলখাটা তোমার শরীরে মনীষার ভাস্বর ছায়া পড়ে একথা আমার অজানা নয়; তোমার কাছে ঋণের আমার অন্ত নেই জাভেদ তুমিই প্রথম আমাকে একটা আশ্চর্য সূর্যোদয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছিলে। আমার চির আকাঙ্ক্ষিত সেই সূর্যোদয় এখনো নাই বা এল সেই স্বপ্নটা আছে তো আর স্বপ্ন আছে বলেই তো।   (অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
মাথার ভেতর এক ঝাঁক ছোট পাখি বেশ কিছু দিন থেকে কিচিরমিচির করে চলেছে হামেশা; শুধু রাত্রিবেলা গাঢ় ঘুমে হয়তো-বা নিঝুম নিশ্চুপ থাকে,-অনুমান করি। এভাবেই অস্বস্তিতে কাটছে জীবন। কে আমাকে বলে দেবে হায়, এই উপদ্রুত মাথায় ঝিঁঝির একটানা ধ্বনি কবে হবে শেষ। আজ এটা, কাল সেটা আছে তো লেগেই যেমন কৌতুকপ্রিয় বালকেরা বেড়ালের লেজে ভারি ঘণ্টা বেঁধে দেয়। অকস্মাৎ চোখে পড়ে দূরে ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো ক’রে ধুঁকছে ভীষণ, যেন এই মুহূর্তেই মৃত্তিকায় খসে পড়ে যাবে। অকস্মাৎ অকারণ কার স্মৃতি প্রস্ফুটিত হৃদয়ে বিধ্বস্ত বাগানে?কোনও কোনও দিন একা ছোট ঘরে এক কোণে ব’সে গোধূলি-বেলায় দরবেশী মন নিয়ে কেবলি ভাবতে থাকি,- আকাশ পাতাল এক হয়ে যায়, কখন যে নিজেকে দেখতে পাই ভ্রাম্যমাণ নিঃসঙ্গ পথিক, হেঁটে হেঁটে পেরিয়ে চলেছি মাঠ, নদীতীর, উপত্যকা, উজাড় নগর, কখনও-বা যত্রতত্র কঙ্কালের ঢিবি চোখে পড়ে। কবেকার এইসব মূক গল্পময় ঢিবি, প্রশ্ন ছুড়ে দিই স্তব্ধ, দূর আকাশের দিকে আর ধিক্কারে রক্তাক্ত করি নিজের স্মৃতিকে! হাঁটতে হাঁটতে ধ্যানী আমি থেমে যাই। কী আশ্চর্য, চোখে পড়ে কবেকার সুদূরের দাস-নেতা স্পার্টাকাস তার উৎপীড়িত অথচ সুদৃঢ় সেনাদের চাবুকের প্রহার-লাঞ্ছিত শরীরের গৌরবপ্রদীপ্ত অরুণিমা নিয়ে দাঁড়ালেন আমার সম্মুখে, দীপ্তকণ্ঠে শোনলেন আশ্বাসের শুভবাণী; আমি তার পৌরুষের অনন্য কান্তিতে প্রজ্বলিত হতেই গেলেন মিশে নক্ষত্রের অনাদি জগতে। পিপাসায় ভীষণ শুকিয়ে আসে জিভ, শিশিরের প্রত্যাশায় শূন্যে দৃষ্টি মেলি।আচমকা মনে হয়, বিভ্রম আমাকে শুধু অর্থহীনতার ধোঁয়াশায় টেনে নিচ্ছে, নিরুত্তর জিজ্ঞাসার হামলায় রক্তাক্ত, বিহ্বলবোধ, অসহায় আমি ফ্যাল ফ্যাল চেয়ে থাকি পানীয়ের ফতুর গেলাশে অন্তহীন। কে আমাকে বলে দেবে গলাভর্তি অত্যাচারী বালি আর কাঁটা থেকে মুক্তি পাওয়ার কসরৎ ঘোর অবেলায়? এক্ষুণি শিখিয়ে দেবে কোন্‌ জাদুবলে? চারদিক থেকে ধেয়ে আসছে শ্বাপদ ছিঁড়ে খেতে আমাকে মেটাতে ক্ষুধা।এখন সহজে কেউ করে না বিশ্বাস কাউকেই। প্রত্যেকের দুটি চোখ সন্দেহের ধূম্রজালে আচ্ছন্ন এবং সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় মনে জাগে আশঙ্কা, হয়তো কেউ অকস্মাৎ ঠেলে ফেলে দেবে বিশ হাত নিচে। সে মুহূর্তে অন্য কারও অন্তরাত্মা ঘেমে ঘেমে কাদাময় হয় বুলেটের বৃষ্টির আচ্ছন্নতায় ডুবে বিলুপ্তির হিম ভয়ে।   (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
যদি বলি কবিতার দিকে মুখ রেখে কাটিয়েছি কতকাল, মিথ্যা বলা হবে? যে কোনো ছুতোয় তার বুকে ঝুঁকে থাকি অপলক, বসি গিয়ে বৃক্ষচূড়ে কপোত-কপোত যথা-মাথায় থাকুন মাইকেল- তার প্রতি ভালবাসা মুদ্রিত করেছি সারাবেলা। কপোতাক্ষ নদীটির তীরে বসে মনে হয়, হায়, প্রকৃত কবিতা আজও আমার নিকট থেকে দূরে সরে আছে পর্দানশিনের লাস্যে; আমার ব্যথিত হৃদয়ের চিতাগ্নিতে এইমাত্র ছিটিয়ে দিয়েছি কিছু জল; ধোঁয়া ওঠে, কী ভীষণ চোখ জ্বালা করে! কমিউনিস্ট ইস্তাহার, বলা যায়, নব্য প্রেরণায় মুখস্ত করেছি; তবু অক্ষরের কেয়ারিতে দেখে গোলাপের পেলবতা, পক্ষীর কটাক্ষ, ভ্রমরের আড়িপাতা, কবিতাকে যত্রতত্র করেছি চুম্বন।   (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
হে আমার বাল্যকাল তুমি সে কেমন মাল্যদান দেখেছিলে খুব বিস্ফারিত চোখে শহুরে সন্ধ্যায়? সে মালার ফুলগুলি স্মৃতির মতন ভেসে যায় মনোজ তীর্থের তীরে, যেন বা পাপড়িরা অফুরান- শতাব্দী শতাব্দী ধরে ঝরে যাবে, বেদনার্ত গান গাইবে জীবন জুড়ে। পথচারী যখন হারায় দিকচিহ্ন, এবং স্মৃতির সঙ্গে বিষণ্ণ ছায়ায় কথোপকথন করে, পথ হয়ে আরো সুনসান।সে পথ পতিতা নাকি ভগ্নী নান, তার চুলচেরা হিসের উভীষ্ট নয়, শুধু দেখি রুক্ষ, পোড়া মাটি আশপাশে- সূর্যাস্তের বর্ণচ্ছটাময়, সুপ্রাচীন রণক্ষেত্র, তরমুজের ফালি, ভাঁড়ের করোটি, ছেঁড়া জুতো এক পাটি; বাল্যকাল, তুমি কেন প্রতিদিন আনো রেলগাড়ি কাটা ঘুড়ি, বাতাসা ও জামবাটি?   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
ফুলকে সুন্দর বলা হয়, পাখিকেও, নক্ষত্রের নদীর রূপের খ্যাতি আছে যার পর্বতমালার সৌন্দর্য কীর্তিত বিশ্বময়। তুমি বস্তুজগতের অন্তর্গত, প্রকৃতির ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশিনী, কিন্তু তোমার এবং তার সুষমায় পার্থক্য অনেক। তোমাকে সুন্দরী বলা চলে, অন্তত আমি তো তাই বলি; চোখ মুখ, চুল গ্রীবা অথবা চিবুক -সবকিছু যেন সমন্বিত ইন্দ্রজাল বাস্তবিক।অথচ যখন তুমি বয়সের ভারে হবে নত, পরিত্যক্ত ভাঙা হাটে, হবে লুপ্ত ইন্দ্রজাল, হায়, মসৃণ পেলব ত্বকে অদৃশ্য লাঙল যাবে রেখে শুকনো গাঢ় রেখাবলী। অতএব, হে নিরুপমা, আজ জানাই প্রার্থনা, লোভাতুর কাফ্রি-মৃত্যু অন্ধকারে এক্ষুণি তোমাকে নিয়ে যাক লুটে প্রেমিকের সাজে।   (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
এখন রোদের যৌবনের তাপ নেই, এটাই তো অনিবার্য পড়ন্ত বেলায়। প্রত্যুষের আনকোরা ক্ষণে মাথা ক’রে হেঁটে চলা দীর্ঘকাল ক্লান্তিকেই করে আলিঙ্গন, জানা আছে যুগ যুগান্তের পথচারীদের। এই যে পথিক আমি হেঁটেছি বিস্তর, সে-তো গোধূলি বেলায় পৌঁছে গেছে।এ চলার পথে কত প্রিয় মুখ থুবড়ে পড়েছে দিগ্ধিদিক, বেদনার্ত দাঁড়িয়েছি ক্ষণকাল, ফের অন্বিষ্টের প্রলোভনে দ্রুত করেছি চলার ভঙ্গি, হোঁচটে হোঁচটে পায়ে ঢের দগদগে ক্ষত ত্বরিত হয়েছে সৃষ্টি, তবু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে অব্যাহত রেখেছি যাত্রার রীতি। হবে কি আখেরে ক্লান্ত মাথা মুকুটে শোভিত?বস্তুত চলার পথে ধূলিকণা জমেছে শরীরে ঢের আর চোখ দুটো ক্লান্তির গহন কুয়াশায় সমাচ্ছন্ন, তবু হেঁটে চলেছি দৌড়ের করুণ, অস্পষ্ট, ব্যর্থ ভঙ্গিমায়। এ খেলায় জয়ের প্রত্যাশা শুধু ধুধু মরীচিকা জানি, তবু আখেরে কোথাও পৌঁছে যাওয়ার প্রত্যাশা জেগে রয়।   (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
বিস্মৃতির ডোবায় আমাকে ছুঁড়ে দিয়ে নিদ্বির্ধায় সে কি আজ তারাভরা আকাশকে শোভা দ্যাখে, নেয় গোলাপের ঘ্রাণ কিংবা অন্য কারো আলিঙ্গনে ধরা দেয় বারবার? না কি শোনে রাতে আমজাদ খাঁর দরবারী, গাছের সবুজে আর গেরুয়া মাটিতে বৃষ্টিপাত? বিছানায় নিঃসঙ্গতা ঘুমায় আমার পাশে আ জপায় আমাকে অন্ধকারে, সে তোমাকে হেলায় ফেলেছে মুছে দ্রুত জলছবির মতন।মনকে প্রবোধ দিই। জানলার ধারে গিয়ে দেখি জনহীন পথ বহুদূরে গেছে বৃষ্টির মঞ্জীর বুকে নিয়ে, গাছে পাখি নিয়েছে আশ্রয় ভেজা গায়ে। হয়তো সে ভোলে নি আমাকে। যত আমি তাকে ভুলে থাকতে চাই ততই মুখশ্রী তার মনে পড়ে আর মনে হয়, দরজায় রয়েছে দাঁড়িয়ে সে প্রতিমা।   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
কোথায় ভাসাব ভেলা? দূরন্ত জলের ধ্বনি শুনে কত বেলা গেল, তবুও আপন মাটির বিরাগ মূর্ত, ঠাঁই নেই ভাই প্রাণের পাড়ায় তাই জানি না কখন কে হারায়। ভয়ে চোখে চোখ রাখি, হাঁটুর বিবরে ঢাকি মুখ, বাঁচার ভাবনা ক্লান্ত হয়ে ফেরে মনে। যাবো না যেখানে কোনোদিন স্বপ্ন তার তেড়ে আসে কুকুরের মতো, মাচার সংসারে রাতে (নিজেকে শুনিয়ে বলি) যতটুকু পারো দেখে নাও মুখ, কে জানে কখন হবে ভোর, কেউ হয়তো তোমার ঝিমানো দুপুরে খুলবে না দোর।কলাইয়ের শূন্য মাঠে কাঁপে সাদা ঢেউ, কে যাবি ঘরের পানে সূর্য-নেভা টানে গোধূলির গরু-ডাকাপথ খরস্রোতা নদী, ফাঁকা সাঁঝে কে দেখাবে আলো? বাজে শুধু ধু-ধু জলধ্বনি ওরে নেই ফিরে যাওয়ার উঠোন। উদয়াস্ত দেখি ছায়া বন্ধ্যা জলে, কাকে পেতে চায় এ হাওয়ার ক্ষুধা। প্রত্যহের পথ প্রাণের তৃষ্ণায় কেঁদে তারা সমকালীন দু’জন তবু উঠল গাছ বেয়ে মানুষ শঙ্খিনী। প্রতিযোগিতার শ্রমে যার দুটি আর্ত ক্লান্ত চোখ। দেখে নিল অন্তিম আকাশ, তার নীল হাহাকার যাবে কতদূর?ভাসমান পশু আর নির্বাক মানুষ ক্যামেরার স্বদেশী খোরাক, অনেক অনেক দূরে শস্যের শিবির… নির্বোধ আশায় আর মজে না যে মন, কত বেলা গেল… কী করে ফিরব ঘরে, কোন ঘাটে ভিড়ে আবার চাঁদের অভিবাদন গ্রহণ?বৈঠায় মারিনি পাখি, শোনো ভুলে কোনো অমোঘ প্রহরে,তবু কেন তবু কেন এই জলের মরণ?   (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
একটি দোতলা ফ্ল্যাটে লকলকে খরার দুপুরে কিঞ্চিৎ ছায়ার লোভে দেয় হানা। পয়লা বৈশাখে। ছিলাম আমরা বসে মুখোমুখি নতুনের ডাকে অনেকেই বহির্মুখী। বৈশাখী মেলায় যে রোদ্দুর ছিলো, তারই আভা বুকে নিয়ে, বলো কতদূর শৈশবের টলটলে পুকুর আমার বলে কাকে তোমার দু’চোখে পাই, কী খেয়ালে তুমি স্তব্ধতাকে হঠাৎ দুলিয়ে ফ্ল্যাটে হও পুরোনো গানের সুর।যখন তোমার কণ্ঠে সাতটি সুরের উন্মীলন চতুষ্পাশ্বে মায়া বোনে, আহত হরিণ শুশ্রূষায় ক্রমান্বয়ে সুস্থ হয় অরণ্যের তন্দ্রালু ঊষায়, ভবঘুরে পুনরায় ফিরে পায় গার্হস্থ্য জীবন, আমার অসুস্থ মন অমৃতের খর পিপাসায় আতর্স্বরে করে উচ্চারণ-চাই ভিন্ন জাগরণ।   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
বাসী বিছনায় আরো কিছুক্ষণ জাগরণে কাটিয়ে সফেদ-কালো স্বপ্নগাঁথা মনে, বাথরুমে দু’দিনের দাড়ি কামিয়ে, বেসিনে মুখ ধুয়ে ভোরবেলা আটটা বত্রিশে (পুরনো টাইমপিস সাক্ষী) না-লেখা অস্পষ্ট গুঞ্জরণ নিয়ে যাই খাবার টেবিলে, টোস্ট, ডিম, মধু জিভে ছড়ায় নিবিড় স্বাদ। প্লেট, কাপ এবং চামচ বেজে ওঠে ঐকতানে, হঠাৎ তোমার হাসির প্রপাত ছোঁয় আমাকে, অথচ তুমি নেই কতদিন থেকে। নীল ছবি, গহনতাময়, ফ্রেমে বাঁধা, টেবিলে কুঁড়ের মতো পড়ে আছে ভোরের কাগজসেখানে কিছুই নেই বস্তুত বেহদা টাইপের উতুঙ্গ বুকনি ছাড়া। অবচেতনের ছায়াচ্ছন্ন গুহা থেকে পাখি উড়ে যায় মাঝে-সাঝে নীল পাহাড়ের দিকে, বাইরে রোদ্দুর নাওয়ায়ে স্নেহ ঢেলে কনকচাঁপাকে। মনে পড়ে ছেঁড়া শাদা ঘুড়ির মতন মৃত সারসের ডানা গাঁথা কাঁটাতারে, অমাবস্যালিপ্ত উঠোনে লণ্ঠন হাতে দঁড়ানো আমার মাতামহী, ছন্দিত লঞ্চের বাঁশি, ফিরে আসা, সাঁকোর গ্রামীণ ভালোবাসা,দূরের কাশের বনে ভগবতী, রুলির ঝিলিক, ভাঙা কলসের কাছে এক ঝাঁক কাক, নৌকোর ভেতরে দোলে মেহগনি কাঠের কফিন।চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছি, হাতে সন্তু অগাস্টাইনের আত্মকথা ভেসে আসে কিয়দ্দূর থেকে চায়ের সোনালি ঘ্রাণ, মুটে বয়ে নিয়ে যায় সবজিভরা ঝাঁকা, ছাদে নুয়ে-পড়া ঝাঁকা ডালে স্ততিগানে মাতে কী একটি পাখি, আচ্ছা আসি, বলতেই হবে কোনোদিন।সবই থেকে চোখ আসমানে যায়, হাত ধরাধরি ক’রে সীসে রঙ দিগ্বলয়ে নাচে সাতজন, মরীচিকা সুদূরে সীমানাহীন, গেরোবাজ পায়রার মতো আমার কবিতা ঝংকৃত উপরে যায়, মরীচিকা ঝালরকে খুব ঠোকরায়, ফিরে আসে পুনরায়, সঙ্গে আনে তার স্মৃতির মতোই কিছু। থাকবে তো? নাকি ওড়া, শুধু ধু-ধু ওড়া?  (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
তিনি, অকৃতদার প্রৌঢ় অধ্যাপক, কির্কেগার্ডের ‘আইদার অর’ গ্রন্থে নিমগ্ন সেই কখন থেকে। দুপুর মিশে গেছে বিকেলে। টেবিলে চা জুড়িয়ে পানি। তশতরিতে একটি করুণ টোস্ট বিস্কুট ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে আছে অধ্যাপকের দিকে। তিনি, নিঃসঙ্গ পাঠক, বই থেকে দৃষ্টি সরিয়ে জানলার বাইরে তাকান। হলদে বিকেল হেলান দিয়েছে আকাশে। অধ্যাপকের মনে হলো কী এক ধূসরতা তাকে ঘিরে ধরেছে। ঘরের চারদিকে ধূসরতা, ঘরভর্তি বই ধূসর, তার চশমা-আঁটা চোখ দুটো ধূসর, এমনকি তার মনেও রাজ্যের ধূসরিমা জড়ো হয়েছে যেন একটা কুণ্ডলীপাকানো চাদরের মতো। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার এখনও বেশ কিছু সময় বাকি, অথচ তার মনে হচ্ছে জমাট অন্ধকার তাকে ভেংচি কাটছে। হাতের বই টেবিলে রেখে তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। চোখে অতিরিক্ত পুস্তক পাঠের ক্লান্তি, বুক জোড়া কেমন অস্বস্তি। হার্ট ত্র্যাটাক হবে না তো! বহুদিন থেকে বহাল আছে উচ্চ রক্তচাপের উৎপীড়ন। হঠাৎ তিনি দেখতে পান, কোত্থেকে একটি রঙিন প্রজাপতি এসে বসল টেবিলে রাখা কির্কেগার্ডের ‘আইদার অর’ মলাটের ওপর। প্রজাপতির উপস্থিতি নিমিষে সরিয়ে দেয় অধ্যাপকের অন্তর্গত ধূসরিমা। প্রজাপতি নেচে বেড়ায় ঘরময়। বুকের অস্বস্তি কোথায় মিলিয়ে যায়। এক সময় জানলা দিয়ে বেরিয়ে যায় ধূসরতা-তাড়ানো প্রজাপতি। তিনি প্রায় ছুটে যান জানলার দিকে, তার দৃষ্টি কী ব্যাকুল অনুসরণ করতে চায় প্রজাপতিটাকে। সেই রঙিন চাঞ্চল্য আর দৃষ্টিগোচর নয়। নিচে, দোতলা থেকে তিনি দেখছেন, ফ্রকপরা এক ছোট্র ফুটফুটে মেয়ে সামনের ফাঁকা জায়গার কৃপণঘাসের ওপর ছুটোছুটি করছে। মেয়েটিকে দেখামাত্র তার অন্তরের জন্ম নেয় বিকেলের রৌদ্রস্নাত ঝর্ণাধারা, যার অন্য নাম মমতা। অকৃতদার প্রৌঢ় অধ্যাপক আগে কখনও মেয়েটিকে দেখেছেন বলে মনে পড়ে না।সেই ক্রীড়াময়ীকে বুকে টেনে নিতে ভারি সাধ হলো তার। ততক্ষণে চঞ্চলা ফ্রক মিলিয়ে গেছে যেন বৈকালী আলোয়। আর সেই মুহূর্তে তার নিজেকে মনে হলো প্ররিত্যক্ত এই চরাচরে বড় নিঃসঙ্গ, ভয়ঙ্কর একা এবং এক জ্যোতির্বলয় থেকে স্বেচ্ছানির্বাসিত।   (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
এই তার বাসগৃহ ছন্নছাড়া বাগানের ধারে অনেক বছর ধরে রয়েছে দাঁড়িয়ে রৌদ্রজলে। এখানে সুন্দর তার হস্তস্পর্শ যার করতলে রেখে যায় আগোচরে, তাকে আজো তো বনবাদাড়ে দেখা যায়, হাতে লাঠি, পিঠে বোঝাই সুদূর পাহাড়ে জনহীন নদীতীরে হাঁটে সে একাকী, পুনরায় ফিরে আসে একজন ব্যথিত কবির আস্তানায়, মানে সে বাসায় যার সত্তা লগ্ন বেহালার তারে।সে তার নিজেরই বাসা হঠাৎ পুড়িয়ে ফেলে কিছু অপরূপ আলো দেখে নিলো। সে আলোয় মর্মমূল আর্তনাদ করে, তবু সেই উদাসীন, দৃষ্টি নিচু করে ভস্মারাশি তুলে নেয় মুঠো ভরে পুনর্বার হাওয়ায় উড়িয়ে দ্যায়। বাসা নেই, দগ্ধ স্মৃতিভার বেড়ে যায়, মাথার ভেতরে কাঁদে কিছু কালি, ঝুল।   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
জাহান্নাম নাকি? নিষ্ঠুরতা বশম্বদ ভয়ানক উৎপীড়কের, লন্ডভন্ড চতুর্দিক, পশুপাখি ফুড়িং, মৌমাছি পোড়ে দাবানলে, অসুরের নখ মাটি আঁচড়াচ্ছে জোরে, এখন উদ্ধারকল্পে ডাকি কাকে? দাউ দাউ বনভূমি। ডান দিকে সাপ ছোটে, বাম দিকে সন্ত্রস্ত নেউল, নেকড়েরা অকস্মাৎ মেষপাল, বৃক্ষগুলি জ্বলন্ত পাথরে মাথা কোটে। পালাতে চাই না, শাপশান্ত স্থগিত থাক আজ, আমাকে চাটছে তপ্ত লকলকে জিভ, যাচ্ছে পুড়ে সমস্ত শরীর, চর্ম ফাটে, চর্বি গলে, এ কেমন কারুকাজ? শিরদাঁড়া খাড়া, হাসি মুখে অগ্নিশুদ্ধ হবো ভোরে, শামুক আত্মা-জুড়ানো পানি ভস্মময় ওষ্ঠ জুড়ে; আমাকে শুইয়ে দাও কবিতার নালাম্বরী ক্রোড়ে।   (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
রূপক
তুইও যাচ্ছিস চ’লে ক্রমশ যাচ্ছিস চ’লে কেমন জগতে। তোর জগতের কোনো সুস্পষ্ট ভূগোল কোনোমতে ত্রঁকে দিতে পারলেও হয়তো বা হতো বোঝাপড়া বড়ো জোর নিজের মনের সঙ্গে। কাফকা অনধিগম্য তোর, ভূতলবাসীর আর্ত অস্তিত্বের উপাখ্যান ওরে তোর তো জানার কথা নয়, তবু কেন কোন সে বিপাকে, ঘোরে ক্রমশ যাচ্ছিস চ’লে অমন জগতে? কোন মন্ত্র করেছে দখল তোকে, কার ষড়যন্ত্র করছে বিচ্ছিন্ন তোকে মার্বেল, পাখির বাসা আর জনক জননী থেকে? কেবলি আড়ালে ডাকে’ কোন অন্ধকার?ফুটফুটে শার্ট আর হাফপ্যান্ট প’রে, আড়াআড়ি ঝুলিয়ে সুনীল ব্যাগ, মায়ের আদর খেয়ে খুব তাড়াতাড়ি যখন যেতিস রোজ মর্নিং ইশকুলে, কী-যে ভালো লাগতো তখন। সারাক্ষণ তোর পথ চেয়ে আলো থাকুক কল্যাণ হয়ে, বলতাম মনে মনে। হায়, চুকেছে ক্লাশের পাট আজ, বইপত্র ধুলিম্লান, অসহায় রঙিন মার্বেলগুলো কোথায় যে আছে প’ড়ে। কখনো হাসিস অকস্মাৎ অকারণ কাঁদিস কখনো- এ কেমন খেলা তোর? পাখি শিস দিলেও সম্প্রতি তুই হোসনে খুশিতে তরঙ্গিত। ঘরের যে কোনো কোণ বেছে নিয়ে থাকিস নিঃসঙ্গ ব’সে; ক্রীড়াপরায়ণ ভাই বোন ডেকেও পায় না কাছে তোকে-এই অলক্ষুণে দৃশ্য দেখে দেখে বড়ো কন্টকিত আমি, ভয়ানক নিঃস্ব।এখন নিঃসঙ্গ আমি, পরিপার্শ্ব কর্কশ বিমুখ, উপরন্তু অত্যন্ত বিরল বন্ধু। বুঝি তাই হৃদয়ের তন্তু কেমন বেসুরো বাজে। হে বালক, হে পুত্র আমার, তুইও শেষে নিলি ঠাঁই গোধূলি জগতে? এ কেমন ভিন দেশে অকালে জমালি পাড়ি? রাত্রিদিন আমাদের সঙ্গে বসবাস ক’রেও প্রবাসী সারাক্ষণ। নীলাকাশে শুকনো ঘাস কিংবা শুধু ঝাঁক ঝাঁক পোকা ও মাকড় দেখিস কি চতুষ্পার্শ্বে? না কি ভয়ংকর হিচককী কাকে ঘর বারবার অতিশয় ভ’রে যেতে দেখে অবিরত দু’হাতে ফেলিস ঢেকে মুখ মন্ত্রচালিতের মতো।   (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
রাজরাজড়াকে হাসানোর ক্ষমতা আমার নেই, হীরে-জহরত ঝলসিত মহিলার কোলজোড়া জুলজুলে দৃষ্টি নিয়ে মোলায়েম থাবা নাচানোর, বারংবার গলার রঙিন ঘুন্টি দোলানোর শিল্প আমি আয়ত্তে আনিনি। বিশাল প্রাসাদে একা দিনরাত্রি অনেক বছর কাটায় যে লোক তার মতো হয়ে গেছি, বলা যায়- খাপছাড়া, অবসাদপ্রস্ত, ছায়াবিলাসে আশিরপদনখ নিমজ্জিত, বড় বেশি প্রতিধ্বনিময় এ আমার সূর্যোদয়, সূর্যাস্তের চুমু-খাওয়া মাথায় কুঠুরি। অতীতের সাথে খুনসুটি করে কাটে বেলা আর কেবলি নিজেকে দুঃখ দিতে পারি, নিতে পারি প্রতিশোধ নিজের ওপর।অপ্রেমের মরুভূমি থেকে হেঁটে আমি তোমার নিকটে পৌঁছেছি সন্ধ্যায়- যে সন্ধ্যায়, মনে পড়ে, আমার একান্ত ব্যক্তিগত নিস্তব্ধতা উঠেছিল বেজে গূঢ় সরোদের মতো, কে অচেতনা পাখি তার তীক্ষ্ম ঠোঁটে করেছিল পান সুখে হৃদয়ের শোনিত আমার! কমলালেবুর খোসাভরা ঘরে তুমি নিউজপ্রিন্টের গন্ধময় ঘরে তুমি কী স্বপ্নের বীজ দূর থেকে দিয়েছিলে দীপ্র ছড়িয়ে সায়াহ্নে। অনেক সন্ধ্যার ধ্যানে যুগ যুগ পরে অমন নিবিড় সন্ধ্যা উঠেছিল ফুটে, যেন পারিজাত। পারিজাত সন্ধ্যা আমি পেয়েছি বলেই শহর শক্রতা সাধে, মধ্যরাত এমন কাঁদায়? বলেছি অজস্র কথা আমরা দু’জন ভোরবেলা, সন্ধ্যেবেলা, মধ্যাহ্নে রাত্তিরে, প্রহরে উপচে রোজ পড়েছে অনেক কথা আর রঙিন ঘুড়ির মতো উড়েছে সে সব কথা আকাশে আকাশে, কখনো জ্বলেছে ওরা উৎসবের বাল্বের মতোন ঝোপে-ঝাড়ে। যখন একলা থাকি, সময় পোহাই শূন্য ঘরে, মনে হয়- এই কি বলতে চেয়েছিলে তুমি? আমিও কি এই আবোল তাবোল আউড়ে তোমাকে হৃদয়ের স্বর শোনাতে চেয়েছি বারংবার? এখন আমরা মুখোমুখি বসে নেই, আমার নিকট তুমি নেই, তবুও প্রখর আমি তোমার মুখের দিকে চেয়ে আছি সকল সময়। আমার মুঠোয় তোমার স্বপ্নিল হাত কোমল প্রাণীর মতো চুমুকে চুমুকে করছে সময় পান আমার দু’চোখে তোমার চোখের পূর্ণ দখল এখন।আঁধারে দুলিয়ে গ্রীবা বলেছিলে, এইতো এসেছি,- দ্যাখো চেয়ে কী সহজে এসে গেছি তোমার কাছেই। আমিও বলেছি, মনে পড়ে, স্বপ্নাচ্ছন্ন কণ্ঠস্বরে, গভীর প্রত্যয়, অনেক শতাব্দী ধরে আমি আছি একাকী তোমারই প্রতীক্ষায়। তোমার দু’চোখে ছিল বিপর্যস্ত সভ্যতার শোক, তোমার শরীরে ছিল বেদনার প্রগাঢ় চুম্বন, তোমার যৌবনে ছিল বসন্তের পুষ্পিত বিলাপ, দুঃখের কবল থেকে ছুটে এসে তুমি দেখলে আমারও দুঃখ ছাড়া আর দেবার মতোন কিছু নেই কিছু নেই।   (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
থমকে থেকো না; আর কতকাল এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে? এগিয়ে যাও। পেছনে হটতে চাও বুঝি? এখন সে পথ বন্ধ; প্রখর দুপুর বিকেলের সঙ্গে ঢলাঢলি শুরু করে দিয়েছে সে কবে, দেখতেই পাচ্ছো। এবার ঝাড়া দিয়ে ওঠো, নয়তো অন্ধকার অচিরে করবে গ্রাস তোমাকেই। তখন অরণ্যে একা-একা কেঁদে বেড়ালেও কেউ করবে না খোঁজ।যদি ভাবো, সময় তোমার মুঠোয় থাকবে বন্দী সারাক্ষণ, তবে ভয়ঙ্কর ভুল হয়ে যাবে হিসেবের হিজিবিজি খাতার পাতায়। পা বাড়াও তাড়াতাড়ি; তোমাকে ছাড়াই সব কিছু ঠিকঠাক চলবে, একথা মনে ঠাঁই দিতে পারো অবশ্যই। তবু বলি, যতদিন আছো প্রবল আবেগ নিয়ে বাঁচো, শক্রর ব্যুহের দিকে এগোতে করো না দ্বিধা। অভিমন্যু হলেও তোমার খেদ থাকা অনুচিত; কেউ কেউ এভাবেই যায়, যেতে হয়, পরিণাম ছায়া হয়ে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকে, যেন মেফিস্টোফিলিস, মুখে হিংস্র হাসি। তোমাকে পাতালে নিয়ে যাবে, সাধ্য কার? নিজের পাহারাদার তুমি।সবারই কিছু না কিছু পিছুটান থাকে। পুরাকালে নাবিকেরা গভীর সমুদ্রে নাকি কখনো সখনো কুহকিনী মোহিনীর গান শুনে চৈতন্যরহিত দ্রুত ভ্রমে হারাতো জীবন নিরুদ্দেশে। যতদূর জানা আছে, তুমি নও তেমন নৌজীবী। সামনের দিকে পা চালাও, দাও ডাক দশদিকে এমন জোড়ালো কণ্ঠে যাতে বজেরও লজ্জায় মুখ বন্ধ হয়ে থাকে।   (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
চা খেতে-সংবাদপত্র পড়ি।স্থুলাক্ষরের হেডলাইন সন্ত্রাসীর মতো চোখ রাঙিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে আমাকে তাড়া করে, আমার দিকে উঁচিয়ে ধরে স্টেনগান। বিপন্ন উদ্বাস্তুর মতো ব’সে থাকি খোলা আকাশের নিচে, ভূমিকম্পে ধসে-পড়া আমার হাত একটি অস্পষ্টস্মৃত কাহিনীর সূচনা এবং সমাপ্তি।বার্ধক্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে একটু জিরিয়ে নেব, স্বপ্নের ডানার নিচে নিদ্রাশিত দ্বীপের মতো থাকব, তার জো নেই। আমাকে ক্রমাগত তাড়িয়ে বেড়ায় এক পাল রক্তলিপ্সু শিকারী কুকুর, যাদের দাঁতে অসংখ্য প্রাক্তন হত্যাচিহ্ন। পালাব কোথায়? এই বয়সেও তারুণ্য আমার শিরায় জিপসি-নৃত্য, পলাতকের ভূমিকা আমার পৌরুষকে ভেংচি কাটে।এই দেখ, আক্রান্ত গোধূলিতে নিরস্ত্র আমি রক্ত খেকোদের সামনে কেমন ঘুরে দাঁড়িয়েছি হাতে নিয়ে কবিতার খাতা। ঘোর অমাবস্যায় আমার কবিতা জ্যোৎস্নাস্নাত পাখি এবং অসত্য আর অন্যায়ের আর বর্বরতার ঋতুতে জাগর আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ।   (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
কবিতা লিখতে গিয়ে প্রায়শ হোঁচট খাই আজ, ধন্দ লাগে বার বার, আর অমাবস্যা নামে খাতার পাতায় যখন তখন, তুমি সাক্ষী। কী ক’রে ফিরিয়ে আনি পূর্ণিমাকে? জানি না সে মন্ত্র, শুধু ক্ষ্যাপা বাউলের মতো ঘুরি গেরুয়া রঙের লুপ্ত লিরিকের পথে। অন্ধত্ব আসন্ন জেনে আলোর ঝর্ণায় স্নান করি অবিরাম।বাগানের ফুল ছেঁড়া হচ্ছে অবিরত, মাস্তানের মরশুম চতুর্দিকে। ইদানীং ঘাতকেরা নির্ধারণ করে আমাদের ভবিষ্যৎ নীল নক্‌শা টেবিলে ছড়িয়ে। শতাব্দীর গোধূলিতে মহত্বের ধড় থেকে মুন্ডু ছিঁড়ে নিয়ে লোফালুফি চিলে চন্ডালের আস্তানায়; এভাবেই সব কিছু সকলের সহনীয় হ’য়ে যায়, অমাবস্যা বলে নির্বোধের সমাবেশে। বসন্তের পিঠে হঠাৎ বসিয়ে ছোরা কে দুর্বৃত্ত ধুলো ছুঁড়ে দিয়েছে চম্পট।বর্বর পোড়ায় মনীষীর জ্ঞানলিপি হাড়হিম শীতরাতে উত্তাপের লোভে। এই শতাব্দীর সেরা গ্রন্থগুলি গণ শৌচাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, তবু আমি কেন কবিতার জন্য নিজেকেই করি ক্ষয়, ধুলোয় মেশাই; তুমি বলেছিলে বটে, ধৈর্য হারিয়ো না; তাই আজও হাতে রয়েছি কলম ধ’রে। সর্বক্ষণ ভয়-যদি কেউ এ তাণ্ডবে আমার কলম কেড়ে নেয়।   (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
যখন শুধাও তুমি, ‘হে বন্ধু কেমন আছো’, আমি কী দেবো উত্তর ভেবে পাই না কিছুই। প্রশ্ন খুব শাদাসিধে, তবু থাকি নিরুত্তর; যিনি অত্নর্যামী তিনিই জানেন শুধু কী রকম আছে এ বেকুর দুঃখজাগানিয়া জনশূন্য ধুধু চরে। এ কেমন দীর্ঘ স্থায়ী পরবাস নিজেরই ভেতর? দীর্ঘ বেলা কাটে জন্মান্ধের মতো। সমাধি ফলক, ঝাউবন, উন্মাদ আশ্রয়, শূন্য ঘর চেতনায় করে খেলাএসব কিছুই আমি বলি না তোমাকে। প্রায়শই তোমার মুখের দিকে চেয়ে থাকি চুপচাপ, কথা সামান্যই বলি, বলি, ‘ভালো আছি’। গূঢ় চঞ্চলতা গোপন শিরায় জাগে, মনোকষ্ট ব্যাকুল লুকোই। মৃতের রহস্যময় চোখ আমার নিকটে আসে লাফাতে লাফাতে, অশ্রুকণা পড়ে থাকে বুনো ঘাসে।   (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
ক্ষমাহীন নিষেধের বেয়নেট উদ্যত চৌদিকে এবং ডাইনে বাঁয়ে কাঁটাতার, যেন বর্ধমান ফণিমনসার বন। ব্যক্তিগত নিবাসসমূহ গিসগিসে গোয়েন্দার অবাধ আস্তানা, শিরস্ত্রাণ- নিয়ন্ত্রিত জীবনের, কিছু গনতান্ত্রিক বিকার এখনো গোলাপ চায় এ মড়কে। মৃত্যুভয় ফিকে হ’য়ে এলে আমাদের প্রিয় লুম্পেন ইচ্ছার ব্যূহ হিজড়োর মতন নেচে ওঠে নিরাশ্রিত চমৎকার।প্রধান সড়কে আ প্রতিটি গলির মোড়ে মোড়ে কাঁটামারা জুতো ঘোরে। এরই মধ্যে হতচ্ছাড়া মন তোমার সংকেত পায়, হৃদয়ের সাহসের তোড়ে আমরা দু’জন ভেসে চলি রূঢ় পথে স্বপ্ন বেয়ে। বনেদী বাড়ির চোখ, গাছপালা, পাখি দ্যাখে চেয়ে, পুলিশও প্রত্যক্ষ করে আমাদের প্রথম চুম্বন।   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
জমিনের বুক চিরে লাঙলের পৌরুষে কৃষক শস্য তোলে কায়ক্লেশে; রকমারি রঙিন আনাজে ঋদ্ধ করে গৃহকোণ। মাঠ ছেড়ে চ’লে আসে সাঁঝে; কোনো কোনো জ্যোৎস্নারাতে কী ব্যাকুল করে সে পরখ, শোঁকে ফসলের ডগা। কিছুতেই ভাবে না নরক নিজের কুটিরটিকে, বিবির পাশেই শোয়, মাঝে উদোম বাচ্চার ঘুম, সারাদিন হাড়ভাঙা কাজে কাটে, রাতে স্বপ্ন দ্যাখে পঙ্গপাল নামে বেধড়ক।কবিও কর্মিষ্ঠ চাষী, রোজ চষে হরফের ক্ষেত নুয়ে-নুয়ে, কখনো কখনো খুব আতশি খরায় জলসেচে মগ্ন হয়, বোনে কিছু বীজ অলৌকিক। মাটি ফুঁড়ে চারা জাগে, তখলিফে আগাছা নিড়ায় কতদিন, ঘ্রাণ নেয় স্তবকের উপমাসমেত; কখনো কখনো পোকা শায়েরকে সাজা দেয় ঠিক।   (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
রূপক
ব্যাপারটা কী ভেবে দেখেছেন একবারও? যতবার যাত্রা শুরু করি, ততবারই পা এসে ঠেকে সর্প কুণ্ডলীর মতো এক কানাগলিতে। এমন হবার কথা নয়, তবু হচ্ছে বারবার একই রকম। কখনো কখনো আমার মনে হয়, বিসমিল্লাতেই গলদ নিশ্চয়; নইলে কেন এই পুনরাবৃত্তির গোলক ধাঁধায় ঘুরপাক খেয়ে মরছি? সত্যি বলতে কি, এই কৃষ্ণপক্ষে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি প্রকৃত পদপ্রদর্শকের অভাব। সে কবে থেকে সোনার পিঁড়ি শূন্য পড়ে আছে, বসবার কেউ নেই। বিখ্যাত পথ প্রদর্শকদের মধ্যে কেউ পর্যটন বিভাগের সৌজন্য টিকিট নিয়ে গেছেন দীর্ঘমেয়াদী বিদেশ ভ্রমণে, কেউ বাতে পঙ্গু হয়ে স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি, কেউ বা পোকার খেলছেন অষ্টপ্রহর এবং মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখছেন আকাশটা ঘোলাজলের ডোবা নাকি স্ফটিকের সমুদ্র।ঢের হয়েছে, আর নয়। সাফ কথা, কারো বাহারি গুলপট্রিতে আর মজবোনা, দৃষ্টি নিবদ্ধ করবো না কোনো ভুল সংকেতে, পদপ্রদর্শক থাক আর নাই থাক এবার পৌঁছুতে হবেই ভবিষ্যতের মতো বড় রাস্তায়।   (অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
পর্যটনে কেটেছে সময়; হেঁটে হেঁটে কায়ক্লেশে নিঃসঙ্গ ধূসরপ্রান্তে এসে গেছি। বসে থাকি একা, অতীতের হাত কাঁধে, আমার চোখের জ্যোতি নিভে যেতে চায়। সম্প্রতি টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে নিশুত রাতের গহন বাণী অক্ষরের আড়ম্বরহীন আয়োজন ধরে রাখি। প্রাতঃকালে আকর্ষণ কমে রচিত বাক্যের প্রতি। যেন আমি সম্পর্ক-রহিত কবিতার সঙ্গে, ছন্নছাড়া আচরণে মেতে থাকিকিছুক্ষণ, স্বাভাবিক মানুষের মতো পুনরায় সমাজে প্রবেশ করে সমাজের বাইরের কেউ হয়ে যাই খোলা আকাশের নিচে কিংবা বন্ধ ঘরে। ভয়ঙ্কর চাদর আমাকে ঢাকে, অদৃশ্য ছোরার ফলা থেকে রক্ত ঝরে, লুট হয় আমার নিঃশ্বাস; খাতার পাতার সব অক্ষরে শোণিত চিহ্ন ফোটে।   (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
হর পরহেজগার মুসলমানের কণ্ঠে প্রায় প্রতিক্ষণ উচ্চারিত হয় আল্লা-রসুলের নাম, ভক্তিরসে নিমজ্জিত হিন্দু হরে কৃষ্ণ হরে রাম, দুর্গা দুর্গা জপেন সর্বদা, নিবেদিত ভক্তপ্রাণ খৃস্টান গির্জায় কিংবা ঘরে যীশু আর মাতা মেরী উচ্চারণে, স্তবে অনলস। কৃচ্ছ্রনিষ্ঠ বৌদ্ধ ভিক্ষু বুদ্ধের উদ্দেশে ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’ মন্ত্র আওড়ান পবিত্রতা ধ্যানে এনে।অথচ এই যে আমি রুগ্ন, অসহায়, ধিক্কার অথবা চরম দণ্ডের প্রতি উদাসীন সকল সময় সুফী ঘরানার নৃত্যপর বৃত্ত ছুঁয়ে অন্তর্গত স্তব্ধতায় লীন কিবা স্বপ্নে কিবা জাগরণে আমার স্পন্দিত ওষ্ঠে ফোটাই তারার মতো অবিরত দয়িতা তোমার প্রিয় নাম।   (তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
সকালে ফাউস্ট পড়লাম, কিছুক্ষণ তরতাজা সংবাদপত্রও বটে, সদ্য-দেখা যুদ্ধার্ত পোলিশ ফিল্মের নানান শট মনে পড়ে। করি ঘষামাজা পঙক্তিমালা কবিতায়, জানালায় মেফিস্টোফিলিস হাসে, পা দোলায় ঘন ঘন, তার উত্তোলিত ভুরু সর্বক্ষণ জপে মৃত্যু, কখনো বা হঠাৎ দাঁড়িয়ে আমাকে শোনায় তত্ত্ব রাশি রাশি। ভেনাসের ঊরু অকস্মাৎ উদ্ভাসিত কিংবা প্ল্যাটো দিলেন বাড়িয়েতাঁর হাত মগজের কোষে কোষে। বেহুলা কখন আসে লখিন্দরময় ভেলা নিয়ে খলখলে জলে, নিজেই বিস্মিত হই। চিত্রকল্প যখন তখন নেচে ওঠে চতুষ্পার্শ্বে, দেয়ালের থেকে কত ছলে হঠাৎ বেরিয়ে আসে চিত্রমালা, শূন্য থেকে আসে, যেমন মেঘের পরে জমে মেঘ। দুপুরে চৈনিকরেস্তোরাঁয় তিনজন তীক্ষ্ম সমালোচকের পাশে বসে আস্তে সুস্থে করলাম মধ্যাহ্ন ভোজন, ঠিক বুঝতে পারিনি কী যে ওঁরা তিব্বতী মন্ত্রের মতো আউড়ে গেলেন কিছুক্ষণ নিশ্চল জ্যাকেট হয়ে, বোঝালেন কী কী বস্তু নিরঞ্জন সাহিত্যসম্মত। বেরুলে নতুন বই কিছুকাল থাকি ভয়ে ভয়ে।রিভিউ মুদ্রিত হলে কোথায় নতুন পাণ্ডুলিপি আপনার বলবে কি প্রকাশক কিংবা সম্পাদক ‘আগামী সংখ্যায় অবশ্যই লেখা চাই’, বলে ছিপি খোলা সোড়া বোতলের মতো হবেন কি? ধ্বক করে ওঠে বুক অকস্মাৎ। থাক, আপাতত বেলা থাক আড্ডা দিয়ে বাদ্য শুনে, স্বপ্নলোকে ছুঁড়ে ঢেলা। প্রায়শই গাঢ় সন্ধ্যা উপহার দেয় কিছু কথা, লতাগুল্ময় উৎস থেকে উচ্ছ্বসিত জ্যোৎস্নামাখা। ঝরণার মতোন হাসি, আধফোটা স্বপ্ন, ব্যাকুলতা।চোখ বুজলেই দেখি কালো বধ্যভুমির উপরে একটি রহস্যময় পাখি উড়ে উড়ে গান গায় সারারাত। কবেকার মিউজিসিয়ান আস্তে করে প্রবেশ আমার ঘরে, ধুলো ঝাড়ে শরীরের, খায়, মদ চামড়ার থলে শূন্য করে। তার বেহালার তারে আদি কান্না, সুপ্রাচীন স্মৃতি বাজে, আমি তাকে ঘরে রেখে নামি পথে। ফুটপাত, গাছ, অন্ধকার, বেশ্যার চোখের মতো রেস্তোঁরার আলো শুধু ডাকেআমাকেই, যে আমি তাদের আপনজন আর আমার নিবাস এখানেই, এই সত্য হয় গান অস্তিত্বের মাঠে, পুনরায় মধ্যরাতে ফিরে আসি ঘরে, কড়া নাড়ি, শুতে যাই, দেখি বিধ্বস্ত বাগান ঘরময়, পরাভুত নগরীর দেয়াল, মিনার স্মৃতির অরণ্য চিরে জাগে, শব্দের বুদ্বুদ নাচে শিরায় শিরায়, হয় পঙক্তিমালা, যেন আদিবাসী আমি নগ্ন, নতজানু অন্ধকারে রহেস্যর কাছে। ঘুমঘোরে ভাবি ফের অর্ফিয়ুস বাজাবে কি বাঁশি?   (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
হালায় আজকা নেশা করছি বহুত। রাইতের লগে দোস্তি আমার পুরানা, কান্দুপট্টির খানকি মাগীর চক্ষুর কাজলের টান এই মাতোয়ালা রাইতের তামাম গতরে। পাও দুইটা কেমুন আলগা আলগা লাগে, গাঢ়া আবরের সুনসান আন্দরমহলে হাঁটে। মগর জমিনে বান্ধা পাওআবে, কোন্ মামদির পো সামনে খাড়ায়? যা কিনার, দেহস না হপায় রাস্তায় আমি নামছি, লৌড় দে; না অইলে হোগায় লাথ্থি খাবি, চটকানা গালে। গতরের বিটায় চেরাগ জ্বলতাছে বেশুমার।আমারে হগলে কয় মইফার পোলা, জুম্মনের বাপ, হস্না বানুর খসম, কয় সুবরাতি মিস্ত্রি। বেহায়া গলির চাম্পা চুমাচাট্টি দিয়া কয়, ‘তুমি ব্যাপারী মনের মানু আমার, দিলের হকদার।’আমার গলায় কার গীত হুনি ঠাণ্ডা আঁসুভরা? আসলে কেউগা আমি? কোন্হানতে আইছি হালায় দাগাবাজ দুনিয়ায়? কৈবা যামু আখেরে ওস্তাদ? চুড়িহাট্টা, চান খাঁর পুল, চকবাজার, আশক জমাদার লেইন, বংশাল; যেহানেই মকানের ঠিকানা থাউক, আমি হেই একই মানু, গোলগাল মাথায় বাবরি; থুতনিতে ফুদ্দি দাড়ি, গালে দাগ, যেমুন আধলি একখান খুব দূর জামানার।আমার হাতের তালু জবর বেগানা লাগে আর আমার কইলজাখান, মনে অয়, আরেক মানুর গতরের বিতরে ফাল পাড়ে; একটুকু চৈন নাই মনে, দিল জিঞ্জিরার জংলা, বিরান দালান। জানে হায়বৎ জহরিলা কেঁকড়ার মতন হাঁটা-ফিরা করে আর রাইতে এমুনবি অয় নিজেরেও বড় ডর লাগে, মনে অয় যেমুন আমিবি জমিনের তলা থন উইঠা আইছি বহুত জমানা বাদ।এ-কার মৈয়ত যায় আন্ধার রাইতে? কোন ব্যাটা বিবি-বাচ্চা ফালাইয়া বেহুদা চিত্তর অইয়া আছে একলা কাঠের খাটে বেফিকির, নোওয়াব যেমুন? বুঝছোনি হউরের পো, এলা আজরাইল আইলে আমিবি হান্দামু হ্যাষে আন্ধার কব্বরে। তয় মিয়া আমার জেবের বিতরের লোটের মতই হাচা মৌত।এহনবি জিন্দা আছি, এহনবি এই নাকে আহে গোলাব ফুলের বাস, মাঠার মতন চান্নি দিলে নিরালা ঝিলিক মারে। খোওয়াবের খুব খোবসুরৎ মাইয়া, গহীন সমুন্দর, হুন্দর পিনিস আর আসমানী হুরীর বারাত; খিড়কির রৈদ, ঝুম কাওয়ালীর তান, পৈখ সুনসান বানায় ইয়াদ। এহনবি জিন্দা আছি, মৌতের হোগায় লাথথি দিয়া মৌত তক সহিসালামত জিন্দা থাকবার চাই।তামাম দালান কোঠা, রাস্তার কিনার, মজিদের মিনার, কলের মুখ, বেগানা মৈয়ত, ফজরের পৈখের আওয়াজ, আন্ধা ফকিরের লাঠির জিকির- হগলই খোওয়াব লাগে আর এই বান্দাবি খোওয়াব!
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
চমৎকার পাখি পুষি, নিজে স্বপ্নপোষ্য হয়ে আছি আজ অব্দি, মাঝে-মধ্যে গান ধরি, শব্দ গাঁথি কিছু আমার ভেতরে যে নিমগ্ন কর্মচারী মাথা নিচু ক’রে থাকে তার মেদমজ্জা চাটে পুপ্ত নীল মাছি। অলপ্পেয়ে পদাবলী একটি মনের কাছাকাছি পৌঁছুতে চেয়েও কায়ক্লেশে ঝরে যায় অন্তরালে, একটি দীপ্তশ্রী মুখ সরে যায়, এ মুখ বাড়ালে আমার সর্বস্ব গেছে তবু এই পৃথিবীতে বাঁচি।সে কবে শ্রাবণঘন যূথীগন্ধী সায়াহ্নের কাছে অকথিত কিছু কথা, কিছু নীরবতা সমর্পণ ক’রে চলে গেছে বহুদূরে। এই জীর্ণ অন্ধকার পিঞ্জরে একাকী আমি, শুধু তাকে মনে পড়ে, নাচে স্বপ্নস্মৃতি, মৃত্যুর পরেও ছিঁড়ে বেবাক কাফন উদ্দাম আসবো ফিরে যদি ডাকে সে আবার।   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
আমার সুপ্রিয়া মুখ ভার করে আছে, বুকে তার কান্না ঠেলে ঠেলে ওঠে নিশিদিন, অব্যক্ত আক্রোশে ফেটে যেতে চায় বুক, কখনো হঠাৎ রুদ্র রোষে জ্বলে ওঠে। অসহায় চোখে দ্যাখে হয়েছে উজাড় কোনো কোনো শান্ত গ্রাম গুলির ধমকে, হাহাকার শোনা যায় দিকে দিকে, যে রকম দূর একাত্তরে উঠত মাতম এই দুখিনী বাংলায় ঘরে ঘরে; নির্যাতনে কম দড় নয় পুলিশ ও বিডিআর।সরকারের অস্ত্রধারী ক্যাডার চৌদিকে দৃপ্ত ঘোরে, ক্রমশ দাপট বাড়ে উহাদের, পথ চলা দায়। নিরাপত্তা পলাতক এইসব দেখে শুনে, হায়, সুপ্রিয়া তুমি কি দূরে গিয়ে নতুন পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে ডাকছে আমাকেও? উপদ্রুত এ নগর ছেড়ে দূরে যাবো না কোথাও, এখানেই আছে ঘর।  (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
হঠাৎ পৃথিবীটাকে কেমন আলাদা মনে হয় বালকের। ভেণ্ডারের কাছ থেকে তৃষ্ণার্ত দুপুরে কিনেছে আইসক্রিম ছোট মাটির কলস ভেঙে জমানো পয়সা বের করে। পৌরপথে হেঁটে-হেঁটে বালক আইসক্রিম করছে লেহন; রূপকথা থেকে এক রাজা এসেছেন এ শহরে, মনে হলো তার; কিন্তু কী বিস্ময়, সে ব্যতীত কেউ তাকে ঠিক লক্ষ করছে না, তাঁর পোশাকের বাহার ভীষণ ব্যর্থ সাধারণ পোশাকের ভিড়ে। রাজার নিকটে যাবে কি যাবে না ভেবে বালক আইসক্রিম হাতে ফুটপাতে উঠে পড়ে, চলে আসে আবার গলির মোড়ে, একা। রাজার আয়ত চোখ মনে পড়ে তার; রৌদ্র-লাগা গোলাপি আইসক্রিম ক্রমশ গলতে থাকে তার মুখের ভেতর, জিভ কেমন বিবশ হয়ে আসে।  (হোমারের স্বপ্নময় হাত কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
হঠাৎ কোত্থেকে বলা নেই কওয়া নেই অসংখ্য শকুন উড়ে এসে জুড়ে বসলো বস্তির খুব কাছে। পুরো জায়গা কালো আসমানের বিরাট এক অংশ হয়ে প্রতিভাত সব পথিকের দৃষ্টিতে। একজন বুড়োসুড়ো লোক টলতে টলতে ভুলক্রমে প্রায় শকুনের ঝাঁকের গা ঘেঁসে হেঁটে যাওয়ার ক্ষণে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো মাটিতে। অবসন্ন, প্রায়-অচেতন বৃদ্ধটিকে ছেঁকে ধরলো শকুনের পাল। ওদের হিংস্র, তীক্ষ্ণ ঠোকর মানুষের মাংসের ঘ্রাণ আরও বেশি লোভাতুর এবং ক্ষুধার্ত করে তুললো। শকুনের পালের হামলা বৃদ্ধকে বড় বেশি কাতর করে তোলে। লোকটি হিংস্র চঞ্চুগুলোর হামলা থেকে রেহাই পাওয়ার তীব্র বাসনায় গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে চায়। শীর্ণ হাত দু’টো দিয়ে জাঁহাবাজ শকুনদের ক্ষুধার্ত, আক্রমণাত্মক ঠোঁট বড় বেশি তেজী, মাংসলোভী হয়ে ওঠে।বৃদ্ধটি নিজের দু’টি হাতকেই বড় বেশি জখমি, ছেঁড়া খোঁড়া হতে দেয় নিরুপায় হয়ে। কয়েকবার কোনও কোনও শকুনের টুঁটি চেপে ধরে, ছিঁড়ে ফেলতে চায় হিংস্র আক্রমণকারীদের মুণ্ডু, ছুড়ে ফেলার তীব্র বাসনায় জ্বলে ওঠে বারুদের মতো, কিন্তু অবসন্ন শরীর তাকে মাটিতে চেপে ধরে, শকুনের পাল তার ওপর সওয়ার হয় ভয়ঙ্কর হিংস্রতায়। কিছুক্ষণ পর শকুনের পাল সরে আসে কিয়দ্দূরে। ওদের ছেড়ে-আসা জায়গায় পড়ে থাকে কয়েকটি মানবিক হাড়।জ্যোৎস্নারাতে বুড়োর হাড়গুলো সজীব, সুন্দর হয়ে একজন অপরূপ মানব হয়ে আসমানে ভাসে।  (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
হেঁটে হেঁটে বেশ কিছুদূর এসে আজ মনে হয়- এই যে এতটা পথ পেরিয়ে এলাম কত আলো, কত অন্ধকার খেলা করেছে আমার সঙ্গে। ভালো, মন্দ এসে ঘিরেছে আমাকে আর ক্রূর দ্বন্দ্বময় অন্তরের ইতিহাস রয়ে যাবে অজানা নিশ্চয়। যদি নগ্নতায় উদ্ভাসিত হতো অন্তর্লোক, তবে অনেকে আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকাতো নীরবে, কেউ কেউ দিতো টিটকিরি দিব্যি রাজপথময়।আমরা এমন যুগে বাস করছি, যখন কেউ পাশে এসে বসলে ভীষণ উসখুস বোধ করি। মনে হয়, পার্শ্ববর্তী ব্যক্তির শার্টের খুব ফিকে আড়ালে রিভলবার কিংবা ছোরা ঘান্টি মারা ফেউ হয়ে আছে। এক্ষুণি লোকটাই হাসিমুখে তড়িঘড়ি হিম লাশ ক’রে দেবে জলজ্যান্ত ভদ্রলোকটিকে!   (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
রক্তচক্ষু রাম বলে রহিমকে, ‘এই দ্যাখ আমার রামদা, তোকে বলি দেবো’ রহিম পাকিয়ে চোখ বলে রামকে, ‘বেদ্বীন, এই তলোয়ার দিকে তোকে টুক্‌রো টুক্‌রো করে কুত্তাকে খাওয়াবো’। অনন্তর রামদা এবং তলোয়ারে কী ভীষণ ঠোকাঠুকি।একজন প্রশান্ত মানুষ, অস্ত্রহীন, ছুটে এসে দাঁড়লেন দু’জনের মাঝখানে, কণ্ঠে তার অনাবিল মৈত্রীর দোহাই। দু’দিকেই দুই অস্ত্র দ্বিধাহীন হানে তাকে। নির্মল, নির্বাক আসমান দ্যাখে রক্তধারা বয়ে যায় চৌরাস্তায়।   (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
তোমার কি মনে পড়ে আলোকিত ঘরে সন্ধেবেলা তুমি খুব রেগে গিয়েছিলে, যেন অন্তরাল থেকে ভীষণ বিকারী কেউ চোখে লালসার রঙ মেখে তোমাকে দেখেছে ফেলে গগ্ন? অথচ আমার খেলা বুঝতে পারোনি তুমি; চুপিসারে ছিপছিপে ভেলা ভাসিয়েছিলাম আমি আটপৌরে বাস্তবকে ঢেকে একটি স্বপ্নের মসলিনে; আমার ভেতরে পেকে উঠেছিলো কামফল উজিয়ে সকল অবহেলা।রাত বাড়ে, তোমার ক্রোধের তাপ আস্তে আস্তে ধিমে হয়ে আসে, যেমন শঙ্খিনী সাপুড়ের বাঁশি শুনে শান্ত হয় ক্রমান্বয়ে। ভস্মীভূত বাসনার হিমে ভিজে মুঢ় বালকের মতো মর্মর মূর্তির পাশে বসে থাকি চুপচাপ, ভাবি, বৃথাই চলেছি বুনে শব্দজাল, পারি না ফোটাতে তারা কারো চিদাকাশে।   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)